#চিত্তসন্ধি
পর্ব ১৫
লেখা: #Azyah
তিনদিন পর মেহতাবের গাড়ীর হর্নে জয়তুন বেগম দৌড়ে আসলেন।এসে দরজার সামনে দাঁড়িয়েছেন।গাড়ি টেনে ভেতরে চলে গেল।সেও পেছন পেছন শাড়ি ধরে এসেছেন।
এসেই ব্যস্ত ভঙ্গীতে বলতে লাগলেন,
“আব্বা আপনি ঠিক আছেন?বাড়ি আহেন নাই কেন এই কয়দিন?রায়হান বাবায় আপনার ঔষধ নিতে আইয়া কইলো আপনি নাকি অসুস্থ।কি অবস্থা এহন?”
মেহতাব স্মিথ হেসে বললো, “শান্ত হন খালা।আমি ঠিক আছি”
“কি কন আব্বা?আপনার চেহারার হাল দেখছেন? শুকায় কি অবস্থা।আমার মনে হয় আপনার নজর লাগছে।আহেন আমি নজরটা পুইড়া দেই”
“আরেহ নাহ খালা!কি বলছেন?আমি একটু দুর্বল এই আরকি”
“সত্যি কইতাছি আব্বা।আমগো ধর্মে নজর লাগা সম্পর্কে কওয়া আছে।আর আপনে দেখতে মেলা সুন্দর।কি জানি কোন ডায়নি, চুন্নি নজর দিছে আপনারে।আপনি যান আমি শুকনা মরিচ আনতাছি ”
মেহতাব এবার শব্দ করে হেসে উঠলো।তার মনে হচ্ছে এই ডায়নি, চুন্নি আদরকে বলা হচ্ছে।তার কথার কোনো উত্তর না দিয়েই উপরে চলে গেলো।
জয়তুন বেগম জোর করে শুকনো মরিচ দিয়ে নজর পুরেছেন।তাকে না করেও লাভ হয়নি।খাবার দিয়ে চলে গেলেন মাত্র।মেহতাব খাবার খেয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো।নিজেকে সুস্থ দাবি করলেও অনেকটা দুর্বল শরীর। সাতদিনে নিজের উপর যে অত্যাচার চালিয়েছে সেটা একদিন পূরণ হওয়া সম্ভব না। ডক্টর খলিল মাত্র কল করে ওষুধ খাওয়ার তাগাদা দিলেন।তার আদেশমত খেয়েও নিয়েছে।তাছারাও শান্তি লাগছে এখন।মনে হচ্ছে বুকের উপর থেকে কেউ বিশাল পাথর সরিয়ে দিলো।
আজ যে কাজটা করেছে সেটা নিয়ে লজ্জাবোধ করছে মেহতাব।এমন একটা কাজ করে ফেলবে সেটা ভাবতেও পারেনি।আচ্ছা আদরের কি অবস্থা?মেয়েটাতো আঁটসাঁট হয়ে গিয়েছিল।থরথর কাপছিলো।সেকি লজ্জা পেয়ে এমনটা করেছিলো নাকি ঘাবড়ে গিয়েছিল?একটাবারও চোখ তুলে তাকায়নি।আমাকে যদি চরিত্রহীন ভাবে?নিজেকে কেনো আটকাতে পারলাম না!নিজের মনকে শান্ত করতে গিয়ে!হটাৎ মনে পড়লো তার কেবিনেতো সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো।যেটার সমস্ত নিয়ন্ত্রণ শুধু মেহতাব এর কাছে।তাহলে আজকের দৃশ্যটাও কি সেখানে আছে?ঝড়ের গতিতে ল্যাপটপ ওপেন করেছে মেহতাব।আজকের ফুটেজ অন করে নিলো।অল্পকিছু সময় পর স্ক্রিনে ভেসে আসলো মেহতাব এর বেহায়া কর্মকাণ্ড।সাথেসাথে মুখ শক্ত করে চোখ বন্ধ করে নিলো।কিন্তু অবাধ্য চোখগুলো বারবার তাড়না দিচ্ছে দেখতে।আদর যখন তার বুকে লেপ্টে ছিল সেই অংশটা পজ করলো।জুম ইন করে তার চেহারাটাই দেখছে বারবার।মনে হচ্ছে এখনও বুকের বামপাশে তার ছোয়া লেগে আছে। লাগামহীন হৃদপিণ্ড দ্রীমদ্রীম শব্দ করেই যাচ্ছে।একটা লাইন বারবার বলে উঠছে,
“তুমি আহামরি কিছু নও।নাই তুমি বিশাল সৌন্দর্যের প্রতিমা।কিন্তু আমার বুকে তোমাকে পৃথিবীর শ্রেষ্ট সুন্দর নারী দেখাচ্ছে কেনো?”
