প্রিয়তোষ পর্ব ৯ লিখা Sidratul Muntaz

0
46

#প্রিয়তোষ
পর্ব ৯
লিখা Sidratul Muntaz

অনেক সময় কেটে গেছে। অন্তরা আর সেজুতি অপেক্ষা করতে করতে অস্থির। নোরার এখনও ফেরার নাম নেই। সেজুতি ব্যাগ থেকে ফলের বক্স বের করে ফল খাচ্ছে। অন্তরাকেও সেধেছিল, সে খায়নি। সেজুতি একাই খেতে খেতে বলল,”দোস্ত, অনেক রেস্ট হয়েছে। এবার চল উঠি।”

” উঠি মানে? নোরা আসবে না?”

” তুই কি নোরার জন্য অপেক্ষা করছিস?”

“তো করবো না? ওকে না নিয়েই চলে যাবো নাকি?”

সেজুতি উপহাসের সুরে হেসে বলল,” সখী, তুমি বোকার স্বর্গে বাস করিতেছো।”

“মানে?”

“মানে ও আর এখানে ভুলেও আসবে না।”

” কেন আসবে না?”

” আরে অনিকস্যারকে পেয়ে গেছে না? আমাদের কথা এখন মনে থাকবে না এটাই স্বাভাবিক। চল দেরি না করে আমরা বাসায় চলে যাই। ওর যখন সময় হবে ও চলে আসবে।”

” কিন্তু এভাবে ওকে একা রেখে আমরা চলে যাবো?”

” নোরা একা না। ওর সাথে অনিকস্যার আছে। একা হলাম আমরা। আমাদের সাথে কেউ নেই।”

” তা অবশ্য ঠিক বলেছিস।”

” নে এবার ওঠ। দেখি সামনে কোনো গাড়ি পাওয়া যায় নাকি।”

” হ্যাঁ চল।”

অন্তরা সেজুতির সাথে হাঁটতে শুরু করল। একটু পর অন্তরা বলল,” আচ্ছা সেজু, আন্টি যদি নোরার কথা জিজ্ঞেস করে তখন আমরা কি বলবো?”

” বলবো কিছু একটা।”

” কিছু একটা কি?”

” যেতে যেতে ভাবি কিছু একটা কি।”

অনিক বড় বড় পা ফেলে হাঁটছে। পেছনে নোরা পা টিপিয়ে টিপিয়ে আসছে। অনিক পেছনে তাকাতেই সে ফট করে গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল। অনিক রুক্ষ গলায় বলল,” নোরা আমি জানি তুমি আমার পেছনেই আসছো। লুকিয়ে লাভ নেই। গাছের পেছন থেকে বের হয়ে আসো।”

নোরা মাথা নিচু করে বেরিয়ে আসল। মুখ মলিন করে বলল,” সরি।”

“সরি কেন?”
” আপনাকে মিথ্যে বলেছি তাই। আর এমন হবে না। এই আমি কান ধরে উঠবস করছি। এক,দুই,তিন, চার..”

“থামো!”
গমগমে ধ’মকে কেঁপে উঠল নোরা। থামল, কিন্তু কান ছাড়ল না। অনিক বলল,” কান থেকে হাত নামাও।”

নোরা কান থেকে হাত নামিয়ে নিল। অনিক কোমরে হাত রেখে কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল,” আচ্ছা আমি তোমাকে নিয়ে যাবোটা কোথায় বলোতো? আমার গন্তব্য এক জায়গায় তোমার গন্তব্য অন্য জায়গায়। তাহলে তুমি আমার সাথে কেন আসছো?”

“কারণ আমি এ জায়গার কিচ্ছু চিনি না।”

অনিক তাচ্ছিল্যপূর্ণ হাসি দিল,” হোয়াট আ জোক! তুমি আবার চেনো না? না চিনেই আমাকে খুঁজতে খুঁজতে এতোদূর চলে এসেছো?”

