কহিনুর_দ্বিতীয়_খণ্ড,পর্ব১১

0
932

#কহিনুর_দ্বিতীয়_খণ্ড,পর্ব১১
কলমে:ইয়াসমিন

আকাশে অর্ধ চাঁদের আলো আর পশ্চিম দিকের ফলের বাগান থেকে আসার জোনাকি পোকার ঝাকের সঙ্গে জোছনার মিতালী বন্ধনে বিশালাকার এই ছাদ জুড়ে অদ্ভুত এক দৃশ্যের সৃষ্টি করেছে। ঐশ্বর্য এসব প্রাকৃতিক রূপ দেখে মোটেই আচ্ছাদিত হয়না। মাথায় চলছে ফিসফিস আওয়াজে কথাবলা ব্যক্তির খোঁজ করতে হবে। দীর্ঘ ছাদের একদিকে পাশাপাশি দু কক্ষের একটা ফ্লাট। বাইরে সামান্য বারান্দা টাইপ তবে ওটা গ্রিল দিয়ে আটকানো আছে। মূলত সোজাসুজি দরজার কাছে না পৌঁছনোর একটা ধান্দা। হঠাৎ ঐশ্বর্যের খেয়াল হলো ছাদে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে সেই ফিসফিস আওয়াজটা বন্ধ হয়ে গেছে। ওর কৌতূহল ক্রমগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। গ্রিলের লক করা অংশে হাত দিয়ে দেখলো লক খোলা পড়ে আছে তাই কিছু না ভেবেই ও ভেতরে ঢুকে পড়লো। গুমট অন্ধকার কক্ষে কিচিরমিচির ইদুর বাদুরের ডাক সঙ্গে তেলাপোকার উড়াউড়ি। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকাই অযাচিত প্রাণীদের বাস্থানে পরিণত হয়েছে কক্ষটা। ঐশ্বর্য প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গেলো। এমন কক্ষে ওর আসার অভিজ্ঞতা এই প্রথমবার। না এখানে ও আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না। কিসের একটা গন্ধে গা গুলিয়ে উঠছে। বমি বমি পাচ্ছে সঙ্গে শরীর অনবরত ঘেমে চলেছে। মনে হচ্ছে আধারের সঙ্গে মিলেমিশে বেশ কিছু চোখ ওকে দেখছে। ঐশ্বর্য চলে আসতে চাইলো ঠিক তখনই কেউ ওকে পেছনে থেকে ঝাপটে ধরলো। হাতদুটো পেছনের দিকে মুচড়ে বেধে ফেলল। হঠাৎ আক্রমণের জন্য ঐশ্বর্য ভয়ে চিৎকার করতে ভুলে গেলো। পেছনের লোকটা নারী নাকি পুরুষ বুঝতে পারলো না। লোকটা এবার ওর মুখটা চেপে ধরলো। শক্ত সেই মুঠোর চাপে ওর মুখোমন্ডল মনে হলো ভেঙেই যাবে। খুব করে আফসোস হলো এখানে আসার জন্য। না আসলে এমন কিছু হতো না। অধরা ওকে এই বিপদের কথায় কি তখন বলেছিল? ঐশ্বর্য ভাবতে পারছে না। নিশ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম। কিভাবে এই ফাঁদ থেকে নিজেকে রক্ষা করবে? লোকটা ওকে রীতিমতো টেনে হিচড়ে কোথায় একটা নিয়ে যাচ্ছে। ঐশ্বর্যের চোখে পানি চলে আসলো। এক সময় লোকটা ওকে অন্ধকার কক্ষের মধ্যে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো। ঐশ্বর্য ছুটে গিয়ে পড়লো পুরাতন আসবাবপত্রের উপরে। শক্ত কাঠের কোনো গিয়ে লাগলো ললাট বারবার। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় ওর শরীর কুকড়ে গেলো। মস্তিষ্ক অকেজো হয়ে ধীরে ধীরে চোখের পাতা বন্ধ হয়ে আসলো। ঐশ্বর্য জ্ঞান হারালো। মনে হলো এটাই হয়তো ওর অন্তিম যাত্রা।
মিটিমিটি আলোতে ঐশ্বর্যের ঘুম ভাঙলো। অধরা জানালার পর্দা উঠিয়ে দিচ্ছে। পূর্ব আকাশে সূর্যমামা উঁকিঝুঁকি কাঁটছে।এই বুঝি টুপ করে রক্তিমা আভা ছড়িয়ে নিজের উষ্ণতা দিয়ে ধরণীকে উত্তপ্ত করে দিবে। রাতের কথা মনে হতেই ঐশ্বর্য দ্রুত বিছানায় উঠে বসলো। তবে শরীরে একদম ব্যথা নেই ।ওকে এভাবে হন্তদন্ত হয়ে উঠতে দেখে অধরা এগিয়ে এসে হাসিমুখে জিঞ্জাসা করলো,
> ঘুম কেমন হলো? তোমার ড্যাড অপেক্ষা করছে জগিং করতে যাবেন তোমার সঙ্গে। কফি খাবে?
ঐশ্বর্য বিছানায় বসেই অধরার কোমর জড়িয়ে ধরে বলল,

> আন্টি ছাদে কেউ ছিল আছে। ও আমাকে মেরে ফেলবে। তুমি জানো রাতে ও আমার উপরে এটাক করেছিল। এই বাড়িতে আমি থাকবো না। খুব ভয় পেয়েছি।

অধরা চিন্তিত হলো মেয়েটার কথা শুনে। ও ভ্রু কুচকে বলল,

> কিচ্ছু হবে না মাম্মা। কিন্তু তুমি ছাদে কেনো গিয়েছিলে? আর কি হয়েছিল আমাকে বলো?

ঐশ্বর্য ভয়ে ভয়ে সবটা খুলে বলল। ঐশ্বর্য জ্ঞান হারিয়েছিল সেইটুকু মনে আছে বাকীটা কিছুই মনে পড়ছে না। এই কক্ষে ওকে কে এনেছে এটাও রহস্য। অধরা ওকে বুঝিয়ে বলল ওটা স্বপ্ন ছিল। স্বপ্নটা ওর কাছে জীবন্ত মনে হচ্ছে। ঐশ্বর্য মানতে পারলো না দ্রুত বেরিয়ে আসলো সিঁড়ির কাছে কিন্তু সেখানে গিয়ে বড় একটা তালা দেখতে পেলো। গতকাল রাতে এখানে কোনো তালা ছিল না এমনকি দরজা পযর্ন্ত ছিল কিনা মনে পড়ছে না। অধরা ওকে বহুকষ্টে শান্ত করে জুবায়ের কে সবটা বলল। জুবায়ের ঐশ্বর্যকে বুঝিয়ে বলল। তাছাড়া রাতে ভূল করেও বাইরে যাওয়া যাবে না বলে সাবধান করলো। ওকে আবারও ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে ওরা বেরিয়ে আসলো। কেমন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। মেয়েটাকে কেউ কি ইচ্ছা করে ভয় দেখানোর চেষ্টা করছে কি কে জানে কথাটা ভেবে জুবায়ের বলল,

> দেখলে রহস্য রহস্য খেলা শুরু হয়ে গেলো। সুলতান ভিলার রহস্যের মুখোশ উন্মোচন করতে তোমাকে শুভেচ্ছা বউ। যাও এবার ছাঁদের রহস্যের সমাধান করে আসো। তবে আগেই বলে রাখছি ছাঁদের দরজা কিন্তু সব সময় বন্ধ থাকে। চাবি দাদুর কাছে আমি চুরি করতে পারবো না।

অধরা বিরক্ত হয়ে বলল,

> আমি নিজেই পারবো আপনাকে কিছু করতে হবে না। আপনি তো আমাকে বড় চুরিতে সাহায্য করবেন। যাকে বলে পুকুর চুরি। প্রস্তুত হয়ে জান।

অধরা হাসলো কিন্তু জুবায়ের চিন্তিত। এই মেয়ের মাথায় কি ঘুরছে কে জানে। কি চু*রি করাবে ভাবতে ভাবতে বলল,

> তুমি সঙ্গে থাকলে শুধুমাত্র চু*রি না ডা*কা*তিও করবো। বউ আছে সামলাবে আমার কি?

