#শুনলাম_বসন্ত_নাকি_আবার_এসেছে
#লেখিকা_সিনথিয়া_হাসান
#পর্বঃ১৬
সময়টা এখন অন্ধকার ছুঁই ছুঁই ৷ বিকেলের লালচে আভা মিলিয়ে গিয়ে সন্ধ্যার আগমনের প্রয়াস চলছে ৷ তানজিদ ওয়েটিং রুমে বসে কারো জন্য অপেক্ষার প্রহর গুণে চলেছে ৷ একপলক হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে পুনরায় জায়গাটা দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল ৷ খুবই পরিপাটি আর পরিষ্কার সবকিছু ৷ দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যায় ৷
আরো কয়েক মিনিট পর স্বাধীন ওখানে উপস্থিত হয়ে তানজিদকে সালাম দিয়ে ব্যস্ত হয়ে বলতে লাগল,,, আফওয়ান আঙ্কেল আপনাকে এতোক্ষণ অপেক্ষা করানোর জন্য ৷ আসলে পেসেন্ট এসে গিয়েছিল তাই একটু দেরি হয়ে গেল ৷
তানজিদ মুচকি হেসে সালামের জবাব দিয়ে বলল,,, ডোন্ট প্যানিক ৷ আই আন্ডারস্ট্যান্ড ৷
স্বাধীন তানজিদকে নিয়ে নিজের ক্যাবিনে চলে গেল ৷ স্বাধীন ক্যাবিনে যাওয়ার আগে দু কাপ কফির অর্ডার দিতে ভুলল না ৷ স্বাভাবিক ভাবে তুবাকে নিয়ে কিছু বেসিক কথাবার্তা বলার পর তানজিদ স্বাধীনের দিকে একটা মোড়ানো প্যাকেট দিয়ে বলল,,,
তোমার ফিজ ৷
স্বাধীন সেটা পাশে রেখে দিল ৷ কফি এসে গেছে ৷ স্বাধীন তানজিদের দিকে একটা কাপ বাড়িয়ে দিয়ে আরেকটা কাপ হাতে তুলে কাপে চুমুক দিতে লাগল ৷ তানজিদ কফির কাপটা কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া দিয়ে মনে মনে কিছু কথা সাজিয়ে নিল ৷ তারপর গলা খাকারি দিয়ে বলে উঠল,,,
তোমার কাচের ডোরটা তুবা ভেঙেছিল ৷
স্বাধীন সবেমাত্র কফির কাপে আরেক চুমুক দিয়েছিল , তানজিদের কথা কর্ণগোচর হতেই ও মুখের সমস্ত কফি বাইরে বের করে দিল আর দুর্ভাগ্যজনক ভাবে সেটা গিয়ে পড়ল তানজিদের মুখে ৷ স্বাধীন ব্যস্ত ভাবে বসা থেকে উঠে তানজিদের মুখ নিজের রুমাল দিয়ে মুছে দিতে দিতে উ*ত্তেজিত হয়ে বলতে লাগল,,,
আ-আফওয়ান আঙ্কেল ৷ আমি ইচ্ছা করে করিনি ৷
তানজিদ প্রথম ধাপে আহাম্মক হয়ে গেলেও নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,,, শান্ত হও ৷ তোমাকে মুছতে হবে না , আমি মুছে নিচ্ছি ৷
বলে তানজিদ স্বাধীনের হাত থেকে রুমাল টা নিয়ে নিজে মুছতে লাগল ৷ স্বাধীন বি*ব্রত মুখে দাঁড়িয়ে আছে ৷ তা দেখে তানজিদ সামান্য হেসে বলল,,,
আমি কিছু মনে করিনি ৷ তুমি বসো ৷
স্বাধীন তবুও ল*জ্জিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকল ৷ ইতস্তত করে বলে উঠল,,, আঙ্কেল আপনিও আপনার কাপের কফি আমার মুখে ঢেলে দিন প্লিজ ৷ আমার ভালো লাগছে না ৷
