#এল_এ_ডেইস
পর্ব ৪৫
লেখনী মাহীরা ফারহীন
ট্রিং ট্রিং শব্দে কলিং বেল বাজচ্ছে। তিরতির করে বাতাস বইছে। চারিদিকে ঝলমল করছে সোনালি রোদ। সেই সোনালি রোদ তীর্যক ভাবে এসে পরেছে দরজার ওপর। বাড়ির সম্মুখেই রাস্তায় যানবাহনের কোলাহল। কিছুক্ষণ পর দরজা খুলে গেল। মিসেস রহমান দাঁড়িয়ে দরজার ওপাশে। দরজার এপাশে দাঁড়িয়ে নাইম ও পাশে মাহীন। ওদের পেছনে মি.মোর্শেদ ও মিসেস নাসরিন। বিকেল সাড়ে চারটা বাজে। ওরা একে একে ভেতরে প্রবেশ করল। মিসেস রহমানের মুখ আন্তরিক হাসিতে উদ্ভাসিত। প্রথমেই তারা একে অপরের সাথে সালাম বিনিময় করলেন। তারপর কুশল বিনিময় করতে ব্যস্ত হলেন। কেন জানি মাহীনের মনে হলো তাদের প্রথম বার দেখা হলেও একে অপরকে যেন যুগ যুগ ধরে চেনেন। অবশ্য ওনাদের হাবভাবটাই এরকম। মিসেস মাদিহ সোফার ওপর বসে ছিলেন। গোটা ঘরময় হলদেটে আলো বিচরণ করছে। এদিক ওদিককার জানালা হতে বিকেলের মরা সোনালি রোদ উঁকি দেয়।
মাহীনের বাবা-মা ওনাকে সালাম জানিয়ে সামনাসামনি বসলেন। বাংলাদেশ থেকে ক্যালিফোর্নিয়ায় আসার পর কারোও বাসায় এভাবে সপরিবারে দাওয়াতে যাওয়া হয়নি মাহীনের। ওর কেন জানি হঠাৎ আগে দেশে থাকতে ঠিক যেমন ঈদের সময় আত্নীয় স্বজনদের বাসায় যাওয়া হতো সেরকম একটা অনুভূতি হলো। যদিও এটা ঈদ নয়। এই বাসায় ও এর আগেও বহুবার এসেছে। তবুও অন্য রকম লাগছে সবকিছু। আসলেই অন্যরকমই লাগছে। কারণ ধূসর পর্দাগুলো বদলিয়ে মাখন রঙা পর্দা লাগানো হয়েছে। সোফার কুশন কভার গুলো পাল্টানো হয়েছে। বুক কেসটায় রাখা শো-পিস গুলোও বোধহয় একটু এদিকওদিক করা হয়েছে। বুক কেসের পাশে দেয়ালে সাধারণত একটা চতুর্ভুজ আকৃতির কাঠের ফ্রেমে রাবিতের একটা ছবি দেখা যেত। এখন সেখানে সোভা পাচ্ছে রাবিত ও রায়েদ দুই ভাইয়ের একসাথে একটা ছবি। সেটা খেয়াল করে মাহীনের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো। রায়েদ বা রাবিত বাড়িতে নেই। অবশ্য ওদের থাকারও কথা না। মাহীনের বাবা-মা মিসেস মাদির সামনাসামনি সোফায় বসে আছেন। নাইমও সেখানেই। কিন্তু মাহীন খুব সহজ ভাবেই উঠে এসে মিসেস রহমানের সাথে রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে আছে। মিসেস রহমান প্রথমেই এক ট্রেতে করে কতগুলো শরবতের গ্লাস ড্রইংরুমের সেন্টার টেবিলে রাখলেন। মাহীন এবার সেখানে গিয়ে ভাইয়ের পাশে বসলো। মি.মোর্শেদ মিসেস মাদিহকে তার বাংলাদেশ হতে ক্যালিফোর্নিয়ায় আসার কাহিনী শোনাচ্ছেন। মিসেস মাদিও বেশ আগ্রহ নিয়ে শুনছেন। মাঝে মাঝে তিনি ফোকলা দাঁত বের করে হাসছেন। ওনার বেশ বয়স হলেও জ্ঞান বুদ্ধি যেন যৌবনকালের মতোই প্রখর আছে। মিসেস নাসরিন প্রথমে বেশ কিছুক্ষণ কথা বললেন। তারপর উঠে আসলেন রান্নাঘরের দিকে।
মিসেস রহমান মহিলাটিকে নিয়ে বড়ই বেশি আগ্রহ ওনার। কত কীই না শুনেছেন মেয়ের মুখে। শুধু অপেক্ষা ছিলো সামনাসামনি দেখা হওয়ার। মিসেস রহমান অতি ব্যস্ততার সঙ্গে সবকিছু এক হাতে সামলাচ্ছেন। কালো বর্ণের চার চুল্লীর স্টোভের চারটিতেই রান্না বসানো রয়েছে। টাইলস বসানো বারের ওপর বেশ কতগুলো বাটিতে বিভিন্ন ধরনের সবজি আগে থেকে কেটে রাখা। মিসেস নাসরিন অবাক হয়ে বললেন, ‘ওহ আল্লাহ আপনি একা হাতে এত কিছু করতে গেলেন কেন?’
মিসেস রহমান হাসলেন। বললেন, ‘করবো না কেন? প্রথমবার আমার বাড়িতে এলেন আপনারা। সর্বোচ্চ দিয়ে আপনাদের আপ্যায়ন না করলে যে আমার শান্তি লাগবে না।’
মিসেস নাসরিন হালকা হাসলেন। বললেন,’আমাদেরকে নিজের মানুষই মনে করুন। আমার মেয়ে তো শুনি অর্ধেক সপ্তাহ আপনার বাসায়ই কাটিয়ে দেয়।’
মিসেস রহমান সহাস্যে বললেন, ‘আমার ভাগ্য বলতে হবে। আপনাদের অনেকদিন ধরেই দাওয়াত দেওয়ার কথা ভাবছিলাম। জানতে বড় ইচ্ছে ছিলো কে সেই ভাগ্যবান মা-বাবা যারা মাহীনের মতো মেয়ে পেয়েছে।’
মিসেস নাসরিন হেসে উঠলেন। বারের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে বললেন, ‘আহা আপনি যদি ওর কান্ডকারবার গুলো সম্পর্কে অবগত থাকতেন এ কথা বলতে পারতেন না। সবচাইতে বেশি দুশ্চিন্তায় থাকি ওকে নিয়ে। কখন কী করতে গিয়ে কোন ঝামেলায় ফাঁসে তার কোনো ঠিক নেই।’
‘তা বটে। এমনটা হলে দুশ্চিন্তা আমারও হতো। তবে এসব সম্পর্কে তো আমি জানিই না। আর আমার একটা মেয়ে নেই বলেই হয়তো বেশি ভালো লাগে ওকে। আপনাকে একটা কথা বলছি কিছু মনে করবেন না, আমার মাঝেমাঝে হিংসে হয় ইশ ও যদি আমার মেয়ে হতো।’
মিসেস নাসরিন হেসে বললেন, ‘আহা তাহলে তো বেঁচেই যেতাম।’ তারপর একটু থামলেন। মিসেস রহমান একটা চুলা থেকে কোফতা নামিয়ে আনলেন ততক্ষণে। ঘরময় কোফতার সুস্বাদু ঘ্রাণ ছড়িয়ে পরেছে। সিংকের ওপরের জানালাটা খোলা। সেখান থেকে বাগানের রঙবেরঙের পেতুনিয়া ফুলগুলো বাতাসের তোড়ে তরতর করে উড়তে দেখা যায়। মিসেস নাসরিন বললেন, ‘আপনার ছেলেরা কেমন আছে?’ প্রশ্নটা করার পরই তিনি তীক্ষ্ণ ভাবে মিসেস রহমানের প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করলেন। মিসেস রহমান তেমন বিশেষ কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালেন না। তিনি অমায়িক হেসে বললেন, ‘আছে ওরা দুজন বেশ ভালোই আছে। মাহীনের প্ল্যান ছিলো রায়েদ যেন আজকের প্রোগ্রাম সম্পর্কে আগে থেকে কিছু না জানতে পারে। রাবিত গিয়েছে ওকে নিয়ে বাইরে। কিছুক্ষণ পর চলে আসবে।’