আজকাল মন আর মস্তিষ্ক অনেকটাই মেহতাবের বিরুদ্ধে কাজকর্মে লিপ্ত।দ্রুত ফুটেজটা ল্যাপটপে সেভ করেছে। প্রাইভেট অ্যালবামে সযত্নে রেখে দিলো। আগেপরের সমস্ত ফুটেজ মেমোরি থেকে ফরমেট মারলো।কোনোভাবে রিস্ক নেওয়া যাবে না।আদরকে নিয়েতো মোটেও না।
___
উপুর হয়ে শুয়ে আছে আদর।বালিশে মুখ গুজে আজকের ঘটনাটা নিয়ে ভাবছে।কি হলো এটা?মস্তিষ্ক পুরোপুরি শূন্য করে দিয়ে গেছে।এই শূন্য মস্তিষ্কে শুধু সেই দৃশ্যটাই ভাসছে।বারবার আদর চাইছে যেনো মনে না পড়ে।ঠিক ততবার তার মাথায় হানা দিচ্ছে।মেহতাব এর ঘন নিঃশ্বাস তার ঘাড়ে পড়ছিল।হাত আপনাআপনি চলে গেলো সেখানে।যেনো বৈদ্যুতিক শক খেয়েছে।
আশরাফ মাহমুদ এসে মেয়ের পাশে বসে বললেন,
“আজ আবার কি হলো আমার মার?ওই পাজি ডাক্টারটা আজ কিছু বলেছে তোমায়?”
বাবার কণ্ঠে উঠে বসলো আদর।মনে মনে ভাবছে আজ যা করেছে সেটা তার কথার চেয়ে বহুগুণে ভয়ঙ্কর। মুখে হাসির রেখা টেনে বলল,
“কই কিছুই হয়নিতো আর কেউ কিছু বলেও নি”
“তাহলে আমার মার গালটা লাল হয়ে আছে কেনো?”
“গাল লাল হয়ে আছে?আসলেই আব্বু!”
বলে উঠে গিয়ে দাঁড়ালো আয়নার সামনে।নাক আর গাল লাল টমেটোর মতন হয়ে আছে।আবারো লজ্জায় পরে গেলো।
বাবাকে বললো,
“ও কিছুনা আব্বু উপুড় হয়ে শুয়ে ছিলাম তাই হয়তো”
“আচ্ছা তোমার রাগ কমেছে?কাজটা করবেতো ঠিকঠাক?”
আদর কিছুক্ষন ভেবে উত্তর দিল, “হ্যা আব্বু”
আশরাফ মাহমুদ মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বললো, “এইতো আমার মা ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে”
আকষ্মিক বাবা থেকে দূরে সরে গেলো।বাবা জড়িয়ে ধরায় ভরকে উঠলো।আশরাফ মাহমুদ আশ্চর্য্য হলেন মেয়ের এমন কাণ্ডে।নিজে সরে গিয়ে নিজেই আবার বেকুব বনে গেলো।সে কেনো করলো এটা?তার বাবাতো পর কেউ না। জন্মদাতা পিতা।বাবা নিশ্চয়ই কষ্ট পেয়েছেন!আজ কসাই সাহেবের এমন কাণ্ডে সব ধরনের জড়িয়ে ধরার উপর আদরের হয়তো ফোবিয়া হয়ে গেছে।বাবাকে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে সঙ্গেসঙ্গে বাবাকে জরিয়ে ধরে বললো,
“আই লাভ ইউ আব্বু”
“আমিও মা”
জোহরা খাতুন ঘরে ঢুকে বললেন, “বাবা মেয়ের ভালোবাসা শেষ হলে এবার এসো খেতে”
খাবার টেবিলে আজ বিরিয়ানি দেখে চোখ সপ্তম আসমানে।এটা কি সত্যি!ঠিকঠাক দেখছেতো?নাকি তার এখন চশমা লাগবে!বিরিয়ানি আদরের সবচেয়ে পছন্দের।কিন্তু ডাক্তারের কাছে যাওয়ার পর থেকে এই বিরিয়ানির চেহারা দেখেনি অনেকদিন। অনেকদিনকে অনেক বছরের মতন লাগছে।একবার বিরিয়ানির দিকে তাকিয়ে আরেকবার মার দিকে তাকাচ্ছে।মাকে অদ্ভুত চেহারা বানিয়ে বোঝাতে যাচ্ছে সে অবাক।
