#নয়নতারা
পর্ব ৫২
Suvhan Årag (ছদ্মনাম)
;;;;;
দরজা খুলে বেশ অবাক হলো তানিয়া।মাথার কাপড় টা একটু টেনে দিল।গলা বাড়িয়ে ডাক দিল ফজলে শেখকে।
—-কোথায় গেলেন আপনি?শিগগিরি এদিকে আসুন তো।
ও ঘর থেকে ফজলে শেখ চেঁচিয়ে উওর দিলেন,
—-আসছি।কি হয়েছে কি?এতো চেচাচ্ছো কেন?
—-আসুন না একবার।
ফজলে শেখকে ডেকে তানিয়া দরজা থেকে একটু সরে দাড়ালো।মুখে হাসির রেখা টেনে বললো,
—-লতিফা আপা।কেমন আছেন?
—-এই তো।ছেলের বিয়ে দিয়েছি।বউ দেখাতে এলাম তোমাকে।
—-আমি কাল ই শুনেছি।যাব যাব করে যাওয়া হয়নি।ভেবেছিলাম বিকেলে যাব।আপনারা চলেই এসেছেন।আসুন আসুন ভেতরে আসুন।
লতিফা প্রথমে ঘরে ঢুকলো।তারপর নাফিজ।তারা নাফিজের দিকে তাকাচ্ছে।ঘরে ঢুকতে ইতস্তত বোধ হচ্ছে তার।নাফিজ ইশারায় তারাকে আসতে বললো।তারা ক্রাচ নিয়ে ঢুকছে।তানিয়া বেশ অদ্ভুত ভাবে চেয়ে আছে তারার দিকে।
—-ওমন করে কি দেখছো তানিয়া?
লতিফার প্রশ্ন শুনে পাশ ফিরে তাকালো তানিয়া।
—-এটাই কি তবে নাফিজের বউ?
—-হ্যা ।কেন?
—-এতো পা কেমন,,,।
—-জানি।সব জেনেই ওকে বিয়ে দিয়েছি নাফিজের সাথে।
—-ওহ।চলুন তো আপা।ভেতরে চলুন।
তানিয়া দরজা লাগিয়ে সবাই কে নিয়ে বসার ঘরে বসতে দিল।এর মধ্যে ফজলে শেখ বসার ঘরে আসলেন।সবাইকে দেখে হাসিমুখে কুশল বিনিময় করে নিজেও আরেক সোফাতে বসলেন।
—-নাফিজ,এখন কোথায় পোস্টিং?
—-কাকু যশোরে আছি এখন।
—-ওহ।আচ্ছা আচ্ছা।
ফজলে শেখ কথার মাঝে তারার দিকে ঘনঘন তাকাচ্ছেন।তারা মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে আছে।মাঝে মাঝে মাথা উঠিয়ে ঘরের কোনে কোনে চোখ বুলাচ্ছে।ফজলে শেখের বেশ লাগছে তারার মায়াবী মুখটা দেখতে।
—-তোমার নাম কি মা?
ফজলে শেখের কথায় তারা কিছুটা চমকে গেল।
—-জি।
—-তোমার নাম কি?
—-তারা।
—-বাহ!বেশ ভালো নাম তো।তোমাকে দেখে বড্ড শান্তি লাগছে মা।
ফজলে শেখের প্রশ্নে চমকে গেল তারা।তিনি কি তাকে চিনতে পেরেছে তবে?
—-আমাকে!
—-হুম।মাশাল্লাহ।কি সুন্দর ফুটফুটে একটা মেয়ে তুমি।তোমাদের বাড়ি কোথায়?
—-যশোরেই।
—-ওহ।বাবার নাম কি?
বাবার নাম কথাটা শুনে চুপ হয়ে গেল তারা।ফজলে শেখের দিকে তাকিয়ে আছে সে।মুখটা পুরোপুরি ভুলে যায়নি সে।বাবাই বলে ডাকতো।এতো সহজে কি ভোলা যায়?আবছা হলেও তো মনে আছে।ফজলে শেখের চোখে চশমা।মুখ ভর্তি দাড়ি।দাড়িতে পাক ধরেছে।চুল গুলো র কিছু কিছু অংশ সাদা দেখা যাচ্ছে।
তারার বড্ড ইচ্ছে করছে জিজ্ঞাসা করতে,বাবার নাম কি বলবো?তুমিই তো আমার বাবাই।দেখো তোমার এই সুন্দর চেহারার আড়ালে এরকম একটা নিষ্ঠুর লোক লুকিয়ে আছে কেউ কি জানে?
