তিমিরে ফোটা গোলাপ পর্বঃ ১০

0
503

তিমিরে ফোটা গোলাপ
পর্বঃ ১০
Writer Taniya Sheikh

চাঁদটা মেঘের আড়ালে লুকিয়েছে। চারিদিকে ঘোর অন্ধকার। সেই অন্ধকারে জ্বলছে নেকড়েগুলোর রক্তজবার মতো টকটকে চোখগুলো। তিনটে মানুষরূপী পিশাচের রক্তাভ ঠোঁটে বিজয়ের হাসি। ওদের দৈহিক সৌন্দর্য যেন চোরাবালির ফাঁদ। যে কেউ আকৃষ্ট হয়ে অজান্তেই মৃত্যুকে আলিঙ্গন করবে তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই ইসাবেলার। প্রথম দর্শনে সেও তো ওদের রূপের মোহে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এখন, ওই রূপের আড়ালের সত্যিটা সে দেখতে পাচ্ছে। নৃশংস, নির্মম ওরা। এদের কথায় কি বলেছিল ভ্যালেরিয়া তাকে? রমণী এবং যুবতির দৃষ্টি ওর দিকে স্থির। দুজনের চোখের বর্ণ এখন একই রকম, ভয়ানক রক্তিম। লাল ঠোঁটের পাশ দিয়ে চকচকে সরু দুটি দাঁত বেরোনো। রমণীর ঠোঁটের কোণে এখনও লেগে আছে ভ্যালেরিয়ার তাজা রক্ত। ভয়, আতঙ্কের অনুভূতি ম্লান হচ্ছে ঘৃণা আর রাগে। ভ্যালেরিয়ার নিথর দেহের দিকে তাকাতে ফুঁপিয়ে ওঠে ইসাবেলা। ভয়ের চাইতে তখন প্রিয় মানুষ হারানোর শোক বেশি। গলার কাছে অনুভব করছে যুবকের ভারী নিঃশ্বাস। ধারালো দাঁত দুটো ছুঁয়ে দিচ্ছে গলার ত্বকের উপর। ইসাবেলা দুহাতে খামচে ধরে আছে পরনের ঘাগরা । রমণী ইসাবেলার দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে গর্জন করা নেকড়েগুলোকে ইশারা করেন। পশুগুলোর গর্জনে আকাশ, জমিন ভারী হয়ে ওঠে। ওরা এগোচ্ছে ভ্যালেরিয়ার পড়ে দেহের দিকে। ভ্যালেরিয়ার দেহ ছিন্ন ভিন্ন হওয়ার দৃশ্য দেখতে পারবে না ইসাবেলা। দুচোখ বন্ধ করে কাঁদতে লাগল। আর কতক্ষণ করতে হবে মৃত্যুর অপেক্ষা? যুবকের হাত ধীরে ধীরে কোমর ছেড়ে ইসাবেলার ঘাড়ে এসে থামে। অন্য হাত এখনও কোমরের একপাশে। পরপুরুষের স্পর্শে ঘৃণায় রি রি করে উঠল ইসাবেলার শরীর। দু’হাতে ঠেলে সরিয়ে দিতে চায় কিন্তু ও যেন রক্ত মাংসের শরীর নয় লোহার ইস্পাতে গড়া। ইসাবেলার মুখশ্রী ব্যথায় নীলবর্ণ ধারণ করে রক্ত পিপাসু যুবকটি ওর ঘাড়ের চামড়ায় দাঁত দুটো ফুটিয়ে দিতে। দু’হাতে আরো জোরে যুবকের দেহ ঠেলে সরাতে গিয়ে ফের ব্যর্থ হয়।

“ছাড়ো আমাকে। ছেড়ে দাও।”

