বকুলতলা
৯.
প্রণয়কে বেশ শান্ত লাগছে এখন। কিছুক্ষণ আগের রাগ আর দেখা যাচ্ছে না। তরীকে আশেপাশে দেখতে না পেয়েও তার প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক। চুপচাপ প্লেটের বিরিয়ানিটুকু খাচ্ছে। আজকের রান্নাটা মজা হয়নি তেমন। প্রত্যেকটা লোকমায় মুখের স্বাদ বিগড়ে যাচ্ছে। নাকি তার মনটাই বিস্বাদে ভরে গেছে?
আয়েশা খাতুন হঠাৎ-ই সেখানে উদয় হয়ে ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললেন, “এত কম খাবার নিয়েছিস কেন বাবা? টেবিলে দেখছি বিরিয়ানির বাটিটাও নেই! এই তরী মেয়েটা কি আদৌ কোনো কাজ ঠিক করে করতে পারে না? মেয়েটা কোথায়?”
আয়েশা খাতুন মাত্রই ঘুম থেকে উঠে এসেছেন বোধহয়। কণ্ঠে ঘুমুঘুমু ভাব স্পষ্ট। প্রণয় তাকালো না। চুপচাপ বিরিয়ানির একেকটা কণা গিলতে লাগলো। পাশ থেকে সালেহা ভয়ে ভয়ে জবাব দিলো, “আপার শরীলডা আইজকা ভালা না ম্যাডাম। কইলো ঘুমাইবো।”
মুহুর্তেই প্রণয় থেকে নজর ঘুরিয়ে সালেহার দিকে তাকালেন তিনি। তীক্ষ্ণ, তাচ্ছিল্য দৃষ্টি। ঠাট্টার সুরে বললেন,
—“এত ক্লান্ত কেন? তোর আপা কি এভারেস্ট জয় করে আসছে নাকি?”
তার এই ঠাট্টাটা কারোই পছন্দ হলো না। সালেহা সামনাসামনি কিছু বলতে না পারলেও মনে মনে ভীষণ রাগে ফুঁসে উঠলো।
আয়েশা খাতুন আবার বললেন, “যাহ্, তোর আপাকে ডেকে নিয়ে আয়। এত ঘুমাতে হবে না। পরে ঘুমাক।”
—“আমার খাওয়া শেষ আম্মু। কাউকে ডাকতে হবে না।” এতক্ষণ বাদে গম্ভীরমুখে বলে উঠলো প্রণয়। বাস্তবিকই তার খাওয়া শেষ প্রায়। আর অল্প একটু আছে।
আয়েশা খাতুন ভয়ংকর ভাবে চোখ-মুখ কুঁচকে ফেললেন। চাহনি হলো কাঁটা কাঁটা। সন্দিহান কণ্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়লেন, “ডাকলে কি সমস্যা? তুই কি আবারো–”
কথা শেষ হলো না। আধখাওয়া প্লেট রেখে তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়ালো প্রণয়। রাগে গা শিরশির করছে। কিছু একটা মনে পরে গেছে আবারও! মায়ের দিকে কেমন কঠিন নয়নে তাকালো সে। কাঠকাঠ গলায় বললো,
—“তুমি কি আমাকে শান্তি দিবে না?”
—“আমি কখন তোকে শান্তি দিলাম না? বরং তুই নিজেই অশান্তির পথে হাঁটছিস। দেখ প্রণয়, তরী ভালো মেয়ে না।”
নিশ্বাসের ঘনত্ব বাড়িয়ে প্রণয় কিছুক্ষণ কথা বললো না। মেজাজ তিরতির করে তেতে যাচ্ছে। রুক্ষ হতে চাচ্ছে আচরণ। তবুও যথেষ্ট শান্ত গলায় সে বললো, “তরী আমার জন্য কেউ না আম্মু। থাকতে এসেছে, থাকুক। ওকে দয়া করে কষ্ট দিও না।”
কিন্তু প্রণয়কে তো আয়েশা খাতুন চিনেন। কথাটা ঠিক বিশ্বাস করতে পারলেন না। বললেন, “প্রণয়, তুই ভুল পথে পা বাড়াচ্ছিস। মায়ের কথা শুন। তোকে তো তিন বছর আগের ঘটনা বলেছিই আমি, তাই না? নির্লজ্জ মেয়েটা অলক্ষী না হলে কি ওমন হতো?”
