#ইচ্ছের_উল্টোপিঠ
#পর্ব_১৮,১৯
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
১৮
নৌকো জুড়ে পিনপতন নিরবতা। মাঝেমধ্যে নদীর পানির তীব্র গর্জন কানে আসছে। ঐশী একপাশে বসে আছে। পূর্বের অস্বস্থি এখন অনেকটাই কমে এসেছে। নদীর এই রূপায়ণ দেখে কখনো কি মন খারাপ করে থাকা যায়?
জুভান ফোন হাতে নিয়ে পাশে বসে থাকা তীর্থকে মেসেজ করলো। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে মেসেজ সেন্ড হলো না। বারবার নেটওয়ার্ক সমস্যা দেখাচ্ছে। জোরে কথা বলাও যাবে না। ঐশী আছে। তাই শেষ পর্যন্ত জুভান হাল ছেড়ে দিয়ে নোটপ্যাড টাইপ করলো,
” কি ব্যাপার ব্রো , ওই মেয়েকে অনেক কেয়ার করছো ? সামথিং ইজ ফিশি, ফিশি । ”
তীর্থ ফোনে গান শুনছিল। জুভান তীর্থর হাতে কনুই দিয়ে ধাক্কা দিলো। তীর্থ চেতে উঠলো। কান থেকে হেডফোন খুলে জুভানের দিকে তাকিয়ে বললো,
” আরে। মাইয়াদের মতন গুতাস কিয়ের ল্যায়? ”
জুভান শুনে দু ভ্রুয়ের মাঝে ভাজ ফেলে তীর্থর দিকে তাকালো। তীর্থ নিভে এলো। মুখখানা নিষ্পাপ করে বললো,
” ভাই আমার। বল কি বলবি। তোর সব কথা শুনতে এই বান্দা সর্বদা হাজির। ”
জুভান নোটপ্যাডে লেখা তীর্থর চোখের সামনে মেলে ধরলো। তীর্থ লেখাটা পড়ে ভ্রু কুচকে তাকালো। জুভানের চোখে প্রশ্নবোধক দৃষ্টি। তীর্থ মৃদু হেসে চোখ বন্ধ করে লম্বা নিশ্বাস নিল। তারপর জুভানের দিকে তাকিয়ে বুকের বা পাশে হাত দিয়ে ইশারা করে বললো,
” শি স্টোল মাই হার্ট , ম্যান। ”
জুভান খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে তাকালো। সে জানতো এমনই হবে। জুভান আবারও নোটপ্যাডে লিখলো,
” ডাফার ,মেয়েটা মুসলিম। তুই হিন্দু। কিভাবে কি ? ”
তীর্থ লেখা দেখে নিজের ফোনের নোটপ্যাডে লিখলো,
” ইটস লাভ , ব্রো। লাভ। ”
জুভান তীক্ষ্ম চোখে ফোনে লিখলো,
” ইটস বুলশিট , ব্রো। বুলশিট। ”
তীর্থ অসহায় চোখে চেয়ে রইলো জুভানের ফোনের নোটপ্যাডের দিকে।
সাঙ্গু নদীর কিছুটা দূরে এসেছে নৌকা। এবার নদীটা ঢালু হয়ে এসেছে । ঐশী ঢোক গিলে তাকালো ঢালু হয়ে নেমে আসা নদীর স্রোতের দিকে। নৌকা ঢালু বেয়ে উঠতেই ঐশী জোরে বলে উঠলো,
” সাবধানে। ”
ঐশীর চিৎকার শুনে নৌকার বাকি সদস্য ওর দিকে বিরক্তি চোখে তাকালো। মাঝি হেসে বললো,
” ভয় পাওয়ার কিছু নাই। এই নদী এমনই। জীবনের মত এই নদীরও অনেক চড়াই-উৎরাই আছে। ”
