#হৃদ_মাঝারে_তুমি,পর্বঃ- ২৩
#লেখকঃ- Tamim Ahmed
,,
,,
-“তোমরা যে বিয়ে করেছ তার প্রমাণ কি?”
রফিক আহমেদের কথায় তানিশা কিছুটা হকচকিয়ে উঠলো। বিয়ে তো তারা করেছে ঠিকই কিন্তু কাবিনমানা তো সানির কাছে। সানি কি সেটা নিজের সাথে এনেছে? তানিশা এসব ভাবতে ভাবতে সানির দিকে তাকালো আর ইশারায় কাবিননামার কথা জিজ্ঞেস করলো। সানি তখন তানিশাকে ইশারায় আস্বস্ত করে নিজের পকেট থেকে দলিলের মতো কিছু কাগজ বের করলো আর সেগুলো রফিক আহমেদের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো, “এই যে এটা আমাদের বিয়ের কাবিননামা।”
রফিক আহমেদ সানির থেকে সেই কাগজগুলো নিয়ে একটা একটা করে দেখতে লাগলেন। প্রথম পৃষ্ঠা দেখেই উনি বুঝে ফেললেন যে এটা আসলেই কাবিননামা। তবে এটা তানিশার বিয়ের কাবিননামা কি-না সেটা বোঝার জন্য উনি বেশ কিছুক্ষণ সেটা দেখতে লাগলেন। পুরো কাবিননামা দেখা শেষ হলে উনি সেটা তানিশার আব্বুর দিকে এগিয়ে বললেন, “এটা আসলেই ওদের বিয়ের কাবিননামা। তুমি চাইলে চেক করে দেখতে পার।”
রফিক আহমেদের থেকে কাবিনমানাটা নিয়ে তানিশার আব্বু সেটা দেখতে লাগলেন। কিছুক্ষণ দেখার পর তিনি সেটা টেবিলের একপাশে রেখে দিলেন। উপস্থিত সবাই এখন চুপ করে বসে আছে, কেউ কোনো কথা বলছে না। নিরবতা কা*টিয়ে রফিক আহমেদ বলে উঠলেন,
-“যা হবার তা তো হয়েই গেছে এখন আর মুখ গোমড়া করে বসে থেকে কি লাভ? তানিশা যা করেছে তা ভুল করেছে। তবে তোমরা যে তানিশার অমতে গিয়ে তাকে ফারহানের সাথে বিয়ে দিতে চাচ্ছিলে সেটা কিন্তু একপ্রকার অন্যায় ছিল। সবদিক দিয়ে বিবেচনা করে দেখলে দেখা যায় এইখানে আমাদেরই ভুল আছে। ফারহানও প্রথমদিকে তানিশাকে বিয়ে করতে রাজি হয়নি কিন্তু পরে আমরা যখন তাদের বিয়ের তারিখ ঠিক করে ফেললাম তখন আর ফারহান বিয়েতে অমত প্রকাশ করেনি, হয়তো তার আম্মুর জন্য। কিন্তু ওইদিন তোমাদের উচিত ছিল তানিশার কথাগুলো একবার শুনে নেওয়ার। যদি ওইদিন তোমরা তার কথাগুলো শুনতে তাহলে আজ সে পালিয়ে বিয়ে করতো না। তাই তোমাদের উচিত এখন তাদেরকে মেনে নেওয়া।”
রফিক আহমেদের কথাগুলো তানিশার আম্মু-আব্বু মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। উনার কথা বলা শেষ হলে এবার তানিশার আম্মু বলে উঠলেন, “আমরা এই বিয়ে মানি না। আমরা আবার এই ছেলের সাথে তানিশার বিয়ে দিব। যদি এই ছেলেটা আবার তানিশাকে বিয়ে করে তাহলেই আমরা তাদেরকে মেনে নিব।”
-“আমরা রাজি।” তানিশার আম্মুর কথাগুলো শুনে তানিশা আর সানি উৎফুল্ল কণ্ঠে একসাথে বলে উঠলো কথাটা।
তানিশা আর সানি নিজেদের এহেন কাজে নিজেরাই খানিকটা লজ্জা পেয়ে গেল আর লজ্জায় মাথা নিচু করে বসে রইলো। এদিকে তাদের এমন কাজে উপস্থিত সবাই নিজের অজান্তেই মিটমিট করে হাসতে আরম্ভ করলেন শুধু রোকসানা বেগম ছাড়া। কেননা উনি এখনো তানিশার বিয়ের বিষয়টা নিয়ে ফ্রাস্ট্রেশনে আছেন।
-“আচ্ছা তাহলে দুলাভাই আপনি একটা কাজি ডেকে আনেন। এক্ষুণি এদের বিয়ে হবে।” তানিশার আম্মু রফিক আহমেদকে উদ্দেশ্য করে বললেন কথাটা।
-“আচ্ছা আমি কাজি সাহেবকে কল দিচ্ছি।” বলেই রফিক আহমেদ উনার ফোনটা বের করে কাজির নাম্বারে কল দিলেন।
.
