#রঙিন_দূত – ১৫,১৬,১৭
লাবিবা ওয়াহিদ
১৫
——————————-
হৃধি কী মনে করে পিছে ফিরে তাকালো। মালিশা সাথে সাথে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিলো। হৃধির কিছুটা সংকচবোধ হতেই সে সামনে ফিরে হাঁটতে লাগলো। হৃধির অস্বস্তিতে গা কাঁপুনি দিয়ে উঠছে। সে একদমই আশা করেনি মাহিন এভাবে ঢোল পিটাবে। হৃধির তো তৎক্ষণাৎ ইচ্ছে করছিলো মাটি ফাঁক করে ঢুকে যেতে। মাহিনের এরূপ উক্তিতে মাহিনের বন্ধুগণ হেসে দিলেও মালিশার চেহারা দেখার মতো ছিলো। এমন উক্তিতে মালিশা সঙ্গে সঙ্গেই হৃধির হাত ছেড়ে দিয়েছিলো। হৃধি ক্ষণিক স্বস্তি পেলেও মালিশার এমন গিলে ফেলা চাহনিতে তার হাত রীতিমতো ঠান্ডা হয়ে গেছিলো। কী অ’স’ভ্য এই ছেলে! সামান্য লাজ-লজ্জা এর মধ্যে এক চুল পরিমাণ নেই।
স-শব্দে ত্বোহার পাশের চেয়ারে বসে পরলো হৃধি। আপাতত নানান ভাবনায় মত্ত। ত্বোহা কান থেকে হেডফোন খুলে হৃধির অবস্থা বোঝার চেষ্টা করলো। হৃধিকে ঠিক লাগছে না বুঝতেই ত্বোহার আলতো করে হৃধির কাঁধে হাত দিলো। ম্লান কন্ঠে বললো,
–“কী হয়েছে হৃধি?”
–“মাহিন এতো ঠোঁটকাটা কেন?”
ত্বোহা অপ্রস্তুত হলো। হৃধি তখনো আনমনা। ত্বোহা ভ্রু কিঞ্চিৎ কুচকে সন্দিহান কন্ঠে আওড়ায়,
–“কী করেছে মাহিন ভাই? রোমান্টিক কিছু বলেছে নাকি?”
হৃধি তড়িৎ ত্বোহার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো। ত্বোহার অধরে দুষ্টুমির হাসি! ত্বোহার কাঁধে এক চা’প’ড় মেরে রাগমিশ্রিত কন্ঠে আওড়ালো,
–“বে’য়া’দ’ব! স্টুপিড মার্কা কথা বলবি না!”
–“তাহলে কী হয়েছে বলবি তো!”
হৃধি বেশ সময় নিয়ে একে একে খুলে বললো ত্বোহাকে। ত্বোহা ঘটনা উপলব্ধি করতেই অট্টহাসিতে ফেটে পরলো। হৃধির বিরক্তিতে কপালে ভাঁজ পরলো। আজব! কৌতুক শুনিয়েছে নাকি? ত্বোহা হাসি সংবরণ করার চেষ্টা করে বলে,
–“মাহিন ভাই, জিও! মেয়েটাকে আচ্ছা নাকানি-চুবানি খাইয়েছে। এত সখ কেন আমার বান্ধুবীর প্রোপার্টিতে নজর দেয়ার?”
–“মাহিন কোনো জমিন না ত্বোহা!”
–“মানুষ তো!”
————
ভার্সিটি থেকে বের হতেই হৃধি এক রিকশাওয়ালাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো। হৃধি ভাবলো অন্যকারো জন্যে, তাই সে পাশে দাঁড়িয়ে রিকশা খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পরলো। মিনিট খানেকের মধ্যেই হৃধির ফোন বেজে ওঠে। ব্যাগ থেকে ফোন বের করতেই মাহিনের নাম্বার ভেসে উঠলো। মাহিনের নাম্বার সেভ করা নেই, তবে লাস্টের দুই ডিজিট দেখতেই হৃধির চিনতে অসুবিধা হয় না। মাহিন হৃধির নিকট এতই পরিচিত ব্যক্তি যে মাহিনের সব কিছুর সাথেই সে ভালোভাবে পরিচিত। হৃধি আশেপাশে তাকিয়ে কল রিসিভ করলো,
–“রিকশায় উঠে বসুন হৃধি। আপনার জন্যেই নির্ধারিত ছিলো!”
হৃধি আশেপাশে তাকালো।
–“কোথায় আপনি?”
–“কেন? আমার সাথে শহর ভ্রমণ করবেন নাকি?”
মাহিনের দুষ্টু কন্ঠস্বর। মুহূর্তে-ই হৃধির গাল জোড়া গরম হয়ে যায়। নিজেকে সামলে মিনমিন করে বলে,
–“আপনাকে ঘুরতে যাওয়ার কথা একদমই বলিনি। উল্টো মিন করেন কেন?”
–“কী জানি! আপনার সাথে এ-ধরণের কথা আওড়াতে আমার বেশ লাগে!”
হৃধি খট করে কল কেটে দিলো। মাহিনের কিছু কথার উত্তরে বলার মতোন খুঁজে পায় না সে। তাইতো হৃধি মাহিনের মুখের ওপর কল কেটে নিজেকে উদ্ধার করে। বাড়ি ফিরে রিকশার ভাড়া মিটিয়ে হৃধি গেট খুলে ভেতরে ঢুকে পরে। সিঁড়ি বেয়ে ওঠার মুহূর্তেই শাফীনের সাথে দেখা হয়ে যায়। শাফীন তো মুচকি হেসেবলে ওঠে,
–“গুড আফটারনুন ভা… সরি আপু!”
–“গুড আফটারনুন শাফীন। যাচ্ছো কোথাও?”
–“হ্যাঁ, ক্লাস করে ফিরলাম, এখন কাচা বাজারে যাচ্ছি!”
–“ওহ আচ্ছা!”
–“আসি ভাব.. সরি আপু। দেরী হলে আম্মু বকবে!”
হৃধি সন্দিহান দৃষ্টি নিক্ষেপ করে শাফীনের দিকে। কিছু একটা বলতে গিয়ে আবার সরি বলছে কেন? অদ্ভুত! হৃধি নিজের কৌতুহল বহিঃপ্রকাশ না করে হাসি মুখে শাফীনকে বিদায় জানালো। মুহূর্তে-ই হৃধির মনে পরলো মাহিনের মায়ের কথা। মাহিনের মা না প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষিকা? তাহলে উনি কীভাবে বকবে? পরমুহূর্তে-ই হৃধির খেয়ালে এলো প্রাইমারি স্কুল বারোটা, সাড়ে বারোটায় ছুটি হয়ে যায়। এখন তো বাজছে বারোটা আটচল্লিশ। হৃধি নিজের কপালে এক চ’ড় মেরে নিজ ফ্ল্যাটের কলিংবেল চাপলো।
কেটে যায় আরও দু’দিন। হৃধি কোচিং থেকে ফেরার মুহূর্তে-ই পরিচিত মুখের সম্মুখীন হয়। হৃধি হাস্যোজ্জ্বল মুখশ্রী করে বলে,
–“রক্তিম ভাইয়া, তুমি?”
রক্তিম প্রথমে অবাক হলেও পরমুহূর্তে অধর প্রসস্থ করলো। বিনয়ী স্বরে বলে,
–“আরে হৃধি যে? কোচিং থেকে ফিরলে নাকি?”
–“হ্যাঁ, ভাইয়া! তুমি এখানে যে?”
–“কাজে এসেছিলাম। চলো, তোমায় পৌঁছে দেই!”
হৃধি বিপরীতে কিছু বলার পূর্বেই তাদের মাঝে হাড্ডি হয়ে দাঁড়ায় মাহিন। মাহিন বেশ আন্তরিকতার সাথে বলে ওঠে,
–“আপনার সাথে গেলে আমি কেন আছি হৃধির জন্যে?”
হৃধি চমকালো এবং একইভাবে ভড়কালো। ঘাড় বাঁকিয়ে মাহিনের দিকে তাকাতেই অজানা আতঙ্কে গা ছমছমে হয়ে ওঠে হৃধির। এই ছেলে হুটহাট কোথা থেকে চলে আসে? কিয়ৎক্ষণ পূর্বেই তো ফাঁকা রাস্তা দেখেছিলো হৃধি। মুখশ্রীতে কেমন হিংস্রভাব ফুটে উঠেছে।
রক্তিম কিছুটা চমকে পাশে ফিরলো এবং ভ্রু কিঞ্চিৎ কুচকে বলে,
–“সরি, কী বললেন?”
–“এক কথা আমি দ্বিতীয়বার রিপিট করি না!”
রক্তিম এবার হৃধির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো। হৃধির চোখে-মুখে ভীতি ভাব ফুটে ওঠেছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামও জমেছে। হৃধি ঢোক গিলে কিছু বলার প্রস্তুতি নিতেই রক্তিম পুণরায় মাহিনের উদ্দেশ্যে বলে ওঠে,
–“হৃধি আমার কাজিন হয়। আমি তাকে বাড়ি পৌঁছে দেয়ার অধিকার রাখি। তুমি ওর বিষয়ে নাক গলানোর কে?”
–“প্রশ্নটা তো আমিও আপনাকে করতে পারি। কাজিন হয়ে এতো অধিকার খাটাতে কে বলেছে আপনাকে? নিজ দূরত্ব বজায় রেখে চলবেন!”
মাহিন হৃধির হাত ধরলে হৃধি হাত ছাড়িয়ে রক্তিমের উদ্দেশ্যে কিছু বলতে নিলে মাহিন এক ধমকে তাকে থামিয়ে দিলো।
–“হোয়াট!! আপনি আমার সাথে ফিরবেন ব্যাস! অতীতের ঘটনা কী ভুলে গেছেন নাকি মনে করিয়ে দিবো?”
মাহিনের এমন ধমকে হৃধির মুখ ঘুচে গেলো। এভাবে ধমকায় কেন লোকটা? যা ইচ্ছে হবে তাই করবে নাকি? এদিকে মাহিনের ব্যবহারে হৃধি লজ্জায় কাবু। কমনসেন্স নেই নাকি? রক্তিম তার মামাতো ভাই হয়। রক্তিম যদি একবার মামার কানে লাগায় তাহলে হৃধির বাসাতেও এই খবর পৌঁছে যাবে। মুহূর্তে-ই হৃধির মুখশ্রীর রঙ পাল্টে আতঙ্ক ভর করলো। মাহিন কোনো দিকে দৃষ্টি না দিয়েই হৃধির হাত ধরে টেনে রক্তিমের সামনে থেকে নিয়ে যায়। হৃধি চলতে চলতে মাহিনের বলিষ্ঠ হাত হতে নিজ হাত মুক্ত করার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে আওড়ায়,
–“ছাড়ুন মাহিন! আপনি কিন্তু বেশি বাড়াবাড়ি করছেন! রক্তিম আমার ভাই হয়! তার সামনে এসবের মানে কী?”
হৃধির উক্তিতে মাহিন থেমে যায়। হৃধির হাত ছেড়ে মাহিন পিছে ঘুরে দাঁড়ায়। চোখ-মুখে রাগি ভাব এনে বলে,
–“আপন ভাই তো না!”
–“কাজিন ভাই তো?”
–“আপন ভাই ছাড়া সকল ভাই মেয়াদ উত্তীর্ণ এবং ঠুনকো। এরা প্রেমে পরবে না গ্যারান্টি কী?”
