বকুলতলা ১৭.

0
627

বকুলতলা

১৭.
জ্বর শরীরে প্রণয় ওই লাইব্রেরী ঘরেই পরে রইলো সকাল পর্যন্ত। কেউ দেখতে আসেনি। খবর নিতে আসেনি। সালেহা অবশ্য একবার খেতে ডেকেছিল। প্রণয় সাড়া দেয়নি। ঘুম ভাঙ্গার পরপরই অলসতা কাটিয়ে ঢুলু ঢুলু পায়ে চলে গিয়েছিল নিজের ঘরে। অগোছালো, কুঁচকানো বিছানাতেই ছেড়ে দিয়েছিল অচল শরীরটা। দেহে যেন প্রাণ ফুরিয়ে গেছে। হাত, পা নাড়াতে কি কষ্ট! কি দারুণ অসারতা!
আয়েশা খাতুন যখন ছেলের জ্বর টের পেলেন, তখন বিকাল প্রায়। মূলত ছেলের হাসপাতালে না যাওয়ার কারন শুনতেই এসেছিলেন তিনি। পরক্ষণেই কপালে হাত ছোঁয়াতেই রীতিমতো আঁতকে উঠলেন। এত জ্বর! কখন হলো?
তাড়াহুড়ো করে প্রণয়ের মাথার কাছে বসলেন আয়েশা খাতুন। কপালে হাত ছুঁইয়ে আরেকবার দেহের তাপমাত্রা পরিমাপ করে নিলেন। কিঞ্চিৎ ক্ষিপ্ত স্বরে প্রশ্ন ছুঁড়লেন, “তুই আমাকে আগে জানাস নি কেন প্রণয়? এত জ্বর কখন এলো?”

প্রণয় উত্তর দিচ্ছে না। নিভু নিভু চোখে চেয়ে আছে মাত্র। চোখ জোড়াও জ্বালা করছে। মাথা ব্যথার যন্ত্রণায় সব কিছু কেমন ফ্যাকাশে ফ্যাকাশে। আয়েশা খাতুন কণ্ঠ নমনীয় করে বললেন, “বেশি খারাপ লাগছে আব্বা? মাথায় জলপট্টি দিয়ে দেই?”
—“কষ্ট হয় আম্মু।”

কষ্ট, আবেগ, হিংসা, অহংকার– সব কিছু ঝাঁপিয়ে বিশাল কিছু ছিল কথাটায়। আয়েশা খাতুন এক মুহুর্তের জন্য থমকালেন। ছেলে তার এভাবে কখনো কথা বলে না। নিজেকে দমিয়ে রাখে। তবে আজ কি হলো? চুলের গভীরে হাত গলিয়ে তিনি ম্লান গলায় বললেন, “বেশি কষ্ট হচ্ছে? ডাক্তার ডাকি?”
—“আমিই তো ডাক্তার আম্মু। ডাক্তারকে ডাক্তার সুস্থ করতে পারে?”
—“কেন পারবে না? তোর ডাক্তার বন্ধুটাকে কল দেই? আসতে বলি?”

প্রণয় সেকথার জবাব দিলো না। চুপচাপ শুয়ে রইলো কিছু ক্ষণ, কিছু মুহুর্ত। তারপর কি যেন হলো। কি ভেবে ভ্রু কুঁচকে গেল। কপালে ভাঁজ পরলো হিং’স্র ভাবে। আচমকা মায়ের ডান হাত শক্ত করে ধরলো সে। এতই শক্ত যে, ফর্সা চামড়া তীক্ষ্ণ নখে বিঁধে ক্ষতবিক্ষত হলো। আয়েশা খাতুন সহ্য করতে পারলেন না। হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে ধমকে উঠলেন, “কি করছিস প্রণয়? আমার হাত ছাড়! ব্যাথা পাচ্ছি আমি!”

প্রণয় শুনলো না। অবাধ্য হলো। ছাড়লো না হাত। চোখের সাদা অংশে লাল রঙ মিশিয়ে আধখোলা পাতায় তাকিয়ে রইলো। দেখে মনে হচ্ছে, সে বুঝি মাতাল। এক্ষুণি কোনো অঘটন ঘটিয়ে ফেলবে। তবে না। প্রশ্নটা সে শান্ত স্বরেই করলো, “তরীকে কি ধর্ষণ করা হয়েছিল আম্মু?”

আয়েশা খাতুন মোটেও চমকালেন না। একদিন না একদিন প্রণয় সত্য জানতোই। সেই একদিন এখন হলে ক্ষতি কি? বললেন,
—“তুই জানলি কিভাবে?”
—“জেনেছি। তুমি আগে বলো নি কেন?”
—“বললে কি করতি? যতটুকু বলার ছিল, বলেছি।”

মনে বিতৃষ্ণা জাগলো। নিজ মাকে ভীষণ বিষাদ লাগলো প্রণয়ের। তেঁতো মুখটা বিচ্ছিরি ঝাঁঝে ভরে গেছে। আয়েশা খাতুনের হাত ছেড়ে তিরিক্ষি মেজাজে সে বললো, “এখান থেকে যাও আম্মু। ভালো লাগছে না।”
—“একটু পরে যাচ্ছি। তুই তো বোধহয় কিছু খাসনি। সালেহাকে ডেকে বলি স্যুপ আনতে? স্যুপ খাবি?”
—“তোমাকে এখনই যেতে বলেছি আম্মু!”
প্রণয়ের উঁচু গলা। আয়েশা খাতুন কষ্ট পেলেন। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন জোড়েসড়ে। বোঝানোর সুরে বললেন, “তখন পরিস্থিতি ভালো ছিল না প্রণয়। তুইও দেশে ছিলি না। তোকে বলে তোর পড়ালেখা নষ্ট করতে চাইনি।”

প্রণয় বুঝি বুঝলো? একদমই না। চোয়াল শক্ত করে রাখলো কঠিন থেকে কঠিন ভাবে। আয়েশা খাতুন আবার বললেন,
—“মেয়েটা আর ভালো নেই প্রণয়। তোর সাথে মানায় না। আমাদের স্টেটাসের সাথেও যায় না। অর্ণব নামের ছেলেটার সাথেও কত কাহিনী হলো! তুই মেয়েটার কথা আর ভাবিস নাতো।”

প্রণয় ভয়ংকর চোখে তাকালো এবার। কপালের নীল রগটা স্পষ্ট হলো। ফোঁসফোঁস শব্দে নিস্তব্ধতা কাটলো। ঝাঁঝালো স্বর শোনা গেল, “তুমি এক্ষুণি বেড়িয়ে যাবে আম্মু! এক্ষুণি!”

আয়েশা খাতুনের হাত জ্বালা করছে। ক্ষীণ রক্তে রঞ্জিত ছোট ছোট নখের দাগগুলো। গরম, গরম অনুভব হচ্ছে। তিনি একপলক প্রণয়ের দিকে তাকালেন। আরও একবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে দরজা ঠেলে বেরিয়ে গেলেন।

বিকালটা সুন্দর। আসন্ন সন্ধ্যার কমলাটে মুহুর্ত। বাতাসের আনাগোনা নেই। তবুও উষ্ণতা ছুঁতে পারছে না। মোটরসাইকেলের পেছনের সীটে বসে তরী একমনে পাশে চেয়ে আছে। দেখছে, দুটো মেয়েকে। দুজন দুজনের বন্ধু হয়তো। আইসক্রিমের গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে চকবার খাচ্ছে। মাঝে মাঝে একে অন্যজনকে খাইয়ে দিচ্ছে। মজা করছে, হাসছে, দুষ্টুমী করছে। তরীর নেত্রজোড়া ঘোলাটে হলো। কেউ একজনকে মনে পরলো হঠাৎ করেই। মনে পরলো, সেইদিনের কথা। রুপালী চলে যাওয়ার পরের আর্তনাদটা। বুকে কামড়ের তীক্ষ্ণটা অনুভব করতে পারছিল তরী। শরীর যন্ত্রণায় কাঁপছিল। হাহাকার করছিল ভেতরটা। গলায় জোড় ছিল না। চোখ উলটে গিয়েছিল। সেই উল্টানো চোখেই আশপাশ দেখার চেষ্টা করছিল তরী। খুঁজছিল কাউকে, সাহায্যের জন্য। পেট সূক্ষ্ণ অথচ বিশাল ভাবে মোচড় দিতেই গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠলো। কাঁদলো হু হু করে। চেঁচিয়ে বারবার ডাকতে লাগলো, “রুপালী? দারোয়ান চাচা? আমাকে বাঁচান কেউ। আমি বাঁচতে চাই। প্লিজ আমি বাঁচতে চাই।”

