#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব–৯৭
Writer তানিয়া শেখ
হলঘরে কঠিন নীরবতা। “তুমি ওকে শেষ করে এলে মা?” এই বাক্যটির শব্দগুলো রহস্য আর উত্তেজনা ধারণ করে হলঘরের বায়ুতে মিশে গেল। এই “ওকে” টা কে তা যেন বুঝতে সময় লাগল বাকিদের। যখন বুঝল একটা হালচাল উঠল। ঠিক হঠাৎ ওঠা বাতাসের ধাক্কায় নদীর জলের বিস্মিত ঢেউ। একবার তরঙ্গ তুলে ফের শান্ত। উপস্থিত মানুষগুলোর কৌতূহলি, জিজ্ঞাসু দৃষ্টি মা মেয়ের দিকে। কারও কারও চোখে আনন্দ খেলে গেল। পিতৃহত্যাকারীর ধ্বংসই যে কাম্য ছিল। এখন ওর স্ত্রীরও শাস্তি হোক। বিধবা হওয়াই কি যাবজ্জীবন শাস্তি না? রজারের স্ত্রী ও সন্তানেরা ঘৃণিত চোখে চেয়ে রইল ইসাবেলার দিকে। ইসাবেলার এখন আর কিছুই অনুভূত হলো না। নিজের অস্ত্বিত্ব কি কিছু টের পাচ্ছে? নিকোলাস নেই কথাটা ও যেন ভাবতে পারে না। আরও ভাবতে পারছে না সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ওর মা কাওকে একেবারে মেরে ফেলতে পারেন। এটা ঠিক বিভিন্ন কারণে তিনি কঠোর হয়েছেন। তবে পাষাণ ঠিক বলা যায় না। মায়েদের সাথে পাষাণ কথাটা বড্ড বেমানান। কিন্তু আজ মায়ের শীতল চোখে চেয়ে কেন মনে হচ্ছে তিনি মানুষ নন, মা নন, একজন পাষাণ মূর্তি। এই মূর্তি সব পারে, সব সম্ভব তাঁর দ্বারা। এমনকি… ইসাবেলার শ্বাসে টান ওঠে। বুকের বা’পাশ মথিত হয়। জিহবা শুকিয়ে এলো। কথা বলতে পারছে না। মনে হলো আর কখনো বলতে পারবে না। এতদিন ছিচকাঁদুনির মতো দিনরাত শুধু কেঁদেছে। কিন্তু আশ্চর্য এখন ওর চোখে খরা। বোবার মতো একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে মায়ের দিকে। চোখে সহ্য হয় না,তবুও চোখ সরায় না।
“তুমি ঠিক আছো আন্নে?”
চকিতে তাকাল ইসাবেলা। দু’চোখে আগুন ঠিকরে বেরোলো যেন মায়ের পাশে দাঁড়ানো ড্যামিয়ানকে দেখে। তারপর একই উত্তাপ আর উষ্মার সাথে করে ফের মাকে দেখল। আন্না মেরিও জোর করে মুখ তুলে আছেন। মেয়ের চোখের তাপ, নীরব অভিযোগ তাঁর ক্লান্তি বাড়িয়ে দেয়। ঘাড়টা ক্লান্তিতে বসে আসতে চাচ্ছে। ধকলও তো কম যায়নি। খুন কি সহজ কাজ! খুন! পিশাচকে মারা কি খুন বলে?
আন্না মেরিও ড্যামিয়ানের কথার জবাব দিলেন না। বোবাকালার ন্যায় চুপ করে রইলেন। অবসন্নতায় হাঁটু ভেঙে আসতে চায়। কয়েক ধাপ সিঁড়ি পার হলেই তাঁর শোয়ার ঘর। বিছানায় গা এলিয়ে দিতে পারলে বাঁচতেন। ড্যামিয়ান আন্না মেরিওর মুখ দেখে একটু ভাবুক হলো। তারপর তাতিয়ানাকে বলল,
“অ্যানা, আন্নেকে কক্ষে নিয়ে যাও।”
তাতিয়ানা নড়ল না। অবাধ্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ড্যামিয়ানের দিকে। সাহস কতবড়ো তাতিয়ানাকে হুকুম করে! হাঁপ ছাড়ে ড্যামিয়ান। নেহাৎ মনটা প্রসন্ন বলে কথা বাড়ালো না। একটুও বদলায়নি এই মেয়ে। এই ধরনের মেয়েকে শায়েস্তা করতেই ভালো লাগে। তবে তাতিয়ানার প্রতি ওর তেমন আকর্ষণ নেই।
ম্যাক্সিম পেছন থেকে স্ত্রীকে হুকুম করলেন আন্নেকে কক্ষে নিয়ে যাওয়ার জন্য। ম্যাক্সিমের স্ত্রী এগিয়ে এলো। মার্কোভিক বসলেন সোফায়। এ বাড়ির প্রধান ভৃত্যা তিখন হাতে এক গ্লাস পানি নিয়ে তাঁর পাশে দাঁড়ালেন। অবসাদ মুখে মুচকি হাসলেন মার্কোভিক। হাত বাড়িয়ে নিলেন গ্লাসটা। তারপর হলঘরের বসা নাতনির নির্মোহ মুখে কটাক্ষে চাইলেন।
ড্যামিয়ানের মনে তখন পৈশাচিক আনন্দ। ইসাবেলার এই শোকাভিভূত নির্বাক চেহারা ওকে সেই অতীত আনন্দ স্মরণ করিয়ে দেয়। আর তো কয়েক মুহূর্ত তারপর ইসাবেলা পুরোপুরি ওর সম্পত্তি। একটাই ক্ষোভ নিকোলাসের স্পর্শ লেগেছে ওর গায়ে। কিছু পেতে গেলে কিছু খোয়াতে হয়। ড্যামিয়ান খুব চেষ্টা করেছে এই কথাটা মানতে, কিন্তু জোর করে সব মানিয়ে নেওয়া যায় না। ইসাবেলাকে এজন্য আরও শাস্তি দেবে। ওর উচিত ছিল নিজেকে সম্পূর্ণ ওই পিশাচকে সঁপে না নেওয়া। ভালো তো পিটারকেও বেসেছিল।কিন্তু ওকে তো সব সঁপেনি। তাহলে নিকোলাসকে কেন? চোয়াল ফুলে ওঠে এসব ভাবতে ভাবতে। ইসাবেলা যত বড়ো হয়েছে ততই ওর প্রতি অধিকারবোধ বেড়েছে। সেটা ওর মন ও শরীর দুটোর ওপরই। আকর্ষণই কি কম? ওকে নিয়ে উষ্ণ সেসব মুহূর্ত কল্পনা করলে শরীর গরম হয়, অস্থিরতা সর্বাঙ্গে নাড়া দেয়। বিড়বিড় করে বলে,”আর তো মাত্র কয়েকটা দিন, আর তো মাত্র কয়েকটা দিন।”
“চলো বসবে।”
ম্যাক্সিম সোফার দিকে এগিয়ে গেল। ইসাবেলাকে নিয়ে এদের আর ভাবনা নেই। দুদিন পর ওই পিশাচের ভূত আপনাতেই নেমে যাবে।
ড্যামিয়ানও যেতে উদ্যত হয়। কয়েক কদম গিয়ে থেমে যায়। খেয়াল হলো এইমাত্র কিছু ও দেখেছে। চকিতে ফেরে। ইসাবেলার ঠোঁটের কোণে তখনও খানিক রক্ত লেগে ছিল। আনমনেই ঠোঁট ভেতরে ঠেলে চুষে নিলো ও। ড্যামিয়ানের উজ্জ্বল চোখদুটোতে মুহূর্তে আঁধার ঘনিয়ে এলো। কোথাও দেখার ভুল হয়েছে। সুতরাং আরও নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। ঢিলেঢালা মেক্সি ড্রেস পুরোপুরি ওর বাড়ন্ত পেট লুকাতে পারেনি।
আন্না মেরিওকে ধরতে শিউরে ওঠেন ম্যাক্সিমের স্ত্রী অ্যানাতোলা। প্রচন্ড ঠাণ্ডা তাঁর হাত।
“তোমার কি অসুস্থবোধ হচ্ছে?” সিঁড়ির দিকে যেতে যেতে চাপা গলায় বললেন আন্না মেরিওকে। আন্না মেরিও দুর্বলভাবে মাথা নাড়ালেন ওপর নিচে৷
“ডাক্তার ডাকতে বলব?”
