তিমিরে ফোটা গোলাপ পর্বঃ ১৭

0
672

তিমিরে ফোটা গোলাপ
পর্বঃ ১৭
Writer Taniya Sheikh

ভালো সময় চোখের পলকে শেষ হয়ে যায়। আজ রাত পোহালে নিকোলাসের বেঁধে দেওয়া দুটো দিন শেষ হবে। ইসাবেলার ভাগ্যে আগামীকাল সকালে কী অপেক্ষা করছে জানা নেই। আশ্চর্য ব্যাপার হলো, এই নিয়ে সামান্য উদ্বিগ্ন হলেও ভীত নয় সে। এ ক’মাসের অতি ভীতিকর পরিবেশে থাকতে থাকতে বুঝি ভয়টাকে আজ আর তেমন ভয় করছে না। মনে হচ্ছে যা হয় হোক। মৃত্যু হবে? সে একদিন সবারই হবে। আফসোস চিরনিদ্রায় শায়িত হওয়ার আগে পরিবারের কারো মুখদর্শন হবে না। তখনই ভীষণ কষ্ট হয়। জীবনটা কেমন বদলে যায়! এই বদল কখনও আশা করেনি। এই বদলে যাওয়া সময়, পরিস্থিতি ইসাবেলার কতটা ক্ষতিসাধন করেছে তা যদি কেউ জানত! বুকের গভীর থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।

“ইসাবেল, ঘুমিয়ে পড়েছ?”

“না, তোমার অপেক্ষা করছিলাম শুয়ে শুয়ে।”

নোভা দরজার মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। মেয়েটা অনিন্দ্য সুন্দরি। ভাইদের মতোই ওর রূপ। কিন্তু হিংস্র আর নিষ্ঠুর নয়। ইসাবেলা সারাক্ষণ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। ওর এমনই তাকিয়ে থাকা দেখে নোভা মাঝেমাঝে হাসে। মেয়েটা যতটা না সুন্দর ওর হাসি তারচেয়ে বেশি সুন্দর।

“আবার ওমন ভ্যাবলার মতো চেয়ে আছো?”

“তোমার রূপই যা, ভ্যাবলা না হয়ে পারি না। আচ্ছা, তোমার রূপের রহস্য কী?”

নোভা হেসে কুটিকুটি হয়। বলে,

“আমার রূপের রহস্য জেনে কী করবে?”

“আমিও একটু সুন্দর হতাম। শ্রী ছাড়া মুখ আমার।”

মুখটা শক্ত হলো নোভার। রাগ রাগ গলায় বলল,

“তোমায় কে বলেছে তোমার মুখে শ্রী নেই?”

“কত লোক বলেছে। আমাদের মহল্লার মেয়েরা সব সময়ই টিটকারি মারত। তারপর পিটার ছেড়ে চলে গেল। আমি অসুন্দর বলেই তো চলে গেল। আমি নিজেও জানি, আমি অসুন্দর।”

“সুন্দর বলতে কী বোঝো তুমি ইসাবেল? গায়ের উজ্জ্বল রং, নিখুঁত চেহারা, নিখুঁত গড়ন এই তো?”
ইসাবেলা একটু ইতস্তত করে। নোভা ওর হাতটা ধরে বলে,

“তোমার কি এসবে কমতি আছে? কোথায় কমতি আছে?”

ইসাবেলা মুখ নিচু করে ফেলে। ওর কমতি কী ও জানে না। আয়নায় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে খুব দেখেছে। সরু ছোটো নাক, ডাগর চোখ, ভ্রমর কালো ভ্রু, গোলাপি পাতলা ঠোঁট।

“লোকে বলে আমি সেকেলে।”

“লোকের কথাকে এত গুরুত্ব কেন দাও ইসাবেল? তোমার জীবনে অন্যের মতামত কেন প্রাধান্য পাবে। নিজেকে ভালোবাসতে শেখো। দেখবে বাকিরাও ভালোবাসবে। তুমি যদি নিজেকে ভাবো অসুন্দর, অন্যদের বলতে বাধবে কেন? ভুল বললাম?”