অথচ ওপাশ নিঃশব্দ। কেউ আসলো না। ভয়ংকর হায়নাগুলো বিশ্রী শব্দ করতে লাগলো শুধু। বিশ্রী হাসলো। কালো লোকটা মুখ এগিয়ে আনলো দ্রুত ভাবে। চুমু খেতে চাইলো তরীর কান্নায় ভেঙ্গে পরা ঠোঁটে। তরী চাচ্ছিল না। সরে যেতে চাইছিল বারবার। অসহ্য রাগে হঠাৎ করেই ফুঁসে উঠে বড় বড় নখগুলো দিয়ে খামচে ধরলো লোকটা বাম চোখ। লোকটা ব্যথা পেয়ে সরলো অনেকটা। ব্যাথাতুর আওয়াজে গড়ালো সবুজ, সতেজ ঘাসে। তরী কিন্তু সুযোগটা কাজে লাগাতে পারতো। পেরেও যেত যদিনা অনিক নামে লোকটার বন্ধু ওকে ধরে না ফেলতো। নরম গালে লোকটার খড়খড়ে হাতের লাগাতার থাপ্পড়ে তরী নেতিয়ে পরেছিল। হাত মুচড়ে ধরায় ব্যথায় শব্দও করতে পারছিল না। কাঁদছিল মাত্র। অল্প অল্প করে। তার পালাতে চাওয়াটাও ছিল যেন মারাত্বক অপরাধ! কষ্টটা বোধহয় এজন্যই একটু বেশিই দিয়েছিল লোকগুলো।

—“তরী, তুমি কি আইসক্রিম খেতে চাচ্ছো?”
তরীর সম্বিৎ ফিরলো। আইসক্রিমের ছোট্ট গাড়িটা থেকে চোখ সরিয়ে মাহাদের দিকে তাকালো। ছেলেটা বাদাম হাতে দাঁড়িয়ে আছে। আবারও একই প্রশ্ন করতেই তরী লহু স্বরে বললো, “খাবো না। বাসায় যাবো।”
—“সত্যি খাবে না?”
উত্তরে ডানে বামে মাথা দুলালো সে। মাহাদের কেন যেন বিশ্বাস হয়ে গেল। মেয়েটার বাচনভঙ্গি বলে দিচ্ছে, সে মিথ্যা বলছে না। এক কদন এগিয়ে মাহাদ মোটরসাইকেলে ধপ করে বসে পরলো। খানিকটা তরীর পাশ ঘেঁষে। ঠাট্টার সুরে বললো, “ওহে নৌকা রমনী, আপনার কি বেশি মন খারাপ? আমার সাথে কি টিএসসিতে ঘুরতে যেতে চান?”
তরী অবাক কণ্ঠে বললো, “সেতো অনেক দূরে। যাবো কিভাবে?”

মাহাদ কয়েকটা বাদাম নিয়ে খোসা ছাড়ালো। তরীর হাতে দিয়ে বললো, “আপনি রাজী কি-না বলুন। নিয়ে যাচ্ছি।”
তরী একটু ভেবে বললো, “নাহ্। যাবো না। আপনি সকাল থেকে ভালো কিছু খাননি। হাবিজাবিতে কি পেট ভরে? বাসায় জলদি গিয়ে জলদি জলদি ভাত খেতে বসে যাবেন।”
মাহাদ শুনলো। ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো কেমন।
—“তুমি এত মিথ্যা করা বলো তরী!”
—“এখন কি মিথ্যা বললাম?”
বিমূঢ়তা স্পষ্ট তরীর মুখশ্রী জুড়ে। মাহাদ শুষ্ক কণ্ঠে আওড়ালো, “এইযে, তুমি আমায় ভালোবাসো না।”

__________________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা
বানান ভুল থাকতে পারে। দুঃখীত।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here