তোমার_আমার_প্রণয় #israt_jahan_arina #part_10

0
1430

#তোমার_আমার_প্রণয়
#israt_jahan_arina
#part_10

আজ আকাশে কালো মেঘ জমেছে।এই মেঘ সবার দৃশ্যপটে আসলেও এক কিশোরীর মনে আকাশে যে মেঘ জমেছে তা দৃশ্যমান নয়। ভীষণ মন খারাপ নিয়ে বারান্দায় বসে দেয়ালে আঁকাআঁকি করছে দৃশ্য। এটা তার ছোটবেলার স্বভাব। যখনই মন খারাপ হবে বারান্দার দেয়ালে বিভিন্ন নকশা আঁকতে শুরু করবে।বারান্দার দেয়াল তার হাজারো নক্সায় ভরপুর। এর জন্য মায়ের কাছে হাজার বকুনি খেয়েছে। কিন্তু তবুও এ বাজে স্বভাব ছাড়তে পারেনি। আজও তার ভীষণ মন খারাপ।

মাহাদের সাথে তার সম্পর্কটা আসলে কি সেটা সে জানে না। নিজের থেকে পাঁচ বছর সিনিয়র একজনকে ঠিক বন্ধুও বলা যায়না। শুধু এটা জানে মাহাদের সাথে কথা বলতে তার ভীষণ ভালো লাগে।সারাক্ষণ সেই ধূসর চোখ গুলো দেখতে ইচ্ছে করে। আচ্ছা ছেলেদের চোখে কি এত সুন্দর হয়?

মাহাদকে নিয়ে তার অনুভূতিটাও এই কিশোরী মনটা বুঝতে পারেনা। স্কুলের প্রায় অনেক মেয়েই মাহাদের ওপর ভীষণ ইমপ্রেস। এ কথা দৃশ্য নিজেও জানে। কিন্তু মাহাদকে কখনো কোন মেয়ের সাথে খুব একটা মিশতে দেখেনি। তার মতে মাহাদ একমাত্র তার সাথে সবচেয়ে ভালো এবং ইজি ভাবে মিশেছে। কিন্তু আজ রামিসার সাথে মাহাদকে ঠিক সহ্য করতে পারেনি দৃশ্য। কেন এমনটা হয়েছে তা সে জানে না।

গত কাল রাত থেকে মাহাদ তাকে অসংখ্য বার কল আর মেসেজ করেছে।সে কোনো রেসপন্স করেনি।আজ সে স্কুলে আর কোচিং এ যায়নি। মাহাদ বেশ কয়েকবার কল করেছে ওকে কিন্তু সে রিসিভ করেনি। মেসেঞ্জারে কোন রিপ্লাই দেয় নি।তার কিশোরী মনে প্রচন্ড অভিমান জমা হয়েছে।

দৃশ্যর হঠাৎ চোখ পরল পাশের বাসার বারান্দার দিকে। তমা আপু বারবার বারান্দায় আসছে আবার ফিরে যাচ্ছে। শত অভিমান এর মাঝেও মুখে হাসি ফুটে উঠল দৃশ্যর। কারণ তমা বারবার ফাহিমের রুমের জানালার দিকে তাকাচ্ছে। সুন্দরী মেয়েদের যদি লিস্ট করা হয় সেখানে তমা আপুকে অনায়াসেই জায়গা দেওয়া যায়। তমা আপুর চুল দেখে ছেলেরা ক্রাশ খায়। হাঁটু অব্দি লম্বা ঘন চুল তার। ভীষণ শান্ত আর লজ্জাবতী মেয়ে সে। ছোটবেলা থেকেই দেখে এসেছে ফাহিম ভাইয়ের প্রতি সে ভীষণ দুর্বল। হবেনাই বা কেন? তার ভাই কম কিসে? 5 ফুট 11 ইঞ্চি লম্বা উজ্জ্বল শ্যামলা গায়ের রঙের ছেলেদের দেখলে সব মেয়েরাই দুর্বল হয়ে পড়ে। তাছাড়া এলাকায় ফাহিম ভাইয়ার বাপের ক্ষমতার একটা প্রভাব রয়েছে। যেটা তিনি প্রয়োজন ভেদে প্রয়োগ করে থাকেন।বাহিরে ফাহিম যেমন হোক না কেনো,ভাই হিসেবে সে বেস্ট। হাসবেন্ড হিসেবেও নিশ্চয়ই ভীষণ কেয়ারিং হবে?
দৃশ্য মুচকি হেসে তমাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো

-“ভাইয়া বাসায় নেই আপু।”

হঠাৎ দৃশ্যর কথায় তমা বিচলিত হয়ে পড়ল।এতক্ষণে সে দৃশ্যকে খেয়াল করলো।এই বিচ্ছু যে এই জায়গাতে বসে আছে টা সে বুঝতে পারেনি।কিছুটা ঘাবড়ে বললো

-“তুই এই সময়ে বাসায় কি করিস? কোচিংয়ে যাসনি?”

