তিমিরে ফোটা গোলাপ পর্বঃ ০৯ Writer Taniya Sheikh

0
441

তিমিরে ফোটা গোলাপ
পর্বঃ ০৯
Writer Taniya Sheikh

ভয়!
মৃত্যুর ভয়, স্বজন হারানোর ভয়, প্রিয় মানুষ হারানোর ভয় আর নিজের স্বাভাবিকতা হারানোর ভয়। একটা মানুষ বোধ হওয়ার পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত ভয়টাকে মাথায় করে বেঁচে থাকে। জীবনের সবখানে ভয় আর ভয়। ইসাবেলা চোখ খুলতেও এখন ভয় পায়, তেমনই চোখ বন্ধ করলেও। সে বুঝতে পারছে ভয় নামক অনুভূতি তার সকল অনুভূতিকে দূর্বল করে দিচ্ছে। জীবনের পথ হঠাৎ বাঁক পালটেছে। কিছুদিন আগেও সে ছিল সবচেয়ে সুখী মানবী। জীবনের এই কঠিন মুহূর্তগুলো থেকে মা তাকে আড়াল করে রেখেছিল। এক পিটারকে ভালোবেসে আজ ওর জীবনে ভয়ের আধিপত্য। এক পিটারের বিরহে আজ ইসাবেলা ভেঙেচুরে বিক্ষিপ্ত। ভালোবাসায় এত যন্ত্রণা কেন? সে তো পবিত্র মনে ভালোবেসেছিল। কোনো মিথ্যা, ছল কিছুই ছিল না। তাহলে কেন বিধাতা এই শাস্তি দিলেন? কেন পিটার ছেড়ে গেল? আজ সে যেখানে দাঁড়িয়ে আছে ক’মাস আগেও কী ভেবেছিল জীবন তাকে টেনে এই ভয়ার্ত পরিস্থিতিতে ফেলবে! এত কাঁদাবে? পরিবারের আদরের ইসাবেলার জীবন ছিল নিরাপদ, সুন্দর। সতেরো বছরের তীরে এসে কেন আজ জীবন এই ক্রুরতা দেখাচ্ছে? দুচোখে কত স্বপ্ন, আশা দেখেছিল। সবই এখন ভয়ের শিশমহলে বন্দি। ভয়! এই শব্দটা অনুচ্চস্বরে আওড়াল কয়েকবার। ভয় উতরে যেতে পারবে কী ইসাবেলা? এখানেও ভয় ওর। সে বোধহয় পারবে না। ভয় প্রচণ্ড ক্ষমতাধর। অন্যদিকে ইসাবেলা দূর্বল, ভীত। পা দুটো কাঁপছে ইসাবেলার। ভয় এই বুঝি ফের পড়ে যায়, চেতনা হারায়। টলতে টলতে জানালার পাশ ছেড়ে এসে বসল বিছানার কোণে। শীতে থরথরিয়ে কাঁপছে। লেপটা গায়ে জড়িয়ে জবুথুবু হয়ে বসল। গতরাতে চেতনা ফেরার পর রুম থেকে বের হয়নি। মাদামের ওই অস্বাভাবিক আচরণে ভীতসন্ত্রস্ত ইসাবেলা। শরীরটা আরো খারাপ লাগছে। রাতে শুয়ে শুয়ে খুব কেঁদেছে। মনে পড়েছে পরিবারের কথা। ভ্যালেরিয়ার কথা। কেন যে আসছে না সে? চিন্তায় চিন্তায় নির্ঘুম কাটিয়েছে রাত। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো গতরাতে দুঃস্বপ্নটা সে দেখেনি কিংবা বলা যায় সেই ভয়ংকর মুহূর্তের সম্মুখীন হতে হয়নি। সারারাত শঙ্কিত ছিল। ভোর হতে চোখের পাতা ঘুমে নেমে আসে। বেশ কয়েক ঘণ্টা ঘুমিয়েছে। দূর্বল, ক্ষুধার্ত ইসাবেলার অবস্থা বড়ো শোচনীয়। হাত দু’টো থরথর করে কাঁপছে। পেটে অসহনীয় যন্ত্রণা। গলা শুকিয়ে কাঠ। এভাবেই বুঝি মৃত্যু হবে ওর, মুক্তি হবে সকল যন্ত্রণা থেকে। তারপর আর দেখবে না পৃথিবীর এই নিষ্ঠুর, বিভৎস রূপ। কিন্তু মনের এককোণে এখনও একটুখানি বাঁচার সাধ। কেন এই সাধ? কীসের মায়া ইসাবেলার বাঁচার সাধ জাগায়? ইসাবেলার ফ্যাকাশে মুখশ্রী বেয়ে উষ্ণ নোনাস্রোত গড়িয়ে পড়ে। ভ্যালেরিয়া কী এবারও আসবে তাকে বাঁচাতে? অস্ফুটে ক্রন্দন করে সে।

“কোথায় তুমি ভ্যালেরি?”

মাদামের পদশব্দে চকিত হলো ইসাবেলা। জ্ঞান ফেরার পর থেকে মাদামের সাড়াশব্দ পায়নি। এই সময় হঠাৎ তাঁর অস্তিত্ব ইসাবেলার ভীতি বাড়িয়ে দেয়। ভয়ে বুক দুরুদুরু করছে। ঈশ্বর নাম জপছে বারংবার। লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে রইল জড়োসড়ো হয়ে। মাদামের পায়ের শব্দ দরজার কাছে এসে থামল। অনেকক্ষণ আর কোনো শব্দ পেল না ইসাবেলা। লেপটা সামান্য সরিয়ে বন্ধ দরজার দিকে তাকায়। দরজার ওপাশে মাদাম এখনও দাঁড়িয়ে আছেন। একেবারে স্থির হয়ে। হঠাৎ বাইরে পরিচিত গলার স্বর শুনতে পায়। একটু মনোযোগ দিয়ে শুনতে বুঝতে পারল প্রতিবেশিনী ভদ্রমহিলার গলার স্বর। মাসলেনিৎসা উৎসবের ধুম গাঁয়ের ঘরে ঘরে। একমাত্র মাদামের গৃহেই বুঝি এই ভয়ানক থমথমে ভাব। বাড়িতে এই সময় কত আনন্দ করেছে সে। সেসব স্মৃতি মনে পড়তে কান্না ঠেলে আসে। ইসাবেলা নিঃশব্দে উঠে বসল। জানালার পর্দা সামান্য সরাতে দেখল প্রতিবেশীদের লনে অতিথিদের হৈ হুল্লোড়। মনে খানিকটা সাহস হলো এবার। সদর দরজার বাইরে প্রতিবেশিনী এখনো ডাকছেন। মাদাম নয় এবার ইসাবেলার নাম ধরে ডাকছেন তিনি। ইসাবেলার দরজার সামনে থেকে মাদামের ছায়ামূর্তিটি তখন সরে গেল। প্রতিবেশিনী বার কয়েকবার ডেকে ক্ষান্ত দিলেন। ফিরে বাড়ির লনে গিয়ে দাঁড়ালেন। ভদ্রমহিলার স্বামী, মেয়ে আর একজন যুবকও সেখানে দাঁড়ান। যুবকের হাতে সুরার গ্লাস। ভদ্রমহিলা মাদামের বাড়ির দিকে লক্ষ্য করে বিমর্ষ মুখে ওদের কিছু বলছেন। ওদের দৃষ্টি জানালার দিকে পড়তে দ্রুত পর্দাটা ফেলে দিলো ইসাবেলা। তারপর মনে হলো, কেন ভয়ে ভয়ে আছে? জানালা খুলে চিৎকার করলেই সাহায্য পাবে। জানালা খোলার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো। একটু খেয়াল করতেই দেখে বাইরে চিকন লম্বা কাঠ দ্বারা একেবারে বন্ধ করে দিয়েছে জানালার কবাট। কাজটা কে করেছে বুঝতে অসুবিধে হলো না ওর। ভয়টা তাতে করে আরো বাড়ল। অনেকক্ষণ বসে রইল অসহায়ভাবে। ওর সামনে এখন দুটো পথ। হয় এভাবে বসে বসে মৃত্যুকে স্বাগত জানানো নয়তো সাহসের সাথে ভয়ের মোকাবেলা করা। সাহসের মৃত্যুতে সম্মান আছে। সে সিদ্ধান্ত নিলো দরজা খুলবে। ভয়ের মুখোমুখি হবে। বিছানা ছেড়ে নেমে দাঁড়ায়। পা দুটো কম্পিত। দেয়াল ধরে দরজার কাছে গিয়ে থামে। লম্বা শ্বাস নিলো। মনে মনে ঈশ্বরের নাম জপল কয়েকবার। আস্তে আস্তে দরজার ছিটকিনি খুলে উঁকি দিলো এদিক ওদিক। মাদাম নেই। ধীর পদে বাইরে বেরিয়ে এলো। ওই তো সদর দরজা। ইসাবেলা সেদিকে পা বাড়ায়। ভয়ে সর্ব শরীর কাঁপছে ওর। এই বুঝি মাদামের সেই ভয়ানক, অপ্রকৃতস্থ রূপটা আবার সামনে এসে দাঁড়ায়। কিন্তু তেমন কিছুই ঘটল না। সে সদর দরজা খুলে আলোতে এসে পৌঁছেছে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে। চোখে মুক্তির আনন্দ জল। প্রতিবেশিনী ভদ্রলোক প্রথম দেখলেন ইসাবেলাকে। তারপর একে একে বাকিরা। সকলে উদ্বিগ্ন মুখে এদিকেই আসছে। ইসাবেলাও ছুটছে সামনে। কিন্তু খুব বেশিদূর যাওয়ার শক্তি ওর মধ্যে নেই। মাদামের বাড়ির সামনের বরফে আচ্ছাদিত উঠোনের উপর মুখ থুবড়ে পড়ল। ভদ্রমহিলা ইসাবেলাকে ধরে তুললেন। ইসাবেলা ফুঁপিয়ে ওঠে। কী হয়েছে জিজ্ঞেস করতে মাদামের দরজার দিকে আঙুল তুলে ইসাবেলা বলল,