মিসেস নাসরিন বললেন, ‘যাক ভালোই হয়েছে। আচ্ছা আমি শুনলাম সেলিও নাকি আসছে।’
‘আসবে না আবার। সে শুধু কী আমার ডাক্তার নাকি, আমার বোনের মতো।’
‘উনাকে এত মাস দেখার পরও কখনো মনেই হয়নি উনি এতটা মিশুক হতে পারেন।’
‘কী জানি। উনি তো প্রথম থেকেই আমাকে চিকিৎসা করার উদ্দেশ্যেই কথা বলতেন তাই হয়তো আমার ওনাকে অন্য রকমই লেগেছে।’
মিসেস নাসরিন আলতো করে সায় জানি মাথা নাড়লেন। এরপরই মিসেস নাসরিনের মাথায় হঠাৎ একটা প্রশ্নের উদয় হলো। কিছুদিন ধরেই প্রশ্নটা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিলো। আজ মিসেস রহমানকে জিজ্ঞেস করবেন কিনা ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না। কিছুক্ষণ নিশ্চুপ ভাবে চিন্তাভাবনার পর প্রশ্নটা করা আসলেই অসংলগ্ন বলে মনে হলো। অবশেষে সেটা মাথার মধ্যে চাপা দিয়ে দিলেন।
.
.
এদিকে মিসেস মাদিহ ওনার এখানে আসার পর পড়াশোনা নিয়ে সংগ্রামের কাহিনী শোনাচ্ছেন। মি.মোর্শেদ থেকে শুরু করে মাহীন ও নাইমও মনোযোগ সহকারে শুনছে। উনি বলে চলেছেন, ‘প্রথমত আমার দেশ, আপনজন সকলকে ছেড়ে এমন একটা দেশে আসা যেটা সম্পর্কে সেকালে আমার কোনো ধারণাই ছিলো না। তার ওপর এখানে সারাদিন কাজ করে ঘর সামলিয়ে পড়াশোনা করা যুদ্ধের চাইতে এক অংশেও কম ছিলো না।…তখনই খুট করে শব্দ হয়ে মূল প্রবেশদ্বার খুলে গেল। মিসেস মাদিহ কথা থামালেন। সকলেই দৃষ্টি ঘুরাল দরজার দিকে। দরজা খুলে প্রথমে রায়েদ ভেতরে ঢুকতেই থমকে দাঁড়ালো। হঠাৎ ঘরে এতগুলো মানুষের উপস্থিতি ওকে হতবাক করে দিলো। তারওপর এতগুলো চোখ ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। প্রথমেই চোখে পরলো সোফায় নাইমের পাশে বসে আছে মাহীন। ও নিজেকে সামলে নিয়ে সবার আগে মি.মোর্শেদ কে সালাম দিলো। সেই ওর সবচাইতে কাছাকাছিতে অবস্থান করছিলো। এরপর দৃষ্টি গেলো রান্না ঘরের দিকে। সেখানে মায়ের সাথে মিসেস নাসরিনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সালাম দিলো। তারপর তাড়াতাড়ি জুতা খুলতে লাগলো। পেছন পেছন রাবিত ভেতরে ঢুকলো। ওকে একটুও অবাক হতে দেখা গেলো না। সেও সকলকে সালাম জানিয়ে জুতা খুলতে ব্যস্ত হলো। এই হঠাৎ আয়োজনে যারপরনাই অবাক হয়েছে রায়েদ। ভাবছে, মাহীন সপরিবারে আমাদের বাসায় আসলো সঙ্গে এত ঘটা করে আয়োজন হলো এবং আমাকে কেউ জানালোও না? কী আশ্চর্য তো!
