#তোমার_আমার_প্রণয়
#israt_jahan_arina
#part_38
পশ্চিম আকাশে রক্তিম সূর্যটা ডুবে গেছে অনেকক্ষণ আগে।রাজশাহী শহরের দুই প্রভাবশালী পরিবারে তখনও চলছে সংঘর্ষ। এ যেনো ক্ষমতার লড়াই।নিজেদের শক্তি জাহির করার লড়াই।
আমরিন আখি রহমানকে জড়িয়ে ধরে আছে।চোখের সামনে এমন অবস্থা দেখে তিনি ভীষণ ভেঙে পড়েছে।আমরিন এর চোখ পড়ে দৃশ্যর দিকে।গোলাপি আভা মিশ্রিত এক নতুন বউ যার আর্তনাদের শব্দ সবচাইতে বেশি শোনা যাচ্ছে।হবে নাইবা কেনো?দুই পক্ষই তার আপনজন।যেই জিতুক হার তো তারই। চোখের কাজল লেপ্টে এলোমেলো অবস্থায় মেয়েটাকে কি মারাত্মক লাগছে।আচ্ছা সেও তো অনেক সুন্দর।কিন্তু বউ সাজে তাকে কি ঠিক এতটা মায়াবী লাগবে?দৃশ্যর গালে আঙ্গুলের ছাপ।এই দুর্বিষহ অবস্থায় ও মেয়েটাকে কেমন মায়াবতী লাগছে। মাহাদ ভাইয়া নিশ্চয়ই এই মায়ায় আটকে গেছিলো।বউ সাজার পরও মেয়েটার মধ্যে একটা বাচ্চা বাচ্চা ভাব রয়ে গেছে।এই মুহূর্তে এই মেয়েটার উপর ভীষণ হিংসে হচ্ছে তার।
ঠিক সেই সময় বাসায় হন্ত দ্বন্ত হয়ে প্রবেশ করে মাহিম।সে বাইরে থেকে চিৎকার চেঁচামেচির শব্দ পেয়ে দৌড়ে আসে।কিন্তু বাসায় পৌছে এই পরিস্থিতি দেখে হতবম্ব হয়ে যায়।বিকেলে তার ভাই কল করে জানিয়েছে সে বিয়ে করে বাড়িতে বউ নিয়ে আসছে।কথাটা শুনে প্রথমে মাহিম চমকে গেলেও পড়ে ভীষণ খুশি হয়েছে।ওই বাচ্চা মেয়েটা ভাবী হিসেবে একদম পারফেক্ট।দেখতেও পুতুল।কিন্তু তার ভাইয়ের এতো কিসের তারা বিয়ে করার?ভেবেছে বাসায় আজ দাদীর একটু ড্রামা দেখবে।এই বুড়ি একটা ড্রামাবাজ।তবে আজকের ড্রামাটা অনেক ইন্টারেস্টিং হবে।কিন্তু এই জায়গাতে তো অন্য কাহিনী চলছে।তার ভাই নিজের শালার সাথেই যুদ্ধ শুরু করেছে।তবে বিষয়টা অনেকটা সিরিয়াস পর্যায় পৌঁছে গেছে সেটা বুঝতে একটু সময় লাগলো।
আমজাদ রহমান কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। মাহাদ আর ফাহিম একে অন্যকে আঘাত করছে।যেনো কোনো প্রতিযোগিতা চলছে।শামসুন্নাহার বেগম বিলাপ করে বলছেন
-“আমার নাতির কেউ বাঁচা।ওই জল্লাদের বংশ আমার নাতিরে শেষ কইরা ফালাইবো।ওই কেউ ধর।”
আরিফ মাহাদ আর ফাহিম কে থামানোর চেষ্টা করছে।মাহিম দৌড়ে গেলো মাহাদকে ছাড়াতে।মাহিম বললো
-“ভাই কি শুরু করেছো?থামো বলছি।”
মাহাদ ক্ষিপ্ত হয়ে বললো
-“ছার আমাকে।একেতো আজ মেরেই ফেলবো।ওরা বাবাকে অপমান করেছে।আর আমার দৃশ্যর গায়ে কতবার হাত তুলেছে জানিস? সব কয়টার হাত ভাঙবো আমি।”
ফাহিম একটা ঘুসি দিয়ে চেঁচিয়ে বললো
-“আস দেখি কে কার হাত ভাঙ্গে। মেয়েবাজ কোথাকার।মেয়ে দেখলে তোদের মাথা ঠিক থাকে না।আমার বোনের দিকে বদ নজর দিয়েছিস?তোর চোখ উপড়ে ফেলবো।”
-“আরে শালা তোর বোন আমার বউ।ওর দিকে আমি যেমন খুশি তেমন নজর দিবো।তুই বলার কে?”