কাজি এসে তানিশা আর সানির বিয়ে পড়িয়ে চলে গেছেন। এই নিয়ে তাদের দ্বিতীয়বার বিয়ে হলো। বিয়ের আগে অবশ্য তানিশার আম্মু-আব্বু সানির থেকে ওর মা-বাবার নাম্বার নিয়ে ওদের সাথে ফোনে কথা বলেছেন। প্রথমে যখন সানির মা-বাবা তাদের ছেলের বিয়ের কথা শুনলেন তখন অনেকটাই অবাক হয়ে গেলেন। তারপর যখন তানিশার আম্মু-আব্বু তাদেরকে সবকিছু বুঝিয়ে বললেন তখন তারা বিষয়টা বুঝতে পারলেন। না দেখেই তারা তানিশাকে ছেলের বউ হিসেবে মেনে নিলেও সানির প্রতি তাদের একটা রাগ থেকেই গেল। থাকবে না কেন? নিজের ছেলে একটা মেয়েকে বিয়ে করে ফেলেছে তাও তাদেরকে না জানিয়েই। তা ছাড়া সানি যখন ঢাকা থেকে সিলেটে আসে (আমার বাসা মূলত সিলেট বিভাগে তাই গল্পতে সিলেটের কথাই উল্লেখ করলাম) তখন তার মা-বাবাকে বন্ধুদের সাথে পিকনিকে যাওয়ার কথা বলে আসে। কিন্তু পিকনিকের নামে যে তাদের ছেলে এতো বড় একটা কাজ করে বসবে সেটা তারা কল্পনায়ও ভাবেনি। এদিকে তানিশার বিয়ে নিয়ে রোকসানা বেগমের একটু মন খারাপ ছিল কিন্তু ফারহানের বুঝানোতে উনি কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছেন।
বর্তমানে তানিশা, সানি আর ফারহান ছাদে বসে বসে আড্ডা দিচ্ছে। এমন সময় ফারহান বলে উঠলো, “আমার আইডিয়াটা সফল হয়েছে তাহলে।”
-“কীসের আইডিয়া?” তানিশা জিজ্ঞেস করলো।
-“ওইযে ওইদিন তোকে বলেছিলাম আমার সাথে তোর বিয়ে হলে তোকে নিয়ে কিছুদিনের জন্য দেশের বাহিরে চলে যাব। ওইদিন তোকে ভয় দেখানোর জন্য মূলত ওইসব বলেছিলাম। অবশ্য তুই যদি ভয় না পেতি তাহলে আমি নিজের জালে নিজেই ফেসে যেতাম। বিয়ের আগে আমি নিজেই বাসা থেকে গুম হয়ে যেতাম। আসলেই তুই একটা ভীতু।”
-“তার মানে তুমি…”
-“সবকিছু আমি প্লেন করেই করেছি। বুঝতে হবে না আমার মাস্টারমাইন্ড ব্রেন বলে কথা।”
-“কাজটা কিন্তু তুমি একদমই ঠিক করনি ভাইয়া।”
-“এ ছাড়া যে আর কোনো উপায় ছিল না।”
-“ভাইয়া আপনার মাস্টারমাইন্ড আইডিয়াকে স্যালুট। এমনটা করাতে একদিক দিয়ে কিন্তু ভালোই হয়েছে।” সানি বললো কথাগুলো।
-“কোনদিক দিয়ে?” তানিশা জিজ্ঞেস করলো।
-“এই যে আমাদের বিয়েটা হয়ে গেল। ভাইয়া যদি এমন মাস্টারমাইন্ড প্লেন না বানাতেন তাহলে কি এতো তাড়াতাড়ি আমাদের বিয়েটা হতো?”