” যতদূর এসেছি ততদূর চিনি। কিন্তু এই জায়গা তো চিনিনা।”

অনিক একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। চারদিকে গহীন জঙ্গল, অচেনা-অজানা পথে এই মেয়েটিকে নিয়ে যাবে কোথায় সে? অনিক সামনে হাঁটতে লাগল। নোরার এবার ভ*য় লাগছে। সে বিরাট ভুল করেছে এখানে এসে। এখন মনে হচ্ছে সত্যিটা বলে দিলেই ভালো হতো। ধ্যাত! ওরা হাঁটতে হাঁটতে জঙ্গল পেরিয়ে মেইনরাস্তায় চলে এসেছে। কিন্তু রাস্তা সম্পুর্ণ পরিষ্কার। একটা সাইকেল পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না।

অনিক বলল,”কারফিউয়ের জন্য একটা বাস পর্যন্ত নেই। এবার কি হবে? চন্দ্রনাথ মন্দির এখান থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে। এতোদূর যাব কিভাবে? হেঁটে যাওয়া তো সম্ভব নয়।”

নোরা হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,” সেটা পরে দেখা যাবে। আগে চলুন পেটগরম করে আসি।”

অনিক মুখ কুঁচকে বলল,” কি?”

” পেটগরম! মানে ক্ষিদে পেয়েছে। ব্রেকফাস্টের কথা বলছি।”

” তো সেটা ঠিক করে বলো। ‘পেটগরম করে আসি’ এটা আবার কেমন ভাষা?”

নোরা দুষ্টু হাসি দিয়ে বলল, ” আরে ওই হলো আর কি! চলুন তো!”

নোরা অনিকের এক হাত জড়িয়ে ধরে হাঁটতে শুরু করল। কিন্তু অনিক আসছে না। ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। নোরার দিকে তাকিয়ে আছে কঠিন দৃষ্টিতে। নোরা বলল,” কি হলো আসুন! আমি কি আপনাকে টেনে টেনে নিয়ে যাবো?”

অনিক হাতের দিকে ইশারা করে বলল,” স্কিউজ মি!”

নোরা হাত ছেড়ে দিয়ে বলল,” ওহ সরি।”

তারপর একটু থেমে আবার বলল,”আপনি সবসময় এমন ভাণ করেন যেন আমার ছোয়া লাগলে আপনার চর্মরোগ বা স্কিন ক্যানসার হয়ে যাবে। ”

অনিক জবাব না দিয়ে গম্ভীর মুখে হাঁটতে শুরু করল।কোনো এক লোকাল ধাবায় ওরা ব্রেকফাস্টের জন্য গেল। অনিক-নোরা যখন খাচ্ছিল ধাবার ভেতর থেকে এক ভদ্রলোক বেরিয়ে এসে হাসি হাসি মুখে অনিককে বললেন,” স্যার, খাবারটা কেমন?”

নোরা লোকটার মুখে স্যার শুনে হিহি করে হেসে দিল। তারপর অনিকের দিকে তাকিয়ে এক চোখ টিপে বলল,” স্যার! আপনি কি জনগণের স্যার?”

অনিক নোরার কথার কোনো উত্তর না দিয়ে ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে বলল,” খাবার ভালো। কিন্তু ঝালের পরিমাণটা একটু বেশি। এটা খেয়াল রাখবেন।”

” ওকে স্যার। থ্যাঙ্কিউ।”

অনিক হেসে আবার খাওয়ায় মনোযোগ দিল। নোরা নিজের খাওয়া রেখে অনিকের খাওয়া দেখছে। একটা মানুষ এতো পারফেক্ট ভাবে কি করে খাবার খেতে পারে? খাওয়ার সময় পুরো মুখ বন্ধ রেখে কুটকুট করে চিবায়। কোনো শব্দ হয়না। আবার টিস্যু দিয়ে মাঝে মাঝে মুখটা হালকাভাবে মুছে। সেই দৃশ্য দেখেই নোরা দিশেহারা হয়ে যায়। লোকটা এখনও দাঁড়িয়ে আছে। আগ্রহ নিয়ে দেখছে তাদের। হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন,” হানিমুন নাকি?”