-“গেলে কি আর এই জায়গায় দেখতে?”

-“আজ যাসনি কেনো?”

-“এমনি।ভালো লাগছে না তাই।”

-“তোর কি মন খারাপ?”

-“না।”

তমা বুঝতে পারলো দৃশ্যর কোনো কারণে মন খারাপ।তাই সে বললো

-“গলির মোড়ে ফুচকা খেতে যাবি?”

মুহূর্তেই দৃশ্য চোখ চকচক করে উঠলো। ফুচকা আইসক্রিম চকলেট এসব জিনিস সে কিছুতেই মানা করতে পারে না।
_______________________
সকাল থেকেই মাহাদের মেজাজ ভীষণ গরম। গতকাল বিকেল থেকে দৃশ্য কে কল করে যাচ্ছে কিন্তু সে কিছুতেই রিসিভ করছে না। তাই সে সকল সকাল রেডি হয়ে কলেজে চলে গেল। ভেবেছে কলেজে দৃশ্য সাথে কথা বলবে। কিন্তু সেখানে যেও দৃশ্যর কোন দেখা পেলো না। না দৃশ্য এসেছে আর না নাবিলা। মৌকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলো আজ দৃশ্য স্কুলে আসেনি। মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল তার।ক্লাসে খুব একটা মনোযোগ দিতে পারেনি। সারাটা দিন খুব কষ্টে কাটিয়ে বিকেলে দৃশ্যর কোচিংয়ের মোড়ে অপেক্ষা করতে লাগলো। না সেখানেও আজ দৃশ্যর কোন দেখা পেল না। মাহাদকে মন খারাপ করতে দেখে জয় বললো

-“দোস্ত তোর তো পুরাই দেবদাসের মতো অবস্থা? আমাদের পিচ্চি ভাবি মাহাদকে পুরা দেবদাস বানাইয়া ছাড়ছে।”

জয়ের কথা শুনে রাফসান আর তানিম হেসে উঠলো।
মাহাদ বিরক্ত নিয়ে বললো

-“শালা মজা নিস না। মন-মেজাজ এমনি খারাপ।”

রাফসান মজার সুরে বললো
-“একটা বাচ্চার প্রেমে পড়ছিস এবার বুঝ মজা। নিজের মনের কথা না বলতে পারছিস, আর না ওই বাচ্চাটা নিজে থেকে বুঝতে পারছে?”

তানিম বুঝতে পারলেও মাহাদের মেজাজ গরম হচ্ছে। তাই সে বললো

-“চল কোথাও ঘুরে আসি। পাশের এলাকায় একটা নতুন শর্মা হাউজ খুলেছে। চল সেখানে ঢু মেরে আসি।”

তামিমের কথায় সবাই রাজি হয়ে গেল। তারা বেরিয়ে পড়লো। সেখান থেকে ফিরতে রাস্তায় হঠাৎ মাহাদের চোখ পরল। দৃশ্য খুব মজা করে ফুচকা খাচ্ছে। পাশের আরেকটা মেয়ে যার সাথে হেসে হেসে কথা বলছে আর একটা করে ফুচকা মুখে পড়ে নিচ্ছে। দৃশ্য সে হাসি যেন মাহাদের অন্তরে জ্বালা ধরিয়ে দিল। এই মেয়ের টেনশনে গতকাল রাতে সে ঠিকমতো ঘুমাতে পারেনি। আজ সারা দিন চরম অস্থিরতায় কাটিয়েছে। যে মেয়ের জন্য তার বন্ধুরা তাকে দেবদাস টাইটেল দিয়ে ফেলেছে, সে মেয়ে কিনা আরামসে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ফুচকা খাচ্ছে? মানে মনে ভীষন রাগ হল দৃশ্যর উপর।