ইসাবেলা মাথা নাড়ায়,

“না”

“দেহের সৌন্দর্য ক্ষয়ে যায়, নিঃশেষ হয় একসময়। কিন্তু এই মন, এই আত্মার সৌন্দর্য অক্ষয়, চিরস্থায়ী। তোমার সৌন্দর্য এখানেই বেশি ইসাবেল। তোমার মনটা বড়ো বেশি সুন্দর, সরল। শুধু মন নয়, তোমার রূপও সুন্দর। তবে আমাদের মতো নয়। তোমার রূপ ঠিক প্রকৃতির শুদ্ধতায় ফোটা গোলাপের ন্যায়। তুমি গোলাপের মতো কোমল, পবিত্র। গোলাপের সৌন্দর্যের কোন কাল নেই। সে সবকালেই একই রকম সুন্দর। বোধহয় জানো না, সাধারণের মধ্যে অসাধারণ তুমি। তোমার জন্য আমি আমার বড়ো ভাইয়ের বিপক্ষে কথা বলেছি। অথচ, তখন তোমাকে আমি চিনতামও না। কেন ওইদিন নেকড়ের হাত থেকে বাঁচিয়েছি জানো?”

“আমাকে তোমার নিষ্পাপ মনে হয়েছে বলে।”

নোভা মাথা নাড়ায়,

“শুধু ওই এক কারণ না।”

“তবে?”

“তোমার মাঝে আমি আমার মৃত মাকে দেখেছি ইসাবেল।”

“তোমার মৃত মা?”

“হ্যাঁ, আমার আর নিকোলাসের মা।”

নোভার মুখ বিমর্ষ। ইসাবেলা ওর হাত ধরে মৃদু চেপে জিজ্ঞেস করে,

“তিনি কি তোমাদের মতো নয়?”

“না, তিনি পবিত্র আত্মা। তোমার মতো সাধারণ কিন্তু মনের দিক থেকে, নীতির দিক থেকে অসাধারণ ছিলেন। আমরা সকলে যখন অস্তিত্ব রক্ষার্থে এই জীবনকে বেছে নিয়েছি, মা তখন নাকচ করেছেন এই জীবন। তিনি স্বাভাবিক মৃত্যুর পথ বেছে নিয়েছিলেন। আমাদের বাবা সবসময়ই ক্ষমতালিপ্সু ছিলেন। ক্ষমতার লোভ তাকে অমানুষ করে তুলেছিল। কিন্তু আমাদের মা ছিলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন। যদিও তিনি ভীষণ ভালোবাসতেন বাবাকে। তাই বলে ধর্ম এবং মনুষ্যত্ব ত্যাগ করেননি। মায়ের প্রিয় এবং আদুরে ছিল নিকোলাস। মা সবসময়ই নিকোলাসকে বাবার খারাপ ছায়া থেকে আগলে রাখতে চেয়েছিল। কিন্তু পারেনি। বাবার আদেশ এবং কমিনিউটির কথা ভেবে মায়ের নিষেধ উপেক্ষা করতে হয় নিকোলাসকে। মায়ের চোখের সামনে পাপের জীবনে পর্দাপন করে। আমার আজও সেদিনের কথা মনে পড়ে, মা চিৎকার করে কাঁদছিলেন। ভয়, আতঙ্ক তাঁর চোখে মুখে ছিল। বুকে আগলে বসে ছিলেন আমার অসুস্থ শরীর। বাবা জোর করে মায়ের কোল থেকে টেনে নিয়ে গেলেন আমাকে। তুলে দিলেন নিকোলাসের সামনে। মায়ের সামনেই তাঁর আরেক সন্তান সেদিন রক্তপিপাসুতে পরিণত হয়। মায়ের কান্না থেমে গেল। সকলের মতো মহামারীতে অসুস্থ ছিলেন তিনিও। নিকোলাস তার সামনে হাঁটু মুড়ে বসে। মা মুখ তুললেন৷ চোখ দুটো রাগে জ্বলছিল। এলোপাতাড়ি চড় মারতে লাগলেন প্রিয় সন্তানের গালে। একসময় তাঁর শ্বাসে টান ওঠে। নিকোলাস শ্বদন্ত বের করে ঝুঁকে পড়বে তখনই মা বাইবেলের কয়েক লাইন আওড়াতে শুরু করেন। ভীষণ কষ্টে ছিটকে সরে যায় নিকোলাস। মা থামলেন। অগ্নিদৃষ্টিতে বললেন,

“আমি স্বাভাবিক মৃত্যু চাই। স্পর্শ করবে না তোমরা কেউ আমাকে। তোমাদের সবার হাত পাপের রক্তে রঞ্জিত। ঘৃণিত পিশাচ তোমরা। তুমি নিকোলাস, তুমি আমার সন্তান নও। তুমি আমার নিকো নও। তুমি একটা পিশাচ। স্বার্থ আর ক্ষমতার লোভের আগুনে তুমি আমার নিকোকে, আমার নোভাকে ভস্মীভূত করেছ। ঘৃণা করে এই মা তোমাকে। একদিন পস্তাবে এই জীবন গ্রহণ করায়। অভিশাপ দেবে নিজেকে। স্মরণ করো সেদিন আমাকে তুমি। আজ আমাকে মুক্তি দাও। ওই পাপের জীবনে নিয়ো না। ঘৃণা করি ওই জীবন আমি। আমার অনুরোধ তুমি রাখো নিকোলাস। মরতে দাও আমায়। আমার কসম লাগে মরতে দাও।”

বাবা নিকোলাসকে জোর করেন। কিন্তু নিকোলাস মায়ের কথা রেখেছিল। সবার বিপক্ষে গিয়ে মাকে মরতে দিয়েছিল স্বাভাবিক ভাবে। চোখের সামনে মায়ের মৃত্যু দেখেছি আমরা। ওইদিনই শেষবার আমি কাঁদতে দেখেছিলাম নিকোলাসকে। এরপরে সে কেমন যেন হয়ে যায়। যদিও আমরা কেউ ই আর স্বাভাবিক নেই। কিন্তু ও যেন একটু বেশিই হিংস্র আর নির্মম হয়ে ওঠে। অনুভূতি শূন্য, নির্দয়। কারো পরওয়ার করেনা, কারো ভালো ভাবে না।”

হাঁফ ছেড়ে থামে নোভা। উঠে গিয়ে সামনের একটা টেবিলের ড্রয়ার খোলে। সাদা সিল্কের কাপড়ে মোড়ানো একটা বস্তু হাতে। আবার বসল ইসাবেলার সামনে। কাপড়টা সরাতে ইসাবেলা মুগ্ধ হয়ে চেয়ে রইল। ভিক্টোরিয়ান ড্রেস, মাথায় স্কার্ফ পরনে। খুব সাদামাটা সাজে দাঁড়ান এক নারী মূর্তির স্থিরচিত্র। তার চোখ দুটো ঠিক নিকোলাসের মতো। নোভা আর ওর মায়ের হাসিতে যথেষ্ট মিল আছে। ভদ্রমহিলার মুখখানা বড্ড মায়াবী।

“খুব মায়াবী মুখটা, না?” নোভা সিক্ত কণ্ঠে বলল। ইসাবেলা জবাব দেয়,

“হুম।”

“ঠিক তোমার মতো। তাইতো তোমাকে আমার এত আপন লাগে।”

ইসাবেলা সলজ্জিত হাসি হাসে। নোভা ওর থুতনি তুলে বলে,

“এসো বাইরে যাই।”