–“সকলকে নিজের মতোন ভাববেন না!”
–“সকলে আপনার মতো সাধুও না, এটা মাথায় রাখবেন!”
নাহ, এই ছেলের নে কথায় পারা অসম্ভব। হৃধি চোখ গরম করে তাকালেও মাহিন নিঁখুতভাবে তা এড়িয়ে গেলো। হৃধি মাহিনের পাশ কেটে চলে গেলে মাহিনও তার পিছু নেয়!
–“আরে, আরে যাচ্ছেন কোথায়? আস্তে হাঁটুন, কিছুর সাথে পা আটকে পরবেন তো!”
–“পরলে পরলাম আপনার কী? দূরে থাকুন আমার থেকে! আমি যা অচ্ছা তাই করবো!”
–“করুন সেটা ভালো কথা, তবে ভুলভাল কিছু করেই দেখুন না। এই মাহিন আপনাকে কঠিন শাস্তি দিবে!”
হৃধি মাহিনকে তোয়াক্কা না করে বাস স্ট্যান্ডে এসে দাঁড়ায়। বাস থামতেই হৃধি বাসে নজর বুলালো। বাসটা লোকাল। ভীড়ও কম নয়। কিছু মানুষ নামছে। তাই ভীড়টা এখন মোটামুটি কম। হৃধি মাহিনের দিকে চোখ বুলাতেই দেখলো মাহিন তার দিকেই আসছে। হৃধি মাহিনের উপর একপ্রকার রাগ দেখিয়েই বাসে উঠলো। মাহিন “হৃধি” বলে হাঁক ছেড়ে ছুটে বাসে উঠলো। হৃধি মাঝামাঝিতে যেতেই এক সিট ছেড়ে লোকটা নেমে গেলো। হৃধি সুযোগ বুঝে সেই সিটে বসতে নিলেই মাহিন হৃধির কনুই চেপে বসার পূর্বেই পুণরায় দাঁড় করিয়ে দিলো। হৃধি চোখ রাঙালে মাহিন দ্বিগুণ তেজে চোখ রাঙায়। মাহিন খালি সিটের পাশে চোখ বুলিয়ে দেখে একটা ছেলে সেখানে বসে আছে। হৃধিকে এই ছেলের পাশে বসতে দিবে? এটা বিলাসিতা ব্যতীত কিছুই না। মাহিন মিনমিন করে বলে,
–“সাহস তো কম না আপনি অন্য ছেলের পাশে বসেন চেষ্টা করেন!”
–“বাসে ছেলে-মেয়ে কেউ দেখে নাকি? আমি সিট পেয়েছি আমি বসবোই!”
–“কেউ না দেখলেও আমি দেখি। আমি বেঁচে থাকতে আপনাকে কখনোই কোনো ছেলের সাথে বসতে দিবো না!”
–“সিনেমার ডায়লগ বাস্তবে খাটে না। হাত ছাঁড়ুন!”
মাহিন তৎক্ষনাৎ পাশের লোকটির উদ্দেশ্যে বললো,
–“অদ্ভুত তো মশাই আপনি! দু’জন মহিলা দাঁড়িয়ে আছে আর আপনি পায়ের উপর পা তুলে বসে আছেন? সামান্য সামাজিকতা নেই?”
মাহিনের এরূপ বক্তব্যে ছেলেটা থতমত খেয়ে যায়। মাহিনের দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে একবার হৃধির দিকে তো আরেকবার কিছুটা দূরে অবস্থান করা মহিলার দিকে তাকালো। হৃধি নিজেও হতভম্ব মাহিনের কথায়। এই ছেলে এতো পরিকল্পনা করে কোথা থেকে? হৃধি ছেলেটির দিকে চোখ বুলাতেই বুঝলো ভদ্র ঘরের ছেলে সে। নয়তো মাহিনের কথায় দুই এক কথা শুনানোর বদলে চুপ মেরে কেন? ছেলেটা আশেপাশে তাকালো। সবাই কেমন করে তার দিকে তাকিয়ে। লজ্জাবোধ করলো ছেলেটি। হাসার চেষ্টা করে উঠে দাঁড়ায় এবং মহিলাটির উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,
–“আপনি আমার সিটে বসতে পারেন!”
মহিলাটি স্মিত হেসে ছেলেটির সিটে বসলো। মহিলা বসতেই মাহিন তড়িৎ হৃধির হাত ছেড়ে দেয়। হৃধি মাহিনের পানে বোকা চাহনি নিক্ষেপ করে বসে পরলো। গাড়ি ঝাকুনি দিয়ে উঠতেই মাহিন হৃধির মাথা নিজের পেটের সাথে চেপে ধরে। হৃধির মুহূর্তে-ই যেন শ্বাস বন্ধ হয়ে এলো। সর্বাঙ্গ শিথিল হয়ে আসে হৃধির। মাহিনের থেকে নিজেকে কিঞ্চিৎ ছাড়াতে নিলে মাহিন আরও শক্ত করে চেপে ধরে। মিনমিন করে আওড়ায়!
–“নড়াচড়া করবেন না হৃধি, এভাবেই থাকুন। গাড়ির ঝাকুনিতে ব্যথা পাওয়ার চান্স কম থাকবে।”
~চলবে, ইনশাল্লাহ।
#রঙিন_দূত – ১৬
লাবিবা ওয়াহিদ
——————————-
হিম হাওয়ায় নিমজ্জিত অপরাহ্ন। উত্তরের শীতল হাওয়া ছুঁয়ে যাচ্ছে অবলীলায়। হুটহাট বৃষ্টি যেন আরও কাঁপিয়ে তুলে সকলকে। হৃধি ছাদে দাঁড়িয়ে ফোন দেখছে৷ কয়েকবার রক্তিমকে ফোন দিবে বলেও দিতে পারছে না নানান দ্বিধায়। রক্তিমকে কল দিলেই বা কী? মাহিনের বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে কী উত্তর দিবে সে? মাহিন তার কী হয়? আদৌ কী মাহিনের সাথে তার কোনো সম্পর্ক আছে? এই পরিচিতিকে কী আদৌ কোনো সম্পর্কের নাম দেয়া যায়? হৃধি তপ্তশ্বাস ফেলে। বেশি সময় নেয়া ঠিক হবে না ভাবতেই চট করে রক্তিমকে কল দেয় হৃধি। তিন-চার বার রিং হতেই রক্তিম কল রিসিভ করলো। রক্তিমের কন্ঠস্বর বেশ থমথমে শোনালো।
–“হ্যাঁ, রক্তিম ভাইয়া?”