তানজিদ জোরে হেসে উঠে বলল,,, পাগল ছেলে ৷ তোমাকে বসতে বলেছি আমি ৷
স্বাধীন বসে পড়ল ৷ তানজিদ স্বাভাবিক গলায় বলতে লাগল,,, তুবা ভুল করে কাচে একটা থা*প্পড় মে*রেছিল যার দরুন কাচটা ভেঙে গেছে ৷ তাই ক্ষ*তিপূরণ হিসেবে তোমার নির্ধারিত ফিজের পাশাপাশি অতিরিক্ত টাকা দিয়েছি ৷ ওই টাকা দিয়ে ডোর টা ঠিক করে নিও ৷
স্বাধীন তৎক্ষণাৎ প্যাকেট টা থেকে অতিরিক্ত এমাউন্ট টুকু বের করে তানজিদের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,,, না আঙ্কেল আমি এটা নিতে পারব না ৷ এমনিতেও আমার ডোর টা পরিবর্তন করার কথা ছিল ৷ ওটা আসলেই একটু একটু দুর্বল ছিল ৷
তানজিদ সে কথা শুনল না ৷ও সেই টাকা নিজেও স্বাধীনের দিকে ফিরিয়ে দিতে লাগল ৷ এভাবে কয়েক দফা এপাশ ওপাশ করতে করতে টাকাগুলোর অবস্থা রফাদফা হয়ে গেল ৷ ওদের জীবন থাকলে ওরা নিশ্চয়ই বলে উঠত,,,, “তোদের দরকার না হলে লেখিকাকে দিয়ে দে সে গরিব নয়তো আমাকে ডাস্টবিনে ফেলে দে তবুও আমার প্রাণপাখি নিয়ে টানাটানি করিস না বাপ , দোহাই লাগে!”
টানাহ্যা*চড়ার এক পর্যায়ে তানজিদ হঠাৎ গলা উচিয়ে বলল,,, নিয়ে নাও রে বাবা ৷ আমি বাসায় গিয়ে এর জন্য মেয়েকে হিসাব দিতে পারব না ৷ ও হিসাবের কথা বলে বলে আমাকে হাফ মেন্টাল করে দিবে!
স্বাধীন অবাক হয়ে গেল তানজিদের হঠাৎ এমন আচরণে ৷ পর মুহূর্তে নিজেকে সামলেও নিল অবশ্য ৷ তবে টাকা নিয়ে আর ধস্তাধস্তি করল না ৷ তানজিদ নিজেকে স্বাভাবিক করে নরম গলায় বলল,,,
কিছু মনে করো না ৷ আসলে আমার মেয়ে অন্যের হকের ব্যাপারে খুবই সতর্ক ৷ ও পরকালে গিয়ে এসবের জন্য হিসাব দিতে রাজি না বুঝেছো?
স্বাধীন ঘোরের মধ্যে থেকেই মাথা ঝাকাল ৷ তানজিদ আরো কিছু কথা বলে উঠে পড়ল ৷ ক্যাবিন থেকে বেরোতে যাবে তখনই কিছু একটা মনে পড়তে ও ফিরে এসে বলল,,,
আর হ্যাঁ আমার মেয়ের সাথে ডোর ভাঙার বিষয়ে কোনো কথা বলবে না ৷ ও তোমার সামনে দো*ষ স্বীকার করতে লজ্জা পাচ্ছে ৷ মনে থাকো যেন বাবা নয়তো এর জন্য তোমার থেকেও হিসাব নিতে পিছপা হবে না ও ৷
তানজিদ চলে গেল ৷ স্বাধীন চোখ বড় বড় করে সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হঠাৎ করে ও জোরে হেসে উঠল ৷ হাসতেই থাকল, হাসতে হাসতে বলল,,,
রুপের আ*গুনের তাপে ভেঙে গেছে , কথাটা বলার রহস্য আজ বুঝলাম ৷ আসলেই ঠিক বলেছে ৷ যে শুটকির মতো চেহারা তা দিয়ে এক ঘু*ষিতে ডোর ভাঙা সম্ভব না ৷ আপনার রুপের আ*গুনের তাপ সহ্য করতে না পেরেই ভেঙে গেছে বেচারা!