জোহরা খাতুন মেয়ের এমন কাণ্ড দেখে বলে উঠলেন,
“হয়েছে এত ঢং করা লাগবে না।আজ দুপুরে মেহমান এসেছিল তাদের জন্য রেধেছি।তোমার বাবা নাকি তোমাকে ছাড়া বিরিয়ানি মুখে তুলবেন না।”
বাবার দিকে তাকিয়ে খুশিতে গদগদ করে উঠলো আদর। বিরিয়ানির ঘ্রানে মোমো করছে সারাঘর।দ্রুত তিনচার চামচ প্লেটে নিয়ে নিলো।
জোহরা খাতুন আবার বললেন,
“একদিনে যেনো পাখনা না গজায়। কাল থেকে ডায়েট ফুড খেতে হবে”
“উফ মা! রাখো তোমার ডায়েট ফুড।এখন বিরিয়ানি ইনজয় করতে দাও”
_____
পেট পুরে বিরিয়ানি খেয়ে সবসময়ের মতন ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসেছে। রূপচর্চায় অতটা মনোযোগী না হলেও রাতে হাতে পায়ে লোওশন মেখে গুনগুন করছে।আয়নাতে নিজের চেহারায় আবার চোখ বুলিয়ে নিলো। এখনো কি লাল হয়ে আছে চেহারাটা!চেহারা দেখতে গিয়ে আবার সকালের দৃশ্য মাথায় বাড়ি খাচ্ছে। বিরক্তিতে “উফ” উচ্চারণ করে লাইট নিভিয়ে শুয়ে পড়লো।
আধ ঘন্টা পাড় করে কিছুতেই ঘুম আসছে না।এপাশ ওপাশ করছে।এক দৃষ্টিতে ড্রিম লাইটের দিকে চেয়ে ভাবলো আচ্ছা ওনারতো শরীর খারাপ।এখন কি ঠিক আছে?উনি বলেছিলো সে একা থাকে।অসুস্থ শরীর নিয়ে কিভাবে একা আছে?একটু খবর নেওয়া দরকার।জ্বরের ঘোরে নাহয় একটা ভুল করে ফেলেছে।কিন্তু আমি এতটা নির্দয় হতে পারি না তার মত।আমাকে ধমকে একটা সরি পর্যন্ত বলেনি।
ভেবেচিন্তে ফোনটা হাতে নিলো। ফেসবুকে তার নামটা সার্চ করেছে। ডক্টর নওশের মেহতাব।সঙ্গেসঙ্গে আইডি সামনে এসে পড়ল।শুধু নওশের মেহতাব। প্রোফাইল চেপে দেখলো আকাশী রঙের শার্ট পড়া একটা ছবি দেওয়া।কভারে রাতের আকাশের তারার ছবি।একটু একটু করে পুরো প্রোফাইল তন্ন তন্ন করলো।হাতে গোনা ছয় সাতটা ছবি।তেমন কিছুই নেই।বড্ড নিরামিষ লোকতো বাপু!চোখের মণি এপাশ ওপাশ ঘুরিয়ে ভাবছে রিকোয়েস্ট পাঠাবে নাকি? দিবে নাকি দিবে না। দিবে নাকি দিবে না।ভাবতে ভাবতে ফোন উপুড় হয়ে পড়লো আদরের নাকে।সঙ্গেসঙ্গে রিকোয়েস্ট চলে গেছে।আদর দ্রুত ক্যানসেল করে দম ছাড়লো।
দমটা পুরোটা ছাড়ার আগেই ফোনে মেহতাবের কল। দুরুদুরু বুক নিয়ে চোখ বন্ধ করে রিসিভ কলে চাপ দিয়েছে। ওপরপ্রান্ত থেকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো মেহতাব,
“না ঘুমিয়ে কি করছেন আপনি?”
“তে..তেমন কিছুই না”
“আমাকে রিকোয়েস্ট দিয়েছিলেন।”
“কই নাতো!ঐযে ভুলে চাপ লেগে গেছে
“স্টক করছিলেন?”