নোরা বিষম খেল। কাশি থামিয়ে কিছু বলতে যাবে তার আগেই অনিক বলল,” কি আজে-বাজে কথা বলছেন? আমার ছোটবোন হয় ও।”

” ও আচ্ছা, আচ্ছা, মাফ করবেন।”

অনিকের উত্তর শুনে নোরার কাশি থেমে গেছে। আহত দৃষ্টিতে থম মেরে তাকিয়ে আছে সে। শেষমেষ ছোটবোন? এও শুনতে হলো? লোকটি লজ্জিত হেসে চলে যেতেই নোরা কপালে হাত ঠেঁকিয়ে বলে উঠল,” হে আল্লাহ, এই কথা শোনার আগে তুমি আমার মরণ কেন দিলে না?”

ড্রামা কুইনের ড্রামা দেখে অনিকের হাসি পেলেও হাসল না সে। চোখ-মুখ শক্ত করে বলল,” খাও চুপ করে। নয়তো আবার বিষম উঠবে।”

সেজুতি আর অন্তরা ক্লান্তপায়ে হাঁটছে। এতোক্ষণ খুঁজেও একটা গাড়ির ব্যবস্থা করতে পারেনি তারা। আজকের দিনে সকল যান চলাচল বন্ধ এটা দুজনের কেউই জানে না। আশেপাশে খোঁজ করতে গিয়ে জানতে পারল যে টানা দুইদিন ধরে কারফিউ চলবে। বড় বড় বাস,ট্রাকের সাথে রিকশা,ভ্যান পর্যন্ত বন্ধ। এদিকে অন্তরা আর সেজুতি রাস্তাও চিনেনা। গুগল ম্যাপ অন করার জন্য কারো ফোনেই ইন্টারনেট নেই। হাঁটতে হাঁটতে দুই বান্ধবী ক্লান্ত হয়ে এক জায়গায় থামল। সেজুতি রাস্তার মাঝখানেই বসে পড়েছে। অন্তরা বলল,” কিরে! কি হয়েছে তোর? বেশি খারাপ লাগছে?”

” আর হাঁটবো না দোস্ত। এবার একটু বোস।”

অন্তরা বসতে বসতে বলল,” দোস্ত আমার না খুব ভয় লাগছে।”

” আর আমার রাগ লাগছে। ওই নোরা শাকচুন্নিটারে এখন হাতের কাছে পাইলে ঘাড় মটকাইতাম।”

” আসলেই। কি একটা বিপদে ফেলে চলে গেল বলতো। শালী ফোনটাও ধরেনা।”

” ধরবে কিভাবে? সাথে ওর অনিক স্যার আছে না? আমাদের কথা কি এখন মনে থাকবে?”

” তাই বলে এতোবার কল দেওয়ার পরেও ধরবেনা? একটু তো বোঝা উচিৎ কোনো জরুরী দরকারেই ফোনটা দিচ্ছি।”

” এইটা যদি বুঝতো তাহলে তো হতোই..”

সেজুতি হঠাৎ থেমে গেল। তারপর কান খাড়া করে কিছু একটা শোনার চেষ্টা করতে লাগল। অন্তরা বলল,” কিরে! কি শুনিস?”

” কার যেন গোঙানির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে দোস্ত। মুখ বেধে রাখলে যেমন হয়না? সেরকম।”

“ওরে বাপরে। আমার ভয় লাগছে দোস্ত চল এখান থেকে চলে যাই।”

” আরে থাম, বিষয়টা বুঝতে দে আগে।”

” কিচ্ছু বোঝার দরকার নাই। আমি সব বুঝে গেছি। নিশ্চয়ই কেউ বিপদে পড়েছে। আর এখানে বেশিক্ষণ থাকলে আমরাও বিপদে পড়বো। তাই চল পালাই।”