দুজনে অন্য রাতের মতো নৈশ ভ্রমনে বের হলো। রাতের জ্যোৎস্নায় নোভার সাথে বনমধ্যে ঘুরতে বেশ লাগে ইসাবেলার। নোভা নিকোলাসদের মতোই রক্তপিপাসু। কিন্তু মায়ের প্রতি ভালোবাসা আর শ্রদ্ধায় সে বছরের পর বছর সাধনা করে মানুষের রক্ত পান ছেড়ে দিয়েছে। পশুর রক্ততে সন্তুষ্ট হতে শিখেছে এখন। রাতে জেগে শিকারে বের হয়। ইসাবেলা পাশেই থাকে। কোনোদিন বনমোরগ, কোনোদিন শেয়াল কিংবা সাপ, এসবেই ওর পিপাসা মেটে। মাঝেমধ্যে পশুর মাংসও সে খায়। নোভার শিকার ধরার দৃশ্য যতটা না কৌতূহলী মনে হয়। শিকার ভক্ষণ করার দৃশ্য ততটায় ভয়ংকর ইসাবেলার কাছে। পেট ভরে গেলে ইসাবেলাকে সাথে করে রাতটা উপভোগ করে। এই জঙ্গলে বিশেষ বিশেষ ফুল রয়েছে। যা কেবল রাতের বেলাতেই ফোটে। ভোর হতে মূর্ছে ঝরে যায়। ওই ফুলগুলো না কি অসম্ভব সুন্দর হয়। আলাদা রকম জ্যোতি বের হয় যখন ফোটে। নোভা ওয়াদা করেছে ইসাবেলাকে একদিন দেখাবে সেই সব ফুল পরিস্ফুটিত হতে। ইসাবেলা মনে মনে হাসে। রাত পোহালেই নিকোলাস নিয়ে যাবে। তারপর কী হবে কে জানে? আর কোনো রাত ওর জীবনে হয়তো আসবে না। নোভার সাথে ঘুরে ঘুরে রাতটা কখন সে শেষ হলো টেরই পেল না। ভোর হতে নোভা ফিরে গেল নিজের কফিনে। আর ইসাবেলা রুমে ফিরে এলো। ঘুম সহজে আসে না। নোভাকে কী বলা উচিত ছিল নিকোলাসের পরিকল্পনার কথা? তাতে কী কোনো লাভ হতো? বাঁচাতে পারত সে ইসাবেলাকে? এসব নানান কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ল। যখন ঘুম ভাঙল চারিদিকে পরিষ্কার আলো। ঘুম ঘুম চোখে বিছানার ওপর উঠে বসল। এই ঘরের দেয়াল ঘড়ি জানান দিচ্ছে দুপুর পৌনে বারোটা বাজে। যে কোনো সময় নিকোলাসের আগমন ঘটবে। সে হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে রইল। কেন যেন এই মুহূর্তে ভীষণ কান্না পাচ্ছে। কিন্তু কাঁদল না। বাইরের দরজায় নক পড়তে অলসভাবে সোজা হয়ে বসল।

“আসুন।”

নিকোলাস আসেনি। দাসীকে ফাঁসীর মঞ্চে নিয়ে যেতে রাজা আসতে যাবে কেন? ভৃত্যটিকে পাঠিয়েছে। সকালের নাস্তার ট্রে পাশে রেখে ভৃত্যটি বলল,

“খাওয়া হলে নিচে নেমে এসো। আমি অপেক্ষা করব সেখানে। বেশি দেরি যেন না হয়।”

ভৃত্যটি চলে যাবে তখনই ইসাবেলা বলল,

“আমার খিদে নেই। চলুন যাওয়া যাক।”

ভৃত্যটি ওর মুখের দিকে তাকাল। আজ এতদিন বাদে লোকটার নির্বিকার মুখে কিছু যেন দেখতে পেল। দয়া? উদ্বিগ্নতা? মনে মনে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল ইসাবেলা। ভৃত্যটিকে পাশ কাটিয়ে সামনে এগোয়। নোভার কফিন রাখা রুমের দিকে যেতে ভৃত্যটি বলল,

“রাজকুমারী সেখানে ইতোমধ্যে পৌঁছে গেছেন।”

“ওহ!”