“মাদাম, মাদাম।” এর বেশি ওর গলা দিয়ে বের হলো না। কান্নায় জড়িয়ে যাচ্ছে শব্দ। ভদ্রমহিলা বুকে জড়িয়ে ধরলেন ইসাবেলার কম্পিত শরীরটা। ভদ্রলোক আর তাঁর সাথের যুবকটা ছুটে গেল মাদামের বাড়ির ভেতর। ইতোমধ্যে আশেপাশের বাড়ির অনেকে এসে কৌতূহলে ভিড় জমিয়েছে। অনেকে ঢুকলেন মাদামের বাড়ির অন্দরে। ইসাবেলার আর্ত দৃষ্টি দরজার দিকে। ভদ্রমহিলার মেয়ে ঘর থেকে গরম কাপড় এনে ওর গায়ে জড়িয়ে দিলো। কবোষ্ণ এক গ্লাস পানি দিলো পান করতে। একটু পর একটা রাগত গলার চিৎকার শোনা গেল। মধ্যবয়সী ভদ্রলোক রেগে অগ্নিমূর্তি হয়ে মাদামের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এদিক ওদিক ছুটলেন। হাতে তাঁর মাদামের সেই রক্তমাখা ধারালো ছুরি। উচ্চৈঃস্বরে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল করছেন মাদামকে উদ্দেশ্যে। তাঁর স্ত্রী, সন্তানেরাও এসে যোগ দিলো। ওরা প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে মাদামের বাড়ির ভেতর ঢুকল সবাই। তখনই ইসাবেলার মনে পড়ল বেড়ালটা কথা। বেড়ালটা ওই ভদ্রলোকের পালিত। মাদামের এই নিষ্ঠুরতা দেখে বাকরুদ্ধ গাঁয়ের লোক। প্রতিবেশিনী ভদ্রলোক এসে জানালেন, মাদাম বাড়ির ভেতর নেই। তাঁকে তন্নতন্ন করে খুঁজে কোথাও পাওয়া গেল না। অথচ, এই খানিকক্ষণ আগেও ইসাবেলা তাঁকে দরজার বাইরে দেখেছে। ওটা কী মাদাম ছিলেন না?

প্রতিবেশিনী ভদ্রমহিলা ইসাবেলাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে এলেন। ডাক্তার ডাকা হলো। ইসাবেলা ভীতসন্ত্রস্ত। ডাক্তারের কোনো কথার জবাবই সে ঠিকমতো দিতে পারল না। নিজের দুঃস্বপ্নের কথা অগোছালো ভাবে বলল। ডাক্তার সেটাকে অসুস্থতাজনিত ভ্রম ভেবে গুরুত্ব দিলেন না। ইসাবেলাকে পরীক্ষা করে দেখলেন, ওর শরীর প্রায় রক্তশূন্য। ইমার্জেন্সি রক্ত দিতে হবে জানালেন ডাক্তার। রক্ত দেওয়ার ব্যবস্থা হলো। এই বাড়ির সেই যুবকটি রক্ত দিলো। যুবক ভদ্রলোকের হবু জামাতা। ইসাবেলার মুখ থেকে সব শুনে চিন্তিত দেখায় তাকে। কিছু একটা আন্দাজ করছে সে। বেশিক্ষণ সেটা নিজের মধ্যে চেপে রাখতে পারল না। রক্ত দেওয়া হলে হবু শ্বশুর এবং ডাক্তারকে আড়ালে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল,

“মেয়েটার এই অবস্থার জন্য অতিপ্রাকৃত কিছু দায়ী নয়তো? ওই দুঃস্বপ্নটার কথা ভেবে দেখেছেন একবার?”