সেজুতি অন্তরার কোনো কথা শুনল না। বসা থেকে উঠে দাড়িয়ে সচেতন পায়ে শব্দের উৎস বরাবর হাঁটতে লাগল। অন্তরা কয়েকবার বাঁধা দিল। কিন্তু লাভ হলনা। পরে সে নিজেও সেজুতির সঙ্গে চলতে শুরু করল। ওরা যত সামনে যাচ্ছিল আওয়াজটা তত গাঢ় হচ্ছিল এবং একসময় মনে হল এটা কারো গোঙানির আওয়াজ না বরং চিৎকারের আওয়াজ। দূর থেকে শব্দটা গোঙানির মতো শোনাচ্ছিল। কেউ চেঁচিয়ে সাহায্য চাইছে। পুরুষকণ্ঠ। ওরা আরো কয়েক ধাপ সামনে এগুতেই দেখল রাস্তা শেষ। নিচে খাদ। সেই খাদের গভীরতা অনেক। একটা ছেলে ভাঙা গাছের ডাল ধরে ঝুলে আছে। সে-ই চিৎকার করছে। কোনোভাবে হাত থেকে গাছের ডালটা ছুটে গেলেই খাদে পড়ে যেতে হবে।

সেজুতি অপরিচিত ছেলেটিকে আশ্বাস দিয়ে বলল শান্ত থাকতে। ওরা ওকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে। তারপর ওরা ওদের ওরনা একসাথে গিট বেঁধে লম্বা দড়ি বানাল। সেই দড়ি ছেলেটার দিকে ফেলল। ছেলেটা দড়ি ধরে উপরে উঠে আসতে সক্ষম হল। উপর থেকে সেজুতি আর অন্তরাও টানছিল। ছেলেটা হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,” থ্যাঙ্কস আপু, থ্যাংক্স আপনাদের।”

সেজুতি ক্লান্ত হয়ে মাটিতে বসে পড়েছে। হঠাৎ কি জানি হল।সেজুতি কিছু বুঝলনা। অন্তরা ভাঙা গাছের ডাল তুলে ছেলেটাকে ধাওয়া করতে শুরু করল। ছেলেটা এক দৌড় দিল, অন্তরাও দৌড়। সেজুতি কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিল। বিস্ময় কাটিয়ে সে-ও দৌড়ানো শুরু করল ওদের পেছনে। অন্তরা দৌড়াচ্ছে আর বলছে,” পালিয়ে যাবি কোথায়? আমি তো তোকে ধরবই। সারাজীবন খালি পালানোটাই শিখলি। মুখোমুখি দাড়ানোর সাহস আছে তোর? কাপুরুষ! ”

ছেলেটা দৌড়াচ্ছে আর হাতজোর করে ক্ষমা চাচ্ছে,” প্লিজ অন্তুপাখি মাফ করে দাও। আমি সেদিনের জন্য ক্ষমাপ্রার্থী। তুমি চাইলে আমি এক্সপ্লেনেশন দিতে পারি।”

” তোর এক্সপ্লেনেশনের আমি গুল্লি মারি। তুই খালি আমার সামনে আয় একবার। বেটা কাপুরষ। তুই আবার আমাকে অন্তুপাখি বইলা ডাকিস? কে তোর পাখি?”

সেজুতি ছুটতে ছুটতে বলল,” তোরা থাম দোহাই লাগে তোদের। অন্তু প্লিজ থাম।”

সেজুতি অন্তরাকে টেনে দাঁড় করাল। অন্তরা থামল কিন্তু দমল না। এখনো বিষধরী নাগিনের মতোর ফোসফোস করছে। অন্তরার অবস্থা দেখে সেজুতির ভয় লাগল। এর আগে কখনো ওকে এতোটা রেগে যেতে দেখেনি সে। সামনে ছেলেটাও থেমে গেছে। ধীরপায়ে ওদের দিকে এগিয়ে আসছে। বোঝাই যাচ্ছে খুব ভয় পাচ্ছে বেচারা। সেজুতি অন্তরাকে বলল,” দোস্ত তুই ঠান্ডা হয়ে বলতো কাহিনি কি?”