নোভা তবে সবটা জানে! ইসাবেলা ভৃত্যকে অনুসরণ করে চলল। হলঘর পেরিয়ে ওরা থামল বড়ো এক লোহার দরজার সামনে। পুরোনো আমলের কারুকার্য দরজায় গায়ে। ঝুলকালির চিহ্ন নেই। এদিকটার সব কটা কক্ষের মেঝে, দেয়াল এবং দরজা ঝকঝকে পরিষ্কার। ভৃত্য দরজা ঠেলতে খুলে গেল। সে ঢুকল না। ইসাবেলাকে ইশারা করল ভেতরে ঢুকতে। লোকটা ওর যথেষ্ট খেয়াল রেখেছে। মৃত্যুর দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে এক চিলতে হাসি কৃতজ্ঞতাস্বরূপ উপহার দিলো। ভৃত্যটি দুঃখভরাক্রান্ত মুখে মাথা নত করে। ইসাবেলা পা রাখল কক্ষের ভেতর। এই কক্ষে সূর্যের আলো প্রবেশ করেনি। গুমোট অন্ধকার কক্ষের ভেতর। ইসাবেলা টের পাচ্ছে ওর হাত- পা কাঁপছে। মৃত্যু ভয় একটু একটু করে স্পর্শ করছে। দুটো মশাল জ্বলে আছে সরু এক খোলা দরজার সামনে। ইসাবেলা সেই দরজার সামনে দাঁড়ায়। ভেতরে পুরুষালি গলায় কে একজন বলছে,

“একটা মেয়ে মানুষের জন্য এতবড়ো রিস্ক নিতে গেছো তুমি? এর পরিণাম কত ভয়াবহ হতে পারে ভাবতে পারো? গায়ের লোকে এ নিয়ে কথাবার্তা বলছে। নেকড়ের রূপে ওরা তোমাকে দেখে ফেলেছে নিকোলাস। আমাদের শত্রুদের কানে গেলে কী হবে ভাবতে পারো? তোমার বোকামিতে আমরা শেষ হয়ে যাব।”

“বাবা! আপনি ভুলে যাচ্ছেন কাকে প্রশ্ন করছেন, কার কাজের কৈফিয়ত চাচ্ছেন। আমি যা করেছি তার কৈফিয়ত কাওকে দেবো না। এই কমিউনিটির রাজা আমি, আপনি নন। কোনটাতে ভালো হবে আর কোনটাতে মন্দ হবে তা আপনার চাইতে ভালো করেই জানা আছে আমার।”

“তাহলে ওকে বাঁচাতে নেকড়ের রূপ ধারণ করলে কেন?”

“আবার বলছি, আমি আমার কাজের কৈফিয়ত দিইনা কারো কাছে। শুধু এটুকু সবার জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি, যা করেছি আমার নিজের কারণে। লোকটা আমাকে অসম্মান করেছিল। অসম্মান কিছুতেই বরদাস্ত করি না আমি। ব্যস, শিক্ষা দিয়েছি। ওই মেয়ে বাঁচল কী মরল তাতে আমার কিছু আসে যায় না। আর কোনো কথা হবে না এই বিষয়ে। বুঝাতে পেরেছি?”

রাগত মুখে পিতার দিকে তাকায়। রিচার্ড রাগ চেপে মাথা নাড়িয়ে বসে নিজের চেয়ারে। নিকোলাসের দৃষ্টি বাকি সবার দিকে যায়। সকলে মাথা নাড়ায়। অতঃপর ইসাবেলার পায়ের শব্দে সবার দৃষ্টি যায় দরজার দিকে। ভেতরে ঢুকে নিকোলাসের কঠোর, হিংস্র দৃষ্টির সম্মুখীন হয় ইসাবেলা। দাম্ভিকতার সাথে কারুকার্য শোভিত সিংহাসনে আসীন নিকোলাস। পরনে সাদা কালো পুরিতান। দৃষ্টি নমনীয় করতে ইসাবেলা অন্যদিকে তাকায়। নোভা ছাড়া দুই সারিতে বসা পিশাচদের রক্তিম চোখ জ্বলজ্বল করে ওঠে। শ্বদন্ত বেরিয়ে আসে লাল টুকটুকে ঠোঁটের পাশ থেকে। ঘর ভর্তি রক্তপিপাসুর মাঝে দাঁড়িয়ে আছে। রক্ত হিম হয়ে এলো ইসাবেলার। নোভা আন্দ্রেইর হাত চেপে ধরতে আন্দ্রেই লোভ সংবরণ করে। নিকোলাসের ভয়ে বড়ো কষ্টে বাকিরা চেয়ারে বসে আছে। নিকোলাসের ভয় না থাকলে এতক্ষণে ইসাবেলাকে লুটেপুটে খেত। নোভা মলিন মুখে জোর পূর্বক হাসল। ইসাবেলাও তাই করে। নিকোলাসের দৃষ্টি এড়িয়ে যাচ্ছে যথাসম্ভব সে।

“আন্দ্রেই”

নিকোলাসের গলার স্বর ঠাণ্ডা অথচ প্রচণ্ড। আন্দ্রেই দাঁড়ায়।

“জি, ভাই।”

“তোমার অপরাধী উপস্থিত। বলো কীভাবে শাস্তি দিতে চাও?”

কক্ষ জুড়ে কিছুক্ষণ পিনপতন নীরবতা নেমে এলো। আন্দ্রেই মুখ খুলল,

“এই মেয়েকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দাসী হিসেবে চাই। তবে__”

“আন্দ্রেই!” ছেলের কথা শেষ হওয়ার আগেই সোফিয়া প্রতিবাদ করে। রিচার্ড রেগে বলেন,

“ও মানুষ। একটা মানুষকে তুমি আমাদের মাঝে রাখতে পারো না। আমাদের সকলের বিপদ ডেকে আনবে এই মেয়ে। এক্ষুনি মেরে ফেলে ঝামেলা শেষ করো।” রিচার্ড হিংস্র মুখে উঠে দাঁড়াতে নিকোলাস থামিয়ে দেয়,

“বাবা, আন্দ্রেইকে কথা শেষ করতে দিন।”

গজগজ করতে করতে পুনরায় বসল রিচার্ড। আন্দ্রেই ইসাবেলা পাশে দাঁড়াতে সরে গেল ইসাবেলা। আন্দ্রেই মুচকি হাসল। নিকোলাস ভ্রু কুঁচকাতে গম্ভীর মুখে বলল,

“আমরা সকলে জানি নোভা নিজেকে বদলে ফেলেছে। মানুষের রক্তের বিপরীতে পশুর রক্তে অভ্যস্ত করেছে নিজেকে। যা আমাদের কমিউনিটির জন্য মোটেও শোভনীয় না। আমরা সকলেই এক। ও কেন আলাদা হবে? মানুষের প্রতি ওর কেন মায়া-মমতার সৃষ্টি হবে। এসব তো দূর্বল মানুষের প্রকৃতি। আমরা সকলে জানি মানুষদের থেকে ভ্যাম্পায়াররা শক্তিশালী। এক নোভা আজ মানুষের প্রকৃতি ধারণ করে বদলে যাচ্ছে। কাল ওর সান্নিধ্যে এসে আরেকজন বদলাবে। এমন চলতে থাকলে ভ্যাম্পায়ার কমিউনিটি আর মানুষের মধ্যে পার্থক্য কী থাকবে?”

“মূল কথায় এসো আন্দ্রেই” নিকোলাস বিরক্ত গলায় বলল। আন্দ্রেই গলা পরিষ্কার করে বলতে শুরু করে,
“আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি সে করেই হোক নোভাকে আবার আগের মতো মানুষের রক্তে অভ্যস্ত করব। কিন্তু সেই জন্য মানুষের রক্তের স্বাদ, গন্ধে আকৃষ্ট করতে হবে ওকে। এই মেয়েটি হবে নোভার দাসী। ওর সাথে সর্বক্ষণ থাকবে। মানুষ আর ভ্যাম্পায়ার আগুন আর জলের মতো। আবার চুম্বক আর লোহার মতোও। একসাথে মিশবে না ঠিকই কিন্তু নিজস্ব চাহিদায় আকৃষ্ট হবে। এই মেয়ের শরীরে প্রবাহিত রক্তকে নোভা বেশিদিন উপেক্ষা করতে পারবে না। নিজের নীতি থেকে বেরিয়ে আসবেই।”