–“বল!”
–“আসলে… আজকে যা হয়েছে তার জন্যে আমি খুবই দু..দুঃখিত। তুমি প্লিজ মামাকে বা আমার বাবাকে কিছু বলিও না!”
–“আচ্ছা, বলবো না। কিন্তু ছেলেটা কে ছিলো হৃধি? আমি ওই ছেলের ব্যবহারে সত্যি-ই অবাক ছিলাম। তুই কী রিলেশনে জড়িয়েছিস?”
হৃধির গলা শুকিয়ে আসলো। কী বলছে রক্তিম? হৃধি আমতা আমতা করে আওড়ায়,
–“এরকম কিছু না ভাইয়া। আ..”
হৃধি কিছু বলার পূর্বেই তার কান থেকে কেউ ফোনটা কেড়ে নিলো। হৃধি চমকে পিছে ফিরে তাকায়। মাহিন হৃধির ফোনের দিকে তাকিয়ে। হৃধির হৃদপিন্ড যেন বেরিয়ে আসার উপক্রম। ফোনের স্ক্রিনে রক্তিমের নাম দেখে মাহিনের আঁখিপল্লব কেমন লাল হয়ে গেলো৷ মাহিন চোখ গরম করে হৃধির দিকে তাকাতেই হৃধি কয়েকটা শুকনো ঢোক গিললো। মাহিন কোনো ভাবনা ছাড়াই কলটা খট করে কেটে দেয়। হৃধির ফোন নিজের পকেটে পুরে হৃধির দিকে দু ধাপ এগিয়ে বলে,
–“তার জন্যে এতো দরদ উতলে পরছে কেন যে একাকী ছাদে দাঁড়িয়ে ওই ছেলের সাথে কথা বলছেন?”
হৃধি ভয়ে দুই ধাপ পিছিয়ে যায়। আটকে আটকে গলায় বললো,
–“আমি যার সাথে ইচ্ছা কথা বলবো, আর আপনি যা কান্ড ঘটিয়েছেন সেটা আমার পরিবার জানলে কী অবস্থা হবে ভাবতে পারছেন? নাকি আপনার ভাবার মতোন মস্তিষ্কটাই নেই!”
মাহিনের কুচকানো ভ্রু-যুগল কিছুটা নরম হয়ে এলো। পা থামিয়ে কী একটা ভেবে মাহিন উত্তর দেয়,
–“কী করবো বলুন তো, মস্তিষ্কে যে আপনি বিচরণ করছেন! আপনি থাকলে আমি আবার দুনিয়া-দারী ভুলে যাই!”
মুখ বাঁকায় হৃধি। মাহিন চট করে হৃধির খুব কাছে এসে দাঁড়ায়। হৃধির আতঙ্কে রেলিঙয়ের সাথে পিঠ ঠেকে যায়। হৃধি মিনমিন করে আওড়ালো,
–“দূ..দূরে যান! কেউ চলে আসলে কী ভাববে?”
বলেই কাঁপা হাতে মাহিনকে ঠেলতে লাগলো। মাহিন হৃধির দিকে অপলক চেয়ে রয়। হৃধির কথা বা ধাক্কানো কিছুই তার মস্তিষ্কে ঢুকছে না। হুট করে হৃধির গাল টেনে স্মিত হেসে বলে,
–“আপনার গাল দু’টো দিন কে দিন গুলুগুলু হয়ে যাচ্ছে হৃধি। ইচ্ছে করে সারাদিন টেনে লাল করে দেই! আপনার এই সৌন্দর্যের কারণ কী হৃধি? কেন এই সৌন্দর্য আমি মাহিনকে এতোটা আসক্তিতে ফেললো? আপনার নেশা যে মাদকতার চেয়েও ভয়ংকর করে তুলেছে।”
হৃধির সর্বাঙ্গ কাঁপুনি দিয়ে উঠলো মাহিনের মাদকমিশ্রিত কন্ঠস্বরে। হৃধি বুঝলো না মাদকতা মাহিনের বুলিতে নাকি হৃধির সৌন্দর্যে? হৃধি তো সুন্দর নয়! হৃধি গাল জোড়া গরম করে মাহিনকে জোরে থাক্কা দিতেই মাহিন দূরে সরে যায়। মাহিন এতে বিরক্তিও প্রকাশ করলো।
–“ছাদের দরজায় শাফীনকে দাঁড় করিয়ে এসেছি আমি! এতো ভয় কিসের আপনার?”