জুতা খুলে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল না। এখন একটু ফ্রেস হতে নিজের কামরায় যাওয়ার চেয়ে সকলের সাথে এখানে বসাটাই অধিক সমিচিন মনে হলো। সোফায় গিয়ে দাদির পাশে বসল। মি.মোর্শেদ জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেমন আছো?’
‘এইতো আছি আলহামদুলিল্লাহ। আপনি?’
‘আমিও ভালোই আছি। এত দেরি হলো যে?’
রায়েদ এর উত্তরে কী বলা উচিত ঠিক বুঝতে পারলো না। ওকে তো রাবিত জোর করে হাঁটতে নিয়ে গিয়েছিল। ঘরে মেহমান আসবে শুনেও গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বাইরে হাঁটতে গিয়েছিল এটা বলা মোটেও ঠিক হবে না। তবে রায়েদের বিভ্রান্তির কথা বুঝতে পেরেই হয়তো মাহীন বলল, ‘বাবা এটা ওর জন্য সারপ্রাইজ ছিলো। ওতো জানতোই না আমরা আসছি।’
মি.মোর্শেদ হাসলেন। বললেন, ‘ওহ আচ্ছা তোর বুদ্ধি না এটা।’ ইতস্তত হাসল মাহীন। রায়েদ প্রথমেই বুঝতে পেরেছিল এসব বুদ্ধি মাহীনের মাথা থেকেই বের হয়। সঙ্গে সঙ্গে আবার মাও তাল দেয়। রাবিত এসে নাইমের পাশে বসলো। মিসেস রহমান অবশেষে বাকলাভা, স্টাফড গ্রেপ লিভস, কোফতা ও সেমাই এনে সেন্টার টেবিলে রাখলেন। মিসেস নাসরিন রাবিতকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আর তুমি কেমন আছো বাবা?’
রাবিত সহাস্যে বলল, ‘এইতো ভালো আছি আন্টি।’
মি.মোর্শেদ রায়েদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তো তোমার পড়াশোনার কী অবস্থা? কয়েকদিন পূর্বেই তো মিডটার্ম পরীক্ষার রেজাল্ট দিলো।’
‘এইতো সামোহির সকল জুনিয়রদের মধ্যে প্রথম হয়েছি।’
মি.মোর্শেদ ও মিসেস নাসরিন দুইজনই বিস্মিত হলেন। মি.মোর্শেদ পুলকিত গলায় বললেন, ‘বাপরে বাপ মাশাল্লাহ!’ বলে রান্নাঘরের দিকে চোখ ফিরিয়ে বললেন, ‘মিসেস রহমান আপনার ছেলে তো ব্রিলিয়ান্ট!’
মিসেস রহমান বারের পেছন থেকেই হাসি মুখে বললেন, ‘তা আর বলতে। ওর হাভার্ড থেকে টেক্সটাইল ইন্জিনিয়ারিং পড়ার ইচ্ছা, ইনশাআল্লাহ কনফার্মই বলা যায়।’
মি.মোর্শেদ বললেন, ‘তাই নাকি? টেক্সটাইল ইন্জিনিয়ারিং ক্যারিয়ার হিসেবে বেছে নেওয়া তো গ্রেট! আর তোমার যেরকম রেজাল্ট সেটা ধরে রাখতে পারলে হাভার্ডে চান্স পাওয়া কোনো ব্যাপারই না।’
রায়েদ হালকা হাসল। কিছু বললো না। নাইম জিজ্ঞেস করল, ‘তো ভাই তুমি সারাদিনই পড়ো? নাকি সব ট্যালেন্টের কারিশমা?’