হবু শ্বশুরমশায় চিন্তিত মুখে বললেন,

“ওসব কিছু নয়। ইসাবেলা এমনিতেও অসুস্থ ছিল। তবে এতটা নয়। এই তো কিছুদিন আগেও বেশ হাসিখুশি দেখেছিলাম। হঠাৎ এমন কেন যে হলো? আপনার কী মনে হয় ডাক্তার সাহেব?”

ডাক্তার একটু ভেবে বললেন,

“শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত মেয়েটি। খাওয়া দাওয়াও ঠিকমতো করেনি। ওই বুড়ি কী ওষুধ দিয়েছে কে জানে? তার উপর বুড়ির ওই পাগলামি মেয়েটিকে ট্রমায় ফেলেছে। সব মিলিয়ে বলা যায়, ভুল চিকিৎসা আর আতঙ্কে আজ ওর এই অবস্থা। প্রোপার টেক কেয়ার আর ট্রিটমেন্টের খুব বেশি প্রয়োজন এখন। আমি ঘুমের ওষুধ দিয়েছি। জাগলে আমাকে জানাবেন।”

ডাক্তারের কথার সাথে যুবক কেন যেন সম্মত হতে পারল না। সে বলল,

“আর ওই যে রাতের ঘটনার কথা বলল। যা কয়েকরাত ধরে ঘটছিল ওর সাথে। ওর শরীরের রক্তশূন্যতা। আপনার মনে হয় না এসব অস্বাভাবিক?”

ডাক্তার মৃদু হাসলেন,

“ওসব ওর ভ্রম। মানসিকভাবে অসুস্থ হলে এমন হ্যালুসিনেশন হয়। সুস্থ হলে দেখবেন সব ঠিক হয়ে গেছে।”

ডাক্তার আর তর্ক করার সুযোগ না দিয়ে বিদায় নিলেন। অযথা সময় নষ্ট করলে পকেটে টাকা আসবে কী করে? এই গাঁয়ের রোগীদের কাছে তাঁর যথেষ্ট চাহিদা। বুড়িটার কারণে একটু আকটু ঝামেলা হতো। এবার সেটাও বোধহয় মিটে গেল।
ডাক্তার চলে যেতে যুবক হবু শ্বশুরকে বলল,

“আমার একটু ভয় হচ্ছে।”

“কেন বলোতো!”

“আপনি রক্তচোষার কথা শুনেছেন?”

হবু শ্বশুরমশায় এত চিন্তার মধ্যেও হাসলেন। হবু জামাতার কাঁধ জড়িয়ে বললেন,

“শুনব না কেন? ওসব কল্পকাহিনি শুনেই তো বড়ো হয়েছি।”

“আপনি হাসছেন? আমি কিন্তু সিরিয়াসভাবেই বলছি। সতেরো শতকের দিকে জার্মানির একটি শহরে রক্তচোষার খুব প্রাদুর্ভাব বেড়েছিল। কথিত আছে, সেখানকটার একটি শহরের প্রায় সকলে মানুষ থেকে রক্তচোষাতে রূপান্তরিত হয়!”

“কোন শহরের কথা বলছ?”

যুবক একটু ভাবুক হয়ে বলল,

“বেসেলের কাছাকাছি একটি শহর। নামটি সঠিকভাবে কেউ বলতে পারে না। কেউ কেউ বলে কোনো অজানা কারণে শহরটিকে মানচিত্র থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছে। অবাক করা বিষয় হলো, যারা কৌতূহল বশত শহরটি খুঁজতে বেরিয়েছিল তাদের কেউই আর ফিরে আসেনি। সুতরাং শহরটি সম্পর্কে গালগল্প থাকলেও সঠিক কোনো তথ্য জানা নেই।”

ভদ্রলোক এবারও হেসে উড়িয়ে দিলেন যুবকের কথা। বললেন,

“এগুলো মনগড়া কথা। আমার বয়স তো কম হলো না। কই আমি তো কখনও ওসব দেখলাম না বা শুনলাম না তেমন ঘটনার কথা। তোমাদের এই বয়সে কত ফ্যান্টাসি মাথায় ঘোরে। আদতে ওগুলোর কোনো অস্তিত্ব নেই। না হলে ওই শহরে অস্তিত্ব থাকবে না কেন? রক্তচোষা বলতে তুমি যা বোঝাচ্ছ তেমন কিছু নেই। ডাক্তার বললেন না, ইসাবেলা মানসিকভাবে অসুস্থ। অযথা, চিন্তা করো না। চলো ভেতরে যাই।”