তারার চাহনি দেখে নিজের মধ্যে কেমন একটা বোধ হচ্ছে ফজলে শেখের।ভাসা ভাসা চোখ।ঘোলাটে চোখের মণি।তার মিষ্টিটার চোখ দুটোর মতো।ঠোঁটের কোনে আবার তিল ও আছে।মিষ্টির মুখটা বড্ড মনে পড়ছে ফজলে শেখের।
—-কিছু বলবে মা?
—-না।
—-ওমন করে তাকিয়ে আছো যে?
—-কিছু না।
নাফিজ আর লতিফা চুপ করে আছে।তাদের কথা বলার সময় এখনো হয়নি হয়তো।
—-তোমার বাবার নাম বললে না যে?
—-আব্রাহাম।সৈয়দ আব্রাহাম।
—-ও।বাবা কি করেন?
—-মেজর।
—-ও।তাই তো বলি নাফিজ যশোরে গিয়েই বিয়ে করে আসলো এতো অল্প দিনে।
এর মধ্যে চায়ের ট্রে নিয়ে চলে এসেছে তানিয়া।চায়ের সাথে বিস্কুট ও এনেছে।সবাইকে চা দিয়ে তারার সামনে চা ধরলো তানিয়া।
—-নেও মা।
—-জি।
চায়ের কাপ হাতে নিয়ে তানিয়াকে অদ্ভুত ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে তারা।কি সুন্দর ব্যবহার,চুপচাপ একটা ভদ্র মহিলা।অথচ এই মহিলা দা নিয়ে তাকে তাড়া করেছিল।এই মহিলার জন্য ই আজ তারা নিজের পায়ে ঠিক মতো দাঁড়াতে পারে না।হারাতে হয়েছে তারাকে নিজের শৈশব টা।
তানিয়া নিজে একটা কাপ নিয়ে ফজলে শেখের পাশে গিয়ে বসলো।
—-তোমার পায়ে কি হয়েছে?জন্ম থেকেই এমন নাকি?
তারা কি উওর দেবে?তারা নাফিজের দিকে অসহায় ভাবে তাকিয়ে আছে।তারার চাহনি দেখে নাফিজ বললো,
—-এক্সিডেন্ট এ এমন হয়েছে কাকিমা।
—-ওহ।তাও ভালো মায়ের সন্তান মায়ের কোলে আছে।মা ডাক শোনার জন্য হলেও মায়ের কোলে সন্তান থাকাটা ভাগ্যের।সবাই তো আর,,,।
থেমে গেল তানিয়া।কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে তার।আবেগে চোখেই পানি চলে এসেছে তার।ফজলে শেখ খেপে গেলেন এটা দেখে।
—-থামবে তুমি!নিজের দোষে সব হারিয়েছো।এখন এই ন্যাকা কান্না বন্ধ করো।
—-দোষ তোত শুধু তানিয়ার একার নয় ফজলে ভাই।আপনি কি বাবা হয়ে পেরেছিলেন ঐ টুকুন বাচ্চাকে আগলে রাখতে?মা মরে গেছে।তাতে কি হয়েছে?আপনি কি পারতেন না মিষ্টির মা বাবা দুটোই হয়ে উঠতে!