আন্না মেরিও ক্ষীণ গলায় বললেন,
“না।”
দুজনে সিঁড়ির কাছাকাছি। আন্না মেরিও সবে এক পা ফেলবেন প্রথম সিঁড়িতে, কিন্তু থমকে গেলেন।
“জবাব না দিয়েই চলে যাচ্ছ? কেন জবাব নেই? দিতে লজ্জাবোধ হচ্ছে বুঝি?” পেছনে মেয়ের তীক্ষ্ণ কণ্ঠ শুনতে পেলেন। কিন্তু প্রত্যুত্তরে কিছুই বললেন না। না ফিরলেন।
হাতটা কোমরের একপাশে রেখে উঠে দাঁড়ায় ইসাবেলা। ছাড়িয়ে নেয় মাতভেইর হাত থেকে নিজেকে। বিদ্রুপের হাসির শব্দ তোলে। তীব্র চাহনি।
“এত সাহস দেখিয়ে, বংশ গৌরবের অহংকারে মাথা উঁচু করে নিকোলাসকে শেষ করতে গেলে আর এখন বলতে সংকোচ হচ্ছে? কেন? তুমি তো মহান কাজ করে এসেছ। ওই দেখো তোমার পিতা ও ভাই কেমন সগর্বে, সদর্পে বসে আছেন। ভবিষ্যৎ ম্যাক্সওয়েলরা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ রাখবে তোমাকে তাঁদের বংশ বাঁচিয়েছ কি না।”
“চুপ করো, বেলা।” মায়ের সে নিষেধ যেন শুনতেই পেল না ও। আরও কাছে এসে দাঁড়ায়। থমথমে মুখ।
“বংশ! তুমিও শেষপর্যন্ত ওই মানুষগুলোর মতো নীচ হলে যারা মনুষ্যত্বের চেয়ে বংশমর্যাদাকে প্রাধান্য দেয়! ছি! তোমার মেয়ে ভাবতে আমার না ভীষণ ছোটো লাগছে। যাকে আদর্শ মেনে এতবড়ো হলাম এখন দেখি পুরোটাই সে অশুদ্ধ, অন্তঃসারশূন্য। নিজের আদর্শ বলে এতকাল যা চালিয়েছে সবটা ভং। ভেতরে ভেতরে তুমি তোমার পিতার মতো বংশগরিমায় অন্ধ, কুসংস্কারাচ্ছন্ন, আত্মকেন্দ্রিক, নিষ্ঠুর, পা..”
“থামো, থামো।” আন্না মেরিওর চিৎকারে মহল কেঁপে ওঠে। রাগত চোখে তাকান মেয়ের দিকে। ইসাবেলা হাসে। মোটেও স্বাভাবিক নয় সে হাসি।
“পিশাচ মেরে এসেছ, মানুষ তো না! তাহলে বলছ না কেন? কীসের বাধা বলতে? ওকে মারতে যখন বাধেনি বলতে বাধছে কেন আন্না মেরিও?”
সাথে সাথে ইসাবেলার গালে বিকট শব্দে চড় পড়ে। নিচে পড়তে পড়তেও টাল সামলায়। গালের একপাশ অসাড়। মা যে ব্যথা আগে দিয়েছে তার কাছে এ ব্যথা কিছুই না।
“সেই তখন থেকে একই বুলি আউড়ে যাচ্ছ! বেয়াদব মেয়ে। এতগুলো মানুষের সামনে মা’কে অপমান, অপদস্ত করে প্রতিশোধ নিচ্ছো? তোমার ওই পিশাচ প্রেমিককে শেষ করেছি বলে? বলো, বলো। তবে শোনো বলছি। হ্যাঁ শেষ করেছি ওকে আমি। কীভাবে করেছি শুনবে? ওর হৃদয়ে ক্রুশবিদ্ধকরে, গলায় ছুরি চালিয়ে আগুনে ভস্মীভূত করে দিয়েছি। ও আর নেই, বেলা। ছাই হয়ে মিশে গেছে শূন্যে। এতক্ষণে হয়তো নরক দুয়ারে পৌঁছে গেছে।”
লম্বা শ্বাস নিলেন আন্না মেরিও। এখনও নিকোলাসের ছাইয়ে পরিনত হওয়ার দৃশ্য যেন প্রত্যক্ষভাবে দেখতে পান। স্বস্তি কেন দেয় না এই স্মৃতি। কেন নিকোলাসের কাতর, পরাজিত মুখ তাঁকে টিটকারি করে। ভুল করলেন কি?
