সুদর্শন শঙ্খচিল’ [০৩]

0
660

‘সুদর্শন শঙ্খচিল’
[০৩]
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)

প্রিয়ম তুয়ার মাথায় ডিম ফাটিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। তুয়া দাঁতে দাঁত চেপে চুপ করে আছে। প্রিয়ম বলল, “এটাকে বলে টিট ফর ট্যাট।”

তুয়ার ইচ্ছে করছে ছেলেটাকে রাম ধোলাই দিতে। কত্ত বড় খাটাশ, বদলাও নিয়ে নিলো। দু’জনের শরীর থেকে ডিমের আঁশটে গন্ধ আসছে। তুয়া চলে আসতে যাবে তখন প্রিয়ম হেসে বলল, “আমার নাম প্রিয়ম আর তোমার নাম কি গো রাগিণী?”

তুয়ার আম্মু তুয়াকে ডাকছেন। তুয়া বলল,”আসছি আম্মু।”

প্রিয়ম হাসতে হাসতে বলল, “তোমার নাম টুপা? বাহ্! একদম ইউনিক নাম। ”

তুয়া একবার রাগী চোখে প্রিয়মের দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনাকে আমি পরে দেখে নিব।”

প্রিয়ম বাঁকা হেসে ওদের ফ্ল্যাটের দরজা দেখিয়ে বলল, “আমাকে যখন দেখতে ইচ্ছে করবে আমার বাসায় চলে এসো, টুপারাণী।”

“আপনি মারাত্মক অসভ্য একটা ছেলে।”

“ধন্যবাদ।”

তুয়া রাগে গজগজ করতে করতে চলে গেল। প্রিয়ম হাসতে হাসতে বাসায় ঢুকে গেল। প্রিয়মকে আজ মোট তিনবার শাওয়ার নিতে হলো। কপাল খারাপ হলে যা হয় আর কি! প্রিয়ম শাওয়ার নিয়ে রান্না করতে গেল। প্রত্যয় আর প্রিয়ম দু’জনেই রান্না করতে পারে। বাসায় মাঝে মাঝে ওরা নিজেরা রান্না করে ওদের আব্বু-আম্মুকে খাওয়ায়। প্রিয়ম ওর আম্মুকে ভিডিও কল করল। ওর আম্মু মিথিলা রায়হান ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, “ছোট রাজকুমার কি রান্না করছেন? আমার বড় রাজকুমার কই?”

প্রিয়ম ফোনটা একসাইডে রাখে, চুলার পাওয়ার কমিয়ে প্যানে থাকা গরম তেলে পেঁয়াজ ছেড়ে নাড়তে নাড়তে বলল, “ভাইয়া হসপিটালে। আমি মাংস আর খিঁচুড়ি রান্না করছি। বাবা এখনো বাসায় ফিরেনি, আম্মু?”

“না! ফোন দিয়ে বলল ফিরতে নাকি রাত হবে।”

“ওহ।”

“তোদের ওখানে কোনো সমস্যা হচ্ছে না তো, আব্বু?”

“না, আম্মু।”

মা-ছেলে কিছুক্ষণ কথা বলে কল কাটল। ওদের আব্বু-আম্মু সামনের সপ্তাহে এখানে চলে আসবেন। মিথিলা ছেলেদের ছাড়া একমুহূর্তও থাকতে নারাজ। উনাদের সব কিছু গুছিয়ে নিতে এক সপ্তাহের মতো লেগে যাবে। তারপর সবাই এখানে এসে সেটেল হবেন। প্রিয়ম গলা ছেড়ে গান গাইতে গাইতে রান্না করতে থাকল। প্রত্যয় কখন ফিরবে তাঁর কোনো ঠিক নেই। আজকেও তাঁকে ওটিতে ঢুকতে হয়েছে। ওর খুব ব্যস্ত সময় যাচ্ছে। সারাদিন সে হসপিটালে থাকে। আবার কখনো কখনো রাতেও বাসাতে ফিরে না। একজন দায়িত্বশীল ডাক্তারের রেস্ট বলে কিছু থাকে না। আর প্রত্যয় নিজের দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার মতো ছেলে নয়। তাঁর যত কষ্টই হোক। প্রত্যয় সর্বদা চেষ্টা করে নিজের দায়িত্বটা সঠিকভাবে পালন করতে।

প্রিয়ম রান্না করে খেয়ে বাকিটা হটপটে তুলে রাখল। ভিডিও কলের মাধ্যমে ওর রাজশাহীর বন্ধুদের সঙ্গে কিছুক্ষণ আড্ডা দিল। সবাইকে সে খুব মিস করছে। সোফাতে টান টান হয়ে শুয়ে সে বেশ কিছুক্ষণ টিভি দেখল। কলি বেলকণিতে বুলি আওড়াতে আছে, সে এখন প্রত্যয়কে ডাকছে। প্রিয়ম কলির ডাকাডাকি শুনে বিরবির করে বলল, “এই ফাজিল পাখিটা আমার কান বয়রা করেই ছাড়বে।”

প্রিয়ম কলিকে বেলকণি থেকে এনে খেতে দিল। কলি এখন ঠুকরে ঠুকরে কাঁচা মরিচ খাচ্ছে। ওর পছন্দের খাবার ঝাল। কলি এখন খাচ্ছে আর একটা বুলি আওড়াচ্ছে, “শুভ রাত্রি! শুভ রাত্রি!”