-“কিসের বউ।আমার বোনকে কোনোদিনই তোর হাতে তুলে দিবো না।”
-“আমার বউকে তুই তুলে দেওয়ার কে?”
এই বলে এদের মধ্যে আবার ঝামেলা শুরু হয়েছে।
মাহাদের বুকটা জ্বলে যাচ্ছে।তার চোখের সামনে এই মানুষ গুলি বাবা আর চাচু কে অপমান করে যাচ্ছে।তার ভালোবাসা,তার স্ত্রীর গায়ে হাত তুলছে।আজ সে কিছুতেই এদের ছাড়বে না।সব কটাকে মাটিতে পুঁতে ফেলবে।
আশরাফ হুসাইন এই ঝামেলার মাঝে দৃশ্যর সামনে এসে তার হাত ধরে দার করালো।আর বললো
-“তোর মতো কুলাঙ্গার মেয়ের জন্য আজ এই দিন দেখতে হচ্ছে।চল এক্ষনি এখান থেকে।আর এক মিনিটও এই জায়গায় থাকবো না।”
দৃশ্য কাদতে কাদতে বললো
-“আমি কোথাও যাবনা বাবা। মাহাদ কে ছেড়ে আমি যাবো না। ও আমার স্বামী।ওকে ছেড়ে আমি থাকতে পারবো না।”
আশরাফ প্রচন্ড রেগে আবার দৃশ্যর গালে একটা থাপ্পর বসিয়ে বললেন
-“তুই যাবিনা তর ঘাড় যাবে।আমি মানিনা এই বিয়ে।আমার মান সম্মান ধূলায় মিশিয়ে ছেরেছিস তুই।তোর নিস্তার নাই আজ।”
-“বাবা প্লিজ আমি যাবো না।তুমি না মানলেও ওই মানুষটা আমার স্বামী।ওই মানুষটার হাত আমি কোনোদিন ছাড়বো না।”
-“চুপ বেয়াদব।তোর মতো মেয়েকে জন্মের সময় মেরে ফেলা উচিত ছিলো। নষ্টা মেয়ে কোথাকার।”
আশরাফ প্রচন্ড রেগে দৃশ্যর হাত ধরে দরজার কাছে নিয়ে যেতে চাইলে আমজাদ রহমান সামনে দাড়ায়। এতক্ষণ তিনি সব মুখ বুজে সহ্য করলেও এখন আর পারলেন না।তিনি কঠিন সুরে বললেন
-“আশরাফ বৌমার হাত ছারো।আমার ঘরের লক্ষীকে এই ভাবে নিয়ে যেতে পারবে না।যে ভাবেই হোক বিয়েটা তো হয়েছে।সেটা তুমি অস্বীকার করতে পারবে না।তাই সে তার স্বামীর বাসায় থাকবে।”
আশরাফ হুসাইন ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন
-“আমার মেয়ে আমি নিয়ে যাবো।দেখি কে আটকায়।”
-“আমি আটকাবো।দেখ এই সব ঝামেলা করে কোনো লাভ হবে না।আমার ছেলে যেহেতু বিয়ে করেছে সেহেতু দৃশ্য এখানেই থাকবে।বৌমা যদি যেতে চাইতো আমি মানা করতাম না।কিন্তু তুমি তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে নিয়ে যাচ্ছো সেটা আমি হতে দিতে পারিনা।”
রাগে আশরাফ হুসেনের কপালের রগ ফুলে উঠেছে।এই মানুষটির সামনে সে কখনোই মাথা নত করবে না।সে জোর করে দৃশ্যকে নিয়ে যেতে চাইলে আমজাদ রহমান তাকে সামনে দাড়িয়ে বাধা দেয়।আশরাফ হুসাইন রেগে হিতাহিত জ্ঞান ভুলে আমজাদ রহমানকে বুকে জোরে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দেয়।