বলে আরো অনেকক্ষন ধরে স্বাধীন হাসতে থাকল ৷ হাসি থামালেও হাসির রেষ এখনও রয়ে গেছে ওর চোখে মুখে ৷ কিছু একটা ভেবে ও ভ্রু কুঁচকে বলল,,,
আর একটা কথা ৷ আমার সব রুমাল কি আপনারা বাবা মেয়ে হাইজ্যাক করার পায়তারা করেছেন নাকি? একদিন আপনি , আজ আপনার বাবা নিয়ে গেল ৷ ভাবছি আরেকটা কিনে আন্টিকে দিয়ে আসব , তারপর আরেকদিন গিয়ে আপনার দাদীকে একটা দিয়ে দিব ৷ তাহলেই ষোলকলা পূর্ণ হবে আমার!
°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°
আয়েশা পাঁচতলা বিল্ডিংয়ের চারতলার ৩২৫ নম্বর ফ্লাটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে ৷ দুই বার কলিংবেল বাজাতেই একটা ১০ বছরের ছেলে বাচ্চা ছুটতে ছুটতে এসে দরজা খুলে দিল ৷ আয়েশা বীরের মাথার চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বলল,,,
কি অবস্থা? এখনও দু*ষ্টুমি করো?
বীর দাঁত বের করে বলল,,,, এখন এক্সপার্ট হয়ে গেছি ৷ দেখতে চাও?
আয়েশা ব্যস্ত হয়ে বলল,,, এতো উপকার করতে হবে না ৷ আমি অবিবাহিত অবস্থায় ম*রতে চাই না ৷
বীরের মা বর্ষা এসে আয়েশাকে বলল,,, আরে ওখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন? ভিতরে আসো ৷
বর্ষাকে যতবার দেখে ততবারই আয়েশা মুগ্ধ হয়ে যায় ৷ কেউ দেখে বলবেই না যে উনি এক বাচ্চার মা ৷ আর সবচেয়ে বড় কথা কার মুখের সাথে যেন হুবহু মিল খুঁজে পায় ও ৷ কিন্তু কে সেটা এখনও জানে না আয়েশা ৷ নিজের মুগ্ধতা কাটিয়ে আয়েশা বর্ষাকে সালাম দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করল ৷
আয়েশা ড্রয়িংরুমের একটা বড় চেয়ার টেবিলের কাছে গিয়ে বসে পড়ল ৷ বীর নিজের রুম থেকে ব্যাগ বই নিয়ে এসে আয়েশার সামনে বসে পড়ল ৷ আয়েশা পড়ানো শুরু করতে চাইলেই বীর আশেপাশে মায়ের অবস্থান আছে কি না লক্ষ্য করে আয়েশার দিকে তাকিয়ে বলল,,,,
হেই সুন্দরী সারাক্ষণ পড়া নিয়ে থাকলে হবে? আজ না আমার প্রথম দিন আজ একটু আলাপ চারিতা করি ৷
আয়েশার চোখ বড় বড় হয়ে গেল ৷ এতো ছোট ছেলে অথচ ওর কথাবার্তার কাছে প্রাপ্তবয়স্করাও যেন ফেল! নিজের হতভম্ভ ভাব কাটিয়ে উঠে আয়েশা চোখ পাকিয়ে বলল,,,
বেশি পাকনা হয়েছো তাই না? এখনি বর্ষা আপুকে বলে তোমার হাড় হাড্ডি ভাঙানোর ব্যবস্থা করছি দাঁড়াও ৷
বীর ব্যস্ত হয়ে বলতে লাগল,,, এই না না ৷ আমি বের করছি তো ৷ তুমি অল্পতেই বেশি বুঝে ফেলো সুন্দরী!
এই ছেলে আমাকে আন্টি বা খালামনি বলে ডাকবে যেহেতু ম্যাম ডাক আমার পছন্দ না ৷ সুন্দরী কি হুহহ?
বারে সুন্দরীকে কি ডা*য়নি বলে ডাকব?
সে তো জানি না কিন্তু আমি আমার ভাইয়ের সাথে প্রতিদিন এক্সারসাইজ করি আর রাইমা খালামনির থেকে ক্যারাটেও শিখেছি বুঝলে? তা তোমাকে ডেমো দেখাব নাকি?