ঐশী তাকালো মাঝির দিকে। মুখে স্মিত হাসি নিয়েই নৌকা চালিয়ে যাচ্ছে। যেনো একজীবনে এই মানুষের মত সুখী দ্বিতীয় কেউ নেই। এত সুখ ! ঐশী চেয়ে রইলো ওই ফোকলা দাঁতের হাসির পানে। এক টুকরো খুশি উপচে পড়া হাসি।
নৌকা ঢালু বেয়ে উঠছে। আর ঐশী নিজের জামা খামচে বসে আছে নিজের জায়গায়। জুভান ব্যাপারটা লক্ষ করলো। ঐশীকে স্বাভাবিক করতে এগিয়ে যেতেই তীর্থ উঠে গিয়ে বসলো ঐশীর পাশে। জুভান থমকালো। তীর্থর এসব যত্ন আত্তি সে আর নিতে পারছে না। কিন্তু , কিন্তু কেনো পারছে না ? খুব স্বাভাবিক ব্যাপারকে সে কেনো অস্বাভাবিক ভাবে নিচ্ছে ? জুভান আপনমনে প্রশ্ন করে উত্তরের ঘটে এক আকাশ শূন্যতা পেলো।
তীর্থ ঐশীর পাশে বসলো। ঐশী তীর্থর দিকে তাকিয়ে বললো,
” খুব ঢালু , তাইনা ? ”
তীর্থ দুপাশের পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
” একদমই না। বরং খুব মোহময়। ”
ঐশী প্রশ্নবোধক চোখে তাকালো। তীর্থ পাহাড়গুলোর দিকে তাকিয়ে বললো,
” সব ভয় কাটিয়ে দাও। মন খুলে শুধু এই জায়গাটাতে মত্ত হও। দেখবে সব ভুলে গেছো। কোথায় আছো, কেমন আছো , কি করছো সব ভুলে যাবে এক পলকে। একবার শুধু দুর দৃষ্টি দাও। খুব দূরে তাকাও। দৃষ্টি সীমার বাইরে। ”
ঐশী কোনো প্রত্যুত্তর না করে সামনে তাকালো। সঙ্গেসঙ্গে মুগ্ধতা ওর দুচোখে ভর করলো। নদীর পাশে জুড়ে শুধু পাহাড় আর পাহাড়। যেনো এক গুচ্ছ সবুজ রঙ শিল্পী ক্যানভাসে আকা। ঐশী হাত বাড়িয়ে ছুতে চাইলো। তবে ছুতে পারলো না। কিন্তু অনুভব করলো অসম্ভব প্রাণ জড়ানো মুগ্ধতা। তীর্থ পাশ থেকে বললো,
” ভালো লাগছে ? ”
মুগ্ধ ঐশী জবাব দিল,
” উফ ! এত সুন্দর ! আমি এসব দেখে ভালো লাগায় মারা যাচ্ছি। ”
তীর্থ হাসলো। ঐশী আবারও বললো,
” মনে হচ্ছে , মনে হচ্ছে এগুলো পাহাড় না। মেঘে ভাসমান সবুজ তুলো। দেখুন, দেখুন পাহাড় গুলো মেঘ ছুঁয়েছে। দেখতে পারছেন ? ”
” পাহাড়গুলো মেঘ ছুঁয়নি। বরং মেঘের নিচে থাকায় দুর থেকে মনে হচ্ছে এগুলো মেঘের সাথে মিশে গেছে। ”
ঐশী চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে রইল। পলক ফেলতে ভুলে গেছে ও। মনে হচ্ছে একটা পলক ফেললে এক ন্যানো সেকেন্ডের জন্য এই অপরূপ সৌন্দর্য মিস করবে। কিন্তু ঐশী দেখতে চায়। প্রাণ ভরে মিশতে চায় প্রকৃতির এই রূপের ছন্দে। তীর্থ বললো,
” দু চোখ বুজে নাও ঐশী। আরো ভালো লাগবে। ”
সঙ্গেসঙ্গে ঐশী চোখ বুজে নিয়ে লম্বা নিঃশ্বাস নিল। ইস! বাতাসটা ওর নাকে ঢুকে গলার কাছে ঠান্ডা পরশ দিতে লাগলো। পেটের মধ্যে গুড়গুড় করছে। এত ভালো লাগছে কেনো ওর ?