তুয়া বাসায় গিয়ে প্রিয়মকে ইচ্ছেমতো গালি দিল। সে এই রকম বেয়াদব ছেলে একটাও দেখে নি। আর ওকে ‘টুপা’ বলে ডাকল। ওর এত সুন্দর নামটার ইজ্জত শেষ করে দিল। তুয়াও এর শেষ দেখেই ছাড়বে। তখন ইচ্ছের আম্মু তুয়ার আম্মুকে ফোন করে দু’টো ডিম দিতে বলেছিল। ইচ্ছে নাকি তখন নুডুলস খাওয়ার বায়না ধরেছিল। ওদের ফ্রিজে ডিম ছিল না। তুয়া তখন ইচ্ছেদের বাসায় ডিম দু’টো দিতেই যাচ্ছিল। কিন্তু প্রিয়মের সাথে অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে ধাক্কা গেলে গেল। আর ওই বিশ্রী ঘটনাটা ঘটল। তুয়া রাগে গজগজ করতে করতে বলল, “ব্যাটা বজ্জাত! দাঁড়া, দেখ আমি তোর কি ব্যবস্থা করছি।”

পরেরদিন সকালে তুয়া আর মিতু কলেজ যাওয়ার জন্য বের হলো। প্রত্যয় সারারাত হসপিটালে থেকে তখন বাসায় ফিরছিল। মিতু প্রত্যয়কে দেখে অবাক হয়ে বলল, “স্যার! আপনি এখানে?”

প্রত্যয় হেসে জানাল সে এই বিল্ডিংয়েই থাকে। মিতু একবার তুয়ার দিকে তাকাল। প্রত্যয় মিতুকে পলকের কথা জিজ্ঞাসা করল। খুব ব্যস্ত থাকায় প্রত্যয় পলকের আর খোঁজ নিতে পারেনি। মিতু জানাল পলক এখন সুস্থ আছে। প্রত্যয় মুচকি হেসে বিদায় নিয়ে চলে গেল। তুয়া বলল, “একজন প্রত্যয় আর আরেকজন প্রিয়ম। এরা মনে হয় দুই ভাই হবে, বুঝলি? এই ডাক্তারটা ভালোই তবে উনার ভাইটা আস্ত বেয়াদব।”

মিতু আর কথা বাড়াল না। দু’জনে গল্প করতে করতে কলেজে চলে গেল। তুয়া আর মিতু দু’জনেই ইন্টার দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী।

প্রত্যয় চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করল। প্রিয়ম এখনো ঘুমাচ্ছে, এজন্য প্রত্যয় আর ওকে ডাকল না। হার্টের অপারেশন করা এক পেশেন্টের অবস্থা হঠাৎ করে খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল। এজন্য সে সারারাত প্রায় জেগেই ছিল। ঘুমটা না হওয়ার কারণে ওর শরীরটা খুব ক্লান্ত লাগছে। প্রত্যয় শাওয়ার নিয়ে ফ্রেশ হলো। এরপর রান্না করে খেয়ে নিলো। সারারাত জেগে ছিল বলে রুমে গিয়ে শুয়ে পড়ল।

প্রিয়মের আজ সকাল দশটার সময় একটা প্রোগ্রাম আছে। কালকে রাতে ঘুমানোর আগে সে এলার্ম দিয়ে ঘুমিয়েছিল। তাই সকাল পৌণে নয়টার দিকে উঠে ফ্রেশ হয়ে নিলো। প্রত্যয়কে একটা মেসেজ করে সে গিটার নিয়ে বেরিয়ে গেল। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে প্রিয়মের ইচ্ছের সাথে দেখা হলো। ইচ্ছে প্রিয়মকে দেখে মুখ ভেংচি দিয়ে চলে গেল। প্রিয়ম মনে মনে বলল, “এই বিল্ডিংয়ের সব মেয়ে গুলোই এমন বারুদ নাকি!”