—-থাক না ভাবী।আর কতো?পাপের শাস্তি তো পাচ্ছি আমি।
—-থাক বললেই সব কিছুর সব সমাধান হয়ে যায় না ফজলে ভাই।আজ আপনার জন্য তানিয়ার জন্য আপনাদের দুজনের কাছে যেটা সামান্য ভুল ছিল সেই সামান্য ভুল টা ঐদিন ছোট্ট মিষ্টিটার জীবন থেকে কত কিছু কেড়ে নিয়েছে জানেন আপনি?হয়তো জানে বেচে গেছে।আল্লাহ বাচিয়ে রেখেছে ওকে।কিন্ত ও কি পেরেছে একটা সুস্থ সাধারণ জীবন যাপন করতে?পেরেছে?আপনাদের সামান্য ভুলের জন্য ঐটুকুন বাচ্চাটা আজীবন ধরে ভুগে যাচ্ছে।
লতিফার কথা শুনে ফজলে শেখ তানিয়া দুজনেই দুজনের দিকে তাকালো।দুজনেই বড্ড উতলা হয়ে উঠেছে।
—-আপা।আপনি কিভাবে জানলেন মিষ্টি বেচে আছে?আপা আপনি কি ওর খোঁজ পেয়েছেন ?আপা বলুন না।
—-পেয়েছি শুধু তাই না কাকু।মিষ্টিকে সাথে করেই আজ এই বাড়িতে পা রেখেছি আমি।নাহলে মিষ্টি হারিয়ে যাওয়ার পর আপনাদের বাড়িতে আজ অবধি কখনো পা রাখিনি আমি।
নাফিজের কথা শুনে অবাক হয়ে গেল দুজনেই।তানিয়া ফজলে শেখ দুজনেই একবার নাফিজের দিকে তাকাচ্ছে একবার লতিফার দিকে।দুজনের নজর গেল এবার তারার দিকে।মায়াবি মুখটা বড্ড টান ছিল ফজলে শেখকে।তানিয়ার ও যে বড্ড চেনা মনে হচ্ছিল।শত হলেও ঝাটা লাথি দিলেও কটাদিন তো মিষ্টি তার কাছেই থেকেছে।
তারার ছলছল দৃষ্টি,দৃষ্টি ভরা ক্ষোভ,যন্ত্রনা সব কিছু ভেসে উঠেছে চোখ দুটো তে।
;;;;;
কান্নায় ভেঙে পড়েছে তানিয়া আর ফজলে শেখ।তাদের দুজনের নিষ্ঠুরতা আজ যে মিষ্টিকে কোন অবস্থায় ফেলেছে।
নাফিজ আর লতিফার সব কথা শুনে মুখ লুকানোর জায়গা খুঁজে পাচ্ছে না দুজনে।ফজলে শেখ চোখ মুছে উঠে দাঁড়ালো।তারা চুপচাপ মাথা নিচু করে বসে আছে।তার চোখে পানি নেই।সে অনেক বেশিই পেয়েছে জীবনে তার পাওনার থেকে।ফজলে শেখ তারার কাছে ছুটে গেল।
—-আমার মিষ্টি মা।
তারা দূরে সরে বসলো।
—-খবর দার।আপনি একদম আমার কাছে আসবেন না।
—-এমন করে বলিস না মা।তোর জন্য কতো কেদেছি এতোগুলো বছর।একবার বাবাই বলে ডাকবি না?
—-কিসের বাবাই?কে বাবাই?আমার বাবা একজন।সে আমার বাপি।মেজর আব্রাহাম।আর একজন ছিলেন।যিনি জন্মদাতা।তিনি সেদিন ই আমার কাছে মরে গেছেন যেদিন সবকিছু হারিয়েছি আমি।দু মুঠো ভাতের জন্য ও হাত পেতেছি। তাও কার কাছে!যে কিনা আমার বাবা হয়!আমার মা দুজন।একজন যিনি মারা গেছেন।আর একজন ডা মাহমুদা ।এরাই আমার মা বাবা।আর কেউ নেই আমার।আর এখন এই বাড়িতে আমার পরিচয় আমি নাফিজের স্ত্রী হয়ে এখানে এসেছি।মা চলো।ক্যাপ্টেন চলুন।আর থাকতে চাই না আমি এখানে।
তানিয়া দৌড়ে গিয়ে তারাকে জড়িয়ে ধরলো।
—-আমাকে ক্ষমা করে দে মা।ক্ষমা করে দে।আর শাস্তি দিস না।দেখ জীবনে মা ডাকটাই শোনা হলো না আমার।
তানিয়া কে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল তারা।নিজেও ক্রাচ নিয়ে উঠে দাঁড়ালো।
—-কিসের ক্ষমা?আমি কি বুঝতাম বলতে পারেন আপনি?কি দোষ করে ছিলাম আমি?আমার মা ছিল না।কখনো কি দেখতাম আপনাকে সৎ মায়ের চোখে ?আরে মা সৎ নাকি আপন কি বুঝতাম আমি?মা ই তো ডাকতাম।একটু মায়া হতো না?আজ আপনার জন্য আমি নিজের পায়ে ঠিকমতো দাঁড়াতে পারিনা।কয়েক বছর আগে তো এখন যা আছি সেটাও পারতাম না।হুইল চেয়ারে বসে থাকতে হতো আমাকে।দৌড়ে দৌড়ে বেরিয়েছি এক সময়।আর আজ?আপনার ক্ষমা চাওয়াতে কি ফিরে পাব আমি আমার সব কিছু?
