রোদেলা
লেখক: মাহাবুবা মিতু
পর্ব: ৩
দেখতে দেখতে বিয়েটা হয়ে গেলো সুন্দর ভাবে। দুজনকে খুব সুন্দর মানিয়েছে। মাশাল্লাহ….!
যে কেও দেখলে মন ভরে দোয়া করবে এমন এক জুটি আল্লাহ তৈরী করে দিয়েছে। মন ভরে দোয়া আসলো ওদের জন্য রোদেলার। রোদেলার মা ভীষণ ব্যস্ত সময় পার করছে বিয়ে উপলক্ষে। নাতাশার শ্বশুরবাড়ীতে পাঠানোর জন্য নানান রকম পিঠা তৈরী চলেছিলো বিয়ের চারদিন আগ থেকে। বড় মামা বিয়ে উপলক্ষে একটা সুন্দর শাড়ি কিনে দিয়েছেন তার জন্য। তিনি কাজে এতই ব্যাস্ত যে নিজে যে তৈরী হবে সে সময় তার নেই। রোদেলা তাকে তৈরী করে দিতে চাইলো। সুন্দর করে শাড়িটা পরিয়ে তার গহনা গুলো পরাতে চাইলো। তার এত সময় নেই সাজগোছ করার, কত কাজ পরে আছে। অথচ বড় মামী সেই সকাল থেকে নাতাশার সাথে পার্লারে। তার ব্যাস্ততা দেখে মনে হচ্ছিল যেন তাঁরই মেয়ের বিয়ে।
কোনমতে শাড়িটা পরলো, চুলগুলো খোঁপা করলো একটা। রোদেলা তার মাকে জোর করে বসিয়ে চুলগুলো আঁচড়ে দিলো। শাড়িটার কুচি গুছিয়ে দিলো, ওর মা তো ওকে বকছে, কি শুরু করে দিছিস, বুড়া কালে কুহারা, কে দেখতে আসবো আমারে, কত কাজ পরে আছে। গয়নার বক্স থেকে লম্বা বল চেইনটা পরিয়ে দিলো। আজ প্রথমবার অন্য রকম এক মাকে আবিষ্কার করলো রোদেলা। এখন ওর মা যেসব বকাবকি করছে এগুলো কপট রাগ। তিনিও চান তাকে কেও জোর করে সাজিয়ে দেক, কেও তার খোঁজ রাখুক, তার যত্ন করুক। কিন্তু তার কপালটা তো পোড়া। এত সুন্দর একটা মানুষের জীবন কত অসুন্দরে মোড়ানো। বিয়ের দিনকার ঘটনাটা রোদেলাকে অনেক ভাবালো। একটু একটু কষ্ট হতে শুরু করলো মায়ের জন্য।
পরদিন বৌভাত অনুষ্ঠানে যাবার জন্য সবাই তৈরী হচ্ছিল। রোদেলা সবাইকে সাজিয়ে দিচ্ছিলো। দুজনকে তৈরী করে দিয়েছে। এখনো ছোট মামী, আর তার বোনকে, ওর মা এসে দেখে যে ও এখনো তৈরী হয় নি।
রোদেলা বলে আমি তো যাবো না মা, ওমনেই তার মাথায় রক্ত উঠে গেলো। সবার সামনেই এত বড় মেয়েকে চুলে ধরে মারা শুরু করলো। ওখানে থাকা সবাই হতভম্ব হয়ে গেলো। এমন সব বিশ্রী কথা বললো রোদেলা লজ্জা পেলো। কারন মামীর বোন বাইরের মানুষ তিনি কি ভাববেন…? কেও ওকে আর জিজ্ঞেস করলো না যে কেন যাবে না..?
ও কোন কথাই বললো না, ওর মাকে ছোট মামীর বোন বললো আপা আপনি যান আমরা রোদেলাকে রাজী করছি…..
বলে ঘর থেকে বের করে দিলো।
ছোট মামী বললো যাও তো তুমিও রেডি হও….?
ও কোন উত্তর দিলো না। চুপ করে রইলো। কি উত্তর দিবে ও। যে সমস্ত কথা তিনি বলেছিলেন নাশতা দিতে যাওয়ার জন্য। ঘৃণায় ও তখনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, যাবে না কখনো ওদের সামনে। গতকাল বিয়ের সময়ও এদিক সেদিক ব্যাস্ত ছিলো। বিয়ের আসরের থেকে দূরে দূরে।
ওদের মনের কষ্ট, অভিমান এসবের কোন দাম নেই কারো কাছে। এই জীবণটা কেটে গেলো অন্যের চাপিয়ে দেয়া সিদ্ধান্ত মাথা পেতে নিতে নিতে। এসব কোন ব্যাপার না এখন ওর কাছে। আগের মতো আর কষ্ট হয় না ওর। সবাই কেমন মিইয়ে গেলো। কিন্তু ও সবাইকে মন মতো সাজিয়ে গুছিয়ে দিলো। কিন্তু ও মনে মনে শক্ত করে প্রতিজ্ঞা করলো- যত যাই হোক আমি যাবো না….
বিকাল সাড়ে তিনটা বাজে, সবাই গাড়িতে অপেক্ষা বাড়ির মেয়ে বৌদের জন্য করছে। কিন্তু রোদেলা শেষ পর্যন্ত গেলো না। ওর মা ও গেলো না শেষ পর্যন্ত। তার মুখ থমথমে। এরকম মাকে রোদেলা খুব চেনে। ও ভালো করে জানে মার ভিতরে এখন অপরাধবোধ কাজ করছে এমন পরিস্থিতি তৈরী করার জন্য, এমনকি আজ রাতেও সে খাবার খেতে পারবে না। সব সময়ই এমনটা হয়। কিন্তু এ অনুতাপের কি দাম আছে…? তিনি জানতেও পারছে না দিনে দিনে মা মেয়ের দূরত্ব বাড়ছে আলোর গতিতে….