” কাহিনি ওই কু*ত্তা জানে। ওই কু*ত্তাকে জিজ্ঞেস কর ও কি করছে।”

এ কথা বলতে বলতে নিজের স্যান্ডেল খুলে ছেলেটার দিকে ছুড়ে মারল অন্তরা। ছেলেটা ক্যাচ ধরতে পেরেই দাঁত বের করে হেসে উঠল। অন্তরা তেতে আরেকটা স্যান্ডেল ছুড়ে মারল। ছেলেটা ওটাও ধরে ফেলল। অন্তরা রাগে নিচ থেকে পাথর নিয়ে জোরে ঢিল মারল। এবার ছেলেটার কপালে আঘাত লাগল। সেজুতি চমকে উঠে বলল,” দোস্ত তোর পায়ে ধরি ঢিলাঢিলি বন্ধ কর। আচ্ছা ভাইয়া আপনি আমাকে বলেন তো ও এমন করছে কেন? আপনাদের মাঝখানে কিসের এতো শত্রুতা?”

ছেলেটা কপাল ডলতে ডলতে বলল,” আমি আলভী। একসময় ওর আর আমার মধ্যে খুব সিরিয়াস রিলেশনশিপ ছিল।”

অন্তরা চেঁচিয়ে বলল,” সিরিয়াস রিলেশনশিপ? নাকি তামাশার রিলেশনশিপ? তোর কাছে তো সবটাই তামাশা ছিল।”

সেজুতি বলল,” আচ্ছা তুই চুপ থাক। উনাকে বলতে দে। ”

সেজুতি আলভীর দিকে তাকিয়ে বলল,” আচ্ছা তাহলে আপনিই আলভী?”

আলভী বলল,” জ্বী। আসলে আমাদের মধ্যে একটা বড় মিস আন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়েছে। তারপর থেকেই রিলেশনটা আর কনটিনিউ হয়নি।”

অন্তরা বলল,” মিস আন্ডারস্ট্যান্ডিং? আচ্ছা! তোকে বুঝাচ্ছি আমি মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং কাকে বলে। একবার সামনে আয়।”
আলভী অন্তরার কাছে এসে ওর দুইকাঁধে হাত রেখে বলল,
” অন্তু তুমি আমার কথাটা একবার শোনো। আমি জানি তুমি আমার উপর খুব রেগে আছো। কিন্তু সেদিন আমি কোন পরিস্থিতিতে ছিলাম সেটা জানলে হয়তো তোমার আর কোনো রাগ থাকবে না।”

অন্তরা আর সামলাতে পারল না নিজেকে। মুখে ওরনা চেপে কেঁদে ফেলল। কাঁদতে কাঁদতে বলল,” কি এমন বাধ্যবাধকতা ছিল যে সেদিন তুমি একটা কথাও বলতে পারলে না? তোমার ভাবী আমাকে ভিডিও কলে এইভাবে অপমান করল, কত বাজে বাজে কথা শোনাল। বলল আমি নাকি ওয়ানটাইম গার্ল। তাও তুমি কিছু বললে না? কিভাবে পারলে চুপ থাকতে আলভী? কিভাবে?”

” অন্তু ও আমার ভাবী না। ভাইয়ার সাথে ওর বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পরে হয়নি। ও ভাইয়ার গার্লফ্রেন্ড ছিল।”

অন্তরা চোখ মুছতে মুছতে বলল,” ও! ভাবীও না? মানে বাহিরের একটা মেয়ে? তোমাদের ফ্যামিলির কেউ হয়না ও তবুও আমাকে ওইভাবে অপমান করল আর তুমি কিচ্ছু বলতে পারলে না?”