তানিয়া নিঃশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।চোখের পানি ফেলা ছাড়া আজ আর তার কিছুই করার নেই।
ফজলে শেখ এগিয়ে গিয়ে তারার হাত ধরলো।
—-আমাকে ক্ষমা করে দে মা।তুই বল এক্ষুণি এই তানিয়া কে আমি বাড়ি থেকে বের করে দেব।
ফজলে শেখের থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিল তারা।
—-কাকে তাড়াবেন?এনাকে?আজ এতো তাড়ানোর কথা বলছেন।এতোই যদি বাবার দায়িত্ব বোধ থাকতো আজ কেন আমি এখানে?কেন ঐরকম ঘটনার শিকার হতে হয়েছিল আমাকে?আপনারা কেউ হন না আমার।আপনাদের ক্ষমা করার মালিক একমাত্র আল্লাহ।তার কাছে কি জবাব দেবেন সেটা তৈরী রাখবেন।আমার মা না হয় অকালে ছেড়ে গেছিল আমাকে।আমার কি বাবা ছিল না?আপনাদের সাথে বিন্দুমাত্র কথা বলতে চাইনা আমি। আজ আমার সব আছে।পরিবার স্বামী সংসার সব।আমি আজ খুব সুখে আছি।আপনাদের মতো লোকের নিষ্ঠুরতা আমাকে শেষ করতে পারে নি।হ্যাঁ সব মিষ্টির জীবন টা তারার মতো হয় না।সবাই মেজর আব্রাহাম ডা মাহমুদা র মতো মা বাবা পায় না।কোনো কোনো মিষ্টি হারিয়ে যায় পৃথিবী থেকে,নয়তো পথে ভিক্ষা করে,পাচার হয়ে যায়,শিকার হয় জানোয়ারদের।আলহামদুলিল্লাহ।আমি অনেক ভালো আছি।অনেক।
তারা চোখ মুখে সরে দাড়ালো।
—-মা।তুমি আমার মায়ের ছবিটা আমাকে এনে দিতে পারবে?আর আমার ছোট বেলার সব ছবি।এখানে যা আছে।আমার কোনো স্মৃতি এই বাড়িতে থাক আমি তা চাই না।
—-চল।
লতিফা এই বাড়ির সবকিছুই মোটামুটি চেনে।কতবার আসা যাওয়া হতো তার।তারাকে নিয়ে খুঁজে খুঁজে একটা শো কেসের মধ্যে কয়েকটা ছবি পেল।রাহেলা বেগমের ছবিও ছিল সাথে।
—-কাকিমা তোকে বড্ড ভালোবাসতো রে।তুই হারিয়ে যাওয়ার পর মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়ে।বেশিদিন আর তার এই পৃথিবীতে থাকা হলো না।
—-দাদীমার ছবি গুলো ও নিয়ে চলো।
ঘর গুলো খুটিয়ে খুটিয়ে নিজের সব কিছু নিয়ে নিল তারা।তানিয়া ফজলে শেখ অনেকবার আটকাতে এসেছে।নাফিজ বাধা দিয়েছে।সবকিছু নিয়ে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে তিনজন।তারা পেছন ঘুরে পুরো বাড়িটাকে আরেকবার দেখে নিল।একটা সময় ছিল তার সব কিছু কাটতো এই বাড়িতে।আর আজ সে অতিথি।অতিথি হয়েই চলে যেতে চায় সে।
—-মিষ্টি মা যাস না আমায় ছেড়ে।
—-কাল আমার বউভাত।এলাকার সবাই আসবে।আপনারা বিশেষ অতিথি সেখানে।অবশ্য ই যাবেন কিন্ত।আপনার সামনে দাড়িয়ে আমি আমার বাপিকে বাপি বলে ডাকব,আর আপনার সামনে দাড়িয়ে আমি আমার মা কে মা বলে ডাকব।আপনি আমার আপন মা নন।সৎ।তবুও দেখব আপনাদের জ্বলন টা কেমন হয়।আর আপনি ফজলে শেখ।জন্মদাতা আমার।আপনার সামনে আমি যখন আমার বাপি কে বাপি বলব না সেটাই হবে আমার পক্ষ থেকে আপনার জন্য শ্রেষ্ঠ শাস্তি।আপনি বাবা হয়েও বাবা ডাক শুনবেন না,আর আপনি মা হয়ে।
ফজলেও শেখ আর তানিয়াকে উদ্দেশ্য করে কথা গুলো বলে বাইরে পা রাখলো তারা।নাফিজ আর লতিফা ও সেই সাথে বেরিয়ে গেল।ফজলে শেখ আর তানিয়ার আর্তনাদ ভেসে আসছে।কিন্ত তারা র কানে আজ কিছুই ঢুকছে না।
ছোট্ট মিষ্টি টাকে যে তারা অনেক আগেই মেরে ফেলেছে।কোমল হৃদয় টা যে আজ পাথরে পরিণত হয়েছে।আজ যে শুধুই তারা।
;;;;;
—-এমা!লতিফা নিজের ছেলেকে কেউ এই পঙ্গু মেয়েটার সাথে বিয়ে দেয়?
—-তাই তো।রূপ থাকলে কি হবে।আমাদের নাফিজের জন্য কি মেয়ের এতোই অভাব পড়েছিল!
বউ সাজে তারা বসে আছে।পাশে নাফিজ বসা।বাড়ি ভর্তি লোকজন।আজ তারার বউভাত।বেশ বড় করে আয়োজন করেছে নাফিজের পরিবার।দূরে দাড়িয়ে তানিয়া ফজলে শেখ ও দেখছে তারাকে।তারা লজ্জায় আর সামনে যেতে চায়না তারার।
দুজন প্রতিবেশী মহিলার কথা শুনে চোখের কোনে পানি চলে এলো তারার।এমনিতেই সে পঙ্গু এই নিয়ে আশেপাশে অনেকেই অনেক কথা বলছে বউ দেখে।কেউ তো বলছে তারার রূপ আর বাপের সম্পত্তি দেখে হয়তো নাফিজ বিয়ে করেছে।
এবার আর সইতে পারল না নাফিজ।উঠে দাড়ালো।
—-সমস্যা কি আপনাদের?আমার বউ হাঁটতে পারে না ঠিকমতো।তো?আমার তো সেই নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথা ব্যথা নেই।আমার সংসার আমার স্ত্রী।আমার যদি সমস্যা না হয় আপনাদের এ তো চিন্তা কিসের?আর কি বলছেন সম্পত্তি !আমি নিজে একজন আর্মি অফিসার।আমার বাবাও একজন সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন।জমি জমা যাই বলুন আলহামদুলিল্লাহ আল্লাহ যা দিয়েছেন তাতে এতোটাই কমতি পড়েনি যে আমার টাকার জন্য বিয়ে করতে হবে।আমি যদি আমার জীবন নিয়ে সুখে থাকি আপনাদের কি?দাওয়াত দিয়েছি।আসবেন খাবেন মজা করবেন।চলে যাবেন।আপনাদের কি খোচা মারার জন্য এখানে ডাকা হয়েছে?আর এই যে আপনারা দুই কাকিমা যে এমন কথা বলছেন, আপনাদের দুজনের দিকটা একটু দেখুন।
দুজনের মধ্যে একজনকে উদ্দেশ্য করে বললো নাফিজ,
—-আপনার মেয়ে না পালিয়ে বিয়ে করেছিল শুনেছিলাম।তাও নাকি বিয়ের আগে অঘটন ও ঘটিয়েছিল।তা সেই বিষয় টা সবাই জানে তো?সবাইকে বলুন না।সবাই শুনুক।
দ্বিতীয় জনের দিকে তাকালো নাফিজ,
—-আপনার ছেলের বউ এর কি গুন আছে বলুন তো কাকিমা।আমার মায়ের কাছে তো বেশ এসে এটা ওটা বলতেন,দেখতে খারাপ,এটা পারেনা ওটা পারেনা।লেখাপড়ার কথা বাদ ই দিলাম।
নাফিজের কথা শুনে মাথা নিচু হয়ে গেছে অনেকেরই।পুরো বাড়িতে যেন স্তব্ধতা বিরাজ করছে।
—-অন্যের ব্যাপারে নাক গলিয়ে এটা দেখানোর প্রয়োজন নেই যে আপনার নাক কত লম্বা।অন্যের মেয়ের সমালোচনা করা বন্ধ করুন।আপনারা অনেকে নিজে মেয়ে হয়েও কিভাবে অন্য একটা মেয়েকে অপমান করেন বলুন তো?আজ যদি আপনার সন্তানের সাথে কোন দুর্ঘটনা ঘটে।সে যদি পঙ্গু হয়ে যায়।তখন কি নিজের সন্তানকে ও এমন কথা বলবেন?