প্রণয় সেসব কথায় কান দিলো না। খাবার ঘর ছেড়ে চলে যেতে লাগলো। ক্রমশই বুক ভারি হয়ে আসছে তার। অসহ্য মাথা ব্যথায় কাতর হচ্ছে শরীর।
সালেহা নীরব দর্শকের মতো সব দেখছিল। বলা যায়, হা করে গিলছিল সব। আয়েশা খাতুন আড়চোখে ওর দিকে একবার তাকালেন। পরপরই জোড়ালো কণ্ঠে ধমক দিয়ে উঠলেন, “যা শুনেছিস, শুনেছিস। কথাগুলো যেন তরীর কানে না যায়।”
অবাক সালেহা আড়ষ্ট ভঙ্গিতে উপর-নিচ মাথা নাড়ালো। একবার, দুবার, লাগাতার।
–
নীল রঙের আকাশ। তার মাঝে একটু একটু করে উড়তে থাকা সাদা মেঘ। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। মন মাতানো বাতাস এসে এসে ছুঁয়ে দিচ্ছে। মাথার ঘোমটা সামলাতে খানিকটা বেগ পেতে হচ্ছে তরীর। হাত উঁচিয়ে ওড়না কপাল অব্দি টেনে নিলো সে। দু’কানে ইয়ারফোন গুঁজে রাখা। এই অবেলায় গানটি বাজছে। তার ভীষণ পছন্দের গান।
মাহাদ কোত্থেকে যেন বাদাম কিনে নিয়ে এসেছে। কুড়ি টাকা দিয়ে। এখন আবার বাদামগুলো থেকে সযত্নে খোসা ছাড়িয়ে তরীর হাতে গুঁজে দিচ্ছে। তরী প্রথমে মানা করেছিল, সে খাবে না। কিন্তু ত্যাড়া লোকটা কি আদৌ তার কথা শুনবে কিংবা কখনো শুনেছে?
—“তরী? আরও খাবে?”
হঠাৎ বলে উঠলো মাহাদ। তরীর কানে ইয়ারফোন থাকায় সে শুনতে পায়নি। অন্য খেয়ালে বিভোর হয়ে আছে। মাহাদ কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করলো। এরপর আচমকাই তরীর কান থেকে একটা ইয়ারফোন খুলে নিজের কানে ঢুকিয়ে নিলো। ওপাশ থেকে গানের লাইন ভেসে আসছে,
‘এই অবেলায়, তোমারি আকাশে, নিরব আপোষে ভেসে যায়
সেই ভীষন শীতল ভেজা চোখ
কখনো দেখাইনি তোমায়।’
শুনে হাসলো মাহাদ। ক্ষীণ হাসি। ইয়ারফোনটা আবার সাবধানে তরীর কানে গুঁজে দিতে দিতে অবাক তরীকে শুধালো, “আমার গাওয়া গান-না তোমার বাজে লাগে? তুমি এত এত মিথ্যে বলো তরী?”
মাহাদ খুব সুন্দর গান গাইতে পারে। দারুণ মারাত্বক কণ্ঠ তার! ক্ষীণ ভরাট, ক্ষীণ ভারি। প্রায়ই তরীর পছন্দের সব গান গেয়ে, রেকর্ড করে তরীকে পাঠায় সে। গিটারও খুব ভালো বাজাতে পারে। তরীর প্লে-লিস্ট এখন মাহাদের গাওয়া গান পর্যন্তই সীমিত। অন্যদের গাওয়া গান এখন আর ভালো লাগে না। অথচ তরী দিব্যি মিথ্যে বলে গেছে, তার মাহাদের গান পছন্দ না। মনে মনে সে কিন্তু ঠিকই অবসর সময়ে, একটুখানি মন খারাপে, একটুখানি আনন্দে কানে ইয়ারফোন গুঁজে বসে থাকে।
তরী মিনমিনে কণ্ঠে বললো, “আমি– আমি অন্য গান শুনছিলাম। হঠাৎ করে এ গান চলে এসেছে। আমি পছন্দ করি না আপনার গান।”
মাহাদ হাসলো আবারও। নিঃশব্দে। লহু স্বরে বললো,
—“মিথ্যে বলাটা হয়নি তরী। মিথ্যে বলার সময় ঠোঁট কাঁপা বারণ। এদিক-ওদিক তাকানো যাবে না। দৃষ্টি স্থির রাখতে হবে। জোড়ে জোড়ে নিশ্বাসও নিতে পারবে না। স্বাভাবিক থাকবে। ঠিকাছে? এবার আবার মিথ্যেটা বলো।”
তরী পলক ঝাপটালো। সরল কণ্ঠে বললো,
—“আপনি কিভাবে বুঝে ফেলেন?”
মাহাদ উত্তর দিলো না। হাসতে হাসতেই প্রশ্ন করলো, “আরও বাদাম খাবে? নিয়ে আসি?”
—“খাবো না।”
বলতে বলতে একটা তীব্র বাতাস এসে উলটপালট করে দিলো চারিদিক। পাখির কিচিরমিচির শব্দ হলো। পাতাগুলো গাছ থেকে আলাদা হয়ে ছুটোছুটি স্বাধীন ভাবে করলো। তরী তাকিয়ে রইলো। ম্লান কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “আপনাকে আমি কেন মেনে নেইনা, সেটা জানতে ইচ্ছে করে না মাহাদ?”
—“করে।”
—“তাহলে কখনো জিজ্ঞেস করেননি কেন?”
—“জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হয়নি। আমার কষ্ট পেতে ভয় লাগে তরী।”
তরী একদম চুপ হয়ে গেল। দৃষ্টি নুইয়ে গেল আস্তে আস্তে। মাহাদ বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললো, “বাস আসতে বোধহয় দেড়ি হবে। ওদিকটায় অনেক জ্যাম বেঁধেছে। আমার আসতেই তো দেড়ি হলো। তৃষ্ণা পেয়েছে না? আমি পানির বোতল নিয়ে আসছি।”
_________________
চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা