#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব–৩৪
Writer তানিয়া শেখ
গুমোট এই খুপরির মধ্যে ইসাবেলার খুব কষ্ট হচ্ছিল। গরমে ওর গায়ের মেরুন রঙা ফ্রকটা ভিজে সেঁটে আছে চামড়ার সাথে। অসহ্য লাগল একপর্যায়ে। তার ওপর ইঁদুর আর পোকামাকড়ের উপদ্রব। রাতে দুচোখের পাতা কিছুতেই এক করতে পারল না। বেলা বাড়তে গুমোট ভাবের সাথে যুক্ত হলো সূর্যের তাপ। হাতপাখা চালাতে চালাতে ওর হাত ধরে এলো। অতিরিক্ত ঘামে শরীর দুর্বল। ও যেন নিজে থেকে একটু জোর করল ঘুমানোর জন্য। সারারাত একটু আতঙ্কে ছিল এই বুঝি নিকোলাসের বলা ওই লোকগুলো এলো। কিন্তু না, এখনও তাদের নামগন্ধ নেই। আর আসবে বলে মনে হলো না। সুতরাং ইসাবেলা এই অসহ্য পরিস্থিতি কাটাতে ঘুমানোর সিদ্ধান্ত নিলো। দুপুর পর্যন্ত ঘুমালেই হবে। তারপর তো নিকোলাস আসবে। তখন নিশ্চয়ই এখানে আর থাকতে হবে না। পরিস্থিতি মানুষকে কত কিছু মানিয়ে নিতে শেখায়। ইসাবেলাও তেমনই মানিয়ে নিলো। অনেকক্ষণ চেষ্টার পর ঘুমিয়ে পড়ল ও। ঘুমের মধ্যে আজ একটা নতুন স্বপ্ন দেখল। পাহাড়ের ওপর সবুজ ঘাসের ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে আছে ও। দু’হাত পেটের ওপর। ঠোঁটে প্রশান্তির হাসি। একটা পরিচিত পুরুষালি হাত এসে থামল ওর গালের একপাশে। লজ্জায় লাল হলো ও। মানুষটা সরে এলো। কাঁধে চুমু দিতে লাগল। ইসাবেলা দুচোখ বন্ধ করে তার উষ্ণতা অনুভব করে। গালে রাখা হাতটা ওর মুখটাকে ধীরে ধীরে এগিয়ে নেয় মানুষটার কাছে। গভীর চুম্বন দেয় ঠোঁটে। ইসাবেলা আস্তে আস্তে চোখ মেলে তাকায় মানুষটার চোখে। চমকে ওঠে সাথে সাথে। কিন্তু পরক্ষণেই শান্ত হয়ে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে তার গলা। টেনে আনে নিবিড় আলিঙ্গনে। ঠোঁটের কোণে মানুষটার মুচকি হাসি টের পায়। দুচোখ আবার বন্ধ করে ও। একই ছন্দে নড়ে দু’জোড়া ঠোঁট, দুটো জিহ্বা। হঠাৎ একটা শব্দে স্বপ্নটা ভেঙে গেল। ইসাবেলা চোখ মেললেও নড়েচড়ে না। ওর সমস্ত শরীর যেন জমে গেছে। কী দেখল ও? ওর মনে হচ্ছে এখনও ঠোঁটের ওপর, মুখের ভেতর সেই উষ্ণতা টের পাচ্ছে। নিকোলাসের চুম্বনের উষ্ণতা। বেশ বড়োসড়ো ঢোক গিললো। লজ্জায় কান গরম হয়ে গেল। হৃৎস্পন্দন তীব্র হলো। এমন স্বপ্ন কেন দেখল তাই ভেবে দিশেহারা হয়। মাথার ওপর থেকে আবার শব্দটা এলো। সজাগ হয় ইসাবেলা। স্বপ্নের রেশের আবেশ ঠেলে সরিয়ে উঠে বসল। কেউ হাঁটছে বাড়ির ভেতর। বেসমেন্টে বসে ও স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে সেই শব্দ। গলা শুকিয়ে এলো। নিকোলাসের দেখিয়ে দেওয়া তক্তার দিকে চোখ গেল। এখনই কি বেরিয়ে যাওয়া ঠিক হবে? না আরেকটু দেখবে? হয়তো ওরা বেসমেন্ট পর্যন্ত আসবে না। ইসাবেলা ভাবতে ভাবতে সতর্কে ওপর থেকে আসা সেই পায়ের শব্দ শুনছে। কিছুক্ষণ শব্দটা থেমে গেল। বোধহয় দোতলায় উঠেছে ওরা। ইসাবেলা ক্রাচটা খোঁজে। বলা তো যায় না যদি নিচে নেমে আসে ওরা? বা’পাশেই ক্রাচটা পড়ে আছে। হাত বাড়িয়ে ওটা নিতে ওর শরীর হিম হয়ে এলো। একটা পায়ের শব্দ সিঁড়ি ধরে বেসমেন্টে নেমে আসছে! কোনো কিছু না ভেবে ক্রাচে ভর করে উঠে দাঁড়ায়। তক্তা তিনটে নিঃশব্দে আলগা করার চেষ্টা বৃথা যায়। শব্দ হলো তক্তা সরাতে গিয়ে। ও শুনল পায়ের শব্দটাও থেমে গেল তখনই। ভয়ে তাড়াতাড়ি কাঠ সরিয়ে বেরিয়ে আসতে গিয়ে হাতে পায়ে কাঠের সাথে লাগা লোহায় খোঁচা খায়। তবুও থামে না। ক্রাচে ভর করে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে আসে। তারপর যত দ্রুত পারে গম খেতের দিকে যেতে লাগল। সূর্যটা আস্তে আস্তে মাথার ওপর সরে আসছে। আশেপাশে জনমানব নেই। বাড়িটা গম খেত থেকে একটুখানি উঁচুতে ছিল। ইসাবেলা খেতে নামতে গিয়ে হুড়মুড়িয়ে পড়ে। কোনোমতে উঠে দাঁড়ায় আবার। ক্রাচটা তুলে নেয়। গম পেকে হলুদ বর্ণ ধারণ করেছে। গমের শস্যদানার সাথে থাকা সুচের মতো সুরু ধারালো বস্তু আর পাতার ধারালো কোণা ইসাবেলার হাতে, পায়ে একটার পর একটা আঘাত করতে লাগল। সব উপেক্ষা করে ইসাবেলা এগোচ্ছে। খেতের প্রায় মাঝামাঝি এসে ও একটু দম নিলো। পেছন ফিরে তাকাল একবার। অনেকদূর চলে এসেছে ও। লিভিয়ার বাড়িটা খুব বেশি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। রোদের চোটে চোখের সামনেটা ঝাপসা বলে বোধহয় এমন হলো। তবুও একটা জিনিস চোখে পড়ল। ওরা যেই ঘরে ছিল সেখানকার জানালাটা খোলা। এক অস্পষ্ট মুখ দেখা যাচ্ছে জানালার কাছে। ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। চোখ মুছে ফের তাকাল। এবার একটু স্পষ্ট হলো সামনের দৃশ্য। বুকটা যেন ধ্বক করে ওঠে। ক্রুর হাসি ঠোঁটে তাকিয়ে আছে লোকটা। ইসাবেলার মনে হলো এই হাসি এবং মুখটা ওর চেনা। কিন্তু মনে করতে পারল না। ভয়ে বসে পড়ল সেখানে। দাঁড়িয়ে গেলে লোকটা ওর পথ চিনে যাবে। এতে নিকোলাস পর্যন্ত পৌঁছাতে ওদের সুবিধা হবে। ইসাবেলা চায় না ওরা নিকোলাসের ক্ষতি করুক। অথচ, ওই একদিন মারতে চেয়েছিল, চেয়েছিল নিকোলাস শেষ হোক। তাহলে আজ কী হলো ওর?
