#ধারাবাহিকগল্প
#কলঙ্কের বোঝা
পর্ব-পাঁচ
মাহবুবা বিথী
অতঃপর সেজান ওর মা বাবাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে শায়লাকে বউ করে আনতে রাজি করালো। আজ শুক্রবার। সেজানের বাবা দুপুরে লাঞ্চ করে ভাতঘুম দেওয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু কিছুতেই ঘুমাতে পারছেন না। বিয়ে নিয়ে মা ছেলের ঠান্ডা লড়াই চলছে। এই কারনে মিজান সাহেবও মানসিক যন্ত্রণায় আছেন।
সেজানের বাবা যেহেতু শিক্ষক মানুষ তাই শায়লাকে চিনতে উনি ভুল করেননি। শায়লা মেধাবী ছাত্রী। সংগ্রাম করা মানুষ। কিভাবে নরম মাটির উপর শক্তভাবে দাঁড়াতে হয় এই টুকু বয়সে শায়লা শিখে গেছে। বাবার পেনশন আর কিছু সঞ্চয়পত্র আর নিজের দুটো টিউশনি দিয়ে অসুস্থ মার চিকিৎসা খরচ, সংসার চালিয়ে নেওয়া নিজের পড়াশোনা সব সুন্দরভাবে সমাধা করছে। এমন মেয়েকে বউ হিসাবে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। সেজানের বাবা মিজান সাহেব সেজানের মাকে নিয়ে একটু টেনশনে আছেন। আজকে আটাশ বছর সেজানের মাকে নিয়ে ঘর করছেন। সেজানের মা সালেহা বেগমকে উনি খুব ভাল করে চেনেন। আর ছেলে মেয়েদের উপর মায়ের প্রভাবটাই বেশী। সালেহা বেগমের ডাকে ভাবনার জগৎ থেকে মিজান সাহেব ফিরে এলেন।
—-কি ঘুমিয়ে পড়লে নাকি?সংসারের সব দায় আমার উপর চাপিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্তে চোখ বন্ধ করে রেখেছো।
—- না ঘুমাইনি। কি বলবে বলো। চোখ বন্ধ থাকলেও কানটা দিব্যি তোমার জন্য খোলা আছে।
—-তুমিতো ছেলেকে একটু বোঝাতে পারতে। একটা এইচএসসি পাশ অল্পবয়সি মেয়ে, বাপের অনেক টাকাপয়সা আছে এরকম ঘর থেকে বউ করে আনলে তাকে নিজের মতো গড়ে পিটে নেওয়া যেতো। ঐ বয়সে একটা মেয়ে কাদার দলার মতো থাকে। বিয়ের সময় নজরানা হিসাবে অনেক কিছু পাওয়া যেতো। তাকে যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে গড়ে নেওয়া যেতো। আর এ হচ্ছে ঝুনো নারিকেল। ওকে তো চালিয়ে নেওয়া কঠিন হয়ে যাবে।
—-শোন সেজানের মা। শায়লাকে চিনতে আমার ভুল হয়নি। ও খুব ভাল মেয়ে। একটু আদর ভালবাসা দিও দেখবে রিমির থেকে ও তোমাকে বেশী ভালবাসবে।
সেজানের বাপের কথাটা সালেহা বেগমের পছন্দ হয়নি। রিমি ওর এক ছাত্রীর বোনকে ভাইয়ের বউ হিসাবে পছন্দ করেছিলো। মেয়েটা এইচএসসি পাশ করে একটা প্রাইভেট ভার্সিটিতে ইংরেজি সাহিত্যে অনার্সে কেবল ভর্তি হয়েছে। বাবারও অগাধ পয়সা আছে। মেয়ের গায়ের রং যেন দুধে আলতা। সব মিলিয়ে সালেহা বেগমের মেয়েটাকে বেশ পছন্দ ছিলো। সালেহা বেগম মনে মনে ভাবছে, “কি হওয়ার কথা ছিলো আর কি হলো”।