” অন্তু তখন আমার সামনে আব্বু ছিল আম্মু ছিল। ওরা দুইজন আমার দুইপাশে দারোগার মতো দাড়িয়েছিল। আমি যদি তখন একটা শব্দ করতাম তাহলেই চড় খেতাম।”

” শুধুমাত্র চড়? আর তোমার ওই ফেইক ভাবী যে প্রতিটা কথায় আমার গালে অদৃশ্য চড় বসাচ্ছিল সেটা? ওর প্রত্যেকটা কথা তো চড়ের থেকেও ভয়ংকর লাগছিল আমার কাছে। এর থেকে আমাকে সামনাসামনি দশটা চড় মারলেও আমি কিচ্ছু মনে করতাম না।”

” আমি জানি অন্তু সে খুব বাজে কাজ করেছে। আর সেজন্য শাস্তিও পেয়েছে। শুধুমাত্র তোমাকে অপমান করার কারণেই আমি ওর সাথে ভাইয়ার বিয়েটা হতে দেইনি। আমি যেমন ওর জন্য আমার ভালোবাসাকে হারিয়েছি, তেমনি ওকেও আমি ওর ভালোবাসা পেতে দেইনি।”

” তাই যদি হয় তাহলে সেদিনের পর থেকে কেন আমার সাথে যোগাযোগ রাখোনি? কেন আমার সামনে আসোনি? জানো কিভাবে কাটিয়েছি আমি এই দুইটি বছর? মানসিক রোগী হয়ে গিয়েছিলাম।”

” প্রথম কয়েক মাস তো আমি কারো সাথেই যোগাযোগ রাখতে পারিনি। আমাকে ফোনই দেওয়া হতোনা। আর তোমার তো ফোন নম্বরও ছিলনা। তুমি ট্যাব ইউজ করতে। সোশ্যাল মিডিয়া ছাড়া তোমার সাথে যোগাযোগের আর কোনো উপায় ছিলনা। অথচ তখন আমি ইন্টারনেট থেকে সম্পুর্ণ বিচ্ছিন্ন ছিলাম।”

” আচ্ছা তারপর? তারপর কেন যোগাযোগ করার চেষ্টা করোনি?”

” তোমাকে আর খুঁজেই পাইনি। তুমি আইডি অফ করে দিয়েছিলে।”

” আসল কথা কেন বলছো না? তখন তুমি সুজিকে পেয়ে গিয়েছিলে। সুজির সাথে ফেসবুকে তোমার ছবি দেখেই তো আইডি অফ করেছিলাম আমি।”

” হ্যা আমি স্বীকার করছি আমার দোষ ছিল। তোমার সাথে রিলেশনের আগে আমার সুজি সাথে রিলেশন ছিল। তুমি চলে যাওয়ার পর সুজি আবার ব্যাক করেছে। আমি তখন ওকে ফেরাতে পারিনি।”

“তা পারবে কি করে? সুজি তো বিশ্বসুন্দরী তাইনা? মতিভ্রম হয়েছিল তোমার। তাহলে এখন আমার রাগ ভাঙাতে কেন এসেছো? তোমার সুজির কাছে যাও।”

” কিভাবে যাবো? সুজি তো এখন হালুয়া হয়ে গেছে।”

” মানে?”

” মানে সুজির বিয়ে হয়ে গেছে।”

” ও। তাহলে এইজন্য এখন আমার কাছে এসেছো?”

” সরি অন্তরা। প্লিজ মাফ করে দাও। আর একটা চান্স দিয়ে দেখো। একদম ভালো হয়ে যাবো।”

আলভী অন্তরার দুইহাত চেপে ধরল। তারপর করুণ দৃষ্টিতে অন্তরার চোখের দিকে তাকিয়ে ক্ষমা চাইল। অন্তরা গলেও গেল। কিন্তু প্রকাশ করল না। সেজুতি তার কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলল,” বেচারাকে দেখে মায়া লাগছে। মাফ করে দে।”

অন্তরা রাগী চোখে। সেজুতি বলল,” ঠিকাছে তোর ইচ্ছে না হলে মাফ করার দরকার নেই। চল আমরা চলে যাই।”

অন্তরা চোখের জল মুছতে মুছতে বলল,” ঠিকাছে যাও মাফ করলাম। কিন্তু আর কখনও যদি অন্যকোনো মেয়ের দিকে তাকিয়েছো তাহলে এখন যেমন ওরনা পেচিয়ে তোমাকে খাদ থেকে তুলেছি, তেমনি ওরনা দিয়ে ধাক্কা মেরেই খাদে ফেলে দিবো। মনে থাকে যেন।”

আলভী হেসে বলল,” যো হুকুম মহারাণী!”