একসপ্তাহ পরে প্রিয়মের আব্বু-আম্মু প্রত্যয়ের ফ্ল্যাটে চলে আসলেন। মিথিলা রায়হান এসেই আগে দুই ছেলেকে জড়িয়ে ধরলেন। বাসাটা এবার যেন প্রাণ পেল। মা ছাড়া বাসাটাও যেন এতিম হয়ে গিয়েছিল। উনারা আসার সময় অনেক আসবাবপত্রও এনেছেন। সেই আসবাবপত্র দিয়ে ফ্ল্যাটটাকে আরো পরিপাটি করে সাজালেন। প্রিয়ম ওর বাইক পেয়ে গেছে। ওকে আর পায় কে, সে ছুটল পুরো শহর ঘুরতে। সে এখানে থেকে মাস্টার্স কমপ্লিট করবে। সে সুবাদে ওর ব্যাচের কয়েকজন বন্ধুও জুটে গেছে। প্রত্যয় অর্ধেক বেলা বাসায় আছে। সে ওর আম্মুর কোলে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। ওর আম্মু ছেলের চুল টেনে দিতে দিতে বললেন, “আব্বু, প্যারিস থেকে ডাক্তারী পড়া সম্পূর্ণ করে তবেই ফিরলে। তুমি তো এখন যথেষ্ট স্বাবলম্বী। এবার তোমার জন্য মেয়ে দেখি?”

“আম্মু, এত তাড়া কিসের?”

“একটা লাল টুকটুকে বউ আনতে হবে তো। বউ ছাড়া যে বাসা পরিপূর্ণ হয় না।”

“আম্মু, আমি বিয়ে নিয়ে এখন ভাবছি না। আমাকে আর একটু সময় দাও।”

“লক্ষী একটা বউ আনব তোর জন্য। যে আমার রাজকুমারকে চোখে হারাবে, বুঝলি?”

“সে পরে দেখা যাবে।”

প্রত্যয় কথাটা কোনো রকম কাটিয়ে দিল। ওর কেন জানি লজ্জা লাগে নিজের বিয়ের কথা বলতে। তাছাড়া সে এখন বিয়ে নিয়ে ভাবছেও না। সে আরেকটু সময় নিয়ে নিজের জায়গাটা আরো পাকাপোক্ত করতে চায়। বিয়ে মানে কারো সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিজের কাঁধে নেওয়া। তাঁকে সর্বোচ্চ ভালো রাখার চেষ্টা করা। তাঁকে সবদিক থেকে আগলে রাখা। তাই প্রত্যয় চাচ্ছে নিজেকে আগে গুছিয়ে নিতে।

প্রত্যয় দেশে ফিরে নিজস্ব একটা হসপিটাল তৈরী করেছে। এই হসপিটালের ইঞ্জিনিয়ার ওর বাবা ইশতিয়াক রায়হান। ছেলের স্বপ্ন পূরণের জন্য উনি সবটা নিজে হাতে করেছেন। প্রত্যয় নিজের হসপিটাল ছাড়াও কয়েকটা হসপিটালে কার্ডিওলজিস্ট হিসেবে সেবা প্রদান করে। সে খুব অল্প সময়ের মধ্যে বেশ ভালো পরিচিতি লাভ করেছে। বিশেষ করে ওর চিকিৎসা, মার্জিত ব্যবহার আর বিনয়ী কথা বার্তার মাধ্যমে। প্রিয়ম একটু চঞ্চল টাইপের হলেও প্রত্যয় একদম শান্ত স্বভাবের। সে ওর কথার মাধুর্যতা দিয়ে মানুষের মন কাড়তে সক্ষম হয়।

তুয়ার আম্মু ইচ্ছেদের বাসায় যাচ্ছিলেন। প্রত্যয়ের আম্মুকে দেখে উনিই আগে কথা বললেন। কথা বলতে বলতে দু’জনে নিচে গেলেন। তুয়ার আম্মু প্রত্যয়ের আম্মুকে অনেকের সাথেই পরিচয় করিয়ে দিলেন। একই বিল্ডিংয়ে যখন থাকবেন তখন সম্পর্কটাও ভালো হওয়া প্রয়োজন।

কলেজ থেকে ফেরার পথে তুয়ার সামনে প্রিয়ম বাইক থামাল। হঠাৎ এমন করাতে তুয়া ভয়ে দুই পা পিছিয়ে গেল। রিকশা না পাওয়াতে কড়া রোদের মধ্যে সে হাঁটছিল। রোদের প্রখর তাপে ওর মেজাজ খিটখিটে হয়ে আছে। তাঁর মধ্যে প্রিয়মের এই কাজে ওর রাগে যেন উচ্চ মাত্রায় বেড়ে গেল। প্রিয়ম ঠোঁটে কোণে বাঁকা হাসি রেখে ফুটিয়ে বলল, “কি গো টুপা! এ কি অবস্থা তোমার?”

“আমার সামনে এসে এভাবে বাইক থামালেন কেন?”

“ভয় পেলে বুঝি? আহারে বাচ্চা মেয়েটা ভয় পেয়েছে। আমার জানামতে এভাবেই বাইক থামাতে হয়।”

“আমাকে শিখাতে এসেছেন?”

“তুমি শিখলে আমার শিখাতে সমস্যা নেই।”

তুয়া প্রিয়মের দিকে তাকাল। প্রিয়ম তুয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। তুয়া মুখের ঘামটা মুছে বলল, “চলুন বাইক নিয়েই একটা বাজি হয়ে যাক।”

To be continue….!!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here