ওর কাকুতিতে হাসে যুবক। ঠোঁট দুটো শামুকের মতো সজোরে চেপে ধরে আছে ইসাবেলার ঘাড়ের চামড়া। শরীর বিবশ হতে লাগল। তবুও জোর দিয়ে দুহাতে ঠেলতে লাগল যুবকের বুক। হঠাৎ আপনাতেই সরে গেল যুবকের দেহের ভার, ঘাড়ের উপরের উষ্ণ ঠোঁটজোড়া। ইসাবেলা ধপ করে হাঁটু ভেঙে বসে পড়ে। দেহের শক্তি বুঝি অনেকখানি শুষে নিয়েছে ওই পিশাচটা। নেকড়েগুলোর গর্জন থেমে গেল হঠাৎই। খানিক নিস্তব্ধতা নেমে এলো। সেই নিস্তব্ধতার মধ্যে একটা পায়ের শব্দ ওর কর্ণকুহরে এসে পৌঁছায়। চোখ মেলে চকিতে তাকাল। যুবক নেই সামনে। ওর শরীরটা পড়ে আছে রমণীর পায়ের কাছে। মুহূর্তে রাগে হিস হিস করে উঠে দাঁড়াল যুবক। রমণী এবং যুবতির দৃষ্টিতে বিস্ময়ভাব। পরক্ষণেই সেটা বদলে গেল। রমণীর দৃষ্টিজোড়া রাগে জ্বলছে ইসাবেলার দিকে চেয়ে। কিন্তু যুবকের মুখে এখন স্বাভাবিক হাসি। কেউ দেখলে ওকে মানুষ বলে ভুল করবে। যুবতী মুখে আবেদনময়ী হাসি। শরীরটা আরো আকর্ষণীয় করে তুললো। ইসাবেলা দেখল কালো বুটজুতো পরা দু’টো পা ওর সামনে। মানুষটার পরনের কালো আলখেল্লার নিচের অংশ থেকে আস্তে আস্তে উপরে তাকাল। চমকে ওঠল ও। উঠে দাঁড়ায় সাথে সাথে।

“নিকোলাস!” ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরবে কিন্তু তা আর হলো না। যে আশা আর ভরসা নিয়ে ছুটে এসেছিল এক নিমেষে হতাশায় পর্যবসিত হয়। নিকোলাসের রুক্ষ, বড়ো ডানহাতটা ওর গলা চেপে ধরেছে। দমবন্ধ হওয়ার উপক্রম। ইসাবেলা বিস্মিত নিকোলাসের আচরণই শুধু নয়, ওকে দেখেও। ঠিক যেই নিকোলাসকে সে দেখেছিল এ সে নয়। ওর সামনে দাঁড়ানো নিকোলাসের দৃষ্টি রুক্ষ। আগুনের লেলিহান শিখার ন্যায় জ্বলছে চোখ দুটো। সেই নীল মণিজোড়া কোথায়? যার মোহে বার বার সম্মোহিত হয়েছিল ইসাবেলা। নিকোলাসের রক্তলাল ঠোঁটজোড়া রাগে শক্ত হয়ে আছে। মুখের সেই শান্তভাব, মুগ্ধ করা হাসি কিছু নেই। নিকোলাসের দৃষ্টি ইসাবেলার দিকে পড়তে ভ্রু কুঁচকে ওঠে। জ্বলন্ত দৃষ্টিজোড়াতে অবিশ্বাস। গলায় চেপে ধরা হাতটা সামান্য শিথিল হলো এবার। নিকোলাসের ঠোঁটের দুপাশ থেকে বেরিয়ে এলো সরু সূঁচালো দুটো দাঁত। ঠিক ওই তিনজনের মতো। তবে কি নিকোলাসও ওদের একজন? ইসাবেলা বজ্রাহতের ন্যায় চেয়ে রইল। কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে যায় ওর হৃৎস্পন্দনের গতি। ইসাবেলার ঘাড়ের চামড়ার ছিদ্র থেকে তখনো রক্ত পড়ছে। নিকোলাস সেদিকে ঝুঁকে গিয়ে আবার মুখ তুলে ইসাবেলার স্তব্ধ মুখের চেয়ে থেমে গেল। ছুঁড়ে ফেলে দেয় ওর শরীরটা। এমনভাবে ফেলল যেন নোংরা কিছু ভুলে ধরে বসেছে সে। ইসাবেলা হাত এবং হাঁটুতে বেজায় ব্যথা পেল নিচে পড়ে।