অনিক আর নোরা ধাবা থেকে বেরিয়েই আবারও হাঁটতে লাগল। নোরা হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত প্রায়। একসময় বলল,” ও স্যার, আর কত হাঁটাবো? পেটে ব্যাথা করছে তো। এবার একটু রেস্ট করি?”

” প্রশ্নই আসেনা। সন্ধ্যা হওয়ার আগে আমাদের পৌঁছাতে হবে। নাহলে অন্ধকারে হারিয়ে যাবো। তখন না তুমি আমাকে খুঁজে পাবে আর না আমি তোমাকে।”

” সেজন্যই তো বলছি স্যার। একসাথে হাঁটি। আপনি আগে আমি পিছে এভাবে তো হচ্ছেনা।”

” তুমি তাড়াতাড়ি হাঁটো। তাহলেই হবে।”

” আমার পায়ে কি মেশিন লাগানো? আমি কিভাবে তাড়াতাড়ি হাঁটবো?”

আরেকটু সামনে এগোতেই একটা মালবাহী ট্রাক দেখল অনিক। শ্রমিকরা ট্রাকের ভেতর মাল তুলছে। অনিক পেছনে ঘুরে নোরাকে বলল, ” নোরা,একটু অ্যাকটিং করতে পারবে?”

তার এমন প্রশ্নে নোরা চ’মকে উঠল। ভ্রু কুঁচকে বলল,” অ্যাকটিং মানে?”

” অসুস্থতার অ্যাকটিং।”

” কেন?”

” বলছি, আগে পারবে কি-না বলো।”

” পারবো। জানেনই তো, অ্যাকটিং-এ আমি ফার্স্ট ক্লাস!”

অনিক হাসল। অভিনয়রত নোরাকে আগলে নিয়ে সে ট্রাক ড্রাইভারের কাছে গিয়ে বলল,” ভাই, একটু সাহায্য করবেন প্লিজ? খুব বিপদে পড়েছি আমরা।”

শ্রমিকরা কাজ বাদ দিয়ে ওদের দিকে তাকাল। ট্রাক ড্রাইভার প্রশ্ন করলেন,” কি অইসে?”

” আমার ওয়াইফ খুব অসুস্থ। কারফিউয়ের জন্য তো যানবাহনও পাওয়া যাচ্ছেনা। যদি একটু আমাদের চন্দ্রনাথ পর্যন্ত পৌঁছে দেন খুব হেল্প হয়।”

ড্রাইভার বিরক্তগলায় বললেন,” না না! সম্ভব না। ওতোদূর যাওয়ার আগেই আমগোরে আটকায় দিবো। পরে গাড়ির চাবি বাজেয়াপ্ত করবো, মাল বাজেয়াপ্ত করবো,অনেক ঝামেলা। মালই পৌঁছাইতে পারতাসি না।”

অনিক বলল,” ট্রাফিক পুলিশদের সাথে আমি কথা বলে নিবো। অসুস্থ রোগীর কথা শুনলে রাজি হয়ে যাবে। প্লিজ চলেন না ভাই। খুব বিপদে আছি। কালরাত থেকে ওকে নিয়ে ঘুরছি। প্লিজ একটু দেখেন না।”

অনেক অনুনয়-বিনয়ের পর ট্রাক ড্রাইভারকে রাজি করানো গেল। অনিক নোরাকে জানালার পাশে বসাল। নিজে বসল মাঝখানে, ড্রাইভারের পাশে। ট্রাকে উঠার পরই নোরা চোখ খুলে একদম স্বাভাবিক হয়ে বসল। ট্রাক ড্রাইভার অবাক হয়ে বললেন,” আপায় না অসুস্থ? ”