রায়েদ কিছু বলার পূর্বেই রাবিত বলল, ‘ওফ যেভাবে বইয়ের সাথে চিপকে থাকে সেটা নিয়ে আর কিছু বলার নেই। ঈদের দিনও বইকে রেহাই দেয় না।’ মি.মোর্শেদ ও মিসেস নাসরিন হাসলেন।
মিসেস মাদিহ হেসে বললেন, ‘এখন দিন পাল্টেছে। এমনিতে আগের চিরাচরিত দৃশ্যই দেখা গেলেও ছুটির দিনগুলোতে আর বই ছুঁয়েও দেখে না। আজকাল বন্ধুদেরও সময় দেয়।’
মিসেস নাসরিন বললেন, ‘অবশ্যই বন্ধুদের সাথেও সময় কাটানো উচিৎ। ছেলেমেয়েদের সবকিছুই সমান ভাবে দরকার।’ রায়েদ মাহীনের দিকে এক নজর তাকাল। ওনারা তো জানেন না ছুটির দিন অন্য কোনো বন্ধু নয় মাহীনের সঙ্গেই ঘুরেবেড়ায় ও। এক মনে নিজের নখ খুটরাচ্ছে মাহীন। যেন এই মুহূর্তে নখ খুটরানোর চাইতে গুরুত্বপূর্ণ কাজ পৃথিবীর আরেকটা নেই। মনে হলো যেন এখানে বসে থেকেও এক প্রকার অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে ও। মিসেস রহমান অবশেষে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। সোফার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘আপনারা খাওয়া দাওয়া করুন। বাকিদের আসতে দেড়ি আছে। আমি এখুনি আসছি।’ সকলে সায় জানিয়ে মাথা নাড়ল। মিসেস রহমান রায়েদের দিকে দৃষ্টি ফেরালেন, তুই আমার সাথে একটু আয় তো।’ হঠাৎ সকলের মাঝখান দিয়ে এভাবে ডেকে নেওয়াতে রায়েদ অবাক হলো। ও কি কোনো ভুল করে ফেলেছে? কোনো ভুল কথা বলে ফেলেছে? নাহলে ঠিক এই মুহূর্তে সকলের মাঝখান থেকে ওকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার কী মানে? রায়েদ উঠে দাঁড়াল। হঠাৎ পুরনো আশঙ্কা এসে হানা দিলো ওর মনে। না জানি কী বলতে চান মা। না জানি পরিস্থিতি কোথা থেকে কোথায় মোর নেয়। এসব আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতেই মায়ের পিছু পিছু ওনার কামরায় প্রবেশ করল। ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছে ও। কপালে গভীর চিন্তার ছাপ। কয়েক মিনিটের ব্যবধানেই নাকের ডগায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। মিসেস রহমান কামরায় প্রবেশ করেই কোনো দিকে দৃষ্টিপাত না করে চাবি নিয়ে আলমারির কাঠের পাল্লা দুটো খুললেন। তারপর একটু ঘাটাঘাটি করে কাঠের ছোট একটা বাক্স বের করে আনলেন। আলমারির দরজা বন্ধ করে এসে বিছানায় বসলেন। রায়েদ নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে ওনার কাজকর্ম লক্ষ করছে। মিসেস রহমান ওর দিকে মুখ তুলে তাকালেন। বললেন,’কী হলো বসো।’ রায়েদ অপ্রতিভ ভাবে এসে বসলো মায়ের পাশে। ভাবলো কাঠের বাক্সটা নিয়েই বুঝি কিছু একটা করতে যাচ্ছেন মা। কিন্তু মিসেস রহমান সেটা একপাশে রেখে দিয়ে রায়েদের দিকে পরিপূর্ণতে দৃষ্টিতে তাকালেন। তারপর ঝট করে ওর হাত দুটো শক্ত করে ধরে শান্ত গলায় বললেন, ‘বাবা দেখ্ এত বছর আমি তোর সাথে যেরকম নিষ্ঠুর আচরণ করেছি তারপরও..মানে ক্ষমা চাওয়ারও মুখ নেই আমার। জানি না এতটা নির্দয় কখন কিভাবে হয়ে গিয়েছিলাম। তারপরও বলছি আমাকে মাফ করে দি…বলতে বলতে গলা ধরে এলো ওনার। চোখের কার্ণিশে নোনাজল চিকচিক করে উঠল। হঠাৎ মায়ের এমন কথায় অদ্ভুত এক প্রশান্তিময় ঢেউ ওর মনের সৈকত ছুঁয়ে গেল। একই সাথে মায়ের চোখে পানি, তার ব্যাথাতুর মুখভঙ্গি ওর মনকে নাড়া দিয়ে গেলো। বুকে চিনচিনে ব্যাথার আবির্ভাব ঘটলো। রায়েদ উল্টে নরম কন্ঠে বললো, ‘মা তোমার তো কোনো দোষ ছিলো না। এবং আমি কখনোও তোমার এমন আচরণে রাগ করিনি। এখনো আমার মনে এসব নিয়ে কোনো রাগ নেই। তুমি যে সুস্থ হয়ে উঠেছো এটাই সবচেয়ে আনন্দের বিষয়।’
মিসেস রহমানের চোখ টপকে দু বিন্দু জল ফর্সা গাল বেয়ে গড়িয়ে পরল। উনি ম্লান কন্ঠে বলল, ‘তাহলে তুই আমাকে মাফ করে দিয়েছিস?’
রায়েদ গাঢ় কন্ঠে বলল, ‘আহা আমি তোমার ওপর কখনোও রাগ করিনি! আমার কোনো অভিযোগ নেই তোমার কাছে তাহলে ক্ষমার বিষয়টা আসছে কোথা থেকে?’ মিসেস রহমানের মুখমণ্ডল গোলাপি বর্ণের হয়ে উঠেছে। তার চোখ পেরিয়ে নিঃশব্দে একের পর এক বিন্দু বিন্দু অশ্রু গড়িয়ে চলেছে। তিনি রায়েদকে জড়িয়ে ধরলেন। তারপর ভাঙ্গা গলায় কোনো ক্রমে বললেন, ‘আমার মনে হচ্ছে চার বছর তুই কোথাও হারিয়ে গিয়েছিলি। এতদিন পর হঠাৎ তোকে পেয়ে গেলাম। চোখের নিমিষেই কত বড় হয়ে গেলি তুই। অথচ এর মাঝে কোনো ঈদ, কোনো রোজা, কোনো অসুখ বিসুখ, পড়াশোনা সবকিছু নিয়েই নির্বিকার ছিলাম আমি।’
রায়েদ নিশ্চুপ। চুপচাপ মায়ের কথাগুলো শুনছে। প্রতিটা কথা ওর মনে এক অনুভূতি জমা করছে। এই অনুভূতিগুলোই নোনাজল রুপে চোখের কোণায় এসে জড়ো হচ্ছে। কিছুক্ষণ পর মিসেস রহমান ওকে ছেড়ে দিলেন। তারপর কিছুটা সময় নিয়ে ধীরে ধীরে বললেন, ‘শোন এখন থেকে তোকে কোনো কষ্ট ছুঁতেও পারবে না। তোর যখন যা মন চায় আমাকে বলবি। চার বছরের হারিয়ে যাওয়া সময়গুলো তো আর ফেরত আনতে পারবো না। কিন্তু এই সময়গুলোকেই সুন্দর ভাবে ঠিকই করতে পারবো।’ বলে থামলেন।
রায়েদ বলল, ‘মা তোমাকে এসব নিয়ে এত ভাবতে হবে না। তুমি যে এখন আবার আগের মতো হয়ে গিয়েছো সেটা এমনিতেই আমার সবকিছুকেই আবার রঙিন করে দিয়েছে।’ মিসেস রহমান স্তিমিত হাসলেন। তারপর হঠাৎ চনমনে হয়ে বললেন, ‘আমি না মাহীন তোর জীবনকে রঙিন করে দিয়েছে।’ বলে থেমে ইতস্ততভাবে বললেন,’আচ্ছা তোর মাহীনকে কেমন লাগে?’ হঠাৎ মায়ের মুখে এমন প্রশ্ন শুনে রায়েদ অপ্রস্তুত হলো। ঠিক বুঝতেও পারলো না ও ঠিক শুনেছে কিনা। জিজ্ঞেস করল, ‘কি বললে?’