আমজাদ রহমান সোজা যেয়ে পড়ে পাশের ছোট কাচের টেবিলে।সাথে সাথে টেবিলের কাচ ভেঙে বিকট শব্দ হয়।দৃশ্য চিৎকার দিয়ে উঠে।আখি রহমান অস্থির চোখে সে দিকে তাকিয়ে আছে। মাহাদ আর ফাহিম নিজেদের মারামারি ভুলে দাড়িয়ে পড়ে। মাহাদের হাত কাপছে।মুহূর্তের মধ্যেই কি হয়ে গেলো কেউ বুঝতে পারলো না।
আমজাদ রহমানের কপাল বেয়ে রক্ত ঝরে পড়ছে।তিনি উঠে বসতে চাইলেন।কিন্তু বুকের তীব্র ব্যাথায় কিছুতেই উঠতে পারছে না।নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।তিনি জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে লাগলেন। মাহাদ দৌড়ে বাবার কাছে এসে বসলো। মাহিম আর আরিফও দৌড়ে আসলো। মাহাদ জোরে কাদতে লাগলো আর বললো
-“বাবা তুমি ঠিক আছো?কষ্ট হচ্ছে তোমার?এই মাহিম জলদি গাড়ি বের কর।বাবাকে হসপিটালে নিতে হবে।বাবা!বাবা! কথা বলো বাবা?”
আমজাদ রহমান এক পলক ছেলেকে দেখলো।ছেলেটা বাচ্চাদের মতো করছে।ঠিক যেমন ছোট বেলায় করতো।বাবা বলতে পাগল ছেলেটা। মাহিম কি করবে ভেবে পাচ্ছে না।দৌড়ে গেলো গাড়ি বের করতে।কিন্তু আদো গাড়ি চালাতে পারবে কিনা সন্দেহ।
মাহাদের মামা কিছু বুঝতে পেরে আমজাদ রহমানের বুকে ঘসতে লাগলেন।আখি রহমান শাড়ির আঁচল দিয়ে কপালের রক্ত মুছে দিচ্ছেন।দৃশ্য দৌড়ে আমজাদ রহমানের পায়ের কাছে বসে পড়লো।তার দেখা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষটির আজ এই অবস্থা।
মাহাদের মামা প্রচন্ড ক্ষিপ্ত হয়ে আশরাফ হুসাইন এর কলার চেপে ধরে শাসিয়ে বললেন
-“তোমার সাহস কি করে হয় আমজাদ ভাইয়ের গায়ে হাত তোলার?এতো অহংকার?তোমার এই ক্ষমতার বড়াই খুব শীগ্রই শেষ করবো।আজ ভাইজানের কিছু হলে তোমাকে আমি ছাড়বো না।তোমার মেয়েকে যে ভাইজান বাড়ির লক্ষ্মী বলে শিকার করেছে এটাই তোমার সাত কপালের ভাগ্য।নেহাত মাহাদ তোমার মেয়েকে ভালোবাসে বলে।নাহলে আমার ভাইজানের নখের যোগ্যতা তোমার নেই।”
শামসুন্নাহার বেগম প্রচন্ড রেগে বললো
-“জানোয়ারের বাচ্চা তোর কোনোদিন ভালা হইবো না।তোর অহংকার একদিন খোইসা খোইসা পারবো।আমার সোনার টুকরা পোলার গায়ে হাত দিছস।আল্লাহর গজব পড়বো তোর উপরে।তোর মতো জল্লাদের মাইয়া আমি বাড়িতে তুলুম না।বের হয় এক্ষনি।তোর অলক্ষী মাইয়া নিয়া বাইর হো আমার বাইত থাইকা।”