ইসাবেলার মুখে রা নেই। নিকোলাস নেই! এবার যে জীবন্ত হলো কথাটা। ওর বুকের ভেতর দুমড়ে মুচড়ে গেল। শরীরের শক্তি বুঝি নিঃশেষ হয়ে আসে। সামনেটা সব ঝাপসা।ইসাবেলা কামড়ে ধরে আছে ঠোঁট। রক্তের স্বাদ পাচ্ছে। কাঁদবে না, কাঁদবে না।
“মাত্র কয়েকদিনের পরিচয়ে ওই পিশাচ তোমার সব হলো, হ্যাঁ? আর আমরা, আমি? বংশমর্যাদায় অন্ধ, আরও কী কী বলছিলে.. তোমার যা ইচ্ছে হয় বলো। তুমি তো আর মা নও তাই আমার ভয়, আমার জ্বালা বুঝতে পারবে না। সে আশাও করি না। কিন্তু মানুষের সামনে এমন করে অপদস্ত করো না। আমি যা করেছি তোমার ভালোর জন্যই করেছি।” বললেন আন্না মেরিও। ইসাবেলা ভগ্ন গলায় বলল,
“ভালো! কত ভালোই না করলে তুমি আমার! তাকাও আমার দিকে, দেখো ভালো করে। সত্যি করে বলো তো ভালো করেছ কি না। জানি তো এখন আর সত্যি বলার সাহস তোমার নেই। কিন্তু আমি বলব। যতই চড়, কিল মারো সত্যি আমি বলবোই। নিকোলাস শুধু আমার প্রেমিক নয় স্বামী। এই কথা জানার পরও তুমি ওকে হত্যা করলে। ও যদি তোমার ভাইয়ের মৃত্যুর, ভাবির বৈধব্যের কারণ হয় তবে তুমিও আমার স্বামীর হত্যাকারী, আমার বৈধব্যদশার কারণ।”
“বেলা!”
“ডাকবে না ওই নামে আর। ওই নামে যে নিকোলাসও আমায় ডাকত। তোমার মুখে ওই নাম আমি আর শুনতে চাই না। ডেকো না।”
বলতে বলতে মায়ের পাশ কেটে সিঁড়ির রেলিং ধরে টলতে টলতে নিজের কক্ষের দিকে চলে গেল। এদের মাঝে দমবন্ধ হয়ে আসছে ইসাবেলার। এমনিতেও কী দম নিতে পারছে সহজে! কান্নার বাঁধ ভাঙছে ভেতরে। তবুও কাঁদবে না। এদের সামনে অন্তত না।
আন্না মেরিওর মাতৃহৃদয় মেয়ের শোকাভিভূত দশা দেখে কাতর হয়। অপরাধবোধটাকে এটা ওটা বুঝিয়েও চাপা দিতে পারলেন না সম্পূর্ণ। খানিক আলগা সে হলোই। কিন্তু তাঁর গম্ভীর ব্যক্তিত্ব অবিচল। ক্ষীণ দ্বিধাবোধ জাগলেও ভুল করেছেন একথা মানতে নারাজ। মেয়ে দৃষ্টি সীমার বাইরে যাওয়ার পরও একইভাবে স্থির রইলেন। তারপর সিঁড়ি মাড়িয়ে কীভাবে যে নিজ কক্ষে পৌছালেন বলতে পারেন না। ওলেগ বিছানার এককোণে গোঁজ হয়ে বসেছিলেন। আন্না মেরিও মনে মনে প্রার্থনা করলেন স্বামী যেন কোনো প্রশ্ন না করে। আজ আর কোনো প্রশ্নের জবাব দেওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। ওলেগ চুপ করেই রইলেন। এখানে বসেই সব