“নিকোলাস!” ব্যথায় কাতরে উঠল ইসাবেলা। সে যেন নিজের চোখকে এখনও বিশ্বাস করে উঠতে পারছে না। নিকোলাস ওকে একপ্রকার উপেক্ষা করে সামনে তাকায়। গর্জে ওঠে ওর গলা,

“আন্দ্রেই”

“বড়ো ভাই”

বড়ো ভাই? ইসাবেলা চকিতে ফিরে তাকায় আন্দ্রেই নামক সেই পিশাচ যুবকের দিকে। তারপর আবার নিকোলাসের দিকে। এরা ভাই! ইসাবেলার ব্রহ্মতালু জ্বলে ওঠে। এত বড়ো ধোঁকা দিলো নিকোলাস ওদের? ছদ্মবেশী, প্রতারক! ইসাবেলা ভয়, ডর সব ভুলে গেল সেই মুহূর্তে। আন্দ্রেই হাসি মুখে দুহাত মেলে এগোতে লাগল। নেকড়েগুলো ভ্যালেরিয়ার পড়ে থাকা দেহের পাশ থেকে একটু দূরে ঘাড় গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে। ঘর ঘর করে চাপা শব্দ বেরোচ্ছে ওদের গলা দিয়ে। নিকোলাসের দিকে ওগুলোর দৃষ্টি স্থির। নিকোলাস রাজার মতো মুখ তুলে দাঁড়িয়ে। মুখের ভাব আরো রুক্ষ, কঠিন। আন্দ্রেই কাছাকাছি আসতে নিকোলাস হাওয়ায় মিশে ওর মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়ায়। আন্দ্রেই থেকে উচ্চতায় নিকোলাস একটু লম্বা। দৈহিক দিক থেকে পেশিবহুল। ওদের সুদর্শন চেহারায় বলে দেয় ওরা একই বাবার সন্তান। কিন্তু হিংস্র আন্দ্রেই থেকে নিকোলাস বেশি। ওর মধ্যে দয়া মায়ার রেশমাত্র নেই। না আপন বোঝে আর না পর। নিজেকে এবং নিজের স্বার্থকেই প্রাধান্য দেয় সে। আন্দ্রেই ওর বিনা অনুমতিতে রাশিয়ায় এসেছে। ফাদার জালোনভের উপর নিকোলাস নিজেও ক্ষুব্ধ। সে শিকার ধরে তাড়িয়ে তাড়িয়ে। সময় নিচ্ছিল তাই। কিন্তু আন্দ্রেই তাকে না বলে ওই গাঁ দখলে গেছে। এত দুঃসাহস আন্দ্রেইর! নিকোলাসকে অমান্য করার, অসম্মান করার দুঃসাহস কেউ দেখালে তার আর রক্ষে থাকে না। আন্দ্রেইর উপর রাগান্বিত সে। নিকোলাস গলা চেপে ধরে মাটি থেকে কয়েক ইঞ্চি উপরে তুলে ধরল আন্দ্রেইর শরীর। কর্কশ গলায় প্রশ্ন করে,

“কার হুকুমে এখানে এসেছিস তুই? কার হুকুমে?”

