অনুভূতিরা মৃত পর্ব চৌদ্দ .

0
196

গল্প- অনুভূতিরা মৃত
পর্ব চৌদ্দ
.
মুগ্ধতা ছুঁয়ে যায় তাকে তা বুঝতে পারে মিহি। ছোট করে মিহি বলে।
— একটা প্রশ্ন করতে পারি?
উত্তর দেয় রুয়েল।
— একটা কেন, অসংখ্য প্রশ্ন করো।
— একটাই প্রশ্ন করব এবং আশা করি উত্তর দিবে।
— সমুদ্রের বিশালতায় দাঁড়িয়ে তোমার হাজারও প্রশ্নের উত্তর দিতে প্রস্তুথ। সুযোগটা কাজে লাগায় মিহি। প্রশ্ন করে সে, আচ্ছা তোমার অনুভূতিরা মৃত কেন? মূহুর্তেই চুপসে যায় রুয়েল। এটা কী প্রশ্ন? কী দিবে এই প্রশ্নের উত্তর। আদৌও এই প্রশ্নের কোন উত্তর আছে, ভাবতে থাকে রুয়েল। মাথায় চিন্তার ভাজ পড়ে, মিহি পুনরায় প্রশ্ন করে। নিরবতা ভেঙ্গে রুয়েল উত্তর দেয়। কথা দিয়েছি বলব তবে এখন না। অপেক্ষা করতে হবে কয়েক ঘণ্টা। রাত বারোটার পর আমার রুমে আসবে তোমার সকল প্রশ্নের উত্তর পাবে।
.
সমুদ্রের বিশালতা, সচ্ছ নীল আকাশের প্রতিবিম্ব সমুদ্রের পানিতে মিশে গিয়ে রূপ নিয়েছে নীল সমুদ্র।নীল প্রিয় রুয়েল। নীল নিয়ে তার অদ্ভুত সব চিন্তাভাবনা। একবার তো মাকে বলেছিলেন, নীল মেয়ে ছাড়া বিয়েই করবেন না। মা প্রচুর হেসেছিলেন। আজকে নীল সমুদ্র তাকে ভাবাচ্ছে, এই নীল সমুদ্র নাকি হয়ে যাবে সবুজ। ব্রিটেনের সাউথাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক দল গবেষক বলেছেন, পৃথিবীর নীল সমুদ্র এক সময় সবুজ হয়ে উঠবে। চলতি শতকের শেষ দিকেই স্পষ্ট হতে থাকবে সবুজ সমুদ্র। নেচার পত্রিকায় প্রকাশিত এই গবেষণাপত্রটি। তবে কি আমাদের নীল গ্রহ ক্রমে সবুজ গ্রহে পরিণত হতে চলেছে! কিন্তু কেন? এর প্রভাব কী পৃথিবীর জন্য মঙ্গলজনক হবে? এসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় গবেষণাপত্রটিতে। গবেষক দলটির অন্যতম সদস্য আনা হিকম্যান বলেছেন, সুমুদ্রের জলে থাকা শৈবালকণা ফাইটোপ্লাংটন সবুজ। এরা ডাঙার সবুজ গাছেদের মতোই সুর্যের আলোকে ব্যবহার করে খাবার তৈরি করে। যেখানে এদের সংখ্যা কম, সেখানে সাগরের জল নীল। যেখানে বেশি, সেখানে সবজেটে। যার ফলে সুমুদ্রের তলদেশের পরিবেশটাই বদলে যাবে। তৈরি হবে অজানা পরিস্থিতির। সেই বদলটা মানুষের তথা পৃথিবীর প্রাণীকুলের পক্ষে ভালো নাকি খারাপ- সেটা নিয়ে রায় দেওয়ার সময় অবশ্য আসেনি। তবে পরিবর্তনটা রাতারাতি নয়, হচ্ছে ধীরে। এমনটা যদি হয় তাহলে আগামী প্রজন্ম বুঝবে না নীল সমুদ্রের বিশালতা।
.
টুপটুপ করে সূর্য ডুবে যেতে যেতে বসল। এরপর হলুদ, কমলা, বেগুনি, নীল আলো রেখে গেলো আকাশজুড়ে, ভয়ংকর রকম সুন্দর লাগছিল তখন। এ যেন সমুদ্রকে আপন করে পাওয়া। অতি শুষ্ক মানুষটিও এই পরিবেশে রোমান্টিক হতে বাধ্য রুয়েলও তার ব্যতিক্রম নয়। ফেইসবুক লগিন করে সে পোস্ট করে। একটা নীল শাড়ি পরে আমার সাথে সূর্যাস্ত দেখবে? সূর্যটা ডুবে গেলে হাত ধরে হাঁটব। সূর্যাস্তের পর পর রাতের আঁধার নেমে আসে। ঘড়ির কাটা বাড়তে থাকে, মিহির অপেক্ষা কমতে থাকে, রাত যত গভীর হয় মিহির আগ্রহ ততো বেড়ে চলে৷ বেড়ে চলে অজানা সব প্রশ্নের খুঁজে। ঘড়ির কাটা তখন ঠিক বারোটা৷ এগিয়ে চলে মিহি। দরজায় নক করতেই খুলে যায়। রুমে প্রবেশ করতেই দেখা মিলে মোমবাতি জ্বালিয়ে বসে আসে রুয়েল সাথে সাজানো জন্মদিনের কেক। অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে আছে মিহি। আজকে কার জন্মদিন? আশেপাশে খুঁজেও উত্তর মিলেনা তার। মিহি বলে– আজ কার জন্মদিন? নিশ্চুপ রুয়েল। কেক কেটে দিয়াশলাই দিয়ে আবারও মোমবাতি জ্বালিয়ে নিলো। এখন মনে হচ্ছে, আজ কারো মৃত্যুবার্ষিকী! কিন্তু কার? এসব পাগলামো কেন করছে, উত্তেজিত হয়ে মিহি বলে।
— এত রাতে এসব কী শুরু করেছো? আমি এখানে আসছি এর পিছনের ঘটনা জানতে, এসব দেখতে নয়।
.
বেদনায় সিক্ত রুয়েল। নিরবতা ভেঙ্গে বলতে শুরু করে। সময়টা তখন কলেজ জীবন। আমার জীবনেও প্রেম এসেছিল। বসন্তের প্রথম দিনে কলেজের লাইব্রেরিতে পড়ছি জীবনানন্দ দাসের বিখ্যাত বনলতা সেন। চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা, মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য, অতিদূর সমুদ্রের পর হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর, তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে, বলেছে সে, ‘এতোদিন কোথায় ছিলেন? পাখির নীড়ের মত চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন। মূহুর্তেই নজর কাড়ে আমার এক অষ্টাদশ তরুণী। কালাে চুল, লাল শাড়ী, হাতের নীল চুড়িতে অপরূপা এক তরুণী। আমি মুগ্ধ। প্রথম দেখায় মুগ্ধ। প্রথম দিনে তার হাতের চুড়ির শব্দ। পায়ে নুপুরের শব্দ আজও আমার কানে বাজে। মেয়েটা ঠিক যেন আমার কল্পনার রাজকন্যা। মেয়েটার নাম দিয়েছিলাম বনলতা। আমার কল্পনার বনলতা।
.
কাকতালীয় ভাবে মেয়েটার নাম আমার দেওয়া নামের সাথে মিলে যায় বনলতা। প্রকৃত অর্থে তার নাম ছিল বনলতা। বসন্তের প্রথম দিনে কলেজের ফাংশনে বনলতার পা দুলানাে নৃত্য, আজও আমার মনের স্মৃতিকোটায় বারবার খুঁজে ফিরি। তার সেই নৃত্যে আজও আমি মাতাল। ফেইসবুকে তার ছবিতে হা করে চেয়ে থাকতাম। উপমা দিতাম, সৃষ্টিকর্তার নিজ হাতে গড়া পৃথিবীর সবেচেয়ে সুন্দরীর নাম বনলতা সেন। কখনও কলেজের ক্যান্টিনে, কখনও কলেজ গেইটের সামনে চশমার ফাক দিয়ে আড় চোখে তাকিয়ে থাকা। কখনও কালাে বল পয়েন্টে লেখা আমার অসুন্দর হাতের চিঠি বনলতার ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখা। আমার কাছে ভালােবাসা ঠিক ততােক্ষণ সুন্দর, যতক্ষণ না আমাদের পছন্দের মানুষকে ভালােবাসার কথা বলতে না পারি। আমিও দিনের পর দিন সুন্দর ভালােবাসাকে দেখে যেতাম কিন্তু কখনাে বলতে পারতাম না। বলেই কি হবে? ভয় হতাে, বললেই এই বুঝি শেষ। মুখ ফুটে বলতে না পারায় আশ্রয় নিলাম চিঠির। আমি তখনও জানতাম না বনলতার নাম। কী তার পরিচয়। এমনকি তার বাসার ঠিকানা। বড় একটা চিরকুটে ছােট করে লিখলাম। বনলতা তুমি আমার হবে কি, বনলতা তুমি আমায় ভালবাসবে কি? দুই লাইনের ছােট কথায় লিখে ফেললাম আমার ভালোবাসার কথা। জন মানব শূন্য ক্লাসে তার বইয়ের ভাঁজে ঢুকিয়ে দিলাম চিঠি। এতটুকু পর্যন্ত ঠিক ছিল তবে ভাগ্য সহায় ছিল না। বইয়ের নড়াচড়ায় হারিয়ে যায় চিঠি, কাকতালীয় ভাবে আমার কাছেই পৌঁছে সেই চিঠি।
.
মিটমিট করে হাসছিলাম। আগে কখনো এমন ভাবে হাসতাম না। প্রেমে পড়লে বুঝি এভাবেই হাসে। আমার হাসি বেশি সময় স্থায়ী হলো না। অনেক কষ্টে বনলতার বাসার ঠিকানা বের করি। এরপর থেকে প্রায় তার বাসার আশেপাশে দেখা যেতো আমায়। দিনটি ছিল শনিবার। কয়েকজন মহিলার সাথে বের হয়েছে বনলতা। হাতে তালা, নানান রকম ফলমূলে সাজানো। কোথায় যাচ্ছে সে? পিছু নিলাম তার। মিনিট দশেক পর এসে থামল মন্দিরের কাছে, নিজের চোখকে সেদিন অবিশ্বাস হয়েছিল। থালা হাতে পূজা দিচ্ছে বনলতা। সেদিনই প্রথম জানতে পারি হিন্দু ধর্মের মেয়েটি সেন বাড়ির ছোট মেয়ে বনলতা সেন।
.
চলবে……………
— সাকিব হাসান রুয়েল

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here