শুনেছেন। দোষ যদি কিছু করে আন্না মেরিও তাতে তাঁর অংশীদারত্ব সমান। উৎসাহ তো তিনিও দিয়েছেন। মেয়ের ব্যথাতুর মুখ ভেবে চোখ টলমল করতে লাগল। আন্না মেরিও ওপাশে ঘুরে শুয়ে আছেন বলে দেখতে পেলেন না। আস্তে আস্তে তাঁর চোখও সজল হলো। মেয়ের প্রতিবাদ, দোষারোপ, আগুনচক্ষু তাঁকে অশান্তি দিলো। জীবনে এমন অশান্তি তিনি কোনোদিন অনুভব করেননি, কোনোদিন না।
বিছানা মড়ার মতো শুয়ে আছে ইসাবেলা। ঠোঁট কেঁপে কেঁপে ওঠে। নিকোলাস নেই, আর দেখবে না, স্পর্শ করতে পারবে না। শুনতে পারবে, “বেলা, আমার বেলা।” ইসাবেলার ভেতরে ঝড় ওঠে। ভেঙেচুরে দেয় সব। কিন্তু কাঁদে না, ওর দৃষ্টি শূন্য। অতি শোকে মানুষ বোধহয় পাথর হয়ে যায়।
পেটের ভেতর কে যেন লাথি দিলো। হলঘরেও একবার হয়তো দিয়েছিল। মনের ভুল ভেবেছে ইসাবেলা। কিন্তু এখন বুঝল মনের ভুল না। একটার পর একটা লাথির মারছে পেটে, নড়ছে। আগের তুলনায় ভীষণ ব্যথা। ইসাবেলার চোখ গড়িয়ে পড়ল অশ্রু। কিন্তু শব্দ হয় না। ধীরে ধীরে হাতটা পেট ওপর রাখে। স্পষ্ট টের পেল এবার। কেউ রয়েছে ওখানে। অন্তঃসত্ত্বা হয়েছে এই সন্দেহ করার অবসর পায়নি। কিংবা পেলেও গুরুত্ব দেয়নি আগে। মা হতে পারবে সেই আশায় কী করেছিল! এখন ওর চোখে আতঙ্ক আর অদ্ভুত এক আবেশ খেলে গেল। মা হবে! নিকোলাসের সন্তানের মা? নিকোলাস! ও বেচারা জেনেও গেল না ইসাবেলা ওর সন্তান ধারণ করেছে। খুশি হতো কী? ইসাবেলা অন্তঃসত্ত্বা হোক ও কোনোদিন চায়নি তবুও হয়তো নারাজ হতো না। ইসাবেলা এবার মৃদু শব্দে কাঁদল পেটের ওপর হাত বুলিয়ে, “কী দুর্ভাগ্য নিয়েই না নিজের অস্তিত্ব জানান দিলি তুই! আমার রিক্ত নিঃস্ব জীবনে তুই যে বিস্ময় নিয়ে এলিরে.. তোর বাবাকে যে ওরা কেঁড়ে নিয়েছে। আমার নিকোলাস! ওকে ছাড়া আমি বাঁচি কী করে বল তো। কিন্তু তোকে দিয়ে ঈশ্বর যে মরার পথও বন্ধ করে দিলো। প্রভু, আমি নিকোলাসকে তোমার সামনে নত হতে দিইনি বলে কী ওকেই কেঁড়ে নিলে! আমার সন্তানের এখন কী হবে? আমার পাপের শাস্তি ওকে পিতৃহারা করে কেন দিলে তুমি? নিকোলাস! প্লীজ ফিরে এসো। নিকোলাস!”
আচমকা ওর হাত ধরে কেউ টেনে তুললো।
“ওই পিশাচের সন্তান ধারণ করেছিস তুই!”
ড্যামিয়ানের ক্ষুব্ধ কণ্ঠ। ইসাবেলা ঘৃণিত চোখে তাকায়,
“হাত ছাড় বলছি। ছাড়!”