আন্দ্রেইকে এবার ভীত দেখাল। আন্দ্রেই ভাইয়ের হাত থেকে নিজেকে ছাড়াতে চেষ্টা করছে। নিকোলাস আবার ওকে ছুঁড়ে ফেলল নিচে। হাওয়ায় মিশে গিয়ে ওর গলার উপর এক পা চেপে ধরে। আন্দ্রেই ব্যথিত গলায় বলল,

“ভাই”

নিকোলাস কিছু শোনার ইচ্ছাতে বোধহয় নেই সেই মুহূর্তে। আন্দ্রেইর মাথাটা ধীরে ধীরে বরফ থেকে আরো নিচে ঢুকে যাচ্ছে। নিকোলাস হুঙ্কার দিয়ে ওঠে,

“আমি তোকে বলেছি এখানে আসতে? কেন এসেছিস? কার হুকুমে আমাকে অবজ্ঞা করার দুঃসাহস দেখিয়েছিস তুই? কার হুকুমে?”

“আমার”

রমণী সদর্পে এগিয়ে এলেন কয়েক কদম। নিকোলাস তাঁর দিকে ফিরল না। আন্দ্রেইর গলার উপর পা রেখেই বলল,

“তাহলে এই ব্যাপার? এখন তুইও আমার বিরুদ্ধাচারণ করছিস আন্দ্রে? ভুলে গেছিস কার অধীন তুই? ভুলে গেছিস কার পোষ্য তুই? বাহ! আমাকে ছোটো করছিস ওই মহিলার কথাতে?”

“সংযত হয়ে শব্দ ব্যবহার করো নিকোলাস। ভুলে যেয়ো না আমি তোমার মা। নিরিথের( কাল্পনিক) রাণী।”

রমণী ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললেন। নিকোলাস কর্কশ কণ্ঠে জবাব দিলো,

“কতবার বলতে হবে, তুমি আমার মা নও সোফিয়া। আর না তুমি নিরিথের রাণী। তুমি কেবল আমার বাবার স্ত্রী। ও হ্যাঁ, দ্বিতীয় স্ত্রী কিংবা মিস্ট্রেস।”

“নিকোলাস!”

“রাজা নিকোলাস” নিকোলাস অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে সৎমায়ের বাক্য শুধরে দিলো। আন্দ্রেইর দিকে ফিরে বলল,

“বল আন্দ্রে, আমার হুকুম অমান্য করার জন্য কী শাস্তি তোর প্রাপ্য?”

আন্দ্রেই চোখ নামিয়ে চুপচাপ রইল। মুখে অপরাধী ভাব। নিকোলাস পা সরিয়ে ওর কলার মুঠোর মধ্যে ধরে বলল,

“ছোটো করেছিস আমাকে তুই। আজ বুঝিয়ে দিয়েছিস সৎ কোনোদিন আপন হয় না। বিশ্বাস ভেঙেছিস তুই আমার আন্দ্রেই। নিজের মায়ের জন্য এই ভাইকে অপমান করেছিস। আজ থেকে তুই আমার কাছে ওই মহিলার মতো__”

“উনি আমার মা ভাই। বার বার মহিলা, বাবার মিস্ট্রেস বলে তাকে তুমি অসম্মান করতে পারো না। ছেলে হয়ে আমি সেটা বরদাস্ত করব না।”

“কী করবি? আমার বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামবি? এই এভাবে?”

“আমি কোনোদিন তোমার বিরুদ্ধে যুদ্ধে যাব না ভাই। আমি_”

“ব্যস। আর কথা না। একদম চুপ। প্রাসাদে ফেরার পর তোমাদের ব্যবস্থা হবে। এক্ষুণি এখান থেকে প্রস্থান করো। নয়তো তোমাদের প্রত্যেকের গলা থেকে মাথা ছিঁড়তে আমি দ্বিধা করব না।”