যুবকের মনের খুঁতখুঁত কিন্তু রয়েই গেল। অপেক্ষা করল ইসাবেলার জ্ঞান ফেরার জন্য। হয়তো তখন সবটা ভালোভাবে জানতে পারবে। কে জানে রক্তচোষাদের সেই কাহিনি যদি সত্যি হয়? যদি ইসাবেলার ভয়টা নিছক ভয় না হয়? দুজনে বাড়ির ভেতর প্রবেশই করবে ঠিক তখন মাদামের বাড়ির সামনে একটি কালো ফিটন এসে থামল। ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন সাদা হ্যাবিট পরনে যুবতি এক সিস্টার। ভদ্রলোক ভ্যালেরিয়াকে চিনতেন। এগিয়ে গেলেন তিনি। ভ্যালেরিয়া মাদামের বাড়ির সদর দরজা খোলা দেখে কপাল কুঁচকাল।

“সিস্টার”

ভ্যালেরিয়া পেছন ফিরে তাকাতে ভদ্রলোককে দেখতে পেলেন। অভিবাদন জানালেন জোরপূর্বক সৌজন্যমূলক হাসি হেসে। ভদ্রলোক ভ্যালেরিয়াকে সবটা খুলে বলতে ভ্যালেরিয়ার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। ইসাবেলার কাছে ছুটে এলো সে। মাদামের হঠাৎ লাপাত্তা হয়ে যাওয়া, ইসাবেলার দুরবস্থা দেখে ভ্যালেরিয়ার বুঝতে বাকি থাকল না কী ঘটেছে। নিজেকে হাজারবার তিরস্কার করল। নীরবে চোখের জল ফেলে ইসাবেলার গালে হাত রেখে। ইসাবেলার কিছু হয়ে গেলে নিজেকে কিছুতেই ক্ষমা করতে পারত না সে। ওর জন্যই মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছে। ভয়ে অসাড় হয়ে যাওয়া শরীরটাকে সেদিন টেনে বেসমেন্টের নোংরা নালায় আড়াল করাতে পিশাচটার হাত থেকে সেই যাত্রায় রক্ষা পেয়েছিল। কিন্তু বিপদ এখনও মাথার উপর। ইসাবেলাকে বাঁচাতে হলে এই মুহূর্তে এই স্থান ত্যাগ করতে হবে। ভদ্রলোককে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তখনই অচেতন ইসাবেলাকে নিয়ে রওনা হলো রিগার উদ্দেশ্যে। যুবক এবং ভদ্রলোক বেশ অবাকই হলো সিস্টার ভ্যালেরিয়ার এই আচরণে। অন্তত এক রাত কাটানোর অনুরোধও সিস্টার ভ্যালেরিয়া রাখেনি। আতঙ্কিত দেখাচ্ছিল তাকে। যুবক সন্দেহবশে রক্তচোষা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতে ভ্যালেরিয়ার মুখের রঙ বদলে যায়। এতেই প্রবল হয় যুবকের সন্দেহ। কিন্তু কে বিশ্বাস করবে তার কথা? নিজের জীবন বাঁচাতে সেও কাওকে কিছু না বলে পালিয়ে যায় ওই গ্রাম থেকে।

কোচওয়ানের জোরাল চাবুকের আঘাত পিঠে পড়তে ঘোড়া প্রাণপণে ছুটছে। লোকালয় পেরিয়ে ফিটন চলল তেপান্তরের পথ ধরে। ইসাবেলার মাথা ভ্যালেরিয়ার কোলে। ভ্যালেরিয়া ওর ঘুমন্ত মুখটার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছে। ওর মুখটা ছুঁয়ে দিচ্ছে আলতো করে। মেয়েটার এই করুণ দশার জন্য নিজেকে দায়ী করল সে। আজ যদি ওর কিছু হয়ে যেত ভ্যালেরিয়া কীভাবে বাঁচত? ইসাবেলা ওর কতটা জুড়ে আছে তা কেবল সেই জানে। ইসাবেলার কোনো ক্ষতি সে হতে দেবে না।
রিগাতে পৌঁছাতে পারলে শান্তির নিঃশ্বাস ছাড়বে ভ্যালেরিয়া। তার আগে ভয়টাকে কিছুতেই দূর করতে পারছে না। বিকেল পড়ে এসেছে। রাতে ভ্রমণ করার সাহস ওর নেই। কোচওয়ানকে বলল,

“আশেপাশে কোনো লোকালয় আছে?”

“না, তবে আরেকটু দূরে একটা পান্থশালা আছে।”

“সন্ধ্যার আগে পৌঁছাতে পারব সেখানে?”

“মনে হয় পারব।”

“তাহলে সেখানে আজ রাত থাকব। সকাল হলেই রওনা হব আবার।”

“জি, আচ্ছা।”

গোধূলির রক্তিম আভা ছড়িয়েছে পশ্চিমাকাশে। আলো যতই নিভছে ততই ভ্যালেরিয়ার আতঙ্ক বাড়ছে। কোচওয়ানকে বার বার তাগাদা দেয় দ্রুত গাড়ি হাঁকানোর জন্য। কোচওয়ান মনে মনে বেজায় বিরক্ত হয় সিস্টারের তাগাদায়। মুখে অবশ্য তা প্রকাশ করল না। দেখতে দেখতে সন্ধ্যার আঁধার নেমে এলো। ভ্যালেরিয়া আর্ত চোখে বাইরে তাকায়। বুকের ক্রুশটা মুঠোবন্দি করে ঈশ্বরের নাম জপে।

“ভ্যালেরি!”

ইসাবেলা পিটপিট করে চোখ মেলল। ভ্যালেরিয়া সকল শঙ্কা, ভয় এক মুহূর্তের জন্য ভুলে গেল। হাসি মুখে ওর মুখ আঁজলা ভরে বলল,

“ক্রাসিভায়া__” ভ্যালেরিয়ার কথা অসমাপ্ত রয়ে যায় ফিটনের সামনের ঘোড়ার অস্বাভাবিক আচরণে। কোচওয়ান কিছুতেই ওটাকে বশে আনতে পারছে না। আচমকা হলো কী ঘোড়ার? ভ্যালেরিয়া এবং ইসাবেলা ভয়ার্ত মুখে পরস্পরের দিকে তাকাল। ইসাবেলার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে বুকে জড়িয়ে ধরে ভ্যালেরিয়া।

“ভয় পেয়ো না। সব ঠিক হয়ে যাবে। সব ঠিক__”

সব ঠিক হয় না। ঘোড়া বাঁধন ছেড়ে কোথাও দৌড়ে পালিয়ে গেল। কোচওয়ান নেমে চিৎকার করতে করতে ছুটল ঘোড়ার পেছনে। ভ্যালেরিয়া ফিটনের জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। ঘোর অন্ধকার চারপাশে। ওরা যে এখন কোথায় বুঝতে পারছে না। মৃদু গলায় কয়েকবার কোচওয়ানকে ডাকল ভ্যালেরিয়া। কিন্তু তার সাড়া নেই। চারিদিকে নিগূঢ় নিস্তব্ধতা। হঠাৎ সেই নিস্তব্ধতা বিদীর্ণ করে ভেসে এলো নেকড়ের কর্কশ গর্জন। ভ্যালেরিয়ার মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিলো। গত দুই দিনে অনেক মৃত্যু দেখেছে সে। সব সাহস, বিশ্বাস ভয়ের শিকলে বাঁধা পড়েছে। লড়াই করার মতো শক্তি ওর নেই। কিন্তু ইসাবেলাকে বাঁচাতে তাকে লড়তে হবে। ভয়টাকে জয় করতেই হবে। ইসাবেলা ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আর্ত কণ্ঠে বলল,

“ওগুলো কীসের গর্জন? আমার ভীষণ ভয় করছে ভ্যালেরি।”

“ভয় পেয়ো না। কিছু হবে না তোমার। আমি বেঁচে থাকতে কিছু হতে দেবো না।”

গলার ক্রুশটা খুলে ইসাবেলার গলায় পরিয়ে দেয়। ইসাবেলা ভ্রু কুঁচকে তাকায় ওর দিকে। ভ্যালেরিয়া ওর কপালে চুমু দিয়ে বলে,

“যা বলছি মনোযোগ দিয়ে শোনো। শক্ত হতে হবে তোমাকে। আমি জানি অনেক সয়েছ এই কদিনে। অনেক শিখেছ তুমি। ক্রাসিভায়া, জীবনের এমন মুহূর্ত আসে যখন মানুষকে সার্ভাইব করা শিখতে হয়। কেউ থাকে না পাশে। তখন নিজেই নিজের শক্তি হতে হয়। তোমাকে আজ নিজের সেই শক্তিকে জাগিয়ে তুলতে হবে। সাহসী হতে হবে তোমাকে। আমাকে ছাড়াই রিগা পৌঁছাতে হবে। এখান থেকে অল্প কিছু দূরে পান্থশালা। এই রুবলগুলো রাখো। রাতটা সেখানে কাটিয়ে পান্থশালার কারো সাহায্যে রিগাগামী ট্রেনে চড়বে। পারবে না?”