শক্তিতে পেরে ওঠে না ইসাবেলা। ড্যামিয়ান আরও শক্ত করে হাত ধরে আছে।
“কেন? আমার স্পর্শ সহ্য হয় না? কিন্তু ওই পিশাচের স্পর্শ সহ্য হয়েছে। ওর সাথে শুতে তোর ভালো লেগেছে, ওর সন্তান পেটে নিতে ভালো লেগেছে। শুধু আমি স্পর্শ করলে তোর গায়ে জ্বালা ধরে, না? কুত্তি মাগী, তোর পেট ছিঁড়ে ওই সন্তান বের করে আনব। আমার শত্রুর বংশ তোর পেটে থাকতে পারে না। তুই আমার তোর সব আমার। ওই পেটে যদি কারো সন্তান থাকে তবে সেটা আমার হবে।”
“খবরদার যদি আমার সন্তানের দিকে হাত বাড়িয়েছিস তুই? আমি সেই ছোটো মেয়েটি নেই যে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে কেঁদে দেবে। নিকোলাসকে শেষ করার মূল ষড়যন্ত্রকারী তুই, তাইনা? আমার মায়ের ব্রেন ওয়াশ করে তুই ওকে শেষ করেছিস। ভেবেছিস এসব করে আমাকে হাসিল করবি? করে দেখা!”
ইসাবেলা চ্যালেঞ্জ আর নির্ভীক রূপ দেখে ড্যামিয়ান যে অবাক হয়নি তা নয়। কিন্তু দ্রুত সেটা আড়াল করে হেসে ওঠে।
“দেখবি? আমাকে চ্যালেঞ্জ করার আগে ভাবা উচিত ছিল বেবিগার্ল। যতটুকু অবশিষ্ট আছিস ওইটুকু ভেঙেচুরে আমার মহলের শোপিস করে রাখব তোকে। কিন্তু তার আগে ওই পিশাচের সন্তান দূর করতে হবে তোর ভেতর থেকে।”
“আমার সন্তানের ক্ষতি করার চেষ্টা করলে তোকে আমি প্রাণে মেরে ফেলব ড্যামিয়ান। হুমকি দিচ্ছি না। আমি আর সেই নিষ্পাপ ইসাবেলা নেই। এই দু’হাতে পিশাচ মেরেছি। তোকে মারতে আর কী।”
ইসাবেলা অন্য হাতে পেট আগলে রাখল। ড্যামিয়ান হঠাৎই ওর গলা চেপে বিছানার ওপর ফেলে দেয়। নিঃশ্বাস নিতে ছটফট করে ইসাবেলা। ছাড়াতে চায় নিজেকে। কিন্তু পেরে ওঠে না। ড্যামিয়ান যেন একটা অসুর।
“আমাকে মারবি? আগে নিজে বেঁচে দেখা। তোকে আজ এমন শাস্তি দেবো যে ফের মুখ তুলে গলা উঁচু করে কথা বলার সাহস করবি না আমার সাথে।” ড্যামিয়ান অন্য হাতে ইসাবেলার বুকের ওপরের কাপড় এক টানে ছিঁড়ে ফেলে। দু টুকরো অন্তর্বাসের মাঝে বাড়ন্ত পেট উন্মুক্ত হয় ওর সামনে। লজ্জায়, অপমানে চিৎকার করে ওঠে ইসাবেলা৷ ড্যামিয়ান দেখে পেটের এদিক ওদিকে কিছু নড়ছে। ক্রুর হেসে খামচে ধরে পেটের উপরিভাগ। ব্যথায় গলা ফাটিয়ে কেঁদে ওঠে ইসাবেলা। ড্যামিয়ান তবুও থামে না। আঙুল গেঁথে দেয় ত্বকে। এই হাত দিয়েই যেন ছিঁড়ে ফেলবে পেট।
“আমার এত বছরের শ্রম তুমি এত সহজে নষ্ট করে দিতে পারো না বেবিগার্ল। আমি তা হতেই দেবো না। এই শিশু পৃথিবীর আলো দেখলে আমার এত ত্যাগ, সফলতা সব যে বৃথা যাবে। জেনেশুনে বিপদ ডেকে আনি কী করে বলো?”