ওদের কথা আর এগুতে পারলো না। বাইরে থেকে শোরগোল ভেসে আসছে। অধরা আর জুবায়ের ছুটলো সেদিকে। এই বাড়িতে থাকা মানেই আতঙ্ক নিয়ে বাঁচা।
***********
ডাইনিং রুমের সোফায় চৌধুরী পরিবারের লোকজন বসে আছে। ছোটরা সব কহিনুরের কক্ষে গিয়ে যোগ দিয়েছে। মিষ্টি কহিনুরকে ধরে আবেগে কান্না করে দিয়েছে। ওদের দুজনের প্রচুর ভাব। কহিনুর চলে আসার দরুন মিষ্টি সারাদিন মন খারাপ করে বসে ছিল। এখানে আসার কথা শুনে লাফিয়ে উঠেছিল। জুবায়ের আর অধরা চেচামেচি শুনে নিচে নেমে আসলো। জুবায়ের দাদু ওদেরকে নিয়ে গল্প জুড়েছেন। উনার মনে একটা পরিকল্পনা এসেছে সেটার বাস্তব প্রয়োগ করা জরুরী। অধরা সকলের সঙ্গে আলাপ করে ডালিয়া হক আর উনার পুত্রবধূদের নিয়ে নিজের কক্ষে চলে গেলেন। ডাইনিং রুমে শুধু পুরুষেরা থাকলো। ডালিয়া হকের চোখমুখ চকচক করছে অধরার সুখ দেখে। মেয়েটা যে এই বাড়ির বউ উনি কখনও কল্পনাও করেননি। ভীষণ খুশি উনি।
****
কহিনুরের দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাঁকিয়ে আছে আদি। এই কক্ষের সঙ্গে মেয়েটাকে একদম মানিয়ে গেছে। রাজকন্যার মতো লাগছে। কহিনুরের চক্করে ওর একদম ঐশ্বর্যের কথা মনে নেই। মনে হচ্ছে পৃথিবী থমকে যাক ঘড়ির কাটা বন্ধ হয়ে সকল প্রাণী জড় পদার্থে পরিণত হোক। আদির নয়ন জোড়া শুধুমাত্র ওই মেয়েটার মুখেরে দিকে অনন্তকাল চেয়ে থাকুক কিন্তু ওর সকল কল্পনার সমাপ্তি ঘটিয়ে আহির বলে উঠলো,

> কহিনুরের কক্ষটা আমার ভীষণ পছন্দ হয়েছে। জামাই হয়ে যখন এখানে আসবো তখন এই কক্ষেই আমার থাকতে দেওয়া হবে।

মিষ্টির চোখমুখ কুচকে গেলো ছেলেটার এমন উদ্ভুট কথাবার্তা শুনে। কোথা থেকে জেনেছে চৌধুরীরা সুলতান ভিলাতে নিমন্ত্রণ পেয়েছে আর অমনি এই ছেলেটা সাত সকালে চৌধুরী বাড়িতে সেজেগুজে হাজির হয়েছে। এক প্রকার বাধ্য হয়ে ওকে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে। মেজাজ খারাপ করছে এখানে এসে। আদি ওর কথায় উত্তর দিলো,
> ভালো পাত্র না পেলে সুলতানারা শুনেছি মেয়েদের কুমারী রাখতেও পিছপা হয়না। কহিনুরের একটা খুত আছে এটার জন্য সুলতানরা কখনও মেয়ের অযোগ্য ছেলেকে জামাই করবে না। সিউর কহিনুরকে ওরা আপনার সঙ্গে কখনও বিয়ে করাবে না।

আহির বেশ ক্ষেপে গেলো আদির কথা শুনে। ছেলেটা ওকে বারবার অপমান করছে।ও রাগে ফুলতে ফুলতে বেরিয়ে আসলো।বাবাকে ফোন দিয়ে বলে দিলো এখানে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতে। যাকে নিয়ে এতোকিছু সে আছে নির্বাক। বোনদের সঙ্গে ইশারায় কথাবার্তা বলছে। হঠাৎ সেখানে ঐশ্বর্যের আগমন ঘটলো। ওর মুখটা ভার হয়ে আছে। ওকে কেউ স্মরণ করেনি বলে অভিযোগ করলো। আদির পাশে গিয়ে বলল,
> এই তোমার ভালোবাসা? দুইটা দিন খোঁজ নেই কিন্তু কিনো আদি? তুমি না আমাকে ভালোবাসো?
আদি ফিসফিস করে উত্তর দিলো,
> একদম ড্রামা করবে না। সব শুনতে পাবে। আর এখানে আমরা কিছুক্ষণ আগেই এসেছি। সুযোগ পেলাম কোথায় যে তোমার সঙ্গে দেখা করবো?