সে ফোনটা বের করে দৃশ্য কে কল করলো। দৃশ্য হাতে থাকা ফোনের দিকে একবার তাকিয়ে আবার ফুচকায় মনোযোগ দিল। মাহাদের রাগটা যেন আরো বেড়ে গেল।এই বাচ্চা মেয়েটা কিনা তাকে ইগনোর করছে? মাহাদ যে রেগে আছে সেটা তার বন্ধুরাও খেয়াল করলো। মাহাদ যেমন শান্ত ঠিক তেমনই পাগলাটে। বন্ধুরা মাহাদের রাগ সম্পর্কে ভালোভাবেই অবগত।ঠিক তখনই রেগে মাহাদ সামনে এগোতে গেলে তানিম তাকে আটকালো। আর বললো

-“প্লিজ মাহাদ এখানে কোন সিনক্রিয়েট করিস না। এতে দৃশ্যর সমস্যা হতে পারে। আর আমি যতটুকু জানি দৃশ্য এই এলাকাতেই থাকে। তাই এখন এখানে রাগ ঝাড়তে যাস না।”

রাফসান আর জয়ও একই কথা বললো। মাহাদ নিজেকে কিছুটা শান্ত করে সেখান থেকে চলে গেল।
রাত আটটার দিকে মাহাদ বাসায় ফিরলো। বাসায় ফিরেই আমজাদ রহমানের সাথে দেখা হলো তার। ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলেন ছেলের কোন কারণে মন খারাপ। তাই তিনি বললেন

-“কি ব্যাপার আমার রাজপুত্রর কি মন খারাপ?”

মাহাদ জোরপূর্বক মুচকি হেসে বলল
-“কই নাতো বাবা?”

-“তা বাবা তোমার গানের প্র্যাকটিস কেমন চলছে?”

-“ভালো। তুমি ঢাকায় যাবে কবে বাবা?”

-“আমি তো কাল বিকেলে যাব।”

-“তোমার জন্য অনেক ঝামেলা হয়ে যায় তাই না বাবা ঢাকা টু রাজশাহী।”

আমজাদ রহমান কিছুটা হেসে বললেন
-“তাতো একটু হয়। কিন্তু আম্মা ঢাকায় যেতে চায় না তাই তো বাধ্য হয়ে আমার একা একাই ঢাকা থাকতে হচ্ছে।”

-“চিন্তা করো না বাবা। ইন্টার শেষ করে আমিও ঢাকায় ভার্সিটিতে ভর্তি হব। তখন তুমি আমি একসাথে ঢাকায় থাকবো।”

-“হ্যাঁ সেটাই ভালো হবে। তখন আর আমি রাজশাহী ফিরবো না দেখবি তোর মা আর দাদী সুড়সুড় করে ঢাকায় চলে এসেছে।”

মাহাদ হেসে বললো
-“বাবা আমি কিন্তু গানটাকে আমার ক্যারিয়ার হিসেবে নিতে চাই।”

আমজাদ রহমান ছেলের কাঁধে হাত রেখে বললেন
-“অবশ্যই কেন না? আমার ছেলের প্রতি আমার সম্পূর্ণ আস্থা আছে।তুই অবশ্যই গানে খুব ভালো ক্যারিয়ার করতে পারবি।”

-“থ্যাংক ইউ বাবা আমাকে সাপোর্ট করার জন্য।”

-“তোদের দুই ভাইকে আমি সবসময় সাপোর্ট করি।”

বাবা-ছেলের কথার মাঝে সেখানে আখি রহমান উপস্থিত হলেন। তিনি মাহাদ কে উদ্দেশ্য করে বললেন

-“কি ব্যাপার মাহাদ বাসায় আসতে এতো দেরি কেন হলো? এতো লেট করে বাসায় আসা কিন্তু আমার মোটেও পছন্দ না। এতদিন মাহিম লেট করে আসতো এখন তুই ও শুরু করেছিস?”