আশরাফ হুসাইন নিজেও বুঝতে পারেননি এমন কিছু হয়ে যাবে।কিন্তু যায় হয়েছে তাতে তার বিন্দু মাত্র আফসোস নেই।তবে এদের কথা শুনে রাগটা আবার বাড়তে লাগলো।এতো অপমান কেউ কোনোদিন করেনি।আজ এই বদমাইশ মেয়ের জন্য কতো কথা শুনতে হচ্ছে।এই মেয়েকে তো আজ সে কেটে টুকরা টুকরা করবে।প্রচন্ড আক্রোশে ফেটে পড়ছে তিনি।দ্রুত দৃশ্যর হাত ধরে টানতে লাগলেন।দৃশ্য চিৎকার করে কাদঁছে।আর বার বার হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করছে।চিৎকার করে কাদতে কাদতে বললো
-“বাবা ছাড়ো আমাকে।আমি কোথাও যাবো না।এতো নিষ্ঠুর হইও না।আংকেল কষ্ট পাচ্ছে।আমাকে তার পাশে থাকতে দাও।বাবা প্লিজ। মাহাদ!মাহাদ! প্লিজ বাবাকে কিছু বলো।আমি কোথাও যাবো না।ভাইয়া প্লিজ বাবাকে বল আমাকে ছেড়ে দিতে।”
মাহাদ বাবার মাথা বুকে নিয়ে চোখের জল ফেলছে।দৃশ্যর চিৎকার শুনে একবার দৃশ্যর দিকে তাকালো।পরক্ষনেই বাবাকে নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পড়ল।
ফাহিম অবাক চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে আছে।তার বাবা এমন একটা কাজ করতে পারবে ভাবতেই পারেনি।সে আর মাহাদ মারামারি করছে মানা যায়।তাদের বয়স কম।রক্ত গরম।কিন্তু তার বাবা এমনটা কি করে করলো?তার মধ্যে কি বিন্দু মাত্র আফসোস কাজ করছে না? এ কোন বাবাকে দেখছে সে।
আশরাফ জোর করে টেনে হিচরে দৃশ্যকে সেখান থেকে নিয়ে আসলো।দৃশ্য ভেজা চোখে মাহাদ আর আমজাদ রহমানকে দেখে যাচ্ছিলো। মাহাদরাও দ্রুত হসপিটালের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো তখন।
বাড়িতে পৌঁছে মেয়েকে ফ্লোরে ছুড়ে ফেললেন আশরাফ।দৃশ্য তখন কনুইতে অনেক বেথা পেলো।আনিকা কবির চিৎকার দিয়ে দৃশ্যকে জড়িয়ে ধরলেন।আশরাফ হোসাইন পায়ের জুতা খুলে দৃশ্যকে মারতে লাগলো।আনিকা কবির কেদে বললেন
-“আমার মেয়েকে আবার কেনো মারছেন?”
-“তোর কুলাঙ্গার মেয়ে কি করেছে জানিস?সে পালিয়ে ওই ছেলেকে বিয়ে করেছে।তুই না বলতি তোর মেয়ে ছোট বাচ্চা।তাইলে এতো কিছু কেমন করে করলো? আজ ওর বিয়ে করার সখ জন্মের মতো ঘুচিয়ে দিবো।”
ফাহিম দৌড়ে বাসায় আসতেই দেখলো বাবা দৃশ্যকে জুতা দিয়ে অনবরত মেরে যাচ্ছে।কয়েকটা বারি মায়ের গায়েও পড়ছে।সে দ্রুত দৌড়ে এসে বাবাকে থামালো আর বললো
-“বাবা প্লিজ থামুন।পাগল হয়ে গেছেন?এই ভাবে মারলে তো ও মরেই যাবে।কি করছেন এইসব।সরুন!”