ভ্যালেরিয়ার চোখ অশ্রুসজল হয়ে ওঠে। ইসাবেলা ওই চোখে চেয়ে কিছু একটা টের পায়। ভ্যালেরিয়ার হাত শক্ত করে চেপে ধরে,

“আমি তোমাকে ছাড়ব না ভ্যালেরি। পারব না একা চলতে। পারব না সাহসী হতে। তোমাকে ছাড়া কিছুই পারব না। আমাকে একা ফেলে যেয়ো না ভ্যালেরি।” অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে বলল ইসাবেলা। নেকড়ের কর্কশ গর্জন ক্রমশ এগোচ্ছে। ভ্যালেরিয়া সময় নষ্ট না করে ইসাবেলার হাত ধরে নেমে এলো। কিন্তু বড্ড দেরি হয়ে গেছে ততক্ষণে। এক পাল নেকড়ের মাঝে জড়াজড়ি করে দুজনে দাঁড়ান। নেকড়েগুলোর রক্তাভ লোলুপ চোখে চেয়ে ওদের শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল । ভ্যালেরিয়ার ভাবনা তখন ইসাবেলাকে নিয়ে। কী করে এই হায়েনাগুলোর হাত থেকে রক্ষা করবে প্রাণপ্রিয় ভাগ্নিকে সে! সম্মোহনী গলার একটা পুরুষ কণ্ঠের ডাক শুনে চমকে ওঠে।

“সিস্টার ভ্যালেরিয়া!”

বাম পাশে তাকাতেই দীর্ঘদেহী, সুদর্শন যুবককে দেখে স্তম্ভিত হয়। পরনের পোশাকে রাজকীয় ভাব। যুবকটি চোখের নিমেষে মুখোমুখি এসে দাঁড়াল। ঠোঁটের কোণে ক্রুর কুটিল হাসি, চোখদুটো রক্তিম। ঘাড় বাঁকিয়ে ইসাবেলার দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকাতে ভ্যালেরিয়া ওকে পেছনে আড়াল করে। যুবকের কুটিল হাসি আরো প্রসস্থ হয় তা দেখে। ইসাবেলা দেখল তীক্ষ্ণ ফলার মতো সাদা চকচকে দু’টি দাঁত বেরিয়ে এলো যুবকের ঠোঁটের দু’পাশ থেকে। ওর লম্বা নখওয়ালা আঙুলগুলো ভ্যালেরিয়ার মুখ ছুঁয়ে আস্তে আস্তে ঠোঁটে নিচে থামল। ঝুঁকে ফিসফিসানি স্বরে বলল,

“ভেবেছিলে বেঁচে যাবে? আহ! তোমার জন্য ভারী দুঃখ হচ্ছে এখন আমার ভ্যা-লে-রি-য়া।”

ভ্যালেরিয়ার বুকের দিকে লালসার দৃষ্টিতে তাকিয়ে যুবক নিচের ঠোঁট কামড়াল। রাগে, ঘৃণায় ভ্যালেরিয়ার শরীর রি রি করে ওঠে। কষে এক চড় বসাল ওর গালে। মুহূর্তে যুবকের রূপ বদলে যায়। গলা টিপে ধরল ভ্যালেরিয়ার। ইসাবেলা চিৎকার করার আগেই ভ্যালেরিয়ার গলা ধরে দূরে ছুঁড়ে ফেলল। ইসাবেলা চেঁচিয়ে কেঁদে ওঠে,

“ভ্যালেরি!”

এবার ইসাবেলার দিকে অগ্রসর হয় যুবক৷ কিন্তু ওর গলার ক্রুশটা দেখতে থমকে যায়। দাঁত খিঁচিয়ে ওঠে। ইসাবেলা দৃষ্টি তখন ভ্যালেরিয়ার দিকে। একজন মধ্যবয়সী অতিব সুন্দরী রমণী ভ্যালেরিয়ার দিকে এগিয়ে আসছেন। তাঁর ঠোঁটের কোণে ক্রুর হাসি। দৃষ্টিজোড়া বড়ো হিংস্র, নির্মম। রমণীর পোশাক এই যুবকের মতোই রাজকীয়। চলনেও রাজকীয় ভাব। যেন কোনো রাজ্যের রাণী তিনি। ভ্যালেরিয়ার আহত শরীরটাকে টেনে দাঁড় করালেন। যুবক সেদিকে চেয়ে মুচকি হেসে বলে,

“বাঁচাতে চাও ওকে?”