আন্দ্রেইর কলার ছেড়ে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দেয় নিকোলাস। নত মাথা নাড়িয়ে পেছন ফিরে তাকায় আন্দ্রেই। ভাইয়ের বিরোধিতা করার ইচ্ছে কিংবা সাহস তার নেই। ওর ইশারা পেয়ে নেকড়েগুলো কয়েক কদম পিছিয়ে গেল। সোফিয়া দাঁতে দাঁত পিষে দাঁড়িয়ে আছেন। আন্দ্রেইর এই ভাতৃভক্তিকে তিনি ঘৃণা করে। অপছন্দ করেন ছেলের এই ভীরুতা। নিকোলাসের গা ঘেঁষে বেড়ানো ইভারলিরও আজ সাহস হলো মুখ খোলার। ঠিক সেই মুহূর্তে সবাইকে অবাক করে দিয়ে কষে নিকোলাসের গালে চড় বসিয়ে দেয় ইসাবেলা। শুধু একটা নয়। দুহাতে এলোপাতাড়ি চড় দিতে লাগল নিকোলাসকে। ক্ষিপ্ত কণ্ঠে বলল,

“পিশাচ, শয়তান, ভণ্ড, তুই আমাদের সাথে ছল করেছিস। মাদামের উন্মাদ হওয়ার কারণ তুই। বেঈমান, মাদামের উপকারের এই প্রতিদিন দিলি? তোকে ঈশ্বর কোনোদিন ক্ষমা করবেন না। আমার ভ্যালেরির মৃত্যুর কারণ তুই। হারামজাদা, তোকে আমি মেরে ফেলব।”

সামান্য এক মানবীর এই ধৃষ্টতা দেখে নিকোলাস রেগে অগ্নিশর্মা। ইসাবেলার গলা টিপে ধরে কর্কশ গলায় বলে,

“এত স্পর্ধা তোর? তুচ্ছ এক মেয়ে মানুষ আমাকে চড় মারিস?”

গলা থেকে ওর হাতটা ছাড়াতে চেষ্টা করে ইসাবেলা। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। খুক খুক করে কেশে বলল,
“এই তুচ্ছ মেয়ে মানুষই তোকে ধ্বংস করবে। আমার ভ্যালেরিকে মেরেছিস তোরা। পশু, তোরা নরকে যাবি। শেষ করে ফেলব তোদের আমি।”

নিকোলাসের রাগ মুহূর্তে উবে গেল। বিদ্রুপের হাসি ঠোঁটে। যেন মজা পেয়েছে। ইসাবেলার গলা ছেড়ে মাথার পেছনের চুল নিজের মুঠির মধ্যে টেনে ধরে। ওর ব্যথাভরা মুখটা দেখে নিকোলাস হেসে শান্ত গলায় বলল,

“তাই বুঝি? বেলা, বোকা মেয়ে তুমি। মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে মৃত্যুকে চোখ রাঙাচ্ছ? আগে আমার হাত থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে দেখাও বোকা মেয়ে। তারপর না হয়__”

নিকোলাসের মুখটা নেমে আসে ইসাবেলার ঘাড়ের সেই পুরোনো ক্ষতে। যেখানে নিকোলাসের দাঁত ফোটানো গর্তে রক্ত জমে রয়েছে। নিকোলাসের উষ্ণ নিঃশ্বাস সেখানে টের পায় ইসাবেলা। রক্ত হিম হয়ে আসে ওর। নিকোলাস ফিসফিসিয়ে পুনরায় বলে,

“তারপর না হয় আমাকে শেষ করার কথা ভেবো।”

সূক্ষ্ম দাঁত দুটো ফুটিয়ে দিতে ব্যথায় গোঙানি দিয়ে ওঠে ইসাবেলা। নিকোলাস মনে মনে হাসছে। এই দূর্বল, ভীতু মেয়ে ওকে হুমকি দেয়! বোকামি করে নিজের মৃত্যুকে ডেকে আনল আজ ও। যদিও এমনিতেও বাঁচত না। অবাক হয়েছে মেয়েটাকে জীবিত দেখে। প্রায় রক্তশূণ্য করে এসেছিল শেষবারে। ভেবেছিল অল্পকিছুদিনে অক্কা পাবে। কিন্তু এখন দেখছে উলটো। নিকোলাস আরো গভীরে দাঁত দুটো ঢুকিয়ে দেয়। ওর রক্তের স্বাদ নিকোলাসকে মাতাল করে তোলে। কী মিষ্টি সুবাস মিশে আছে ইসাবেলার রক্তে! নিকোলাস আসক্ত হয়ে গিয়েছিল ওই কদিনে। আজ আবার সেই আসক্তি ফিরে এলো যেন। ইসাবেলা সুযোগে সাহস সঞ্চয় করে লুকানো ক্রুশটা বের করে বসিয়ে দেয় নিকোলাসের বুকের বামপাশে। ছিটকে সরে দাঁড়ায় নিকোলাস। বুক পুড়ে যাচ্ছে। কালো ধোঁয়া বের হতে লাগল সেখান থেকে। অসহ্য পীড়া হচ্ছে ওর। হাঁটু মুড়ে বসে পড়ল সামনে। ইসাবেলা ঘাড়ের ক্ষতে হাত রেখে নির্ভয়ে বলল,