ফাহিম ঠেলে বাবাকে সরিয়ে দৃশ্যর দিকে তাকালো।দৃশ্য ততক্ষণে অচেতন হয়ে ফ্লোরে পড়ে গেছে।তার দুই গাল টকটকে লাল হয়ে গেছে।হাতের কোথাও কোথাও দাগ হয়ে রক্ত জমাট বেধে গেছে।সে দৃশ্যর কাধ ঝাকিয়ে ডাকতে লাগলো।
-“দৃশ্য!দৃশ্য চোখ খোল। পাখি আমার কি হলো তোর?”
আনিকা কবির কেঁদে কেঁদে বললেন
-“মনে হয় সেন্সলেস হয়ে গেছে। ওকে দ্রুত রুমে নিয়ে চল।”
ফাহিম দ্রুত দৃশ্যকে কোলে তুলে রুমে নিয়ে গেলো।
মাহাদ হসপিটালের করিডোরে বসে আছে।চোখ যেনো আজ কোনো বাধা মানছে না।মাহিম অস্থির হয়ে পায়চারি করছে।আখি রহমান চেয়ারে বসে কান্নায় ভেঙে পড়েছে।আর আরিফ সবাইকে পর্যবেক্ষণ করছে।বিষয়টা এমন জটিল হবে সে ভাবতেই পারেনি।তাহলে হয়তো আর এমনটা করতো না।আশরাফ যে এমন একটা কাজ করে বসবে সে ভাবতেই পারেনি।
মাহাদ কিছুই ভাবতে পারছে না। আজ বাবার কিছু হয়ে গেলে নিজেকে কিছুতেই ক্ষমা করতে পারবে না।কিছুক্ষণ পর ডক্টর বেরিয়ে এসে জানালেন আমজাদ রহমান স্ট্রোক করেছেন।মেন্টাল প্রেসার আর বুকে প্রচন্ড চাপ পড়ায় এমনটা হয়েছে।আর তাছাড়া তার বুকে হয়তো আগে থেকেই ব্যাথা ছিলো।যেটা তিনি হয়তো গুরুত্ব দেয়নি। অবস্থা খুব একটা ভালো না।তারা কিছু সময় অবজারভেশনে রাখবেন।
কথাটা শুনে মাহাদের পরিবারে যেনো শোকের ছায়া নেমে গেলো। মাহাদ সেখানেই স্থির হয়ে গেলো।বাবা যে তার সবচাইতে ভালো বন্ধু।যার কাছে সে নিজের মনের কথা নির্দ্বিধায় বলে দেয়।এই মানুষটার কিছু হলে সে নিঃশেষে হয়ে যাবে।আরিফ মাহাদের কাধে হাত রাখতেই মাহাদ তার চাচু কে জড়িয়ে ধরলো।কাধে মুখ লুকিয়ে ফুপাতে লাগলো।বুকটা তার ফেটে যাচ্ছে।পরিস্থিতি এতটাই বেগতিক যে সে কিছুই সামলে উঠতে পারছে না।
তার ঠিক দুই দিন পর তাদের জীবনে সবচাইতে বড় ঝড় আসে।প্রথম দিকে আমজাদ রহমান কিছুটা ভালো থাকেও পরে তার শরীর বেশি খারাপ হতে থাকে।দৃশ্য বাসা থেকে লুকিয়ে একবার হসপিটালে আসলেও শামসুন্নাহার বেগম তাকে আমজাদ রহমানের সাথে দেখা করতে দেয়নি।দৃশ্য অনেক বার মিনতি করেও শশুরের সাথে দেখা করতে পারেনি।বরং অনেক বকা ঝকা করে বের করে দিয়েছেন।তাদের মনের অবস্থা চিন্তা করে দৃশ্য আর জেদ করেনি।কিন্তু দৃশ্যর কিশোরী মন একটাবার নিজের স্বামী দেখা পেতে চেয়েছিল।মানুষটা ঠিক আছেতো?কিন্তু মাহাদের দেখা পায়নি।সে আমজাদ রহমানের কাছে কেবিনে ছিলো।বাচ্চা মেয়েটা সেদিন কাদতে কাদতে বাসায় ফিরেছিল।