“প্লিজ! তোমার পায়ে পড়ছি ছেড়ে দাও ভ্যালেরিকে।” ইসাবেলা মিনতি করে। যুবকের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল,

“তবে গলার ওটা খুলে ফেলো। খোলো, খোলো।”

ইসাবেলা ক্রুশটা মুঠোবন্দি করে মাথা নাড়ায়। সে জানে এটা খুললে কী হবে। যুবক দাঁতে দাঁত পিষে খিঁচিয়ে ওঠে,

“তবে মরুক ও। মেরে ফেলো সিস্টারকে।”

“না, না। মেরো না ওকে। আমি খুলছি।”

ভ্যালেরিয়া নিষেধ করতে চায়। কিন্তু রমণী ওর গলা ধরে চেপে আছে। গোঙানি ছাড়া কিছুই যেন বের হলো না। ইসাবেলার পরিণতি স্মরণ করে কাঁদতে লাগল। সিস্টার ভ্যালেরিয়ার কান্না রমণীর আনন্দ আরো বাড়িয়ে দেয়। অদৃশ্য থেকে লাল চুলের অনিন্দ্য সুন্দরি এক যুবতি হেলেদুলে এসে থামল রমণীর পাশে। ওর মুখের আবেদনময়ী হাসি দপ করে নিভে গেল। খিঁচিয়ে উঠল হিংস্রতার সাথে,

“শেষ করে ফেলো এই মাগিটাকে। বড্ড জ্বালিয়েছে আমাদের। আজ ওর রক্ত দিয়ে হলি খেলে তবেই শান্তি হবে।”

“ভাষা সংযত করো ইভারলি। ভুলে যাচ্ছো কার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছ তুমি। বার বার একই ভুলের ক্ষমা মিলবে না। গলা থেকে মুন্ডুটা আলাদা করে ফেলব পরবর্তীতে এহেন আচরণ করলে। নত হও আমার সামনে, নত হও।”

রমণী গর্জে ওঠেন। ইভারলি নাম্নি মেয়েটি অনিচ্ছা স্বত্বেও নত হয়। রমণীর দৃষ্টি আবার ফেরে ভ্যালেরিয়ার মুখের উপর। ভ্যালেরিয়ার এই ভয়, যন্ত্রণা তিনি ভীষণ উপভোগ করছেন। স্বীকারকে একটু নাড়িয়ে চাড়িয়ে শেষ করার আনন্দই অন্যরকম।

“তোমার মৃত্যু তোমার অন্য সকল সাথীদের মতোই হবে সিস্টার। স্বর্গে বসে তোমার এই মানব শরীরের অপমান দেখবে। তোমার ঔদ্ধত্যে আমি ক্ষুব্ধ হয়েছি। আমার ক্ষুব্ধতা আজ তোমার রক্তপানে মিটবে। তারপর তোমার লাশটাকে ওই ক্ষুধার্ত নেকড়েগুলোর সামনে ফেলে দেবো। ছিঁড়ে খাবে ওরা তোমার শরীর।”

নিষ্ঠুর অট্টহাসিতে ফেটে পড়েন রমণী। মুখ নামিয়ে এনে ফিসফিসিয়ে বলেন,
“আলবিদা সিস্টার। আর হ্যাঁ, তোমার সঙ্গীকে একটু পরেই পাঠাচ্ছি। অপেক্ষা করো উপরে বসে।”

রমণী ইসাবেলার দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে তীক্ষ্ণ দাঁত দু’টি বসিয়ে দিলো ভ্যালেরিয়ার গলায়। ভ্যালেরিয়ার শরীর তীব্র ঝাঁকুনি দিয়ে ওঠে। গোঁ গোঁ শব্দ বের হয় ওর গলা দিয়ে।

“ভ্যালেরি! না, না, ওকে ছেড়ে দাও।”

ইসাবেলা ছুটে যেতে চায় কিন্তু যুবকটি তাকে দুবাহুতে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। একটু দূরে পড়ে আছে ভ্যালেরিয়ার দেওয়া ক্রুশটা। ইসাবেলার চোখের সামনে ভ্যালেরিয়ার নিথর দেহটি বরফের উপর আছরে পড়ে। ইসাবেলা স্তব্ধ, বিমূঢ়। ওর চোখ দিয়ে অবাধে জল গড়াচ্ছে। গলার কাছে রক্তপিপাসু যুবকের উষ্ণ নিঃশ্বাস আর তীক্ষ্ণ দাঁতের স্পর্শ অনুভব করে। কিন্তু আজ আর ভয় নেই। দু-চোখ বন্ধ করে অপেক্ষা করে মৃত্যুর। ভয়, মৃত্যু! আজ এই দুটি থেকে তার মুক্তি হবে।

চলবে,,

(ওই যে জার্মানির রক্তচোষার কাহিনি উল্লেখ করেছি ওসব কথা উপন্যাসের খাতিরে বানানো। কেউ আবার সত্যি সত্যি মনে করবেন না।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here