#লীলাবালি🌺
#পর্ব_৫৪
আফনান লারা
.
‘আমি ঠিক বুঝতে পারছিনা,সূর্যটা কি আজ তার দিক ভুলে অন্যদিক থেকে উঠেছে?যে মেয়েটা আমায় সহ্য করতে পারেনা আজ সে আমায় খুঁজে যাচ্ছে?হাত দিয়ে ইশারাও করছে?ওয়াও!গ্রেট’
জুথি হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়েছিল।মৃদুলের কথা শেষহতেই ওর হাতে ঘড়িটা ধরিয়ে দিয়ে বললো,’আমি বিনাকারণে খুঁজিনি।এটা হলো সেই কারণ।’
‘ঘড়িটা আমি তোমার জন্য রেখে এসেছিলাম ইচ্ছে করেই।আমার স্মৃতি হিসেবে রেখে দাও বরং’
জুথি জবাব দিলোনা।চলে গেলো।মৃদুল ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে ক্লাসে ফিরে গেছে।
—–
অর্ণব মাথায় গামছা বেঁধে রান্নায় নেমেছে।কুসুমকে ধরতে দিচ্ছেনা।সে পাশে থেকে সব বলে বলে দিচ্ছিলো।বাবা মা আসলেন দুপুরের দিকে।কুসুমের মুখ দেখে মা তো আতংকে পড়ে গেছেন।ওর শরীর ঠিক কতটা খারাপ সেটা ওর চোখ মুখে যেন ভেসে আছে।অর্ণব তাদের ডাক্তারের কথা বলে আপাতত দমিয়ে রেখেছে।বলেছে রিপোর্ট আসলেই ডাক্তার ঔষুধ দেবে তারপর ঠিক হয়ে যাবে।
আজকের খাবারে লবণ নিয়ে সমস্যা হলো।একটু কম হয়ে গেছে।তবে সব ঠিক ছিল।বাবা মা কুসুমের অনেক প্রশংসা করলেন।তারা জানেন না রান্না সব অর্ণব করেছে।শেষে কুসুম নিজ থেকেই বলে দিলো আসল কথা।
বাবা তো অবাক।তার ছেলে কিনা এত সব রাঁধলো।ভাবা যায়!যে ছেলে মেসে জীবনেও নিজে রাঁধতোনা।দরকার পড়লে রেস্টুরেন্টে গিয়ে খেতো রান্না করার ভয়ে। আজ সেই ছেলে কিনা এত পদ রেঁধে ফেলেছে।
বাবা বুঝতে পারলেন সমস্তটা।তার ছেলে দায়িত্ব নিতে জানতো,তবে আজ সে কুসুমের দায়িত্ব নেওয়াও শিখে গেছে।অতীতে যখন ওর মা অসুস্থ হয়ে পড়তেন তখন তিনিও এমনটাই করতেন।বাপের মতন হয়েছে ছেলেটা।
আজ অনেক গর্ব লাগলো।কুসুম মেয়েটার যে মায়ায় আমরা পড়ে ওকে বিয়ে করাতে চেয়েছিলাম মনে হয় আমার ছেলেটাও সেই মায়ায় পড়ে গেছে।
বেশ ভাল লক্ষণ। মেয়েটা যে আমার ছেলের জন্য ষোলআনা সৌভাগ্য সেটা আমি আগেও জানতাম।আমি এটাও জানি ভবিষ্যতে সে অর্ণবকে এতটা মানিয়ে নেবে যে অর্ণব ওকে চোখে হারাবে।সেই দিন খুব কাছে।দোয়া করি দুজনে যেন সুখী থাকে।’
দুপুরের খাবার শেষে তারা দুজনে ঘুমোতে চলে গিয়েছিল।অর্ণব গিয়ে ঘুমাচ্ছে তার রুমে।কুসুমের চোখে বিন্দুমাত্র ঘুম নেই।মাথার যন্ত্রনা বেড়েছে।অর্ণবকে জ্বালাতে চায়না বলে ওর পাশে শোয়ার চেষ্টা করলো একবার।কিন্তু শুলেই মনে হয় যন্ত্রনা আরও বেড়ে গেছে।তাই মাথা ধরে বসে রইলো সে অনেকক্ষণ যাবত।অর্ণব এত কাজ করেছে যে এখন ক্লান্তি দূরীকরণের ঘুম ঘুমাচ্ছে সে।
কুসুম ভুলেও ওকে জাগাতে চায়না।কিন্তু এই অসহ্য যন্ত্রনা তাকে এক জায়গায় স্থির থাকতে দিচ্ছেনা।সহ্য করতে না পেরে কেঁদে ফেলেছে ।তবে কোনো শব্দ করলোনা।
আজ বাবা মায়ের কথা খুব মনে পড়ছে।মাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করে।তাকে ধরলে সব অসুস্থতা চলে যায় কিন্তু এখন তিনি নেই বলে অসুস্থতা যাওয়ার নাম নিচ্ছেনা।
চোখ মুছে নিজের ফোন বের করে বসে থাকলো।মায়ের নাম্বার তো তার চেনা নয়।তাছাড়া নাম সেভ থাকলেও সে তো পড়তে জানেনা।অর্ণবের নাম্বারে স্টিকার থাকে বলে চিনতে পারে।
ফোন রেখে ধীরে সুস্থে বিছানা থেকে নেমে পুরো বাসায় ঘোরাঘুরি করলো সে অনেকক্ষণ।সময় যায়না।কখন বিকেল হবে আর কখন সবাই ঘুম থেকে উঠে বসবে।ছাদে যেতে খুব ইচ্ছে হলো কিন্তু ঐ শেয়ালের ভয়ে যাবার ইচ্ছা পানিতে ডুবে মরে গেছে।
জবা ফুল গাছটাকে অনেকক্ষণ যাবত দেখে একটা ফুল নিয়ে কানে গুজে ফ্লোরের উপর বসে আছে সে।সকালে অর্ণব শিখিয়েছে এক, দুই, তিন, চার আর পাঁচ।বাকিগুলো মনে নেই।আঙ্গুলে এক দুই তিন চার পাঁচ গুনে সেকি আনন্দ হলো তার।কিছুক্ষণের জন্য মাথা ব্যাথার কথাটাই ভুলে গেছে সে আনন্দে।
বারান্দায় বসে যখন সে গুনছিল তখন রাস্তা দিয়ে এক ফেরিওয়ালাকে যেতে দেখে থামতে বললো।তার কাছে ঝিনুকের মালা ছিল কতগুলো।আশ্চর্যের কথা হলো মালাগুলো সাদা নয়।নীল,লাল আর কালো রঙের।কুসুম দাম জানতে চেয়েছে।লোকটা বললো পঞ্চাশ টাকা।
কুসুম ভাবছে টাকা কই পাবে।অনেক ভেবে অর্ণবের কাছে গিয়ে ওর দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে ছিল।ওর ঘুমের বাহার দেখে জাগিয়ে তুলতে ইচ্ছেই করেনা।এদিকে রঙিন মালা হাত ছাড়া করলে আফসোসে জীবন শেষ হবে।সে মাকে প্রায় সময় দেখতো বাবার পকেট থেকে টাকার নোট নিয়ে কোমড়ে গুজতে।এই বুদ্ধিটা আসায় ভাবলো অর্ণব যদি রাগ করে বসে?পরে ভাবলো জানিয়ে দেবে একদিন তাহলে রাগ হবেনা।দেরি না করে অর্ণবের ঝুলিয়ে রাখা পাঞ্জাবি হাতিয়ে দশ টাকার, বিশ টাকার,একশো টাকার নোট পেলো সে।কিন্তু সে তো জানেনা পঞ্চাশ টাকা কত তে হয়।
তাই টাকার নেট কয়েকটা নিয়ে ছুটে নিচে চলে গেলো ফেরিওয়ালার কাছে।তাকে একটা নোট দিয়ে চুপ করে রইলো।
যদি তিনি বলেন কম হয়েছে তাহলে আবার আরেকটা নোট দেবে।