নাফিজের কথা শুনে আব্রাহাম সাহেব মাহমুদা বেগমের চোখের কোনে পানি চলে এসেছে।তারা যে ভুল মানুষকে বাছেনি তারার জন্য এটা যেন আজ প্রমাণিত।সবার সামনেই হুট করে নাফিজ তারাকে কোলে তুলে নিল।তারা তো অবাক।সাথে বাকিরাও।
—-তিন কবুল বলেছি নিজের স্ত্রীর অপমান সহ্য করার জন্য নয়।আমার স্ত্রী।সে সুন্দর হোক অসুস্থ হোক অসুন্দর হোক যাই হোক সে আমার স্ত্রী।সে একান্ত ই আমার।তার সবকিছু আমার।তার দিকে কেউ আঙুল তোলা মানে আমার দিকে আঙুল তোলা।আজ এখানে যারা আছে সবাই কে বলছি আর যদি কখনো আমার স্ত্রীকে অপমান করার মানসিকতা নিয়ে আসেন তো বলে রাখছি আপনি যেই হোন আত্মীয়তার সমাপ্তি ঘটিয়ে দেবেন।আমার সংসার আমি করব।আপনারা না।আপনাদের থাকা না থাকাতে আমার কিছু যায় আসে না।আমার স্ত্রী র থাকাটাই আমার কাছে বড়।
;;;;;
রাত নেমেছে।তারাকে কোলে নিয়ে ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে উঠছে নাফিজ।উদ্দেশ্য ছাদ।সবাই এখন ঘুমিয়ে আছে।
—-কি করবে বলোতো?এতো রাতে ছাদে কেন?
—-চুপ কর।কথা বলবি না।
তারা চুপ হয়ে গেল।একটু আগে ফুলে সজ্জিত বাসর ঘরে দ্বিতীয় বারের মতো বসে ছিল সে।পুরো বাসর ঘরটা আজ নয়নতারা ফুল দিয়ে সাজিয়েছিল নাফিজ।আজ নিজে হলুদ পানজাবি পড়ে তারাকে নিজ হাতে নীল শাড়ি পড়িয়ে ,সাজিয়ে নাফিজ ছাদের দিকে এগোচ্ছে।অবশেষে যাত্রা শেষ হলো।তারাকে নিয়ে ছাদের ওপরের দোলনাটাতে বসালো নাফিজ।
তারা অবাক হয়ে পুরো ছাদ টা দেখছে।পুরো ছাদ টা ই যেন নয়নতারা বাগান।সব নয়নতারা ফুলের গাছ।
—-কি দেখছিস?
—-এতো ফুল!
—-হুম।মিষ্টি তুই ছোট বেলায় একবার বলেছিলি নয়নতারা বেশি ভালো লাগে তোর।তার পর থেকে অন্য সব গাছ উপড়ে ফেলে এগুলোই লাগাতাম।
—-অনেক সুন্দর।
—-একটু দাড়াও।
নাফিজ উঠে গিয়ে ছাদের কর্নারের দিকে গেলো।সেখান থেকে ফিরলো হাতে দুটো নয়নতারা ফুলের মালা নিয়ে।নাফিজ এনে তারা সামনে হাঁটু গেড়ে বসলো।একটা মালা তারার গলায় পড়িয়ে দিল।আরেকঁ টা তারার মাথায় দিল।তারা অবাক হয়ে দেখছে নাফিজের কান্ড।
—-আমার নয়নতারা রাজ্য আজ পরিপূর্ণ হলো।আমার রাণী আজ আমার।শুধু আমার।
তারার হাতে চুমু খেল নাফিজ।
—-ভালোবাসি বউ সোনা চাঁদের কনা।
—-ভালোবাসি ক্যাপ্টেন নাফিজ ভাইয়া।
“নিশি রাতের চাঁদের ছায়া,
তোমার মাঝে আমার মায়া,
ভালোবাসার এই রজনী,
কাটাব দুজন বুলবুল বুলবুলি,
আমার হলুদ পানজাবির মাঝে
তুমি লজ্জা মাখা মুখটা লুকাবে,
আর আমি তোমার নীল শাড়ির আঁচলহব
জড়িয়ে নেব এই বুকেতে।
আমি হিমু,
তুমি রূপা”।
নাফিজের কবিতা ছুটে হেসে উঠলো তারা।
চলবে———–
৫৫ পর্বে সমাপ্তি হবে
ছবিয়াল: Zarin Tasnim