“আপনাকে আমি স্টক করবো কেনো আজব।আমার সামনে আপনার আইডি ঘুরছিল।ভুলে চাপ লেগে গেছে।আর আপনার আইডিতে তেমন কিছুই নেই যে আমি স্টক করবো!”
“যদি স্টক নাও করে থাকেন তাহলে জানলেন কি করে আমার আইডিতে কিছু নেই?”
জ্বিভ কাটলো আদর।নিজেকে রক্ষা করার জন্য অনর্গল সত্যি কথা বলে গেছে।আর ধরাও খেয়ে গেলো।হাতের গিটারে মৃদু আওয়াজে ঝংকার তুলতে তুলতে মৃদু হাসলো মেহতাব।
“আসলে একটা মানুষকে রাতে কল দেওয়া ঠিক দেখায় না।আর আপনি বলেছিলেন রাতে আপনাকে কোনো কাজে বিরক্ত না করতে।ফেসবুকে টুয়েন্টি ফোর সেভেন মেসেজ করা যায়।”
“আচ্ছা তাহলে কেনো আমাকে ফোন আর মেসেজ করতে চাচ্ছিলেন?”
“ঐযে আপনি অসুস্থ না।একটু হালচাল জিজ্ঞেস করতাম এই আরকি আর কিছু না”
“জিজ্ঞেস করেন তাহলে?”
যতবার রাতে মেহতাবের সাথে কথা হয়েছে ততবার তার অদ্ভুত কণ্ঠের স্বীকার হয়েছে আদর।কন্ঠ শুনলে মনে হয় মাদকাসক্ত সে। নেশায় বুদ হয়ে কথা বলছে।
“না থাক!”
কানে হেডফোন গুজে কথা বলতে বলতে থেমে গেলো আদর।ফোনের স্ক্রিনে নোটিফিকেশন ভেসে আসছে।কসাই সাহেব তাকে রিকোয়েস্ট দিয়েছেন।আদর ভাবলো একসেপ্ট করবে না। ঝুলে থাকুক।
“আমার সাথে আর আমার কাজের সাথে জড়িত বাকিদের সাথে অ্যাড হয়ে নিন।আমি আপনাকে হসপিটালের বাকি গ্রুপগুলোতে অ্যাড করে দিবো।অনেক প্রয়োজনীয় নোটিশ আর ইনফরমেশন দেওয়া হয় এখানে।সবসময় সব ফোনে বলা সম্ভব না।সব ফলো করবেন।নেক্সটে কাজ বাড়বে।জানতে হবে এসব”
“জ্বি আচ্ছা”
“ঘুমান”
“উম..আপনি..”
আদরের আমতা আমতা শুনে মেহতাব বললো,
“আমি অনেকটা সুস্থ”
অবাক হতে চেয়েও নিজেকে আটকে নিলো।সেতো অন্তর্যামী।কিছু বলার আগেই ধরে ফেলে।আপাদত এসব ব্যপারে আশ্চর্য্য,অবাক, বিমূর কোনোটাই হওয়া যাবে না।
“ঠিক আছে।”
“আর শুনেন”
“হ্যা”
“কাল ডিউটি নেই।আমাকে জোর করে ছুটি দিয়েছেন খলিল স্যার অসুস্থতার জন্য।”
“জ্বি”
বলে ফোন কেটে দিয়েছে আদর।ফোন রেখে মিনিট পাঁচেকের মধ্যে রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করে নিলো।আজ আকাশটা পরিষ্কার। চাঁদটা বিশাল আকারের আকাশে নিজের আধিপত্য বিস্তার করে আছে।
মেহতাব গান গায়।বেশ সুন্দর গান গায়।তার চেহারা দেখলে সেটা বোঝার উপায় নেই।প্রত্যেকটা গানের কিছু অংশ তার বেজায় পছন্দের। ধরেধরে সেই লাইনগুলো গায় সে।আজ মনের বিশাল আবদার।এই লাইনটা না গাইলেই নয়।
“তবু আবার বলবো সেদিন..
আজ জানেকি জিদ না কারো”
চলবে…
কালকে থেকে একটা করেই পর্ব আসবে।আজকে আরেকটা দিলাম আপনাদের আবদারে।এসাইনমেন্ট দিয়েছে ভার্সিটি থেকে। আলবিদা পৃথিবী।🙂
Oneek din por etto shundor ekta golpo porsi. Shob cheye Boro Kotha ei golpo ta last part porjonto ase. Beshir vag golpoi oshomapto.