কিন্তু লোকটা পঞ্চাশ টাকার নোট বের করে ওর হাতে দিলো উল্টে ।
ও বললো টাকা কেন দিয়েছে।লোকটা জানালো সে তো একশো টাকার নোট দিয়েছে।বাকি পঞ্চাশ তো ওর পাওনা,যেহেতু সে একটা মালা নিয়েছে।কুসুম আগাগোড়া কিছুই বোঝেনি তাও টাকাটা নিয়ে মুঠোবন্দি করে রাখলো।
সে লাল রঙের মালাটা নিয়েছিল।তড়িগড়ি করে বাসায় ফিরে টাকা সব আবার আগের জায়গায় রাখছে সে এখন।
সেসময়ে অর্ণব উঠে পড়েছে ঘুম থেকে।কুসুমকে ওর পাঞ্জাবিতে কি যেন করতে দেখে এগিয়ে এসে দাঁড়ালো কাছে।
কুসুম টাকাগুলো রেখে পেছনে তাকিয়ে আচমকা অর্ণবকে দেখতে পেয়ে ভয় পেয়ে গেলো।ভয়ের চোটে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে সে।
অর্ণব ওর দিকে কপাল কুঁচকে তাকিয়োছিল।ও কিছু বলছেনা দেখে এগিয়ে এসে ওর কোমড় থেকে দশ টাকার নোটটা টেনে বের করে বললো,’টাকা তোমার কোমড়ে কি করে?’
কুসুম লজ্জায় লাল হয়ে আছে।অর্ণব ওর নিরবতা দেখে আবারও প্রশ্ন করেছে।কিন্তু এবারও কুসুম কিছু বললোনা দেখে সে বললো,’আমার পকেট থেকে টাকা নিয়ে নিজেকে চোর ভাববেনা।আমি কি তোমায় মারতাম?ওমন ভয় পাচ্ছো কেন?’
‘না কিছুনা’
‘টাকা কোমড়ে রাখে মানুষ?তাও এমন করে যে সবার আগে আমার চোখ টাকার উপরই গেলো?’
কুসুম লজ্জার সাথে যুদ্ধে হেরে অর্ণবের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে এখনও।
সে চলে যাবার পর দম ফেলে মালাটাকে সামনে ধরে মুচকি হাসলো।
—–
জুথির বাবা পরীক্ষার খাতা দেখা শেষে সব গুছিয়ে রাখছিলেন।সামনেই ফোন রাখা।তাতে ভিডিও কল চলছিল।জুথির মা গালে হাত দিয়ে বসে দেখছিলেন তাকে।আর মিটমিট করে হাসছিলেন।
কারণটা হলো জুথি চলে যাবার পর জনাব করিম এতদিন নিজেকে যতটা একা মনে করতেন এরপর আরও বেশি একা হয়ে যাবেন।এদিকে জুথি চলে আসছে শুনে মা ভীষণ খুশি।কারণ তিনি তো কত বছর একা কাটাচ্ছেন। এমতাবস্থায় জুথির বাবার হাল দেখে তার মশকরা ছাড়া মাথায় আর কিছু আসছেনা।তার হাসি দেখে বিরক্তি নিয়ে জনাব করিম বললেন,’জুথি আমাকে ছেড়ে বেশিদিন থাকবেনা।আবারও চলে আসবে সে।হতে পারে আসার সময় তোমায় ও নিয়ে আসলো।সুতরাং দাঁত কেলানো বন্ধ করো’
‘জ্বলছে তোমার?অথচ দুই যুগ আগে যখন আমাদের বিয়ে হয়েছিল তখন তুমি আমায় বলেছিলে আমার হাসিতে তুমি মত্ত।আর এখন তার উল্টো কথা বলছো?’
‘ওসব ছাড়ো।এই তো সুন্দর বাংলা পারছো।চলে আসলে কি হয়?শ্বশুর শাশুড়ির প্রতি কোনো দায়িত্ব নেই?আমি আর কতকাল একা থাকবো?’