জুভান ঐশীর কাজকর্ম দেখে ওঠে এলো। ঐশীর পাশে বসে বললো,
” এখন যদি একটা জ্যাক থাকতো তোমার পাশে , তাহলে , দা গ্রেট টাইটানিক সিন হয়ে যেত। ব্যাপারটা দারুন না ? ”
জুভান যে ঐশীকে ব্যঙ্গাত্মক গলায় বললো তা দিশেহারা ঐশী বুঝতে না পারলেও তীর্থ বুঝলো। ঐশী মাঝপিঠে বলে উঠলো,
” দরকার নেই কোনো জ্যাক মানবের । আমি একাই দুশো ।”
জুভান শুধু ঐশীর প্রাণ খোলা হাসি দেখলো। এই মেয়েটাকে এত সুখী কখনোই দেখেনি ও। এই জায়গায় এত সুন্দর সুন্দর দৃশ্য দেখে সে আর নিজের মাঝে নেই। যদি তীর্থর সামান্য মেহনতের ফলে মেয়েটার মুখে হাসি ফুটে তবে তাই ভালো। তাহলে জুভান কেনো ভিতরে ভিতরে পুড়ছে?
জুভানের ঐশীকে হাসতে দেখে মনের ভিতরে সুখ সুখ লাগে। মনে হয় মেয়েটার মুখে হাসিটা কি অমায়িক ! একদম কৃত্রিমতা নেই ওতে। কিন্তু কেনো মনে হলো এমন ? উত্তর কই?
_____________________
জায়গাটা রেমাক্রী। নৌকা এসে ঠেকেছে তীরে। ঐশী’রা নেমে দাড়িয়েছে।
জুভান আগে আগে হাঁটছে। পিছন পিছন ঐশী আর তীর্থ আসছে। ঐশী হঠাৎ জিজ্ঞেস করলো,
” ওই যে ঘর দেখা যাচ্ছে , ওগুলো কি ? ”
তীর্থ হাঁটতে হাঁটতে বললো,
” ওগুলো কে মারমা ভাষায় ‘ খুম ‘ বলে। উপজাতিরা থাকে ওখানে। ”
” ‘ খুম ‘ মানে কি ? ”
” জলপ্রপাত। ”
” ওহ। ভালো লাগছে দেখতে। ”
” তুমি জানো আমরা এখন কোথায় যাচ্ছি ? ”
ঐশী নিরুত্তর তাকালো তীর্থর দিকে। তীর্থ জিন্সের পকেটে হাত গুজে বললো,
” নাও , আমরা ” নাফাখুম ” জলপ্রপাত দেখতে যাচ্ছি। ”
” ওয়াও। জলপ্রপাত ? নায়াগ্রার মত ? ”
” না। নায়াগ্রার মতন না। নায়াগ্রা ত খুব বড়। নাফাখুম একটু ছোট সেটা থেকে। ”
” খুব মজা হবে। তাইনা ? ”
” হুম। তাতো অবশ্যই। ”
ঐশী খুশির চোটে আগে আগে হাঁটছে। মনে তর সইছে না। হাঁটতে হবে অনেকখানি। ইশ ! যদি আরো একটু আগে পৌঁছানো যেতো?