—————
হৃধি তখন থেকে নিজের ফোন খুঁজেই চলেছে। কিন্তু ফোনটার দেখা সে পাচ্ছেই না। রুমের এক কোণাও সে বাদ রাখেনি। শেষমেষ বালিশের তলা খুঁজেও পেলো না। হতাশায় তপ্তশ্বাস ফেলতেই কলিংবেলের শব্দ শোনা যায়। হৃধি উম্মুক্ত দরজার দিকে তাকাতেই দেখলো রাবেয়া খাতুন রান্নাঘর থেকে ছুটে যাচ্ছেন সদর দরজার দিকে। দরজা খুলেই রাবেয়া খাতুনের মিষ্টি কন্ঠস্বর শোনা যায়। রাবেয়া খাতুন কী বলছেন সেটা অস্পষ্ট শোনা গেলো। পরবর্তীতে পুরুষালি কন্ঠস্বর শুনতেই হৃধি চট করে মাথায় ওড়না জড়িয়ে পা টিপে টিপে রুম থেকে বের হয়। সদর দরজার দিকে উঁকি দিতেই হৃধির আঁখিযুগল বড়ো বড়ো হয়ে গেলো। স্বয়ং মাহিন দাঁড়িয়ে তাদের দরজার সামনে। কী মিষ্টি করে কথা বলছেন রাবেয়া খাতুন। মাহিনের মুখেও সৌজন্যমূলক হাসি। এদের হাসি-তামাশার মানে বুঝলো না হৃধি। এর মানে মাহিন তার মাকে পটিয়ে ফেললো? রাবেয়া খাতুনের প্রশ্নে হৃধির ঘোর ভাঙলো।
–“আরে বাবা, বাহিরে দাঁড়িয়ে কেন? ভেতরে আসো!”
–“না আন্টি। অন্য একদিন আসবো। আজ একটু কাজে এসেছিলাম!”
–“কী কাজ বাবা?”
–“আসলে.. হৃধির সাথে কাজ ছিলো! ওকে কী একটু ডেকে দেয়া যাবে?”
রাবেয়া খাতুন চমকালেন মাহিনের উক্তিতে। রাবেয়া খাতুনের সাথে হৃধিও সমানতালে চমকালো। ভয়ে তার কপালে ঘামেদের আনাগোনা দেখা গেলো। হৃধি শুকনো ঢোক গিলতেই রাবেয়া খাতুন অধরে কৃত্রিম হাসি ঝুলিয়ে হৃধিকে ডাকলেন এবং বললেন,
–“হৃধি মা, মাহিন তোর সাথে দেখা করতে চায়!”
হৃধি ওড়নার অংশ দিয়ে কপালে জমা বিন্দু বিন্দু ঘাম মুছে নিলো। অতঃপর হৃধি এগিয়ে এলো দরজার পানে। হৃধির হৃদপিন্ডটা কেমন ধুক ধুক শব্দ করেই চলেছে। বিকালে মাহিনের যেই রূপ দেখেছে তাতে হৃধি লজ্জায় পারে না মাটি ফাঁক করে ভেতরে ঢুকে যেতে। এখন তো না গিয়েও উপায় নেই, ব’দ’মা’ই’শ’টা যে তার দ্বারেই দাঁড়িয়ে। হৃধি আল্লাহ’র নাম জোপ করতে করতে দরজার সামনে মায়ের পাশে এসে দাঁড়ালো। মাহিন হৃধিকে দেখতেই চমৎকার হাসি দিলো এবং হৃধির দিকে হৃধির ফোনটা বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
–“আপনার ফোনটা আমি ছাদে পেয়েছি! হয়তো ভুলবশত ফেলে এসেছেন। আপনার ফোনের ওয়ালপেপার দেখেই আপনাকে চিনলাম!”
হৃধি মাহিনের দিকে তাকালেই মাহিন রাবেয়া খাতুনের অগোচরে চোখ টিপ দেয়। হৃধির গাল পুণরায় গরম হয়ে যায়। রাবেয়া খাতুন যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। পরমুহূর্তে চোখ রাঙায় হৃধির দিকে তাকিয়ে।
–“সামান্য আক্কেল, জ্ঞান নেই? কেউ নিজের ফোন ছাদে ফেলে আসে? মাহিন ব্যতীত অন্য কেউ ফোনটা পেলে কী তোকে ফিরিয়ে দিতো? ভাগ্যিস ছেলেটা পেয়েছে। মাহিনের থেকে ফোন নে, আমি রান্নাঘরে যাচ্ছি!”
হৃধিকে কিছু বলার এক বিন্দু সুযোগ না দিয়ে রাবেয়া খাতুন প্রস্থান করলেন। হৃধি বোকার মতোন মায়ের চলে যাওয়া দেখলো। সম্বিৎ ফিরতেই কিছুটা লজ্জা অনুভব করলো। রাবেয়া খাতুন তাকে মাহিনের সামনেই ঝাড়লেন? পরমুহূর্তে মাহিনের দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকাতেই মাহিন বক্ষঃস্থলের বা পাশে হাত রেখে নাটকীয় ভঙ্গিতে বললো,
–“আহ, হৃধি! এভাবে তাকাতে মানা করেছিলাম না, তীরের মতো এইখানে লাগে যে!”
বা পাশে ইশারা করে!
–“নাটক কম করেন। আপনার জন্যে আমি মায়ের কাছে এতগুলো বকা খেলাম। এতো মিথ্যাবাদী কেন আপনি?”
মাহিন একবার হৃধির ফ্ল্যাটের ভেতরটা চেক করে সিঁড়ির দিকটা চেক করে নিলো। অতঃপর হৃধির দিকে কিছুটা ঝুঁকে বলে,
–“প্রেমিক হওয়ার ক্ষেত্রে মিথ্যাবাদী হওয়া অপরাধ নয়!”
হৃধি মাহিনের হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিয়ে রাগী কন্ঠেই আওড়ায়,
–“হয়েছে, আপনি এখন আসতে পারেন!”
মাহিন দাঁত কপাটি বের করে নিঃশব্দে হাসলো। হেসে পুণরায় মিনমিন স্বরে বললো,
–“আপনার ফোনের ওয়ালপেপারের শাড়ি পরিহিত আপনিকে দেখে আমি নতুনভাবে প্রেমে পরেছি হৃধি। কবে সৌভাগ্য হবে বলুনতো, বাস্তবে শাড়ি পরিহিত আপনিকে দেখার?”
~চলবে, ইনশাল্লাহ।
#রঙিন_দূত – ১৭
লাবিবা ওয়াহিদ
———————————–
ডিসেম্বর মানেই চারপাশে বিয়ের আমেজ। হৃধিদের ছাদেও বিয়ের প্যান্ডেল করা হচ্ছে। হৃধি অবশ্য জানতো না যে ছাদেই হলুদের প্রোগ্রাম করা হবে। তাইতো ছাদে এসে কিছুটা অপ্রস্তুত হয় সে। বেশ কিছু যুবক ছাদের বেশ কিছুটা জায়গা দখল করে আড্ডায় মত্ত। হৃধি তাদের দৃষ্টিতে পরার পূর্বেই কোনো এক বলিষ্ঠ হাত তাকে টেনে নিয়ে যায় ছাদের গাছগাছালির অংশতে। এখানটায় অনুষ্ঠানের কারো আসা নিষিদ্ধ। হৃধি চমকে সামনে তাকাতেই মাহিনকে দেখতে পেলো। হৃধি ভ্রু কুচকে সর্বপ্রথম নিজের মাথার ওড়না ঠিক করলো। ওড়না ঠিক করার পরপর মাহিনের দিকে তাকাতেই উপলব্ধি করলো মাহিনের অদ্ভুত দৃষ্টি। হৃধি ফোঁস করে এক নিঃশ্বাস ফেলে বলে,
–“আপনি কী সবসময় আমায় চোখে চোখে রাখেন নাকি?”
–“হিরের খেয়াল কে না রাখে?”
–“মোটেও আমি হিরে নই। আমি একজন সাধারণ নারী!”
মাহিন অধর বাঁকিয়ে হাসলো। অতঃপর হৃধি পিচ্ছিল ওড়না মাথা থেকে পরে যাবার পূর্বেই টেনে দিলো। যত্ন সহকারে হৃধির মাথায় ওড়না জড়িয়ে শীতল কন্ঠে বলে,
–“আপনি যে কতোটা অসাধারণ, তা জানলে নিজেই নিজেকে সিন্দুকে লুকিয়ে রাখতেন। হৃধি নামক মেয়েটি যে তার অমূল্য চাহনিতে আমায় কতটা পোড়ায় সেটা আল্লাহ্ ব্যতীত কেউ জানে না!”
হৃধি চমকালো, সমানতালে মুগ্ধও হলো। মাহিন ছেলেটার কথার জ্বালে নিজেকে বারবার জড়িয়ে ফেলে সে। কী মধুময় তার একেকটি বাক্য। এই ছেলের মারাত্মক ব্যক্তিত্ব আছে বলেই তো এতো সুন্দর করে একজন নারীকে উপস্থাপন করতে পারছে সে। নারীকে অমূল্য সেই যুবক-ই ভাবতে পারে, যেই যুবক একজন নারীর মূল্য দিতে জানে। মাহিন প্রতিবার তাকে কোনো না কোনো বিপদ থেকে বাঁচিয়েছে। তাও কিসের সন্দেহ এই ছেলের অনুভূতিতে? কিসের সন্দেহ ওই আঁখিপল্লবে, যেই আঁখিপল্লব হৃধিকে সম্মান করে এসেছে! আর রইলো ঠোঁটকাটা বাক্যগুলো। ওসব যে হৃধিকে লজ্জাতে ফেলতে বলে সেটা হৃধির বুঝতে বাকি নেই। হৃধি এদিক সেদিক তাকিয়ে নিজের ঘোর ভাঙলো। অতঃপর মিইয়ে যাওয়া গলায় বলে,
–“ডেকোরেশন কিসের জন্যে হচ্ছে?”
–“চার তলার কোন মেয়ের নাকি বিয়ে, সেই মেয়ের হলুদের অনুষ্ঠান আজ। আচ্ছা আপনি কী ইনভাইটেড?”
শেষোক্ত প্রশ্নটি মাহিন ভ্রু কুচকে করলো। হৃধি বুঝলো কার বিয়ের কথা বলছে। ওটা তো চার তলার রাইসা আপুর বিয়ে। সেদিন তার বাসায় রাইসার মা ইনভাইট করে গেছিলো। তবে হৃধি জানে না হলুদেও ইনভাইটেড কি না! হৃধি পুণরায় চাপা স্বরে বলে,
–“বিয়েতে ইনভাইটেড, হলুদে আছি কিনা জানি না!”
–“তাহলে এখন বাসায় যান, বেশি সাজবেন না। শাড়ি তো একদমই পরবেন না!”
হৃধি ভ্রু কুচকে তাকালো মাহিনের পানে।
–“আপনি এতটা শিওর কীভাবে হলুদে আমাদের দাওয়াত আছে?”
–“সিক্সথ সেন্স বললো। আমি যা বলেছি তা করবেন। নয়তো আপনার শাড়িতে আমি আগুন লাগিয়ে দিবো আর আপনার সজ্জিত মুখমন্ডলে পানি ঢেলে দিবো। এখন চয়েজ আপনার।”
হৃধি মুখ বাঁকালো। ভেঙচি কেটে আওড়ায়,
–“সেদিন তো খুব বলেছিলেন আমায় শাড়ি পরিহিত দেখবেন, হ্যান করবেন ত্যান করবেন! আজ হঠাৎ গিরগিটি চেয়েও দ্রুত রঙ বদলালেন কেন?”
–“আপনাকে শাড়ি পরিহিত শুধু আমি দেখবো। অন্য’রা দেখার কে? আগে আপনাকে পুরোপুরি পটাতে সক্ষম হই, তারপর নাহয় বউ করে শাড়ির আবদার মেটাবো। নাও, আই উইল কান্ট্রোল মাইসেল্ফ!”
হৃধির কী হলো জানে না। হঠাৎ তার সমস্ত তনু শিউরে ওঠে। হৃধি গাল গরম করে মাহিনের পানে তাকাতেই মাহিন চোখ টিপ মেরে বাঁকা হেসে বলে,
–“আপনি কী জানেন হৃধি? আপনি আমার বোকারাণীর পাশাপাশি লাল রঙা লজ্জাবতী! যাকে দেখে আমার হৃদয়ের গোধূলি আকাশও হিংসে করে?”
—————————-
আটটায় হৃধি রেডি হয়ে লিভিংরুমে বসে আছে। বসে একপ্রকার পা নাচাচ্ছে সে। দু’দিনের জন্যে করিম উল্লাহ চাকরির কাজে শহরের বাহিরে গেছে। যাওয়ার পূর্বে রিনাকে আদেশ করে গেছে রিনা যেন দু’দিন এ বাড়িতেই থাকে। রিনাও বিনা-বাক্যে রাজি হয়ে যায়, বস্তীতে সে আর ফিরে না। হৃধিকে চোখ পাকিয়ে দেখে রিনা বলে উঠলো,
–“এ কী আপা? শাড়ি পরলেন না ক্যা?”
তখনই শাড়ির কুচি ঠিক করতে করতে রাবেয়া খাতুন ভেতরের রুম থেকে বেরিয়ে এলেন। মেয়ের দিকে কোণা দৃষ্টি দিয়ে ম্লান স্বরে বলে,
–“শাড়ি সামলাতে পারে না আমার মেয়ে। পরেনি ভালোই করেছে!”
হৃধির পা নাচানি বন্ধ হয়ে গেলো। হৃধি বেশ বুঝতে পারছে শাড়ি না পরাতে তার মা অসন্তুষ্ট। তবে হৃধিরও উপায়ন্তর নেই৷ হৃধি বড্ড লাজুক। শুধু মেয়েরা থাকলে সে নির্দ্বিধায় শাড়ি পরতে পারতো। কিন্তু এতগুলো ছেলেকে দেখে তার শাড়ির আকাঙ্খা মরে গেছে। আর যাই হোক, এতো ছেলের মাঝে সে কিছুতেই শাড়ি পরবে না। শাড়ি বেঠিক হলে হৃধি লজ্জায় আর দু’দিন এ মুখো হবে না। তাই রিস্ক নেয়ার চাইতে লং চুড়িদার-ই বেশি প্রশান্তিময় মনে করলো। তার এই ড্রেস চয়েজে মাহিনও কম ভয় দেখায়নি তাকে। মাহিন বারবার ভাঙা রেডিও’র মতো এক কথাই আওড়িয়েছে,
–“শাড়ি পরবেন না, অনেক অনেক ছেলেরা থাকবে!”
ব্যাস, হৃধি হেরে যায়। হৃধি এক তপ্তশ্বাস ফেলে রাবেয়ার উদ্দেশ্যে বললো,
–“এখন কী তুমি যাবে? অদ্ভুত, আমার রেডি হতে সময় লাগলো আর তোমার যতো সময় অপচয়। সবসময় তো আমার সাথে চেঁচাও, আজ তোমার ভিমরতি হয়েছে নাকি?”
রাবেয়া খাতুন রেগে পাশের টেবিল থেকে ঝাটা-টা নিলো। অতঃপর সেটা হৃধিকে দেখিয়ে হিঁসহিঁসিয়ে বলে,
–“বুড়ি বয়সে ঝাটার মা’ইর খেতে না চাইলে থাম। তোর মতো সারাদিন আজাইরা বসে থাকি না আমি। রিনার সাথে ছাদে তুই আগে যা, আমি পাশের বাসার ভাবীর সাথে একসাথে যাবো!”
–“আহ কতো দরদ!”
মিনমিন করে হৃধি আওড়ে রিনার দিকে তাকালো। রিনা তো পারছে না হৃধিকে ফেলেই ছাদের দিকে দৌড় লাগাতে। রিনা এক গাল হেসে ইতিবাচক মাথা নাড়ায়। রাবেয়া এদিকে আর মাথা না ঘামিয়ে ডাইনিং টেবিলের দিকে চলে যায়। হৃধি কোনো কথা ছাড়াই রিনার সাথে ছাদের উদ্দেশ্যে চলে যায়। সিঁড়ি বেয়ে ওঠার সময় হৃধি কিছু ছেলের মুখোমুখি হলে বারংবার মাথায় ভালো করে ওড়না দিচ্ছিলো সে। রিনা এমন ভাবে তাকে টানছে যে ভুলবশত যার তার সাথে হৃধি ধাক্কা খাচ্ছে। এ বিষয়টা একসময় হৃধিকে বিরক্তি ধরিয়ে দিয়েছিলো তাই সে একপ্রকার ধমকে রিনার থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নেয়। রিনা ধমক খেয়ে প্রথমে চুল থাকলেও গানের শব্দ পেয়ে হৃধিকে ফেলেই সে একপ্রকার দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেলো। আর হৃধি মাথার ওড়না ঠিক করতে করতে মিনমিন করে আওড়ায়,
–“মা যে কোন পিচ্চির কাছে আমার দায়িত্ব দিয়েছে, তা যদি বুঝতো!”
হৃধি ছাদে উঠতেই তার মাথা খুলি হতে খুলে আসার উপক্রম৷ এতো জোরে গান বাজাচ্ছে যে হৃধির মাথা ধরে গেলো। হৃধিও ভুলবশত বড় দুই স্পিকারের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। কানে দুই হাত চেপে দ্রুত সেই স্থান ত্যাগ করলো হৃধি। অপরদিকে আসতেই দেখতে পেলো স্টেজে রাইসাকে কয়েকজন ধরে ওঠাচ্ছে, আর সেটা দেখেই ছেলেরা চেঁচিয়ে “নববঁধু” সহ নানান নামে রাইসাকে ডাকছে এবং টিপ্পনী কাটছে। এতো ছেলে দেখে হৃধির অস্বস্তি বেড়ে যায়। হৃধি আশেপাশে তাকিয়ে রিনাকে খুঁজতে লাগলো। কিন্তু মেয়েটা যে কই হাওয়া হয়ে গেলো কিছু-ই বুঝতে পারছে না হৃধি। একাকীত্বে হৃধির ভয়টাও ধীরে ধীরে বাড়ছে। হৃধির অস্থির চোখ জোড়া চেনা মুখ খুঁজতে ব্যস্ত। কোনো একজন পরিচিত থাকলে তার সাথে দাঁড়ালে হয়তো এই অস্বস্তি ভাব কমতো। চেনা ছাদে এখন অচেনাদের ভীড় বেড়েছে। হৃধি কিছু না ভেবে কোলাহলমুক্ত জায়গায় রেলিঙ ঘেষে দাঁড়ালো। অনুষ্ঠানে এতো মানুষের গিজগিজ তাকে চরম বিরক্ত এবং অস্বস্তিকর করে তুলেছে।
এর মাঝে হৃধি পাশে কারো অস্তিত্ব টের পেলো। পাশে তাকাতেই হৃধি যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। মুখে সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে বলে,
–“আরে শাফীন?”
–“ভাইয়া বলেছে আপনার খেয়াল রাখতে তাই আপনার খেদমতে হাজির ভা.. সরি আপু!”
হৃধি শব্দ করে হাসতে গিয়েও হাসতে পারলো না। এবার বুঝেছে শাফীনের কথা আটকানোর মানে। আসলে মুড এবং মস্তিষ্ক সচল থাকলে সব কথাই সে উপলব্ধি করতে পারে। হৃধি কিছু না বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। মন হতে মাহিনকে ধন্যবাদ দিতেও ভুলে না। হুট করে হৃধির মনে এক প্রশ্ন উঁকি দিলো। মাহিন কোথায়? সে নিজে না এসে শাফীনকে কেন পাঠালো? এত ভেবেও মস্তিষ্ক তার সঠিক উত্তরটি দিতে অক্ষম। এবার হৃধি চোখ বুলালো অদূরে মানুষে গিজগিজ করা অনুষ্ঠানে। চোখজোড়াতে কিছুতেই মাহিন ধরা দিচ্ছে না। হৃধির এই খুঁজাখুঁজি শাফীন ধরতে পারলো। শাফীন স্মিত হেসে বলে,
–“তাকে খুঁজে লাভ নেই ভা.. সরি আপু। মাহিন ভাইকে রাইসা আপুর আত্নীয়’রা ভালো মতোন ধরেছে।”
হৃধি ভ্রু কুচকে শাফীনের দিকে তাকালো। কোণা চোখে অনুষ্ঠানে নজর বুলিয়ে আওড়ায়,
–“মানে?”
–“আর বলো না। রাইসা আপু প্রায়-ই নাকি রাস্তা-ঘাটে ভাইয়াকে দেখতো। ভাইয়াকে পছন্দও করেছিলো। পরে রাইসা আপুর ফ্যামিলিতে জানা-জানি হলে আপুকে জোর করে বিয়ে দিচ্ছে। নিজের বিয়েতে পছন্দের মানুষ-সহ পুরো পরিবার এসেছে। অবাক বিষয় না? আর রাইসা আপু মনে হচ্ছে ঢোল পিটিয়ে আমার ভাইয়ের কথা সবাইকে বলেছিলো, তাইতো ভাইকে পেয়ে কেউ আর ছাড়ছেই না। মন ভরে দেখছে আর উল্টো তাদের মেয়েদের জন্যে সমন্ধ পাঠাচ্ছে!”
শাফীন সবটা বলে শেষ করতেই অট্টহাসিতে ফেটে পরলো। হৃধি যেন চেয়েও হাসতে পারছে না। বক্ষঃস্থল কেমন আঁধারে ছেয়ে আছে। চিনচিন ব্যথাও অনুভূতি হচ্ছে তার। এক মাহিনকে ঘিরে কতোজন পাগল আর এই মাহিন-ই তার পিছে ঘুরে? মাহিন চাইলেও তো কতজনের মাঝে নিজের জীবনসঙ্গিনী খুঁজে নিতে পারে, সেই মাহিন কেন-ই বা একজন সাধারণ নারীর প্রতি দুর্বলতা প্রকাশ করে? আচ্ছা বাস্তবতা কী এমনই? আমাকে দুনিয়ার সবাই চাইলেও আমি যাকে চাই সে আমায় চায় না? অপরাধবোধ এবং ধোয়াঁশাময় ভবিষ্যৎ হৃধিকে কিয়ৎক্ষণের জন্যে বোবা যন্ত্র হতে বাধ্য করলো। তার জন্যে উত্তম পথ কোনটি? কোন পথকে সে বেছে নিবে?
এর মাঝেই হৃধি মাহিনকে দেখতে পেলো। বলা বাহুল্য, হুট করেই হৃধির দৃষ্টিতে মাহিন পরে যায়। মাহিনকে দেখে হৃধির দৃষ্টি মাহিনতেই নিবদ্ধ হয়। গভীর চাহনিতে মাহিনকে পর্যবেক্ষণ করলো সে। পাঞ্জাবি পরিহিত মাহিনকে দেখে হৃধি পূর্বের ন্যায় এবারও যেন মেঝেতে মুখ থুবড়ে পরলো। বেগুনি পাঞ্জাবিতে কী দারুণ সুদর্শনই না লাগছে মাহিনকে। হৃধি চেয়ে রইলো অবিশ্রান্ত! হৃধির দিকে মাহিনের দৃষ্টি পরলে মুহূর্তে-ই দুটি স্নিগ্ধ চোখজোড়ার দৃষ্টি আদান-প্রদান ঘটে।
~চলবে, ইনশাল্লাহ।