পুরো বাড়িতে রইলো রোদেলা, ওর মা আর ওর নানু। যার মেয়ের বিয়ে সেও সেজেগুজে গিয়েছে মেয়ের বৌভতে।
রোদেলা নিজেকে ব্যাস্ত রাখলো। ঘরদোর সব গুছগাছ করে রাখলো। রোদেলার মা গেলো রান্নার আয়োজন করতে। এটাই হয়তো মনের কষ্ট ভুলে থাকার উপায়।
রোদেলার বোন প্রিসিলার সামনে এসএসসি পরীক্ষা। ওর তেমন উচ্ছাস নেই বিয়ে উপলক্ষে। সবসময় সিরিয়াস পড়াশোনা নিয়ে। যদিও বাধ্য হয়ে গিয়েছিল নাতাশার বৌভাতে। কারন রোদেলা যায় নি, প্রিসিলাও যদি না যেতো তাহলে ওদের মা ঘরে আগুন লাগিয়ে দিতো। তাই বাধ্য হয়ে এই যাওয়া।
রাত নয়টা নাগাদ বর-বৌ এসে হাজির। নাতাশার সাথে ওর ছোট ননদ এসেছে। রোদেলা রান্নাঘরের কাজেই ব্যাস্ত রাখলো নিজেকে। নাতাশা এসে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো ওকে। গহনা, শাড়ি পরা এক মুর্তি ওকে যেন আবিষ্ট করে ফেললো। এক গাল হাসি নিয়ে মুখ ঘুরিয়ে দেখে নাতাশা। ও ও পরম মমতায় জরিয়ে ধরলো নাতাশাকে। নিজেকে ছাড়িয়ে হাত টেনে নিয়ে গেলো বরের কাছে। ওকে নাকি নাতাশার বর দেখেই নি। পরিচয় করিয়ে দিলো রেদেলাকে। নাতাশার এসব বাচ্চামি দেখে সবাই হাসছে। অথচ এমন একটা কান্ড ও যদি করতো কেও কিছু বলতো না ওর মা-ই ওকে বকতো।
নাতাশা পরিচয় করিয়ে দিলো রোদেলাও হাসিমুখে সালাম দিয়ে কেমন আছেন, বাসার সবাই কেমন আছে এ ধরণের কথা বলে সেখান থেকে চলে আসলো। নাতাশাও ওর পিছুপিছু রান্নাঘরে আসছে…
রোদেলা বললো
তুই যা উনার কাছে, উনি একা বসে আছেন, কাউকে তেমন চিনে না ভালো করে। উনার অস্বস্থি লাগবে। কে শোনে কার কথা। নাতাশা ব্যাস্ত ঐ বাড়ির গল্প বলতে….
রোদেলা ওর দিকে তাকিয়ে মনে মন ভাবলো -এটা বাচ্চামি নাকি বোকামি….
নাতাশার গল্পই শেষ হয় না, কে ফুফু, কে খালা, সবাই নাকি দেখতে একইরকম। সকালে উঠে ব্যাগ খুজে না পেয়ে রান্না ঘরে ওর বড় ননদের ঘরে গিয়ে বলছে –
আপা আমার ব্যাগটা খুঁজে পাচ্ছি না, আমাকে একটু সাহায্য করবেন খুঁজে পেতে…?
মেয়েটি পেছন ঘুরে আমার গাল টেনে বলে, বোকা মেয়ে আমি তেমার ফুফু শ্বাশুড়ি….. কি যে একটা অবস্থা আপা তোকে কি বলবো…
আবার কি হলো শোন – রাতে সবাই যখন আমাকে দেখতে এলো আমার শ্বাশুড়ি বললো বৌ সালাম করো। তিনি একজন একজন করে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। সবাইকে আমি সালাম করলাম। সবাই আমার হাতে টাকা গুঁজে দিচ্ছে। আমি শ্বাশুড়ির দিকে তাকালাম তিনি ইশারায় নিতে বললেন। সালাম করতে করতে আমি ওদের বাড়ির বুয়াকেও সালাম করে ফেলেছি… ওর কাজিনরা হেসে গড়াগড়ি খাওয়ার অবস্থা। আমি কিছু বুঝিনি প্রথমে। বুয়া আমাকে তুলে দৌড়ে চলে গেলো মনে হলো। কল্লোল আমার পাশে এসে দাড়িয়ে বললো উনি রহিমা খালা, মার সাহায্যকারী, তাই ওরা হাসছে..
একটু পরে দেখি রহিমা খালা একশ টাকার একটা নোট দিলো আমাকে… আমি নিতে চাই নি, কল্লোল এগিয়ে এসে বললো নাও খালা ভালোবেসে দিলো…
রোদেলা বললো যাক প্রথম দিন ভালোই গেলো তোর। এখন এই চা নিয়ে ভাগ এখান থেকে। মা এসে দেখলে তোকে তো বকবেই সাথে আমাকেও….
যা পরে শুনবোনি বাকী কথা….
Previous :
https://www.facebook.com/659404701187391/posts/1469263916868128/
Next
https://www.facebook.com/659404701187391/posts/1477214669406386/