-“তা অবশ্য ঠিক বলেছ। এর জন্য তোমাকে ধন্যবাদ। তবে তুমি ওইদিন আমাকে ওইসব বলে ভয় না দেখিয়ে সবকিছু বুঝিয়েও বলতে পারতে।”
-“বুঝিয়ে বললে তো তুই রিস্ক নিয়ে এতকিছু করতি না। তাই তোকে অন্যভাবেই বোঝাতে হলো।”
এহেম এহেম…
কারও কাশির শব্দ শুনে সবাই পিছনে ফিরে তাকালো দেখলো আরশি ছাদের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। আরশিকে দেখে তানিশা আর সানি কিছুটা ভীত হয়ে উঠলো। আরশি হয়তো তাদের সব কথা শুনে ফেলেছে। আর সে এখন নিচে গিয়ে সবাইকে সবকিছু বলে দিবে এটাই তানিশা আর সানি মনে মনে ভাবছে। কিন্তু তাদের ধারণা ভুল প্রমাণিত করে আরশি কিছুটা এগিয়ে এসে বলে উঠলো,
-“তানিশা তোমাদেরকে তোমার আম্মু খুঁজতেছেন।”
আরশির এমন কথায় তানিশা আর সানি কিছুটা অবাক হয়ে মনে মনে ভাবলো, আরশি হয়তো তাদের কথা শুনেনি।
-“কেন আপু?”
-“জানি না, তোমরা গিয়ে জেনে নাও।”
-“আচ্ছা ঠিক আছে, এই চল।” সানিকে উদ্দেশ্য করে বললো তানিশা।
তারপর তানিশা আর সানি দুজনে ছাদ থেকে নেমে নিচে চলে গেল। ওরা চলে যাওয়ার পর আরশি গিয়ে ফারহানের পাশাপাশি দাঁড়ালো। ফারহান তখন ছাদের রেলিং ধরে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। আরশি এবার ফারহানের দিকে না তাকিয়েই বলে উঠলো, “তা তোমার মাস্টারমাইন্ড প্লেনের গল্পটা আমায় শোনাবে না?”
আরশি এহেন কথায় ফারহান খানিকটা চমকে উঠলো তবে মূহুর্তেই নিজেকে সামলে নিল। ফারহান বুঝতে পারলো আরশি তাদের কিছুক্ষণ আগের কথাগুলো শুনে ফেলেছে। এখন আরশিকে কীভাবে দমিয়ে রাখা যায় সেই চিন্তাই করছে ফারহান।
এদিকে ফারহানকে চুপ করে কি যেন ভাবতে দেখে আরশি আবার বলে উঠলো, “শোনাবে না নাকি?”
-“তখন তাহলে আমাদের কথা শুনে ফেলেছিস তাইনা? ওকে শুনেই যখন ফেলেছিস তাহলে পুরো ঘটনাটাও জেনে নে। তোকে বলতে তো আমার কোনো অসুবিধা নেই। শুন তাহলে ওইদিন কি হয়েছিল। আমি তানিশাকে বলেছিলাম আমার সাথে ওর বিয়ে হলে ওকে নিয়ে দেশের বাহিরে চলে যাব সাথে এটাও বলেছিলাম ও যদি আমায় বিয়ে করতে না চায় তাহলে সে যেন তার বয়ফ্রেন্ড মানে সানিকে এইখানে আসতে বলে আর ওর সাথে পালিয়ে গিয়ে কোনো একটা কাজি অফিসে বিয়ে করে নেয়। আমার কথা শুনে তানিশা সাথে সাথে আমায় না করে দেয় যে সে এটা করতে পারবে না। তখন আমিও তাকে একটু চাপে ফেলার জন্য বলি সে যেন আমাকে বিয়ে করার জন্য তৈরি হয়ে নেয়। তারপর তানিশা পুরো একটা দিন ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিল সে সানিকে এইখানে আসতে বলবে আর তাকে নিয়ে কোথাও পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে নিবে। তো ভাবনা অনুযায়ী সে সানিকে ফোন করে সবকিছু বুঝিয়ে বলে। প্রথমে সানি আসতে চাচ্ছিল না পরে সে সানিকে সুইসাইড করার ভয় দেখিয়ে এইখানে আসতে বাধ্য করে। তারপর তো তারা দুজনে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে ফেলে, শেষ কাহিনী।” একনাগাড়ে কথাগুলো বলে ফারহান থামলো।
-“কিন্তু তানিশা বাসা থেকে পালালো কীভাবে? সন্ধ্যার আগ থেকেই তো তুমি ড্রয়িংরুমে বসে ছিলে।”
-“সন্ধ্যার আগ মূহুর্তে কিন্তু আমি বাহির থেকে বাসায় ফিরেছিলাম মাত্র। আর এসেই ড্রয়িংরুমে গিয়ে বসে পরি। এর আগের রাতে আমি তানিশাকে বলে রেখেছিলাম যে আমি এই টাইমে বাহির থেকে বাসায় ফিরবো তখন সবাই নানান কাজে ব্যস্ত থাকবে তখনই তুই দরজা দিয়ে বেরিয়ে পালিয়ে যাবি।”
-“তার মানে তুমি যখন বাসায় এসেছিলে তখনই তানিশা সদর দরজা দিয়ে পালিয়ে যায়?”