“ও আমাকে অনেক সাহায্য করেছে। উপকারীর অপকার করার শিক্ষা আমার মা দেয়নি।”
আপনমনেই জবাব দিলো ইসাবেলা। ওর মন জানে এই কথাগুলো পুরোপুরি সত্য নয়। এরপরেও কিছু কথা আছে। কিছু কথা মানুষ মনে রাখলেও মুখে আনতে চায় না।
হামাগুড়ি দিয়ে সামনে এগোতে লাগল ও। কয়েকদিনের অনাবৃষ্টিতে মাটি লোহার মতো শক্ত হয়ে গেছে। শক্ত মাটির ওপর হামাগুড়ি দিয়ে সামনে এগোতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে ওর। জীবনের এই পর্যায়ে এসে বুঝেছে টিকে থাকার সংগ্রাম সহজ না। পরিবারের সাথে থাকা ওই জীবন আর এই জীবনে আকাশ পাতাল তফাত। তাতিয়ানার কথাটা আজ ভীষণ মনে পড়ল। ওই যে বলেছিল,
“বড্ড নিষ্পাপ তুই ইসাবেল। পৃথিবীর রূঢ় বাস্তবতা থেকে মা তোকে আড়াল করে রেখেছে। একটা ঘোরের মধ্যে বাস করছিস তুই। আমি এখন মনেপ্রাণে চাই ঘোরটা তোর না কাটুক। কারণ, তোর মতো সকলে নিষ্পাপ না রে। ভয়টা এখানেই আমার।”
ইসাবেলার ঘোর এখন বুঝি কেটে গেছে। তাতিয়ানার ভয় সত্যিতে পরিণত হয়েছে। পৃথিবীর রূঢ় বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছে ও। বুঝেছে জীবন মায়ের ক্রোড়ের সেই কোমলতা নয়। সতেরো বছরের সুখী জীবন এখন কেবল অতীত। আঠারো বছরের বর্তমানের প্রতি মুহূর্ত ভয় আর আতঙ্কে ঘেরা। মৃত্যু ছায়া হয়ে ওরই সাথে হামাগুড়ি দিয়ে এগোচ্ছে। সুযোগ পেলে হামলে পড়বে ওর ওপর। টেনে বের করে নেবে প্রাণপাখিটা। ইসাবেলা মরতে চায় না। এই পৃথিবীর রূঢ় বাস্তবতা সত্ত্বেও কিছু সৌন্দর্য তো আছে। ইসাবেলা তাই উপভোগ করতে চায়। স্বপ্নটার কথা আবার মনে পড়ে। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। মাথা নাড়িয়ে বিড়বিড় করে,
“স্বপ্ন কখনও সত্যি হয় না। স্বপ্ন কখনও সত্যি হয় না। স্বপ্ন ভ্রম। মনের ভুল। আমি এবং আমার মন কেবল পিটারের।”
জঙ্গলটা কোনদিকে দেখার জন্য সামান্য মাথা তুললো। ঠিক পথেই এগোচ্ছে ও। আর বেশি দূরেও নেই জঙ্গল। হামাগুড়ি দিয়ে খেতের শেষ এসে থামল। হাতের তালু, হাঁটুর চামড়া ছিঁড়ে গেছে। অল্প অল্প রক্ত পড়ছে। ফ্রকের নিচটা দিয়ে রক্ত মুছতে গিয়ে ব্যথায় ককিয়ে উঠল। মাটি, খরকুটো লেগে লেপ্টে আছে রক্তের সাথে। সবটা পরিষ্কার করার ধৈর্য নেই। ওভাবেই উঠে দাঁড়ায়। মনে পড়ল ক্রাচটা ভুলে রেখে এসেছে। এখন উপায়? আশেপাশে তাকিয়ে একটা মোটা ডাল পেল। ওটাতে ভর করে জঙ্গলে প্রবেশ করে ইসাবেলা। কোনদিকে যাবে স্থির করতে না পেরে কাছাকাছি একটা মোটা গাছের ছায়ায় বসল। ক্লান্ত লাগছে খুব। নিকোলাস বলেছিল জঙ্গলে থাকলেই খুঁজে নেবে। ইসাবেলার আর এগোনোর শক্তি নেই। ও ঠিক করল এখানেই অপেক্ষা করবে। পা মেলতে হাঁটুর ব্যথা সমস্ত শরীরের