পুরো বিষয়টি নিয়ে ফাহিমের মধ্যে খারাপ লাগা কাজ করছিল। মাহাদকে সে পছন্দ না করলো কেনো যেনো আমজাদ রহমানের প্রতি তার একটা শ্রদ্ধাবোধ কাজ করতো।এই মানুষটার সম্পর্কে সে একমাত্র তার বাবা ছাড়া আর কারো কাছে কোনো খারাপ কথা শুনেনি।বরং প্রশংসাই শুনেছে।সে নিজেও রাজনীতিতে যুক্ত।একজন আদর্শ নেতার মধ্যে ঠিক যেমন গুন থাকে আমজাদ রহমানের মধ্যে সবই আছে।কিন্তু নিজের ফুপির বিষয়টা জানার পর ওই পরিবারের প্রতি একটা অদৃশ্য রাগ রয়ে গেছিলো।যা সময়ের সাথে সাথে বাড়তে থাকে।আর প্রায় সময় মাহাদের সাথে তার ঝামেলা বেধে যেতো।যার ফলে সে আরো ওই পরিবারকে ঘৃণা করতে থাকে।কিন্তু আজ এতো কিছুর পর একটা অদৃশ্য অপরাধ বোধ কাজ করছে।তাই সে লুকিয়ে একবার হসপিটালে যায় আমজাদ রহমানকে দেখতে।
তার পরদিন আমজাদ রহমান পৃথিবীর মায়া তেগ করেন।কথাটা শোনা মাত্র আখি রহমান অচেতন হয়ে ফ্লোরে পড়ে যান।মানুটিকে তিনি ভীষণ ভালোবাসে।আর মানুষটাও তাকে সবসময় আদর,যত্ন আর সম্মান করতো।বন্ধু মহলে সবাই তাকে বউ পাগলা উপাধিও দিয়েছে।আজ সে পাশে নেই সেটা যেনো ভাবতেই পারছেন না।
মাহিম বাবাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাদতে থাকে।তার মামা জোর করে তাকে সেখান থেকে নিয়ে যায়। মাহাদ কয়েক মুহূর্তের জন্য স্থির হয়ে যায়।তার কান এই কথাটা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারেনি।সে বাবার লাশের পাশে বসে মাথাটা কোলে তুলে নেয়।অজস্র চুমুতে ভরিয়ে তুলে বাবার মুখে।ছোট বেলাতেও নাকি সে এই কাজ করতো।বাবার পুরো মুখে লালায় ভরিয়ে চুমু খেতো।আর বলতো
-“আমাল বাবা বেস্ট। আমাল বাবা বেস্ট।”
আর আমজাদ রহমান হেসে বলতেন
-“উঁহু!আমার রাজপুত্র বেস্ট।”
কথাটা মনে পড়তেই মাহাদের বুকটা ধক করে উঠলো।সে বাবাকে ঝাকিয়ে বলতে লাগলো
-“বাবা উঠো প্লিজ।চোখ খোল।এই দেখো আমি কান ধরছি।আর কোনো দিন তোমার কথার অবাধ্য হবো না।চোখ খোল বাবা।আমার উপর অভিমান করে এমন করছো তাই না?উঠনা বাবা।তুমি না বলেছিলে আমার প্রথম গানের অ্যালবামের গানে তুমি ডান্স করবে? আর সবচাইতে রোমান্টিক সঙ্গে মায়ের সাথে কাপল ডান্স করবে?আমি কিন্তু মাকে বলিনি আমার প্রথম অ্যালবামের কথা।তুমি বলেছিলে যেদিন বের হবে সেদিন মাকে সারপ্রাইজ দিবে?তাহলে এমন করছো কেনো?আমাকে রকস্টার হতে দেখতে চেয়ে ছিলে না? তাহলে এতো জলদি কেনো চলে যাচ্ছো?”