অনিক হেসে বলল,”অসুস্থ হওয়া কি খুব জরুরী? ”

ড্রাইভার বললেন,” কাজটা কইলাম ঠিক হইতাসে না ভাই।”

অনিক ড্রাইভারের কাঁধ চাপড়ে বলল,” আরে এতো ভাববেন না ভাই। টাকা বেশি দিবো। আপনি খালি স্টেয়ারিং ঘুরান।”

নোরা হাসতে লাগল। জীবনে এই প্রথমবার ট্রাকে উঠেছে সে। তার ভীষণ মজা লাগছে। তাদের এই ট্রাক জার্নি খুব একটা সুখকর হলো না। সামনেই পড়ল টহল পুলিশ। ওখানেই ট্রাক থামানো হলো। ট্রাক ড্রাইভারকে কলার ধরে টানতে টানতে এক অফিসার নিয়ে চলে গেল। নোরা তখন ভয়ে অস্থির। অনিক আশ্বাস দিল, কিচ্ছু হবেনা। নোরাকে আবার সেই অসুস্থতার অ্যাকটিং চালিয়ে যেতে বলল। বেশ কিছুক্ষণ পর ট্রাক ড্রাইভার বিধ্বস্ত অবস্থায় ফিরে আসলেন। অনিক বলল,” কি হয়েছে? অনুমতি পাওয়া গেছে?”

ড্রাইভার হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন,” ওরা লেন-দেনের কথা বলে।”

অনিক সঙ্গে সঙ্গে ওয়ালেট বের করে জানতে চাইল “কত চায়?”

ড্রাইভার বললেন,” টাকা না। ওরা অন্যকিছু দাবী করছে।”

অনিক ভ্রু কুঁচকে বলল,” অন্যকিছু কি?”

ড্রাইভার নোরার দিকে তাকালেন। অনিকের আত্মা কেঁপে উঠল। নোরা কিচ্ছু বুঝতে পারছে না। সরল মুখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,” কি হয়েছে?”

অনিক কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,”নোরা নামো।”

” নামবো কেন?”

অনিক বলল,”নামতে হবে। ভাই, আপনি আগান আমরা আসছি।”

ড্রাইভার বললেন,” কি কন ভাই?”

অনিক বলল,” আপনাকে যা বলছি তাই করুন।”

ড্রাইভার আর কোনো প্রশ্ন করলনা। সামনে আগাতে লাগল। অনিক-নোরাকে নিয়ে ট্রাক থেকে নেমেই উল্টোদিকে দৌড় লাগাল। নোরা বুঝতে পারছে না তারা কেন দৌড়াচ্ছে। কিন্তু অনিক যেহেতু দৌড়াতে বলছে তাহলে নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে। ওদের পেছনে পুলিশ বাহিনীও আসছে। বুলেটের বিকট আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। অনিকের চোখেমুখে আতঙ্ক। সে দৌড়াতে দৌড়াতে হঠাৎ নোরাকে নিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। একটা গাছের পেছনে লুকিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে নোরার দুই গাল স্পর্শ করে বলল,” নোরা, একটা কথা মনোযোগ দিয়ে শোনো। বলার সুযোগ আবার নাও আসতে পারে। হয়তো এখানেই সব শেষ। তাই বলছি, আই লভ ইউ। অনেক আগে থেকে। প্রায় চারবছর আগে, তোমাকে একটা জায়গায় দেখেছিলাম। তখন থেকেই ভালো লাগতো। ভালোবাসতাম। এখনও ভালোবাসি। ”

কথাগুলো বলতে বলতে অনিক নোরার কপালে চুমু দিল সে। নোরা হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অনিকের মুখে আই লভ ইউ শুনেও কোনো অনুভূতি হচ্ছেনা তার। কারণ এর আগে যে আরেকটা বাক্য ছিল। হয়তো এখানেই সব শেষ!

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here