ঐশী জুভানের পাশে পাশে পা চালাচ্ছে। জুভান ভিডিও করতে করতে বললো,
” তাহ। তীর্থর সাথে থাকতে খুব ভালোই লাগছে, মিস ঐশী ? ”
জুভানের কথা শুনে ঐশীর উত্তেজনায় ভাটা পড়লো। ভ্রু কুঁচকে জুভানের দিকে তাকিয়ে বললো,
” মানে ? ”
” আমি তো বাংলায় বললাম। বোঝোনি কেনো ? ”
” তীর্থ একজন ভালো মানুষ। অচেনা জায়গা এত সুন্দর করে বিশ্লেষন করছিলেন। তাই আমিও উনার সাথে কথা বলেছি। বাট , আপনি এই কথা বললেন কেনো ? বুঝলাম না আমি। ”
জুভান মাথা নেড়ে প্রশ্নটা এড়িয়ে গেলো। ঐশী শুধু চেয়ে রইলো জুভানের দিকে। তবে লোকটার কথার রহস্য ভেদ করতে পারলো না।
তীর্থ এগিয়ে আসলো জুভানের কাছে। একটু হয়রান হয়ে বললো,
” কিছু খাবি না ? সকাল থেকে পেটে কিছু পড়েনি। এখানে অনেক হোটেল আছে। যাবি ? ”
জুভান মাথা নেড়ে সম্মতি দিলো।
খাওয়া দাওয়া শেষ করে ওরা পা বাড়ালো ” নাফাখুম ” জলপ্রপাতের পথে। তিন ঘণ্টা হেঁটে পৌঁছতে হবে সেখানে।
যেতে যেতে ঐশী মাঝপথে থমকে গেলো। ঐশীকে থামতে দেখে ওরা দুজনও থেমে গেলো। ঐশীর কাছে এসে জুভান বললো,
” হোয়াট ? থেমে গেলো কেনো ? দেরি হয়ে যাচ্ছে। ”
ঐশী পা ধরে নাক মুখ কুচকে বললো,
” পায়ে ব্যাথা করছে খুব। ”
জুভান থমথমে গলায় বললো,
” হাঁটলে তো ব্যাথা করবেই। এখন সহ্য করে উঠে দাড়াও। আর আধা ঘণ্টার পথ। ”
ঐশী এবার কান্না পাচ্ছে। কান্না আটকে বললো,
” আমি সত্যি বলছি। খুব ব্যাথা করছে পায়ে। ”
এমনিতেই তীর্থর ঐশীর প্রতি এসব আদিক্ষেতা দেখে জুভান বিরক্ত। তাই ঐশীর উপর সব ঝাঝ ঢালতে জুভান আরো দু এক কথা শুনাতে যাবে তখনই ঐশীর মুখের দিকে চেয়ে থেমে গেলো। ঐশীর পায়ের কাছে হাঁটু গেরে বসে বললো,
” কোথায় ব্যাথা করছে। দেখাও তো। ”
ঐশী পায়ের এক অংশ দেখিয়ে দিলো। জুভান পায়ে হাত দিতে গেলে ঐশী ঝটকে পা সরিয়ে নিলো। ব্যস্থতা দেখিয়ে বললো,
” পায়ে হাত দিবেন না। ”
জুভান উত্তর করলো না। বরং জোরপূর্বক ঐশীর পা নিজের কাছে টেনে দিল এক মোচড়। ঐশী ব্যাথায় আর্তনাদ করে উঠলো। পায়ে হাত দিয়ে নাক মুখ কুচকে বললো,
” আপনি খুব খারাপ। খুব খারাপ আপনি। ”
জুভান উঠে দাড়ালো। বাঁকা হেসে বললো,
” আমি জানি আমি মানুষটা ভালো নই। এত ঘটা করে বলতে হবে না। ”
ঐশী হঠাৎ উজ্জ্বল চোখে তাকালো জুভানের দিকে। একটু আগে ব্যাথায় টনটন করা পা এখন ঝরঝরে। একটুও ব্যাথা নেই। ঐশী অবাক হলো। ব্যাথা ভ্যানিশ হলো কি করে ?