আরিফ পাশে দাড়িয়ে কাদঁছে আর মাহাদের পাগলামি দেখছে।নিজেকে ভীষণ অপরাধী লাগছে।হয়তো তার ডিসিশন ভুল ছিলো।যার কারণে তার ভাই আজ চলে গেলো।শামসুন্নাহার বেগম ফ্লোরে বসে কখনো বুক চাপড়াচ্ছেন তো কখনো মাথা চাপড়াচ্ছেন। কাদতে কাদতে বির বির করছেন
-“আব্বা।আমার আব্বা কই গেলা?মায়ের বুক খালি কইরা কই গেলা আব্বা।আমারেও নিয়ে যাও আব্বা।এই নিষ্ঠুর দুনিয়ায় আমারে ফালায়া কই গেলা আব্বা?”
মাহাদ বাবাকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাদতে লাগলো। এ যেনো এক হৃদয় বিদারক কান্না।তার আর্তনাদে পুরো হসপিটাল গরম হয়ে উঠলো।আসে পাশে মানুষ জন তাকে দেখে চোখের পানি ধরে রাখতে পারছে না।এক সুদর্শন যুবক তার বাবাকে কোলে নিয়ে বাচ্চাদের মতো কাদছে। এর চাইতে মর্মান্তিক দৃশ্য আর কি হতে পারে?
মাহাদ চিৎকার করে বলছে
-“বাবা আমাকে ছেড়ে যেও না।আমি একা হয়ে যাবো।তোমাকে ছাড়া আমি কি করে থাকবো?মায়ের বকুনি থেকে আমাকে কে বাঁচাবে?আমাকে কে বড়ো রাজপুত্র বলে ডাকবে?আর মাহিম?ও কে না ডক্টর হতে দেখতে চেয়েছো? আরতো মাত্র কয়েকদিন।তার পরই তোমার ছোটো রাজপুত্র ডক্টর হয়ে যাবে।তুমি বলেছিলে তার প্রথম পেশেন্ট হবে তুমি।তাহলে এক্ষনি কেনো চলে যাচ্ছো?তুমি চলে গেলে বাবা বলবো কাকে?আমাকে এতিম করে যেওনা বাবা।মাকে কি জবাব দিব আমি?সব আমার জন্য হয়েছে।আমার জন্য হয়েছে।সব আমার দোষ।”
এই বলে মাহাদ পাগলামি করতে লাগলো।পাশের টেবিল থেকে একটা ছুরি দিয়ে হতে হাতে একটা আঁচড় কাটলো।সাথে সাথে চুয়ে চুয়ে রক্ত পড়তে লাগলো।আঘাতটা তেমন একটা গভীর না হওয়াতে সে আবার আঘাত করতে যাবে তখনই আরিফ আর তার ছোট মামা আটকায়। মাহাদ নিজেকে আঘাত করার জন্য পাগলামি শুরু করে।আর বলতে থাকে
-“চাচু ছাড়ো আমাকে।আমার জন্য বাবা চলে গেছে।আমার সাথে অভিমান করে বাবা চলে গেছে।আমি খুব কষ্ট দিয়েছি বাবাকে।আমার জন্য বাবা এতো অপমানিত হয়েছে।আমি শেষ করে ফেলবো নিজেকে।”
আরিফ মাহাদের মাথা বুকে চেপে ধরে।আর মাথায় হাত বুলিয়ে বলতে থাকে
-“শান্ত হো মাহাদ।এমন পাগলামি করিস না।তোর কিছু হলে তোর মায়ের কি হবে ভেবেছিস?তোর ভাইয়ের কি হবে?তাদের যে তোকেই সামলাতে হবে।আর ভাইয়া তোর উপর কোনো অভিমান করেনি।সে সব সময় তোদের সুখে দেখতে চেয়েছে।এমন করলে ভাইয়া কষ্ট পাবে। এখন তোকে শক্ত হতে হবে।বাবার সব স্বপ্ন পূরণ করতে হবে।এমন পাগলামি করিস না।”
মাহাদ চাচু কে জড়িয়ে ধরে কাদতে লাগলো।আরিফ কিছুতেই ভেবে পাচ্ছেনা এই ধাক্কাটা মাহাদ কি করে সামলাবে। এই ঝড় যে মাহাদ আর দৃশ্যর জীবনে জলোচ্ছাস নিয়ে আসবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।