“আমি এই মেয়েকে দাসী হিসেবে কিছুতেই রাখব না।”

নোভা প্রতিবাদ করে। আন্দ্রেই জোর গলায় বলে,

“অবশ্যই রাখবে।”

“কিছুতেই না। বাবা আন্দ্রেইকে নিষেধ করুন। আমি যেমন আছি বেশ আছি। আমার ব্যাপারে নাক গলালে খারাপ হয়ে যাবে বলে দিলাম।”

“আন্দ্রেই ঠিক বলেছে। তোমার স্বভাব পরিবর্তন আমাদের ছোটো করেছে নোভালি আগাথা ওয়াল্টার। নিজের কাজে লজ্জা হওয়ার বদলে গলা উঁচু করছ? লজ্জা হওয়া উচিত তোমার। ডারলিং, কিছু বলো মেয়েকে।”

রিচার্ড অন্যমনস্ক হয়ে ছিল। স্ত্রীর ডাকে মৃদু গলা ঝেড়ে বলল,

“ভাইয়েরা যা বলে তাই করো নোভা। তোমার মায়ের মতো লজ্জিত করো না আমাকে।”

নোভা প্রতিবাদ করতেই যাচ্ছিল কিন্তু নিকোলাসের কর্কশ গলার স্বরে থেমে গেল।
“ব্যস! আন্দ্রেই, তুমি তাহলে এই মেয়েকে মারতে চাচ্ছ না?”

“না”

“নোভা তুমি কি এই মেয়েকে দাসী হিসেবে রাখবে?”

“বড়ো ভাই মানে__”

“হ্যাঁ অথবা না?”

নোভা পরাজিত মুখে মাথা নত করে রইল।

“হ্যাঁ অথবা না নোভা?”

“হ্যাঁ। রাখব ওকে।”

পুরো কক্ষে এবার ফিসিরফিসির শুরু হলো। একজন তো বলেই ফেলল,

“এই মেয়ের কারণে কোনো বিপদ নেমে এলে? বিশ্বাস কী এই মেয়ের, সে আমাদের মাঝে থেকে আমাদের ক্ষতি করবে না? তাছাড়া ও এখানে থাকলে একটা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে।”

নিকোলাস উঠে দাঁড়াতে চুপ হয়ে যায় সকলে। নোভার দিকে তাকায় নিকোলাস।

“জবাব দাও নোভা।”

আন্দ্রেই ছোটো বোনের পক্ষ হয়ে বলে,

“আমি গ্যারান্টি দিচ্ছি তেমন কিছুই হবে। আর হ্যাঁ, একটা বোকা, তুচ্ছ মেয়েমানুষকে নিয়ে এতটাও ভয় পাওয়া উচিত নয় আপনাদের।”

সকলে আন্দ্রেইর কথাতে পুরোপুরি সম্মত না হলেও আর প্রতিবাদ করে না। নিকোলাস ইসাবেলার দিকে তাকায়। ইসাবেলার দৃষ্টি পায়ের দিকে। ভাইয়ের অনুমতিতে নোভা ওর হাত ধরে বেরিয়ে এলো। কী যে হলো মাথামুণ্ডু বুঝল না ইসাবেলা। আন্দ্রেই কেন এমন সিদ্ধান্ত নিলো? এসব যখন ভাবছিল তখনই ফিসফিসিয়ে আন্দ্রেই নোভাকে বলল,

“তুমি যে কী করতে চাইছ বুঝতে পারছি না। ভাই আসল ব্যাপার টের পেলে রক্ষে থাকবে না আমাদের।”

নোভা প্রত্যুত্তরে মুচকি হাসল। ইসাবেলা এবং আন্দ্রেই ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল।

চলবে,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here