#চলবে…
#ইচ্ছের_উল্টোপিঠ
#পর্ব_১৯
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
শেষ পর্যন্ত ঐশী , জুভান আর তীর্থ এসে পৌঁছাল নাফাখুম জলপ্রপাতের কাছে। চোখের সামনে পাথরের গা বেয়ে বয়ে যাওয়া অবিরাম জলধারা দেখে সবাই আপ্লুত হয়ে আছে। ঐশী মুখে হাত চেপে এক জায়গায় থম মেরে দাড়িয়ে আছে। কথা ফুটছে না ওর মুখে। চোখের রাজ্যের বিস্ময়। জুভান একবার তীর্থর দিলে তাকালো। তারপর দুজনে একসাথে দৌড়ে এগিয়ে গেলো জলপ্রপাতের খুব কাছে। একদম কাছে। ঐশী মুখে হাত চেপে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলো ওদের কাছে। জুভান পাথরের উপর হেঁটে হেঁটে এগিয়ে গেল জলের কাছে। হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখলো স্বচ্ছ জল। তারপর ফোন বের করে ভিডিও করলো। তীর্থ ঐশীকে একপাশে দাড়িয়ে থাকতে দেখে বললো,
” যাবে পানির কাছে? ”
ঐশী সঙ্গেসঙ্গে বললো,
” হ্যা। যাবো ,যাবো। ”
তীর্থ ঐশীকে নিয়ে গেলো পাথরের কাছে। কিন্তু ঐশী পাথর ডিঙিয়ে পানির কাছে যেতে ভয় পাচ্ছে। তীর্থ ততক্ষণে চলে গেছে পানির কাছে। কিন্তু ঐশীকে প্রান্তে দাড়িয়ে থাকতে দেখে আবারও পাথর ডিঙিয়ে ঐশীর কাছে এলো। হাত বাড়িয়ে বললো,
” আসো। ”
ঐশী তীর্থর বাড়ানো হাতের দিকে তাকিয়ে কিছুটা ইতস্তত বোধ করলো। তীর্থর হাত এভাবে ছুবে ব্যাপারটা কিছুটা অস্বস্তিকর। তীর্থ ঐশীকে চুপচাপ দাড়িয়ে থাকতে দেখে হাত আর একটু এগিয়ে বললো,
” কি হলো আসো। ভয় নেই। আমি আছি। আসো। ”
ঐশী কিছুটা ভেবে মৃদু হেসে বললো,
” বাকি জীবনটাতো একা একা পার করতে হবে। তাই এখন থেকেই ট্রাই করা উচিৎ। ”
তীর্থ হাত গুটিয়ে নিল। ঐশী খুব সন্তর্পনে পাথর ডিঙিয়ে পানির কাছে এলো।
পানি দেখে কারো যেনো হুশ নেই। এই পানি ত আর যেই সেই পানি নয়। পাহাড় থেকে বেয়ে আসা জলপ্রপাত।ওরা নিজেকে সামলাতে না পেরে পানি নিয়ে খুব খেললো। শেষ পর্যন্ত ওরা আবারও নিজেদের হোটেলে ফিরে এলো। আজ সারাদিন অনেক ধকল গেছে। তাই জুভান আর ঐশী নিজেদের রুমে এসে বেডে শটান হয়ে শুয়ে পড়ল।
_________________
সকালে জুভানের শুট আছে। ঐশী ঘুম থেকে উঠে রেডি হয়ে জুভানের ফোনে কল দিলো। কয়েকবার রিং হওয়ার পর জুভান বেডে হাতড়ে খুঁজে ফোন রিসিভ করে কানে লাগালো। ঘুমঘুম কণ্ঠে বললো,
” হ্যালো … ”
জুভানের ঘুমঘুম কণ্ঠ শুনে ঐশী অনুভূতির বেড়াজালে বন্দী হয়ে চোখ বুজে লম্বা নিঃশ্বাস নিল। নিজেকে সামলে মিহি সুরে বলল,
” স্যার , আপনার শুট আছে দশটার দিকে। নাও ইটস নাইন ফরটিন। ”
জুভানের ঘুম এখনো কাটেনি। ঐশীর কথা কানেই যায়নি ওর। ফোন কানে নিয়েই আবারও চোখ বুজলো। ওপাশ থেকে জুভানের কোনো জবাব না পেয়ে ঐশী জোরালো ভাবে বললো,
” স্যার , স্যার।আপনি জেগে আছেন ? ”
জুভান জেগে উঠে বললো,
” হুম। উঠছি। তুমি রিসেপশনে ওয়েট করো। আই অ্যাম কামিং। ”
ঐশী কিছু বলার আগেই জুভান ফোন কেটে দিলো। ঐশী ফোন কান থেকে নামিয়ে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে এক নিঃশ্বাস নিলো। অতঃপর টেবিল থেকে ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে।
_______________________
শুটিং স্পটে খা খা রোদ্দুর। সেই রোদ্দুরে অতিষ্ঠ হয়ে উঠছে জনমানব। ঐশী একপাশে স্ক্রিপ্ট নিয়ে দাড়িয়ে আছে আর জুভান শট দিচ্ছে।
একসময় ডিরেক্টর তার সহকারী কর্মচারীকে ডেকে বিরক্ত গলায় বললো,
” জুভানের সাইড মডেল হিসেবে যাকে সিলেক্ট করা হয়েছিল সে মেয়ে কই ? আসেনি এখনো ? ”
সহকারী কর্মচারী ফটাফট উত্তর দিলো,
” না, স্যার। উনি জ্যামে আটকে আছেন। ”
ডিরেক্টর ভ্রু কুচকে বললো,
” তুমি কিভাবে জানো ? তুমি দেখেছো ওকে ? ”
কর্মচারী আমতা আমতা করে বললো,
” আসলে স্যার। ফোন দিয়েছিলাম উনাকে। ”
” শাট আপ। ফোন দিয়েছিলেন উনি ! রাবিশ। ওই মডেলকে আমার সিলেক্ট করাই উচিত হয়নি। সবসময় লেট করার রেকর্ড আছে ওর। এখন অলটারনেটিভ খুঁজো। গো। ”
বলেই ডিরেক্টর শুট চেক করা শুরু করলেন। পাশ থেকে কর্মচারী থম মেরে দাড়িয়ে রইলেন। মহা ফ্যাসাদে পড়েছে। এখন হুট করে মডেলের অলটারনেটিভ কোথা থেকে পাবে?
কর্মচারী আমতা আমতা করে বললো,
” স্যার, এখন হুট করে অলটারনেটিভ কোথায় পাবো ? আমরা কি আরও কিছুক্ষণ ওয়েট করতে পারিনা ? ”
ডিরেক্টর ভ্রু কুচকে তাকালেন তার দিকে। জুভান পাশ থেকে ওদের কথোপকথনে অধৈর্য্য হয়ে চেয়ার থেকে উঠে দাড়ালো। মুঠোফোন পকেটে পুড়তে পুড়তে বললো,
” আজকের শুট ক্যান্সেল করে দাও। আমার ওতো টাইম নেই ওই মডেলের জন্যে অপেক্ষা করার। ”
এই বলে জুভান চলে যেতে নিলে ডিরেক্টর পিছন থেকে ডাক দেন,
” আরে , জুভান।”
জুভান কপালে ভাঁজ ফেলে ফিরে তাকালে ডিরেক্টর বললেন,
” একটু দাড়াও। আমরা একটা উপায় খুঁজে বের করছি। জাস্ট ফাইভ মিনিটস। ”
জুভান একটা হাফ ছেড়ে দিয়ে আবারও চেয়ারে বসলো। ডিরেক্টর হলেন দিশেহারা। জুভান এখন চলে গেলে তো মহা মুশকিল হয়ে পড়বে। একবার আজকের শিডিউল মিস হয়ে গেলে জুভান আর কক্ষণো সেই সিন শুট করবে না। যা
ঘাড়ত্যারা। খুব ভালো করে চিনেন উনি জুভানকে।
হঠাৎ ডিরেক্টরের চোখ গেলো ঐশীর দিকে। বারবার হাত ঘড়ি দেখে বিরক্ত হয়ে সামনে তাকাচ্ছে। ঐশীকে দেখে ডিরেক্টরের ঠোঁটে হাসি ফুটলো। তিনি নিজে ঐশীর পাশে এসে দাড়ালেন। ঐশী উনাকে দেখে একটু অবাক হলেও মুখে স্মিত হাসি টেনে বললো,
” কোনো দরকার স্যার ? ”
ডিরেক্টর হেসে বললেন,
” একটা রিকোয়েস্ট আছে। মানবে ? ”
ঐশী প্রশ্নবোধক চোখে তাকালে উনি বললেন,
” আজকের সিনের সাইড মডেল হবে ? ”
ঐশী যেনো চমকে উঠলো। মডেল আর ও ! ঐশী মাথা নেড়ে বললো,
” অসম্ভব স্যার। আমি মডেলিং পারিনা। ”
” এটা জাস্ট একটা ছোট সিন। ভেরি সিম্পল। ইউ ক্যান ডু ইট , গার্ল। ভরসা রাখো নিজের উপর। ”
শেষ পর্যন্ত ডিরেক্টরের পীড়াপীড়িতে ঐশী রাজি হলো।
________________________
জুভান চেয়ারে বসে ফোন স্ক্রল করছে। চোখে মুখে বিরক্তি ফুটে আছে। কপালে সূক্ষ্ম তিনটে ভাজ। চুলগুলো উড়ে কপালে লেপ্টে আছে। শার্টের সামনের দুটো বোতাম খোলা। আর এসব একদৃষ্টিতে পরখ করে যাচ্ছে একজন মেকাপ আর্টিস্ট। জুভানের একজন বড় ফ্যান বলা যায়। কিন্তু এত সামনে থেকে দেখেও কখনো একটা কথা বলতে পারেনি জুভানের সাথে। কথা শুরু করলেই জুভানের তীক্ষ্ম চোখের তাকানো ওর সব কথা উলোটপালোট করে দেয়।
প্রায় আধ ঘন্টা পর ঐশী মেকাপ রুম থেকে বেরিয়ে আসে। পড়নে একটা সবুজ রঙের হলুদ পারের শাড়ি। ঐশী শাড়ীর কুচি সামলাতে সামলাতে রুম থেকে বেরোচ্ছে। আর ঠিক তখনই জুভানের চোখ পড়ে ঐশীর দিকে। জুভান থমকে যায়। নিস্তেজ হাতে ফোন নিয়ে অপলক চেয়ে থাকে ঐশীর দিকে। ঐশীর কুচি সমালানো দেখে আরো একবার হার্টবিট মিস করলো ও। এত সুন্দর লাগছে কেন ওকে ? প্রাণ কাপানো সৌন্দর্য্য যাকে বলে। কই ? আগে তো ঐশীকে এতবার কাছ থেকে দেখেছে। এত সুন্দর লাগেনি। নাকি শাড়ি পড়লে সব মেয়েকেই মায়াবী লাগে ? জুভান আপনমনে প্রশ্ন করে কোনো উত্তর পেলো না। তবুও চেয়ে রইলো।
ঐশীর হাঁটতে হাঁটতে একবার চোখ পড়ে জুভানের দিকে। সঙ্গেসঙ্গে দুজনের চোখাচোখি হয়ে যায়। জুভান একটু অপ্রস্তুত হয়ে নজর সরিয়ে ফেলে। পুনরায় ফোনে চোখ রাখে। কিন্তু বেহায়া নজর বারবার আড়চোখে ঐশীকে দেখেই যাচ্ছে।
ঐশী আসলে ডিরেক্টর উচ্চস্বরে বললেন,
” এখন সিন শুরু করা যাক। এই সিন একটা ড্যান্স স্টেপ। ঐশীর আঙ্গুল ধরে তুমি ঐশীকে ঘুরাবে। তারপরের স্টেপ হলো তুমি ঐশীর কোমর আর হাত ধরে সফট ড্যান্স করবে। ঠিক তখনই রোল মডেলের এন্ট্রি হবে। গট ইট ? ”
জুভান কিছু না বলে চেয়ার থেকে উঠে দাড়ালো। আর ঐশী কাচুমাচু হয়ে জুভানের পাশে এসে দাঁড়াল। জুভানের সাথে শুট করবে ভেবেই লজ্জায় আর তীব্র অস্বস্থিতে কুকড়ে যাচ্ছে।
ডিরেক্টর ” অ্যাকশন ” বলতেই জুভান বুকে হাত দিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে ