রঙিন_দূত – ২৮,২৯,৩০

0
408

#রঙিন_দূত – ২৮,২৯,৩০
লাবিবা ওয়াহিদ
২৮
———————–
কোলাহলবিহীন মধ্য রজনী। হৃধি পা টিপে টিপে দরজার দিকে যাচ্ছে। উদ্দেশ্য ছাদ। ঘুমন্ত বাবা-মা যাতে কোনো ভাবে না জাগে তার জন্য হৃধির বেশ সাবধানতা অবলম্বন করতে হচ্ছে। সদর দরজার সামনে আসতেই হৃধি নিজের মাথায় ওড়নাটা ভালো ভাবে দিয়ে নিলো। অতঃপর খুব ধীরে দরজা খুলে বেরিয়ে গেলো। ছাদে আসতেই ছাদের এক কোণে মাহিনকে দেখা গেলো। আবছা আলোয় শুধু অবয়ব-ই দৃশ্যমান হলো। মাহিনের মতো লম্বা, দেহের গঠন দেখে হৃধির তাকে চিনতে বেশি বেগ পোহাতে হলো না। হৃধি নিঃশব্দে মাহিনের দিকে এগিয়ে গেলো। মাহিন তখনো ঠাঁয় দাঁড়িয়ে। নিশ্চুপ! পরিবেশ যেন ভয়ংকর রকম নিস্তেজ। যেন তারা কোনো ঝড়ের পূর্বাভাস দিচ্ছে। হৃধি মিনমিন করে মাহিনকে ডাকলো! মাহিন ফিরে তাকালো। আবছা আলোয় মাহিনের ফ্যাকাসে মুখটা দেখ হৃধি আঁতকে উঠলো। মাহিনের মেসেজ পেয়েই মূলত সে এসেছে। এসে যে মাহিনের এরূপ অবস্থা দেখবে সে কখনো কল্পনাও করেনি। হৃধি গোল গোল চোখে মাহিনের দিকে সেভাবেই তাকিয়ে রয়। দৃষ্টি তার স্থির, স্তব্ধ। কয়েকবার ঢোঁকও গিললো সে৷ কিছু বলার জন্য প্রস্তুতি নিতেই দ্রুত গতিতে মাহিন হৃধির কাছে চলে আসলো। তার চেয়েও দ্রুত হৃধিকে নিজ বক্ষে ঝাপটে ধরলো। মুহূর্তে-ই যেন হৃধি বাক্যহারা, হতবুদ্ধিও হারিয়ে ফেলে। সব কিছু এতটাই দ্রুত ঘটলো যে সবটাই হৃধির মাথার উপর দিয়ে গেলো। হৃধির বর্তমানে কী করণীয় সেটাও সে ভুলে যায়। মস্তিষ্কশূণ্য হয়ে সেভাবেই ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রয়। মাহিন হৃধিকে আরও আঁকড়ে ধরলো।
হৃধির সম্বিৎ ফিরতেই হৃধি নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু মাহিন আজ তাকে ছাড়তে বড্ড নারাজ। একসময় হৃধি শান্ত হয়ে পরলো। শান্ত হলেও তার অস্বস্তির মাত্রা ক্রমাগত বাড়ছেই। হৃধির কোমড়ে রাখা মাহিনের শীতল হাতটি তাকে প্রচন্ডরকম কাঁপিয়ে তুলছে। তবে এর মাঝে অনুভব করলো মাহিনের তীব্র গতিতে ছুটা হৃদপিন্ডের ধুকপুকানি। এছাড়াও হৃধি উপলব্ধি করলো এই বক্ষে ঠাই পেলে সে আজীবন এখানেই কাটিয়ে দিতে পারবে। এ কী জাদুকর অনুভূতি! কী আছে মাহিনের এই বক্ষঃস্থলে? এতটা শান্তিপূর্ণ কেন? নিরবতা চললো বহু সময়। এর মাঝে মাহিন নিরবতা ভাঙলো। মাহিন বেশ কাতর কন্ঠে আওড়ায়,
–“হৃধি! আমি সিঙ্গার হতে চাই। মন থেকে চাই। মনের গভীর থেকে চাই!”

মাহিনের হঠাৎ এতো উত্তেজনাময় কন্ঠস্বর শনে হৃধি চমকে উঠলো। তার বুঝতে বাকি নেই, কিছু একটা হয়েছে। অবশ্যই হয়েছে। তবে সেটা কী, তা জিজ্ঞেস করার পূর্বে মাহিনকে শান্ত করা জরুরি। হৃধি মাহিনকে সামলাতে তার কম্পিত হাতটি আলতো করে মাহিনের পিঠে রাখলো৷ অতঃপর ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে নির্বিঘ্নে আওড়ায়,
–“আপনি শান্ত হন মাহিন। কী হয়েছে? বলুন আমায়!”

মাহিন হৃধিকে ছেড়ে দাঁড়ায়। অতঃপর মুখটা নুইয়ে মিনমিন স্বরে বললো,
–“আমার এই প্রফেশন বাবা একদম মানছে না হৃধি। তিনি চান আমি যেন তার ব্যবসা, তার মল সামলাই৷ বাট আমি এসব পারবো না। আমি গানের আলাদা এক জগতে বাঁচতে চাই। এসব নাহয় শাফীন করবে। কিন্তু বাবা এ নিয়ে..”

মাহিন থামলো। সে চাচ্ছে না পারিবারিক বিষয় সম্পূর্ণ হৃধির সামনে খুলে বলতে৷ পরবর্তীতে সংক্ষিপ্ত করে বললো,
–“মোট কথা, বাবা একদম চাচ্ছে না আমি এই প্যাশন বেছে নিই। এটা নাকি ছেলেখেলা বৈ কিছু নয়। আমি কী করবো বুঝতে পারছি না। প্লিজ হৃধি আমার শান্তির প্রয়োজন। আমি আপনাকে যতবার দেখি ততবার-ই নিজের গানের সখকে মনে পরে। আপনি আমার স্বপ্ন, ইচ্ছে সবকিছুকে কেন্দ্র করে। আপনি কী হবেন আমার সাফল্যের কারণ? আপনি কী হবেন আমার উজ্জ্বল সূর্যের আলো? এই দূত? পুণরায় করবেন আমায় রঙিন?”

———————–
এক সপ্তাহ কেটে যায়। হৃধি আপনমনে চেয়ে আছে মাস্টার্স ভবনের দিকে। এখন হৃধি ত্বোহার সাথেই তার প্রিয় জায়গাটাতে বসে আছে। সেই রাতের পর মাহিনকে হৃধি দেখেনি। ইনফেক্ট কোচিং এও মাহিন তাকে নিতে আসে না। কোথায় গেছে, কী করছে কোনো খোঁজ-ই সে পাচ্ছে না। লজ্জার মাথা খেয়ে সেদিন শাফীনকে জিজ্ঞেস করেছিলো। শাফীন বিশেষ কিছু বলতে পারেনি। মাহিনকে দেখতে না পেয়ে তার বুকটা কেমন খাঁ খাঁ করছে৷ প্রতিটা মুহূর্তে তার মনে হয়, মাহিনকে তার প্রয়োজন। ভিষণ প্রয়োজন! একবারের জন্যে হলেও মাহিনকে সে দেখতে চায়। কিন্তু বান্দা আপনি কোথায়? সে নিজেই যে নিখোঁজ। মাহিনের কোনো খোঁজ খবর না পেলেও মাহিন প্রতিদিন রাত্রে একটি মেসেজ দেয়।
–“শুভ রাত্রি হৃধি। আপনাকে ভিষণ মিস করছি!”

পরবর্তীতে হৃধি যখন জিজ্ঞেস করে, “আপনি কোথায়?” তখন মাহিন আর রিপ্লাই করে না। হয়তো মেসেজটি দিয়েই ঘুমের দেশে পাড়ি জমায়। হৃধি একবারের জন্যেও মাহিনকে কল করার সাহস পায়নি। এর মাঝে ত্বোহা তাকে নাড়িয়ে তুললো। হৃধির সম্বিৎ ফিরলে ঘাড় বাঁকিয়ে ত্বোহার দিকে তাকায়। ত্বোহা হৃধির বিষণ্ণ মুখটার দিকে তাকিয়ে হৃধির উদ্দেশ্যে বললো,
–“ভালোবাসিস, মাহিন ভাইকে?”

হৃধি বরাবরের মতোই নির্বিকার। উত্তর দেয়ার মতো অবস্থা তার নেই। হয়তো জানে না এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর। তবে ভেতরটা কালো মেঘে ভার হয়ে আছে। কখন যেন তুমুলভাবে কাল বৈশাখের ঝড় নামবে বক্ষঃস্থলে।

~চলবে, ইনশাল্লাহ।

#রঙিন_দূত – ২৯
লাবিবা ওয়াহিদ

—————————-
হৃধি গাল, নাক ফুলিয়ে থম মেরে বসে আছে। তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে শাফীন এবং ত্বোহা। ত্বোহার হাতে একটি বড় ব্যাগ। যেটাতে হৃধির বসন্তের অলংকার এবং শাড়ি আছে। এবং এসব মাহিন-ই পাঠিয়েছে৷ ত্বোহাও কোথা থেকে আজই উদয় হলো হৃধি জানে না। মাহিনের প্রতি হৃধির ভিষণ অভিমান। সে ভুল করেও সেসব গ্রহণ করবে না। এতদিন খোঁজ খবর না নিয়ে নিখোঁজ ছিলো অথচ আজ এই পহেলা ফাগুনে এসেছে নাটক করতে। খবর যেহেতু নিবেই না তাহলে এসব আদিখ্যেতার দরকার কী? হৃধি নাক ফুলিয়ে বেশ তেঁজি স্বরে বললো,
–“অন্যের দেয়া জিনিস আমি কিছুতেই নিবো না!”
–“দু’দিন পর যে তোর জামাই হবে তার জিনিস নিতে এতো দ্বিধা? ঢং কম কর।”
–“জামাই? মাথা খারাপ তোর? উনি কোন খবরটা নিয়েছে আমার? মাহিনের করা কর্মগুলো ঢং না? শুধু আমি-ই দোষী, ঢং করি?”

শাফীনের মুখটা যেন ছোট হয়ে এলো। শাফীন মিনুতির স্বরে আওড়ায়,
–“প্লিজ, ভাবী। এগুলো গ্রহণ করুন। ভাইয়া টিউশনি করিয়ে এসব কিনেছে। এমনও নয় যে বাবা অথবা মায়ের থেকে টাকা নিয়েছে। আজ ভাই আসবে। এটুকু কী যথেষ্ট নয় খুশি হওয়ার মতো?”

হৃধি নিশ্চুপ রইলো। শাফীন পুণরায় বলে ওঠে,
–“এখন প্লিজ রাগ দেখাবেন না ভাবী। এগুলো চুপ করে পরে বেরিয়ে আসেন। ভাইয়ের সাথে দেখা হলে যতো রাগ ঝাড়ার তার উপর-ই ঝাড়িয়েন। আমরা তো আপনাদের মধ্যে তৃতীয় পক্ষ!”

ত্বোহা বেশ সন্তুষ্ট হলো শাফীনের বচনে। মানতে হবে, ছেলেটা কথা গুছিয়ে বলতে পারে। সে নিজেও শাফীনের সাথে একমত। তাই ত্বোহাও শাফীনের সাথে সুর তুলে বললো,
–“হ্যাঁ শাফীন ঠিক বলেছে। দ্রুত রেডি হয়ে নে তো!”

বলেই জোর করে হৃধির হাতে প্যাকেটটা ধরিয়ে দিয়ে দু’জন বেরিয়ে গেলো। হৃধি নির্বাক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রইলো প্যাকেটটির দিকে। বেশ সময় নিয়ে হৃধি প্যাকেটটি খুললো। কেন যেন গলায় কান্না’রা দলা পাকিয়ে আসছে। হৃধি নিজেকে শক্ত করার চেষ্টা করে প্যাকেটের ভেতর থেকে সব একে একে বের করলো। একটি কাতান শাড়ি। হলুদ এর মাঝে কালো সুতোয় কাজ করা। তিন ডজন চুড়ি, চুলের গাঁজড়া, শাড়ির সাথে ম্যাচিং করে কান এবং গলার অলংকার। কাজল এবং কিছু চকলেটও আছে। সবকিছু হাত দিয়ে আলতো করে ছুঁয়ে যাচ্ছে হৃধি। চোখে অশ্রুরা টলমল করছে। ঝাপসা দৃষ্টিতে তৃপ্তি নিয়ে সবটা দেখছে হৃধি। কেন টিউশনির টাকা এভাবে জলে ফেললো ছেলেটা? আর কতো ঋনি করে তুলবে সে? প্যাকেট পুণরায় খুলতেই ভেতরে দেখলো একটা লাল রঙের চিরকুট পরে আছে। হৃধি অশ্রুসিক্ত চাহনিতে সেটি হাতে তুলে নিলো।
–“আপনার বসন্ত পছন্দ হৃধি, আমি আপনায় বসন্ত কোকিল হিসেবে দেখতে চাই। দেখুন, নিজ আয় এ আপনার জন্য এগুলো কিনেছি। খুশি তো আপনি?”

টুপ করে লাল চিরকুটটার উপরে এক ফোটা জল পরলো। হৃধি নিজেকে আর সামলে রাখতে পারলো না। বক্ষে লাল চিরকুটটি জড়িয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। কেন এতো পোড়াচ্ছে মাহিন? কেন সে মাহিনের জন্যে, তাকে একপলক দেখার জন্যে এভাবে পুড়ছে? কেন তার অবাধ্য মন তার মস্তিষ্কের কথা শুনলো না? কেন মস্তিষ্ক হৃদয়ের চরণে লুটিয়ে পরলো? হৃধি অনেকক্ষণ কাঁদলো। আছরের আযানের ধ্বনি কানে আসতেই হৃধি কান্না থামিয়ে ফেললো। নাক টেনে চিরকুটটার দিকে পুণরায় দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো। ভেঁজা গাল হাতের উল্টোপিঠে মুছে চিরকুটটা খুব যত্নে রেখে দিলো। অতঃপর দ্রুত ওয়াশরুমে ছুটলো চোখে-মুখে পানি দিতে। ফ্রেশ হয়ে এসে চুপচাপ রেডি হতে শুরু করলো। শাড়ি পরার অভ্যেস তার আছে। ইউটিউব দেখে শিখেছিলো। শাড়ি পরে হৃধি আয়নার সামনে দাঁড়ালো। অলংকার পরে এক হাতে হলুদ চুড়িগুলো পরলো। মাথার মাঝে সিঁথি করে সিল্কি চুলগুলো ছেড়ে দিলো। হৃধির চুলগুলো অবশ্য আহামরি বড় নয়। চোখে এক পট্টি কাজল দিলো। অধরে হালকা গোলাপি লিপজেল ছুঁয়ে নিজেকে আয়নায় দেখলো। নির্বাক হয়ে তাকিয়ে রয় আয়নায় থাকার নিজের প্রতিচ্ছবির দিকে।

এর মাঝে রাবেয়া খাতুন রুমে প্রবেশ করলেন। মেয়েকে ত্বোহার সাথে যাওয়ার তাড়া দিতেই মূলত। রাবেয়া খাতুন হৃধিকে দেখে সেখানেই ‘থ’ মেরে দাঁড়িয়ে রইলো। এ যেন কোনো নতুন সজ্জিত হৃধিকে দেখছেন সে। রাবেয়া খাতুনের পিছেই ত্বোহা এসেছে। হৃধিকে দেখে ত্বোহার মুখ হা হয়ে যায়, আঁখিপল্লবও হয় বড়ো বড়ো। রাবেয়া খাতুন নির্বাক হয়ে মেয়ের দিকে এগোতে লাগলেন। হৃধি কারো উপস্থিতি টের পেতেই দরজার দিকে তাকালো। মাকে দেখে হৃধি সটান হয়ে দাঁড়ালো। চোখ-মুখে অদ্ভুত জড়তা, আশংকা। রাবেয়া খাতুন নিষ্পলক মেয়েকে দেখলেন। অতঃপর হৃধির থুতনি ছুঁয়ে আপনমনে আওড়ায়,
–“মাহশাল্লাহ! আমার মেয়েটাকে কতো অপরূপ লাগছে। কারো নজর না লাগুক। এই কাজল কোথায় রে?”

বলেই ড্রেসিংটেবিলে কাজল খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পরলেন। কাজলটা চোখে পরতেই তড়িৎ সেটা হাত তুলে মেয়ের কানের পিছে কাজলের টিপ এঁকে দেন! আবেগে মেয়ের কপালে চুমু খেলেন। হৃধিও আবেশে চোখ বুজে ফেলে।
–“সাবধানে যাবি। ত্বোহা এবং তুই একসাথে থাকবি। বুঝলি?”
–“কিন্তু মা..”
–“বাবার কথা ভাবিস না। যা গিয়ে মজা কর।”

হৃধি ম্লান হাসলো। দরজার দিকে চোখ যেতেই ত্বোহাকে দেখতে পেলো। সে এখনো হৃধির দিকেই হা করে তাকিয়ে।

———————–
–“বইন, তোর ফোলা গাল, চোখে কতটা স্নিগ্ধ লাগছে রে। তার উপর এমন সুন্দর করে সেঁজেছিস! আজ আমি হলফ করে বলতে পারি মাহিন ভাইয়ার মাথা ঘুরে যাবে!”
–“চুপ কর তো। আজেবাজে বকবি না একদম। আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস সেটা আগে বল!”
–“কোথায় আবার, তোমার হবু সোয়ামীর♥️ কাছে!”

বলেই ত্বোহা মুখ টিপে হেসে চোখ টিপ দিলো। ত্বোহা নটি মাইন্ডেড চাহনি হৃধির বুঝতে বাকি নেই। হৃধি গলা খাঁকারি দিয়ে অন্যদিকে ফিরে গেলো। আর কোনো প্রশ্ন করার চেষ্টা করলো না। চুপচাপ অনুভব করছে হৃদপিন্ডের তীব্র ধুকধুকানি। অনুভব করছে মাহিনকে দেখার জন্যে ব্যাকুলতা। কে জানতো এই নিষিদ্ধ মানুষটার প্রতি রক্তজবার ন্যায় নুইয়ে পরবে?

জনমানব পূর্ণ জায়গাটি। লেকের পাশে একটি ছোট পার্ক। লেকটি অসম্ভব সুন্দর। লেকের চারপাশে বড়ো বড়ো গাছ-গাছালিতে ভর্তি। লেকের বেশ কিছুটা দূর পরপর বসার জায়গা করে দেয়া হয়েছে। আজ পহেলা ফাগুন এবং ভালোবাসা দিবস। এজন্য জায়গাটি আজ মানুষে গিজগিজ করছে। বেশিরভাগ-ই চারপাশে দেখা যাচ্ছে কপোত-কপোতী। আজ ফেরিওয়ালা’রাও বসেছে বেশ ভালো রকম-ই। ফুচকা, বাদাম চুড়ি, ফুলের ফেরিওয়ালা তারা। তাদের কাছে রয়েছে বস্তাভর্তি সুখ। সেই সুখের খোঁজে কপোতী’রা তাদের প্রিয় মানবদের সাথে ছুটে যাচ্ছে এক মুঠো সুখ কিনতে।

হৃধি এতো মানুষের মাঝে মাহিনকে কোথাও দেখলো না। ত্বোহাটাও যে কখন হাত ছেড়ে হারালো হৃধি টেরও পেলো না। এখন এই ভীড়ে একা হৃধির ভিষণ ভয় করছে। এমনিতেই এই সাজে এসেছে। কোনো অঘটন না ঘটলেই হয়। হঠাৎ ভীড়ের মাঝে হাতে টান অনুভব করলো। কে টানলো এবং কীভাবে কী হলো সেটা বুঝে ওঠার পূর্বেই হৃধিকে নিয়ে ভীড়ের মাঝেই চললো আগন্তুকটি। হৃধিও যেন পুতুলের মতো সামনের আগন্তুকটির পায়ের সাথে পা মিলিয়ে চলছে। পা গুলো যেন সামনের আগন্তুকটির গোলাম হয়ে গেছে।

–“উফ, হৃধি। আপনার দিক থেকে যে চোখ ফেরানোই দায় হয়ে পরেছে। আপনি কী আমার দৃষ্টিতেই সুন্দর নাকি দিনদিন আরও সুন্দর হয়ে যাচ্ছেন?”

হৃধি চমকে মাহিনের দিকে তাকালো। এই কন্ঠস্বরের মালিক তার সম্মুখে দাঁড়িয়ে? হৃধি পলকহীন তাকিয়ে রয় সেই স্নিগ্ধ মুখশ্রীর নিকট। বুকটা অদ্ভুত ভাবে হালকা হতে শুরু করেছে। যেন কতো জনম সেখানে বড় পাথর দখল করে বসেছিলো। হৃধির মুখে কোনো উত্তর নেই। সে যে চাতক পাখির ন্যায় ছটফট করছে।মাহিন হৃধির সেই কাজল কৃষ্ণ চোখদু’টোর দিকে অনিমেষ তাকিয়ে রয়। মাহিন হুট করে হৃধিকে নিজের সঙ্গে জড়িয়ে ধরলো। হৃধির আবেশে চোখ বুজে এলো। কয়েক মিনিট সেভাবে থেকে হৃধি নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। অতঃপর দৃষ্টি নুইয়ে মিনমিন স্বরে বললো,
–“এতদিন কোথায় ছিলেন আপনি?”
–“সাফল্যের সন্ধান পেয়েছি হৃধি। আপাতত সেদিকেই ছুটছি। ভালো ক্যারিয়ার না হলে আপনার বাবার কাছে আপনাকে চাইবো কী করে বলুন তো? কোন বাবা চাইবে তার আদরের মেয়েকে বেকার ছেলেকে তুলে দিতে? এছাড়া…!”

মাহিন হঠাৎ থেমে যাওয়ায় হৃধি মাথা তুলে মাহিনের দিকে তাকালো। মাহি৷ নিষ্পলক হৃধির মুখশ্রীতে চোখ বুলিয়ে আওড়ায়,
–“আপনায় নিজের করতে বড্ড ব্যাকুল আমি হৃধি। আর পারছি না, আপনি ব্যতীত জীবনের বাকি পথটা চলতে।”

মাহিনের কাতরে ভরা কন্ঠস্বর হৃধির জন্যে অতলস্পর্শী ছিলো। হৃধি পুণরায় মাথা নুইয়ে ফেললো। মাহিন হেসে প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে হৃধির ডান হাতটা নিজ হাতের মুঠোয় নিলো।
–“এই হাতটা খালি কেন হৃধি?”

হৃধি ডান হাতের দিকে তাকালো। তাড়াহুড়োয় বাম হাতে চুড়ি পরে ডান হাতে পরতে-ই ভুলে গেছে। হৃধি সেটা মুখে বলতে পারলো না, তবে মাহিন যেন বুঝে নিলো। মাহিন মুচকি হেসে বললো,
–“আসুন আমার সাথে।”

বলেই হৃধির হাত ধরে তাকে ভীড়ের মাঝে আগলে রেখে চললো ফেরিওয়ালার নিকট। ফুল এবং চুড়ির ফেরিওয়ালা পাশাপাশি বসেছে। মাহিন তাদের সামনেই হৃধিকে নিয়ে আসলো। মাহিন ঘাড় বাঁকিয়ে হৃধির দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে আওড়ায়,
–“এক প্যাকেট চুড়ি লাগবে নাকি গাঁজরা?”

হৃধি কী বলবে বুঝে উঠতে পারলো না। গলায় যে কথাগুলো মাকড়শার জ্বালে আটকেছে। হৃধির গাল দুটোও যেন ভার হয়ে আসলো। হৃধি দৃষ্টি নামিয়ে অনেক কষ্টে বললো,
–“জানি না!”

মাহিন শুনলো না হৃধির কন্ঠস্বর। সে নিজে দুটো থেকে পছন্দ করে হাতের গাঁজরা কিনলো। অতঃপর গাঁজরাটি নিয়ে হৃধির সম্মুখে দাঁড়ালো। হৃধির শাড়িতে খামচে ধরা হাতটা টেনে নিয়ে গাঁজরাটি নিজ দায়িত্বে পরিয়ে দিলো। তার চেয়েও ভয়ংকর কান্ড ঘটালো মাহিন। হৃধির হাতের উল্টোপিঠে চুম্বন করেছে। এতে হৃধির রন্ধ্রে রন্ধ্রে শিহরণ ছড়িয়ে পরলো। হাঁটুজোড়াও অসম্ভব রকম কম্পিত হলো। হাতটি যেন অসাড় হয়ে পরলো এই শীতল স্পর্শে। হৃধির মুখশ্রীতে একরাশ লাজ উপলব্ধি করতেই মাহিন প্রাণখুলে হাসলো। একসময় হাসি থামিয়ে নেশাক্ত কন্ঠে আওড়ালো,
–“আপনার এই বাসন্তী কোকিল সাজে ফোলা ফোলা মুখশ্রী আমায় ভিষণ ঘায়েল করেছে হৃধি। আমার তো আপনাকে ছাড়তে ইচ্ছে করছে না। চলুন না, বিয়েটা করে ফেলি?”

~চলবে, ইনশাল্লাহ।

#রঙিন_দূত – ৩০
লাবিবা ওয়াহিদ

————————
হৃধি নিশ্চুপ হয়ে রেজাল্ট হাতে বসে আছে। রেজাল্ট ভালো হলেও মুখশ্রীতে খুশির ঝলক নেই। করিম উল্লাহ মেয়ের রেজাল্ট শুনে ছুটে গিয়েছে মিষ্টির দোকানে। রাবেয়া খাতুনও খুশিতে গদগদ হয়ে তার আত্নীয়দের হৃধির রেজাল্ট জানাচ্ছে। হৃধি দ্বিতীয় হয়ে দ্বিতীয় বর্ষে উত্তীর্ণ হয়েছে। সকলে আজ খুশি থাকলেও হৃধির মুখে হাসি নেই। ফ্যাকাসে মুখটায় আগের মতো যত্ন নেই, চোখের নিচে কালো দাগ। আজ কতগুলো দিন হয়েছে মাহিনের সাথে দেখা হয় না। পহেলা ফাগুনেই ছিলো তাদের শেষ দেখা। মাস্টার্সের পরীক্ষাও শেষ সেই কবে। একটিবারের জন্যেও মাহিন তার সামনে আসেনি। এই তার ভালোবাসা? কোথায় গেলো পুরানো দিনের সেসব পাগলামি? কোথায় গেলো তাকে বিয়ে করার জন্যে ছটফট করা মাহিন? অতীতের সকল মুহূর্তগুলো ইদানীং ফিঁকে লাগছে তার। শাফীনের কাছে শুনেছে, তার বাবার সাথে নাকি মাহিনের বেশ বড় ঝামেলা হয়েছে। ঝামেলার এক পর্যায়ে মাহিনও নাকি প্রতিজ্ঞা করেছে নিজের নাম সে না গড়ে এই এলাকায় প্রবেশ করবে না। আচ্ছা, প্রতিজ্ঞা করার সময় কী একবারও খেয়াল হলো না হৃধির কথা? সে কী বুঝলো না হৃধি তাকে ছাড়া কী করে থাকবে?

মাহিন তো তাকে একদিন না দেখলেই চাতক পাখির ন্যায় কাঁতরাতো। এখন কী সে পূর্বের ন্যায় কাঁতরায় না? কী করে থাকলো মাসের পর মাস এভাবে দূরে সরে থাকতে? পথ-ঘাটে রাফিদ সহ ওর সকল বন্ধুকেই হৃধি দেখতে পায়। ইদানীং সাব্বির রাজনীতিতে ঢুকেছে। তাই রাফিস এবং সিফাতকেই বেশিরভাগ সময় দেখা যায়। ওরা হৃধিকে দেখলে মুচকি হেসে বলে,
–“ভালো আছেন ভাবী?”

হৃধি আগে হাসিমুখে উত্তর দিতে পারলেও এখন সে এই উত্তর দিতে পারে না। ভালো থাকার মতো অবস্থা তার নেই। মিথ্যে উত্তর দিয়ে কী করবে সে? মাহিন এখন নাম করেছে। তার পূর্বেই এক ইউটিউব চ্যানেল ছিলো। যেদিন ওদের শেষ দেখা হয়েছিলো সেদিন মাহিন আরেকটি গান কভার শুট করে। কাকতালীয় ভাবে সেদিনের “ডুবে ডুবে ভালোবাসি” গানটি ভাইরাল হয়ে যায়। পরপর আরও কয়েকটি গান আসে। বলা চলে প্রায় অনেকগুলো কভার গেয়েছে সে। বেশ ভালোই নাম করেছে সে। তবে মাঝখান দিয়ে হৃধিকে ভুলে গেছে সে। না জানি কোন মেয়ের ফাঁদে সে পরেছে। এমন জানলে হৃধি কখনোই মাহিনের প্রেমে পরতো না। সেই প্রথম দিনই চড় মেরে দিতো। হ্যাঁ ভালোবেসে ফেলেছে সে মাহিনকে। হৃধি জানে না তার এই কষ্টেএ মূল কারণ কী? অতীতের এতগুলা দিন মাহিনকে কষ্ট দেবার শাস্তি পাচ্ছে নাকি মাহিন নিজ থেকে তাকে এভাবে কষ্ট দিচ্ছে। তবে তার মন এক কথাই বলে,
–“আগে তো মাহিনকে কষ্ট দিতি, এখন বুঝ ভালোবাসা কতটা পোড়ায়। আগে বুঝলে কী এরকম হতো?”

এখন হৃধি সবসময় নিকাব পরে বের হয়। নিকাব পরা তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। আজ ত্বোহার সাথে বেরিয়েছে কিছু শপিং করতে৷ ত্বোহা তার ড্রেস চেক করতে করতে হৃধির ভাব-ভঙ্গি লক্ষ্য করলো। চোখে-মুখে কেমন বিরক্তির ছাপ। ত্বোহা এরূপ লক্ষ্য করতেই প্রশ্ন ছুঁড়লো। হৃধি বিরক্তির স্বরে আওড়ায়,
–“আর বলিস না। এতদিন বাবা সম্বন্ধ আটকে রেখেছিলো। এখন যেন বিয়ের সম্বন্ধ প্রতিদিন এত এত আসছেই। না জানি কবে বাবা কাকে কথা দিয়ে ফেলে!”
–“মেয়ে বড়ো হয়েছে বিয়ে তো দিতে হবেই। এখন তোর মতামত কী? মাহিন ভাইয়ের জন্যে অপেক্ষা করবি নাকি বিয়ে করে সংসারে হাত লাগাবি?”