বীর ব্যাগ থেকে বই বের করে সম্পূর্ণ মনোযোগী হয়ে বলল,,, খালামনি এখানে এই গল্পটা কোন বিষয়ে লেখা হয়েছে?
আয়েশা ঠোঁট টিপে হেসে ওকে পড়ানোয় মনোযোগ দিল ৷ শুরুতেই বীর যা একটু আগ্রহ দেখিয়েছিল কিন্তু তারপর থেকে নানাভাবে দু*ষ্টুমি করতেছে ৷ ওকে কোনোভাবেই পড়া মাথায় ঢুকাতে পারছে না আয়েশা ৷ বীরের দুষ্টু*মিতে আয়েশার মাথার রগ দপদপ করতেছে ৷ ও সেন্টি মার্কা মুখ বানিয়ে হতাশ শ্বাস ফেলে বীরের দিকে তাকিয়ে আছে ৷ এমন সময় কলিংবেল বেজে উঠতেই আচমকা বীর ভদ্র হয়ে গেল ৷
বীরের এহেন পরিবর্তনে আয়েশা ভ্রু কুঁচকে বলল,,, কি ব্যাপার? পৃথিবী কি ঘুরে গেল নাকি? এতো ভদ্র হলে কিভাবে?
বীর বইয়ের দিকে চোখ রেখে বলতে লাগল,,, মামু এসেছে ৷ মামু এসেছে ৷ দুষ্টু*মি করো না , মামু এক আ*ছাড় মা*রবে তোমাকে!
সেটা তুমি ভাবো বাছা ৷ আমার মতো ভদ্র মানুষ কোথাও খুঁজে পাবে না ৷
আয়েশা মনে মনে বেশ খুশি হলো ৷ বীরের মামুর সাথে ভাব জমিয়ে বীরকে আয়ত্তে আনার কৌশল শিখতে হবে তাহলেই বীরের মুখটা কঙ্কালের মতো গোস্তহীন করা যাবে ৷ কিন্তু বীরের মামুকে দেখে আয়েশার মুখটাই যে কঙ্কালের মতো গোস্তহীন হয়ে যাবে তা কে জানতো?
আয়েশার হৃৎপিন্ড ভয়ে জমাট হয়ে গেল ৷ নিঃশ্বাস নিতে ভুলে গেল ও ৷ বারিশ থ্রি কোয়াটারের চেয়ে একটু মানে সামান্য একটু বড় প্যান্ট আর টি শার্ট পড়ে উশকোখুশকো চুলে হাই তুলতে তুলতে ড্রয়িংরুমের সোফায় এসে ধপ করে বসে পড়ল ৷ বীরদের দিকে না দেখেই ও হাই তুলতে তুলতে বলল,,,
তোমার পছন্দের সেই মহান ম্যাডাম এসে গেছে?
বীর অত্যন্ত ভদ্র গলায় বলল,,, জ্বি মামু ৷
বারিশ নিজের এলোমেলো চুলগুলোতে হাত বুলিয়ে আবারও হাই তুলে বীরের দিকে তাকাল ৷ সেখানে চোয়াল ঝুলে পড়া মুখের রসগোল্লার মতো বড় করে রাখা চোখের মালিক আয়েশাকে দেখতেই বারিশের হাই তোলা সম্পুর্ণ না হয়ে অর্ধেক অবস্থাতেই আটকে গেল ৷
মেঝের উপর ভূ*মিকম্প তুলে বারিশ সা*ইক্লোনের বেগে ওদের সামনে থেকে দৌঁড়ে পালাল ৷ পালানোর সময় একবার উস্টা খেয়েও পড়েছে বটে ৷ আয়েশার হতভম্ভ ভাব সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছে গেল ৷ ও বীরকে উদ্দেশ্য করে বলল,,,
বাছা আমি পাঁচমিনিটের জন্য একটু বাথরুমে গেলাম হাসার জন্য ৷ এখানে হাসা ঠিক হবে না মনে হচ্ছে ৷ শুধু পাঁচ টা মিনিট হেসে ফিরে আসব ঠিক আছে? গেলাম আমি , আটকানো যাচ্ছে না ৷
চলবে,,,,