রগে রগে ঝিলিক দিয়ে উঠল। দাঁত কামড়ে হাত দিয়ে সোজা করে মেলে দিলো পা দুটো। এইটুকুতেই হাঁপিয়ে ওঠে। শরীর ছেড়ে দেয় গাছের গায়ে। বেশ বাতাস বইছে। ছায়াতরুর তলে বসে চোখ দুটো ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে আসে। ভাবনাজুড়ে তখন একটা ব্যাপারই ঘুরপাক খায়-কে ছিল ওই লোক? কেন চেনা লাগল ওই মুখ? স্মৃতি হাতরেও এর জবাব ও পায় না। কেমন ধোঁয়াশা হয়ে জড়িয়ে আছে যেন লোকটার মুখ। ধোঁয়াশা কাটানোর চেষ্টা করতে করতে খানিক পরেই ঘুমিয়ে পড়ল ইসাবেলা।
একটা পরিত্যক্ত বাড়ির বেসমেন্টে দুপুর পর্যন্ত ছিল নিকোলাস। জেগে উঠে রওনা হলো লিভিয়ার বাড়ির দিকে। মনে কিছুতেই শান্তি পাচ্ছিল না ইসাবেলাকে একা রেখে এসে। ধোঁয়ার কুন্ডলি হয়ে বাড়ির কাছাকাছি আসতে থেমে যায়। তিনটে পুরুষলোক বেরিয়ে এলো সদর দরজা দিয়ে। কালো আলখেল্লা পরা। দুজনকে ও গতকালই দেখেছে। কিন্তু চেনেনি। তৃতীয়জনকে সাথে সাথে চিনে ফেলল। নিকোলাস পিছিয়ে গেল। এমন না ও ভয় পায় তৃতীয় ব্যক্তিকে। কিন্তু সময় এবং স্থান ওর অনুকূলে না। বোকা নয় নিকোলাস। ঝোঁকের বসে ভুল পদক্ষেপ কিছুতেই নেবে না। ইসাবেলার জন্য চিন্তা হলো ওর। ও কি ঠিক আছে? এরা নিকোলাসের এখানে থাকার কথা জানলো কী করে সেটাই ভেবে পেল না ও। এত সহজ নয় নিকোলাস পর্যন্ত পৌঁছানো। তবে কী করে এখানে এলো এরা? তৃতীয় ব্যক্তিটি মাথায় হুডি তুলে গাড়িতে বসল। বাকি দুজন বসল সামনে। গাড়ি চলে যেতে নিকোলাস বাড়ির পেছন দিকে যায়। তক্তা খোলা। অর্থাৎ ইসাবেলা পালিয়েছে। নিকোলাস জঙ্গলে মুখ করে ফের হাওয়ায় মিশে যায়। বাতাসে ইসাবেলার ঘ্রাণ খুঁজতে খুঁজতে ওকে পেয়ে গেল জঙ্গলের বড়ো গাছটার নিচে। স্বস্তি পেল নিকোলাস। নিঃশব্দে ওর কাছে এসে এক হাঁটু ভেঙে বসল। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ইসাবেলা। ওর হাত আর পায়ের ক্ষত চোখে পড়তে বিমর্ষ হয়ে গেল নিকোলাসের মুখ। আস্তে করে একটা হাত তুলে নিলো হাতে। তালুর ক্ষততে রক্ত জমে ময়লা লেপ্টে আছে। হাঁটুর অবস্থাও একই রকম। হাতের তালুর দিকে চেয়ে বলল,
“তোমার সকল কষ্টের কারণ আমি তাই না, বেলা? আমি তোমার জীবনে না এলে আজ হয়তো এইদিন দেখতে হতো না তোমাকে। ঘৃণিত পিশাচ আমি। অভিশপ্ত আমার জীবন। আমি যত তাড়াতাড়ি পারি এই অভিশপ্ত জীবন থেকে তোমাকে বিচ্ছিন্ন করে দেবো বেলা। আবার সুখী হবে তুমি। আবার আগের মতো হাসি খুশি হবে তোমার জীবন।”
ইসাবেলার হাতটাতে চুম্বন করতে যাবে কিন্তু ঘুমের ঘোরে নড়ে ওঠে ইসাবেলা। হাতটা সরিয়ে নেয় নিকোলাসের হাত থেকে। শূন্য হাতের দিকে চেয়ে রইল নিকোলাস। এই যেন ওর ভবিষ্যৎ। শূন্যতা আর শূন্যতা।
চলবে,,,