> এই কক্ষে আসতে তোমার সময় লাগেনি? আমি জুবায়ের ফারুকীর মেয়ে না বলে ইগনোর করছো আমাকে তাইনা? ভালোবাসবে না আমাকে সেইটা ভেবেছো?
> আজেবাজে কথাবার্তা বলবে না। চুপচাপ থাকলে থাকো নয়তো হাটো।

ঐশ্বর্যের চোখ ঝাপসা হয়ে আসলো আদির এই অমূল পরিবর্তন দেখে। ছেলেটা ওর জন্য পাগল ছিল কিন্তু এখন সব বদলে গেলো। সব রাগ গিয়ে জমা হলো কহিনুরের উপরে। এই মেয়েটাই ওর সব সুখ কেড়ে নিয়েছে। দুফোটা পানি নেত্র থেকে বেরিয়ে আসতেই কহিনুর সেদিকে থমথমে মুখ নিয়ে তাঁকিয়ে থাকলো। অন্যদিকে জুবায়েরের দাদু আদির সঙ্গে ঐশ্বর্যের বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন চৌধুরীর সাহেবের কাছে। বিয়ের উপহার সামগ্রী নিয়ে কোনো কৃপণতা দেখাবে না সুলতান পরিবার। চৌধুরী সাহেব ভাবার জন্য সময় নিলেন। তাছাড়া যৌথ পরিবারে সকলের মতামতের গুরুত্ব দেওয়া হয়।
*******
জার্মানির সময় সকাল দশটা বেজে চল্লিশ মিনিট। থমথমে মুখ নিয়ে তুষারপাতের দিকে চোখ রেখে দাঁড়িয়ে আছে এক যুবক। বেবি ফেস আর ধুসর নেত্রের দৃষ্টি ওর চেহারায় আলাদা সৌন্দর্য যুক্ত করেছে। মায়ের মতো উজ্জ্বল ফর্সা গায়ের রঙ কিন্তু বাবার মতো কালো চুল যেটা দেখে বোঝা যায় চেলেটা বাঙ্গালী পরিবারের নয়তো বিদেশি বলে সবাই ওকে ভুল বুঝতো। পড়াশোনা নিয়ে বেশ মনোযোগী এই যুবকের বাবা শামির তালুকদার একজন তুখোড় ব্যবসায়ী। বাংলাদেশে বাবার পৈতৃক টাকা পয়সা যায় থাকুক জার্মান শশুরের বিশাল সম্পত্তির সে একমাত্র মালিক। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ছেলেটা হয়েছে উনার মায়ের মতো ঘাড়তেড়া। সব সময় নিজেকে পিউর রাখতে যথাযথ চেনা চালিয়ে যাবে। কিন্তু পিতার জন্য মাঝেমাঝে সেটাকে ধামাচাপা দিয়ে ইচ্ছের বিরুদ্ধে বহু অন্যায়কে ন্যায় বলতে হয়। ছেলেটার ইচ্ছে ছিল ডাক্তার হওয়ার কিন্তু বাবার কথা রাখতে গিয়ে হলো না। পড়াশোনা শেষ এখন বাবার ব্যবসায় মনোনিবেশ করতে হচ্ছে। বুক চিরে দীর্ঘ নিশ্বাস বেরিয়ে আসলো যুবকের। নিজের জীবন নিয়ে যথেষ্ট আক্ষেপ রয়েছে হৃদয়ের ছোট্ট কুটিরে। আমদানি রপ্তানির বাজারে সুলতানদের সঙ্গে ওদের প্রখর প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলে। আমির তালুকদার কখনও সুলতানদের সঙ্গে পেরে উঠে না। উনি ছেলেকে কথা দিয়েছেন যদি ও সুলতানদের চাইতে এবছর অধিক মুনাফা অর্জন করতে পারে তবে উনি ছেলেকে ইচ্ছে অনুযায়ী চলতে দিবেন আর না পারলে উনি যা বলবেন ওকে তাই শুনতে হবে এটা নিয়ে যুবকের চিন্তার শেষ নেই। হঠাৎ পেছন থেকে কারো ডাকে ওর ধ্যান ভাঙলো,

> স্যার ফাইল রেডি একটা সাইন লাগবে।

ছেলেটা পেছন ফিরে ফাইলটা চেক করে সাইন করে দিল। ফাইনালের উপরে জ্বলজ্বল করে জ্বলছে” ইমরোজ খান পাথর “। পাথর নামটা ওর নানুর দেওয়া নাম। এই নামের পেছনে একটা বিখ্যাত ইতিহাস আছে যেটা শুনতে শুনতে ওর বড় হওয়া।

চলবে

ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here