মাহাদ মুচকি হেসে মাকে বললো
-“সরি মা আর এমন হবেনা।”

-“গানের প্রোগ্রাম থাকলে তো আমি মানা করি না রাতে বাসায় বাইরে থাকতে। কিন্তু অকারণে বাড়ির বাইরে রাতে থাকাটা আমার পছন্দ না।”

মাহাদ মায়ের কোলে মাথা রেখে বললো
-“ওকে আম্মাজান এরপর থেকে খেয়াল রাখবো।”

আখি রহমান হেসে ছেলের মাথায় হাত বুলাতে থাকলেন।
পরদিন স্কুলে এসেই মাহাদ দৃশ্যের খোঁজ করলো। এখনো স্কুলে আসেনি। স্কুলের গেটে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর দেখতে পেল দৃশ্য আর নাবিলা আসছে। মাহাদ ইশারায় দৃশ্যকে কাছে ডাকলো। কিন্তু দৃশ্য না দেখার ভান করে ক্লাস রুমে চলে গেল। মাহাদ অবাক হয় সে দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। দৃশ্যর এমন করার কারণ সে কিছুতেই ধরতে পারছে না। সে চলে গেল সোজা অডিটোরিয়ামে। কাল স্কুলে অনুষ্ঠান তাই তাকে বেশ কিছু কাজ দেখাশোনা করতে হবে।
টিফিন আওয়ারে দৃশ্য, নাবিলা,মৌ আর সায়মা বের হলো ক্যান্টিনের উদ্দেশ্যে। অডিটোরিয়ামের পাশ দিয়ে যেতেই তারা সবাই দাঁড়িয়ে পড়ল। কাল অনুষ্ঠানের জন্য অডিটোরিয়াম কে সুন্দরভাবে সাজানো হচ্ছে। তারা দাঁড়িয়ে সে সাজানো দেখতে লাগলো। কিন্তু দৃশ্য নজর অন্যদিকে। মাহাদ মই দিয়ে উপরে উঠে বেলুন সাজাচ্ছে। আর নিচে দাঁড়িয়ে রামিসা মাহাদকে বেলুন পাস করছেন। দুজনের মধ্যে বেশ কথা হচ্ছে। হঠাৎ সায়মা বলে উঠলো

-“রামিসা আপু আর মাহাদ ভাই কি রিলেশন আছে?”

মৌ কপাল কুঁচকে বললো
-“জানিনাতো? তোর এমন কেন মনে হলো?”

-“আরে দেখিস না, ইদানিং রামিসা আপু আর মাহাদ ভাই কেমন চিপকে থাকে।”

-“ঠিক বলেছিস আমিও বিষয়টা খেয়াল করেছি। কিন্তু এই রমিসা আপুকে আমার মোটেও ভালো লাগে না। ভীষণ রকমের ঢঙ্গী মাইয়া। এর আদিখ্যেতা দেখলে গা জ্বালা করে।”

দৃশ্য ওদের কথা শুনছে আর রাগে ফুঁসছে। আবার চোখ ফিরালো মাহাদের দিকে। মাহাদ মই থেকে নিচে নামতেই রামিসা মহাদের বুকের পাশে এসে হাত দিয়ে শার্ট ঝড়তে লাগলো।আর মাহাদ হেসে তাকে মানা করতে লাগলো।এই ঘটনাটা দৃশ্যর কোমল মনে ভীষণ আঘাত হানে। মাহাদকে অন্য কোনো মেয়ে স্পর্শ করছে এইটা সে কিছুতেই মানতে পারছে না।তার চোখ জোড়া মূহুর্তে ভিজে উঠলো।মনে মনে সে মাহাদকে বেশ কয়েকটা গালি দিলো।খুব সাবধানে সবার আড়ালে চোখ মুছে নিলো।আর ভাবলো

আর জীবনে কোনো দিন এই ব্যাটাকে দেখবে না।কোনোদিন এই লোকের সাথে কথা বলবে না।আর একবার তাকে কল দিলে অনেক গুলা গালি দিয়ে দিবে।দৃশ্য ছোট বেলা থেকে ভীষণ আদরে বড়ো হয়েছে।সবার ছোট হওয়াতে কোনোদিন নিজের কোনো জিনিস কারো সাথে শেয়ার করতে হয়নি।তাই সে নিজের জিনিসের ভাগ দেওয়া কখনো শেখেনি।তবে আজ তার মনে হচ্ছে কেউ তার সবচাইতে প্রিয় জিনিসে ভাগ বসাচ্ছে। যেটা সে কিছুতেই মানতে পারছে না।পরক্ষণে ভাবলো সে কি কোনো ভাবে ওই মানুষটাকে নিজের বলে ভাবছে?আদো ওই মানুষটাকি তার?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here