হৃধি চোখ গরম করে ত্বোহার দিকে তাকালো। মনে মনে এক ভয়ংকর গা/লি আসলেও বহিঃপ্রকাশ করলো না। বেশ সময় নিয়ে গা/লিটাকে এক দমে গিলে ফেললো সে। এর সাথে কথা বলাই বেকার। কই ভবিষ্যৎ সমাধান দিবে তা না, যত্তোসব আলতু ফালতু কথাবার্তা! হৃধি মুখ ঘুচে ড্রেস চয়েস করে ত্বোহার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বেরিয়ে এলো। ত্বোহা দ্রুত বিল পে করে বেরিয়ে এলো হৃধির পিছু পিছু।

হৃধি বাসায় পৌঁছাতেই বেশ চমকে উঠলো। বৈঠকঘরে রক্তিম এবং তার মামা, মামী বসে আছে। হৃধির মাথায় মুহূর্তে-ই চড়লো অতীতের ঘটনা। সঙ্গে সঙ্গে শুকনো ঢোঁক গিলে নিলো। পরমুহূর্তেই মাথায় এলো, রক্তিম যেহেতু এতদিন কিছু বলেনি সেহেতু নিশ্চিত আজও কিছুই বলবে না। এরকম ভাবতেই হৃধি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। হৃধিকে দেখতেই করিম উল্লাহ হাসিমুখে মেয়ের উদ্দেশ্যে বললো,
–“যাও মামুণি, রক্তিমকে নিয়ে নিজের রুমে যাও। আমরা কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছি, সেটা নাহয় ওর মুখ থেকেই শুনে নিও!”

হৃধি চমকালো, ভড়কালো। কিসের সিদ্ধান্তের কথা বলছে করিম উল্লাহ? আচ্ছা সে যা ভাবছে তা নয় তো? সে তো কোনো বাচ্চা না যে এই ইঙ্গিত বুঝবে না।রক্তিম তার পাঞ্জাবির কলার ঠিক করতে করতে উঠে দাঁড়ায় এবং হৃধির সম্মুখে এসে দাঁড়ায়।

—————–
–“শাট ইওর মাউথ রাফিদ। হৃধির বিয়ে আর তুই সেটা আমাকে বিশ্বাস করতে বলছিস, ইডিয়েট?”
–“সত্যি ভাই, তুই যে বর্তমানে কার সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছিস সেটা সবাই জানে। ইভেন হৃধিও। সোশ্যাল মিডিয়ায় মাতামাতিও কম হচ্ছে না!”
–“যার জন্য এতো সংগ্রাম, তাকে অন্যের ঘরে যেতে দিবো ভাবলি কী করে? রাতেই আমি আসছি, জাস্ট ওয়েট এন্ড সি।”

বলেই খট করে কল কেটে দেয়। পুণরায় হৃধিকে কল দেয়। আবারও সুইচড অফ। মাহিন নিজের ক্রোধ দমাতে না পেরে বিছানায় ফোন ছুঁড়ে মারলো।

মাঝরাতে ঘুমন্ত হৃধির রুমে প্রবেশ করলো এক অবয়ব। হৃধির সম্মুখে এসে তার নাকে এক স্প্রে মারলো। হৃধি ঘুমন্ত অবস্থায় সেই স্প্রের ঘ্রাণ নিজের অজান্তেই শুকে ফেলে এবং জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।

জ্ঞান ফিরলে নিজেকে এক অজানা রুমে আবিষ্কার করে। হৃধি চট করে উঠে বসে। চারপাশ দেখে তার বুক কেঁপে উঠে। কোথায় আছে সে? কার রুমে আছে? কিছুক্ষণ যেতেই দরজা খুলে কয়েকজন প্রবেশ করলো। সবার পিছের মানুষটিকে দেখে হৃধি চমকে উঠলো। মা..মাহিন!? কিন্তু মাহিন তার দিকে এভাবে তাকিয়ে আছে কেন? মাহিন হৃধির দিকে তাকিয়ে থমথমে স্বরে বললো,
–“বিয়ে পড়ানো শুরু করেন কাজি সাহেব।”

~চলবে, ইনশাল্লাহ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here