জুথির মা রাগ করে কলটাই কেটে দিয়েছেন।জুথি তখন মৃদুলের কথা ভাবছিল।কাউকে মনে আঘাত করলে কতটা কষ্ট সে পায় তা জুথি বরাবর জানে।সে বুঝতে পারছে মৃদুলের মনের অবস্থা কেমন।কিন্তু সে তো চায়নি মৃদুল তাতে আসক্ত হয়ে যাক।শুরু থেকে ওকে ইগনর করে এসেছে ঠিক এই জন্যই।সে নিজ থেকে এতদূর এসে এখন মানা করাটা কেন নিতে পারছেনা?এই ভেবে জুথির খারাপ লাগে।তার নিজের মনটাই খারাপ ওর কথা ভাবতে গিয়ে।একটা সাক্ষাৎ হয়ত ওর মনের অবস্থা ভাল করে দেবে কিন্তু তাতে করে মৃদুল সম্পর্কে আরেক ধাপ এগিয়ে আসবে।
‘কি করলে এই অশান্তি দূর হবে!!মন চাইছে আজই সিঙ্গাপুর চলে যাই।তাহলে আজকেই সব কিছু থেকে মুক্তি পাওয়া যেতো।’
—-
অর্ণব কি মনে করে আবারও কুসুমের কাছে ফিরে এসেছে।কুসুম ওকে আসতে দেখে যেই জায়গায় ছিল ঐ জায়হায় দাঁড়িয়ে পড়লো।ও সোজা কুসুমের কান থেকে জবা ফুলটা হাতে নিয়ে বললো,’তোমাকে না বললাম এই ফুল কানে দিবানা!’
‘মনে ছিলনা।দিন ফেলে দিই’
‘ফুল ফেলবার জিনিস না।ছিঁড়ছো যখন তখন নিজের কাছেই রাখো।’
এটা বলে অর্ণব বিড়বিড় করে আরও কয়েকটা লাইন বললো।সেগুলো হলো’একটা কথা শোনেনা আমার।ঘাঁড়ত্যাড়া মেয়ে কোথাকার!’
কুসুম শোনেনি তবে বুঝতে পেরেছে অর্ণব কিছু একটা বলেছিল।সবসময় ওর কথা সে অক্ষরে অক্ষরে পালন করে আসলেও জবা ফুলের ব্যাপারে সেটা করতে পারেনা।কিসের একটা আকর্ষণ টান দেয় ওর দিকে।জবা দেখলে অর্ণবের নিষেধের কথা মাথায় আসেনা।ফুলটাকে অনেকক্ষণ দেখে মনে মনে ঠিক করলো আর কোনোদিন এই কথা অমান্য করবেনা সে।
অর্ণব ভাবছে কুসুম হঠাৎ টাকা নিচ্ছিলো কেন।
‘কিসের দরকার পড়লো যে চুপিচুপি নিলো?জিজ্ঞেস করা তো ঠিক হবেনা।হাতেনাতে ধরেছি বলে লজ্জায় যে লাল হয়েছে সে লাল এখনও ওর মুখ থেকে নড়েনি।তবে কি নিলো?আর ও তো হিসেব জানেনা।কি করেই বা নিলো!
ভাবতে ভাবতে কুসুমকে সামনে দিয়ে যেতে দেখে একবার ওর দিকে গভীর মনযোগ দিয়ে তাকালো সে।সব ঠিক আছে কিন্তু গলার মালাটা নতুন লাগে।এটা তো এর আগে সে পরেনি।তাহলে কি এটাই কিনেছে?
ঝিনুকের মালা ওর এত পছন্দের?একদিন যদি সময় এবং সুযোগ দুটোই পাই হবে এই ঝিনুকের পাগলা ভক্তটাকে সমুদ্র সৈকত দেখিয়ে আনবো।
হায়! তখন তো তাকে হয়ত ওখান থেকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে আসতে হবে।চোখের সামনে জ্যান্ত হাজার হাজার ঝিনুক দেখলে তাকে তো আমি জোর করেও নিয়ে আসতে পারবোনা। কি সুন্দর হবে দৃশ্যটা।’
চলবে♥
জয়েন হোন আমাদের নতুন গ্রুপে
https://www.facebook.com/groups/676436250036874/