“আমার ভয়ই আমার সাহস আজ। আমার শোক আমার শক্তি। ভীতুর মতো মরব না। দ্যাখ হারামজাদা, দ্যাখ, তোকে আমি ভয় পাই না। তোকে হাঁটুর উপর বসিয়েছে এই তুচ্ছ, দূর্বল নারী। তোকে শেষও করব আমিই।”

ঘা খাওয়া হিংস্র পশুর ন্যায় গর্জন করে ওঠে নিকোলাস। আন্দ্রেই ছুটে আসে ভাইয়ের কাছে। সোফিয়া ছেলেকে বাধা দিতে ব্যর্থ হয়। আন্দ্রেই ধ্বংস হবে জেনেও কোনো ভাবনা চিন্তা না করেই ভাইয়ের বুকের ক্রুশটা টেনে তুলে সরে দাঁড়ায়। হাত পুড়ে যাচ্ছে আন্দ্রেইর। সর্ব শরীর নিস্তেজ হয়ে এলো। ক্রুশটা ছুঁড়ে ফেলতে ওর নিস্পন্দ শরীরটা পড়ে যায় নিচে। সোফিয়া চিৎকার করে দৌড়ে এলো ছেলের নিথর দেহের কাছে। ইভারলি হাওয়ার বেগে ইসাবেলার উপর আক্রমণ করতে ছুটে আসে। নেকড়েগুলোও ছোটে। কিন্তু ইসাবেলা আগে থেকে সতর্ক হয়ে আছে। হাতে তুলে নিয়েছে পাশে পড়ে থাকা শুকনো মোটা ডালটা। ইভারলির অদৃশ্য প্রায় ছুটে আসা শরীরটাতে ডালটা দিয়ে সজোরে দিলো বাড়ি। বাড়ির চোটে দূরে গিয়ে পড়ল ইভারলির শরীর। চোখের নিমেষে ঘুরে দাঁড়িয়েছে ইসাবেলার দিকে। খিস্তি দিয়ে উঠল ইভারলি। নেকড়েগুলো ঘিরে ধরেছে ইসাবেলাকে। সবগুলো একসাথে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য প্রস্তুত। ওদের আক্রমণ পুনরায় প্রতিহত করার জন্য তৈরি ইসাবেলা। জানে মৃত্যু নিশ্চিত। তবুও শেষ লড়াইটা সে লড়বে। ভীরুর মতো মরবে না। ভ্যালেরিয়ার মৃত্যুর প্রতিশোধ ও নেবেই। অন্তত একটাকে শেষ করে হলেও। দূর্বল শরীরে এতকিছু সহজ হচ্ছে না মোটেও। জোরে জোরে মুখ দিয়ে শ্বাস টানছে। ইভারলির অদৃশ্য শরীর ফের ছুটে এলো, নেকড়ে গুলোও ঝাঁপিয়ে পড়েছে। ওদের নখের থাবায় ক্ষত বিক্ষত ইসাবেলার শরীর। চাপা আর্তনাদ বেরিয়ে আসে ওর গলা দিয়ে। সমস্ত শক্তি দিয়ে ডালটা দিয়ে প্রতিহত করার চেষ্টা করছে। কিন্তু বেশিক্ষণ আত্মরক্ষা করতে পারে না। ইভারলি আর নেকড়েগুলোর আক্রমনে বিপর্যস্ত ইসাবেলা। ওর হাত -পা, শরীরের এখানে ওখানে নেকড়েগুলো কামড়ে ধরেছে। ইভারলি ওর মুখের উপর পা দিয়ে চেপে ধরে আছে। ডায়নিটার হিলের আঘাতে ইসাবেলার নাক, মুখের চামড়া ছিঁড়ে যায়। মরেই যেত কিন্তু মৃত্যু এবারও প্রত্যাখ্যান করল। নিকোলাসের মুখ দেখতে পাচ্ছে। শয়তানটা হাসছে। ওর পদধ্বনি পেয়ে নেকড়েগুলো সরে গেল। ইভারলি লাথি মারল ওর পেটে। ব্যথায় ককিয়ে ওঠে ইসাবেলা। শরীরে একবিন্দু শক্তি নেই। পরনের গোলাপি ব্লাউজ, সাদা ঘাগড়া রক্তে ভেজা। নিকোলাস ওর ঘাড় চেপে ধরে মুখোমুখি দাঁড় করায়। ঘৃণায় মুখ বিকৃত করে ইসাবেলা। নিকোলাসের হাসি আরো প্রসস্থ হয়। যেন সে মজা পাচ্ছে। ইভারলি ইসাবেলার রক্ত দেখে লকলকে জিহ্বা বের করে এগিয়ে এলো। ভেবেছিল নিকোলাস কিছু বলবে না। কিন্তু তর্জনী তুলে নিষেধ করল এগোতে নিকোলাস। ইভারলি দাঁত কটমট করে নিজেকে সংযত রাখে।নিকোলাস ঝুঁকে ইসাবেলার ঠোঁটের কোণের রক্ত শুষে নেয়। আঙুলে ওর গালের একপাশের রক্ত তুলে আঙুলটা মুখে পুরে সম্মোহনী গলায় বলল,

“তোমার সাহস আমাকে মুগ্ধ করেছে বেলা। আমি মুগ্ধ তোমাতে। এত সহজ মৃত্যু তোমাকে আমি দেবো না। তোমাকে আমার চাই। প্রতিদিন চাই। যতদিন আমার আসক্তি শেষ না হয় ততদিন চাই।”

ইসাবেলার ঘাড়ের গড়িয়ে পড়া তাজা রক্ত জিহ্বাতে চেটে নিলো। উষ্ণ ভেজা জিহ্বার স্পর্শে
শিহরিত হয় ইসাবেলা। ভয়ে ভেতরটা শুকিয়ে এসেছে। কিন্তু নিকোলাসের চোখে চোখ রাখল নির্ভয়ে। ভয়ই মানুষের সবচেয়ে বড়ো শত্রু। আর ইসাবেলার দ্বিতীয় শত্রু নিকোলাস। দুটোকেই সে শেষ করবে। ওদের কিছুতেই আর প্রভাব খাটাতে দেবে না নিজের উপর। ইসাবেলার এই দুঃসাহসে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ নিকোলাস। আন্দ্রেইর নিথর শরীরটার দিকে চেয়ে মনে মনে ইসাবেলার শাস্তি নির্ধারণ করে ফেলল। একেবারে নয়, এই মেয়েকে নিকোলাস তিলে তিলে মারবে। যেই ভয়কে ও সাহস বানিয়েছে তাই ফিরিয়ে আনবে। ওর চোখে আবার সেই ভয় দেখার পরই শেষ করবে এই তুচ্ছ, দূর্বল মেয়েটাকে। নিরিথের রাজাকে
অসম্মান করার শাস্তি কতটা ভয়ানক হয় আজ থেকে মর্মে মর্মে উপলব্ধি করবে সে।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here