‘বললাম তোর মাহীন কেমন লাগে?’
‘ভালো।’ ছোট করে বলল রায়েদ। রায়েদের সারা মুখময় লালচে আভা ছড়িয়ে পরেছে। মিসেস রহমান সেটা লক্ষ্য করে মুচকি হাসলেন। আর রাখঢাক না করে বললেন, ‘তুই মাহীনকে পছন্দ করিস তাই না?’
রায়েদ এ পর্যায়ে অস্বস্তি ও বিব্রততার চরম পর্যায় পৌঁছে গেল। কেন মা হঠাৎ করে সোজাসুজি এমন প্রশ্ন করা শুরু করেছেন। সামান্য হ্যা বলতে কেমন লজ্জা করছে। তবুও ইতস্তত করে কোনো ক্রমে উত্তর দিলো, ‘ওকে কার পছন্দ হবে না মা।’
মিসেস রহমান এবার পাশে রাখা কাঠের বাক্সটা হাতে তুলে নিলেন। কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে বাক্সটির দিকে তাকিয়ে থেকে সেটা খুললেন। ভেতরে লাল মোলায়েম কাপড়ের মাঝে একটি সোনালী ব্রেসলেট রাখা। মিসেস রহমান ব্রেসলেটটা হাতে নিয়ে রায়েদের সামনে তুলে ধরে বললেন, ‘তাহলে শোন মাহীনকে যদি এটা এখন দিয়ে দেই বেশি বারাবাড়ি হয়ে যাবে না তো?’
রায়েদের মনেই হয়েছিল উনি এমন কিছু একটা করতে পারেন। তবুও চোখ বড় বড় করে তাকাল। বলল,
‘মা মাহীনকে তাই বলে হঠাৎ তোমার সোনার ব্রেসলেট দিবা তুমি? এতে ওর মা-বাবা কী ভাববে?’
মিসেস রহমান হালকা হাসলেন। নরম কন্ঠে বললেম,
‘ভাববেন, অনেক কিছুই ভাবতে পারেন। তবে আমি কী তাদের সাথে কথা বলবো না? আমি মনে করি এই ব্যাপারটা নিয়ে ওনাদেরও পরিষ্কার একটা ধারণা থাকা উচিৎ। এবং সেটা বোধহয় আমার কাছ থেকে সামনাসামনি জানাটাই বেশি ভালো হয়।’
রায়েদের অস্থিরতা এবং বিচলিত ভাবটা পুনরায় ফিরে এলো তবে এবার দুশ্চিন্তাকে সঙ্গে নিয়ে। বিভ্রান্তিভরা দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘কিন্তু মা মাহীন তো এসব নিয়ে একদমই প্রস্তুত না। ওতো…
মিসেস রহমান থামিয়ে দিলেন ওকে। প্রলম্বিত শ্বাস ফেললেন। গাঢ় কন্ঠে বললেন, ‘দেখ এসব জিনিস এভাবে লুকাচুরি করে হয় না। তোদের বিয়ের বয়স হলে বিয়ে দিয়ে দিতাম। তা তো আর করতে পারছি না। তাই আপাতত সবাইকে সবকিছু জানিয়ে রাখা ভালো। কাউকে অন্ধকারে রাখা উচিং না।’ বলে উঠে দাঁড়ালেন। বাক্সটা তার হাতে রয়েছে। রায়েদও উঠে দাঁড়াল। শান্ত কন্ঠে বলল, ‘ঠিক আছে মা তুমি যা ভালো বোঝো তাই করো।’