-“এক্স্যাক্টলি। আর ওইসময় বাসার মহিলারা সব রান্নাঘরে ছিল। আর ওদিকে আব্বু আর খালু কাজি আনতে গিয়েছিলেন। আর মামা তো আমাদের এইখানে তখন আসেনই নাই কেননা তিনি তখন উনার অফিসে ছিলেন।”
ফারহানের কথাগুলো শুনে আরশি কিছুক্ষণ তার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। ফারহান কীভাবে এতো পারফেক্টলি সবকিছু প্লেন করেছিল তা এই মূহুর্তে না শুনলে আরশি বুঝতেই পারতো না। আরশি এবার নিজেকে স্বাভাবিক করে নিল আর ফারহানের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো, “ওয়াও তোমার মাস্টারমাইন্ড প্লেনটা তো সেইরকম ভাবে কাজে লেগেছে। তবে তোমার এই মাস্টারমাইন্ড প্লেনের গল্প আমি একা শুনলেই কি হবে? অন্যদেরও তো শোনানো লাগবে।”
-“তুই সবার কাছে গিয়ে এইসব কথা বলবি আর সবাই তোর কথা বিশ্বাস করে নিবে?”
-“না আমি কেন কষ্ট করে সবাইকে এইসব কথা বলবো। তুমি নিজেই সবাইকে পুরো কাহিনী শুনাবে।”
আরশির কথার মানে বুঝতে না পেরে ফারহান প্রশ্নবোধক চাহনিতে তার দিকে তাকিয়ে রইলো। আরশি এবার নিজের ফোনের লক খুলে একটা ভয়েজ রেকর্ড চালু করে ফোনটা ফারহানের সামনে ধরলো। সেই ভয়েজটা মূলত ফারহানের। সে একটু আগে যা যা বলেছে সবটাই এর মধ্যে রেকর্ড করা হয়েছে। তানিশা আর সানি যখন ছাদ থেকে চলে যায় তখন আরশি ফারহানের অগোচরে তার ফোন রেকর্ডারটা চালু করে ফারহানের পাশে এসে দাঁড়ায় আর ফারহান তা বুঝতেও পারেনি।
-“এখন আমি গিয়ে সবাইকে এটা শুনাই?”
-“আরশি ভয়েজটা ডিলেট কর।”
-“করতে পারি একটা শর্তে।”
-“কি শর্ত?” ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করলো ফারহান।
-“আমাকে যে এতো বছর ধরে চড় মেরে এসেছ তার জন্য একশতবার কানে ধরে ওঠবস করা লাগবে।”
-“কিহহ! পাগল নাকি তুই, একশতবার কানে ধরে ওঠবস কীভাবে করবো?”
-“সেটা তুমিই জান। নাও এবার তাড়াতাড়ি শুরু কর, আমার হাতে আবার বেশি সময় নেই।”
-“পারবো না।”
-“তাহলে আর কি করার, তোমার মাস্টারমাইন্ড প্লেনের গল্পটা সবাইকে গিয়ে একটু শুনিয়ে আসি।” বলেই আরশি ছাদের দরজার দিকে হাঁটা ধরলো।
-“আরশি দ্বারা, ভুলেও এমন কাজ করিস না।” পিছন থেকে ফারহান বললো কথাটা।
-“তাহলে একশতবার ওঠবস কর।” হাঁটা থামিয়ে পিছন ফিরে বললো আরশি।
-“বললাম না এটা করতে পারবো না। অন্যকিছু বল।”
-“করলে এটাই করতে হবে নাহলে আমি গেলাম।” বলে আরশি আবার সামনের দিকে হাঁটা ধরলো।
ফারহান এবারও আরশিকে পিছন থেকে ডাক দিয়ে দাঁড়াতে বললো কিন্তু আরশি এবার দাঁড়ালো না। এভাবে কয়েকবার ডাকার পর আরশি যখন তার হাঁটা থামালো না তখন ফারহান দৌড়ে গিয়ে পিছন থেকে আরশির হাত টেনে ধরে আর একটানে তাকে নিজের কাছে নিয়ে আসে। আরশিকে নিজের কাছে নিয়ে এসেই ফারহান তার ডান হাত দিয়ে আরশির কোমড় চেপে ধরলো। আচমকা ফারহানের এহেন কাজে আরশি পুরো রোবটের ন্যায় শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।
.
.
Loading…….