সালেহা বেগমের একটু হীনমন্যতাও আছে। তার লেখাপড়ার দৌড় খুব একটা ছিলো না। এসএসসিও পাশ করতে পারেননি। ওনার আসলে পড়ালেখা খুব একটা ভাল লাগতো না। বিয়ে হওয়ার জন্য ঐ টুকু পড়াশোনা অনেক কষ্ট করে পড়েছেন। বিয়ের পর সেজানের বাবা পড়াতে চেয়েছিলো। উনি রাজি হননি। উনার কথা উনি তো আর চাকরি করবেন না সংসার করার জন্য যেটুকু পড়াশোনার দরকার সেটা ওনার ঝুলিতে আছে। সুতরাং উনার আর লেখাপড়ার দরকার নেই। এদিকে ছেলের বউ এতো শিক্ষিত চাকরিজীবি হলে ওকে চালানো সালেহা বেগমের জন্য মুশকিল হয়ে যাবে। আবার ছেলেকেও হাতে রাখতে হবে। ছেলে এখন একলক্ষ টাকা বেতন পায়। ছেলেকে তো চটানো যাবে না। বহু কাঠখড় পুড়িয়ে মিজান সাহেবের এতো অল্প আয় দিয়ে ছেলেমেয়ে দুটোকে মানুষ করেছেন। সুতরাং উনাকে খুব সাবধানে এ জগৎসংসারে পা ফেলতে হবে। যাতে লাঠিও না ভাঙ্গে সাপও মরে।
যদিও জানে সেজান রাজি হবে না তারপরও সালেহা বেগম রিমিকে তলব করলেন। মা মেয়ে মিলে যদি ছেলেকে একটু বোঝানো যায়। শেষ চেষ্টা টুকু করে দেখা যায় লাভ হলে হতেও পারে কোন ক্ষতি নাই।
রিমি ইডেন কলেজ থেকে বোটানিতে অনার্স কমপ্লিট করেছে। এখন একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে মাস্টারি করছে। স্কুল ছুটির পর মোহাম্মদপুর থেকে বাড্ডায় যেতে অনেকটা সময় লেগে যায়। স্কুল ছুটির পর ঐ সময়টায় রাস্তায় অনেক জ্যাম থাকে। বাসায় যেতে যেতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো। টেবিলে ভাত বেড়ে দিয়ে সালেহা বেগম মেয়েকে খেতে ডাকলেন।
—-মা তুমি বাবা খেয়ে নিয়েছো?
—-বেলা চারটা বাজে। তোর বাবা তো আবার ওষুধ খায়। তাই ঠিক সময়ে লাঞ্চ করতে হয়। আমরা দুজনেই দুটোর সময় খেয়েছি।
রিমি খাওয়া শেষ করে ওর মাকে বললো,
—-ভাইয়া অফিস থেকে কটায় বাড়ি আসে?
—ছ,টা বেজে যায়।
—-আমার তো বাড়ি ফিরতে হবে।
—-চিন্তা করিস না। সেজান তোকে উবার ঠিক করে দিবে।
—-মা, তুমি কি মেয়েটাকে দেখেছো?
—-ছবি দেখেছি। সামনাসামনি দেখা হয়নি। দেখ রিমি, আজকে তুই আমি মিলে সেজানকে বুঝানোর চেষ্টা করি।
—-মা আমার মনে হয় না ভাইয়া রাজি হবে। কারণ মেয়ে তো ভাইয়ার মতোই চাকরি করে। বেতনও একই রকম। এদিক থেকে ভাইয়া বিরাট সাপোর্ট পাবে।
—-শোন রিমি, মেয়েটার মা অসুস্থ। সেই খরচ তো মেয়েটাকেই বইতে হবে। আর সেজানের কি সাপোর্ট হবে বরঞ্চ সেজানের টাকা ওর মায়ের পিছনে খরচ করতে হয় কিনা দেখ। এমন সময় ডোর বেলটা বেজে উঠলো। রিমি গিয়ে দরজাটা খুলে দিলো। রিমিকে দেখে সেজান বললো,
—-কখন এসেছিস?
—-চারটার সময়।
—-ভাত খেয়েছিস?
—-হ্যা খেয়েছি। তুমি ফ্রেস হয়ে আসো আমি টেবিলে ভাত বেড়ে দেই।
সেজানের ভাত খাওয়ার পর সালেহা বেগম ছেলেকে বললো,
—-সেজান তুই আমার পছন্দের মেয়েটার কথা আর একবার ভেবে দেখ বাবা।
—-মা,এতো ছোটো মেয়ে বিয়ে করে এনে আমি কি পুতুল খেলবো নাকি ফিডারে দুধ খাওয়াবো?কর্পোরেট সেক্টরে কাজ করছি। টাকাটা এমনি এমনি দেয় না। অনেক প্যারা খেয়ে তারপর টাকাটা হাতে পাই। তারউপর পিচ্চি মেয়ে বিয়ে করে আর এক প্যারার মধ্যে গিয়ে লাইফটাকে হেল করা। তোমার সমস্যা থাকলে এই মূহুর্তে আমার বিয়ে করা দরকার নেই।
ছেলের মেজাজ দেখে সালেহা বেগম আর কিছু বললেন না। রিমিও কোন বিতর্কের মধ্যে না গিয়ে বাবার সাথে দেখা করে বাড়ির পথে রওয়ানা হলো।
পাশের রুম থেকে মিজান সাহেব স্ত্রী পুত্রের কথা শুনতে পেলেন। উনি আর আলোচনায় অংশ নিলেন না। অবসরপ্রাপ্ত স্কুল মাস্টার। ছেলেমেয়েরা বড় হয়েছে। ওদের ভালমন্দ ওরা ভালই বুঝে। আর স্ত্রী সালেহা বেগম বরাবর নিজের বুদ্ধিতে চলেছেন। এখানে কথা খরচ করে লাভ নেই।
অবশেষে সেজানদের বাসার সবাই বিয়েতে মত দিলো। আনুষ্ঠানিকভাবে সেজান ওর বাবা মা সহ বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে শায়লাদের বাসায় গেলো। ওখানে ওরা নিজেরা বসে আক্দ এর তারিখ ঠিক করলো। পরে দুই পরিবার মিলে রিসিপশনের আয়োজন করবে।
আকদ এর দিন সেজান ওর মা বাবা বোন বোনের জামাই রায়হান দুই একজন বন্ধু সহ কনের বাসায় রওয়ানা হলো। কাজি সাহেব বিয়ে পড়িয়ে দিলেন। শায়লাদের বাসা থেকে ওর চাচা ফুফুরা বিয়েতে অংশ নিয়েছে। শায়লার মামারা কেউ এই বিয়েতে আসেনি।
সেজানের মা রিমিকে বলে
—-তোর ভাবিকে নাকফুলটা পড়িয়ে দে। বউ বউ লাগবে।
শায়লার মা বললো,
—-শায়লা নাকফুল পড়তে চায় না। নাকফুল পড়লে ওর হাঁচি হয়।
—-কি বলেন বেয়াইন। বিয়ের পর মেয়েদের নাকফুল পড়া উচিত। এতে স্বামীর মঙ্গল হয়।
মিজান সাহেব বললো,
—-সালেহা এসব মানতে হয় না। এসব মানা বিদআত
শাশুড়ীর কথা শোনার পর শায়লাও কিছু একটা বলতে চাচ্ছিলো। ওর মা ইশারা করাতে শায়লা কিছু বললো না। কিন্তু মনে মনে নবাগত শাশুড়ির উপর রেগে গেলো।
সালেহা বেগমও স্বামীর উপর মনে মনে রেগে গেলেন। সব জায়গায় এই লোকটা ফাউল কথা বলে বেড়ায়।
সেজান ও শায়লার দিকে তাকিয়ে দেখলো শায়লা গম্ভীর হয়ে আছে। এর মাঝে রিমি এসে বললো,
—-ভাবি তোমাকে নাকফুলটা পড়িয়ে দেই।
নাকে হাত দেওয়ার সাথে সাথে শায়লার এতো জোরে হাঁচি হলো নাকফুলটা দূরে ছিটকে পড়ে গেলো। সেজানের মা হায় হায় করে শায়লার মাকে বললো,
—-বেয়াইন নাকফুলটা খুঁজে বের করেন। নাকফুল হারিয়ে যাওয়া ভাল নয়। এতে স্বামীর অমঙ্গল হয়। শায়লা যদিও বা পড়তাে এই অমঙ্গলের কথা শুনে নাকফুল পড়ার ইচ্ছাটা মন থেকে হারিয়ে গেলো।
চলবে