ইসাবেলার চিৎকারে মাতভেই ও ভ্লাদিমি ছুটে এলো। এসে যেই দৃশ্য দেখল তাতে খুন চেপে যায় ওদের মাথায়। দুই জনে টেনে ছাড়িয়ে আনার চেষ্টা করে। ড্যামিয়ানের একার শক্তির সাথে কুলিয়ে উঠতে পারে না ওরা। ভ্লাদিমি এলোপাতাড়ি লাথি ঘুষি দিয়ে বিছানার একপাশে ফেলে দেয়। মাতভেই ওর বুকের ওপর উঠে বসে সেই সুযোগে। জানালার পর্দা টেনে ছিঁড়ে বোনের লজ্জা ঢাকল ভ্লাদিমি। জড়িয়ে ধরে ওর কম্পিত শরীর।
“বোন আমার, ভয় নেই। ভাই তোর কিছু হতে দেবে না।”
তাতিয়ানা দৌড়ে এসে ওকে নিজের কাছে নিলো। ভ্লাদিমিকে ক্রোধিত হয়ে বলল,
“ওই শয়তান যে হাতে আমার বোনকে ছুঁয়েছে ভেঙে ফেল সে হাত। কুকুরটাকে আজ উচিত শিক্ষা দিয়ে ছাড়বি ভ্লাদিমি।”
মাতভেই ও ভ্লাদিমির সাথে খুব মারামারি শুরু হলো ড্যামিয়ানের। ওর সাথে পেরে ওঠে না দুজন। কিন্তু বেশ আঘাতপ্রাপ্ত হয় ড্যামিয়ান। ভ্লাদিমি বড়বোনের কথামতো ওর একটা হাত ঠিক মুচরে দিলো। পালটা আঘাত হিসেবে ভ্লাদিমির মাথা ফাটিয়ে দেয় দেওয়ালে আছরে। মাতভেই বুক চেপে ধরে মেঝেতে গোঙাচ্ছে। ড্যামিয়ান রাগে হিস হিস করতে করতে ফের হিংস্র ভঙ্গিতে ইসাবেলার দিকে অগ্রসর হয়। তাতিয়ানা ভীত হলেও ওকে সতর্ক করে,
“খবরদার ড্যামিয়ান, আর এক পা এগোবি না।”
ড্যামিয়ান আমলেও নিলো না। ইসাবেলা আর্ত মুখে দুহাতে পেট আগলে রাখে। ড্যামিয়ান সেদিকে হাত বাড়াতে আন্না মেরিও পেছন থেকে ওকে ভারী কাঁচের ফুলদানি দিয়ে আঘাত করেন। ছিটকে পড়ে যায় নিচে ও৷ মাথার পেছনে ব্যথা অনুসরণ করে হাত দিতে রক্তে ভিজে গেল হাত।
“তোর সাহস কী করে আমার মেয়ের দিকে হাত বাড়ানোর?”
“আন্নে!” ড্যামিয়ান উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে কিছু বলতে চায় কিন্তু সেই সুযোগ আন্না মেরিও দিলেন না। কষে চড় দিলেন ওর গালে। ফের দেবেন মার্কোভিক চেঁচিয়ে থামিয়ে দিলেন।
“কী হচ্ছে এখানে?”
“জিজ্ঞেস করুন এই শয়তানকে। কোন সাহসে ও আমার মেয়ের ঘরে ঢুকল। দেখুন কী করেছে। ওকে তো আমি জীবন্ত কবর দেবো আজ।”
এই বলে মারতে উদ্যত হয় আন্না মেরিও। ড্যামিয়ান তাঁর হাত ধরে ফেললো।
“আর না আন্নে, আর না। তোমার প্রতি সামান্য শ্রদ্ধাবোধ আছে বলেই মারলে, গালমন্দ করলেও কিছু বলিনি। সব সময় তো এমন হবে না।”
“ড্যামিয়ান!” মার্কোভিক সাবধান করল কড়া গলায়। ড্যামিয়ান ছেড়ে দেয় আন্না মেরিওর হাত। তারপর ইসাবেলার আতঙ্কিত মুখে চেয়ে চোয়াল শক্ত করে বলে,
“তোমার নাতনি ফের ওই পিশাচকে ফিরিয়ে আনতে চাইছে। অন্তঃসত্ত্বা ও। নিকোলাসের সন্তান ওর গর্ভে।”
চলবে,,,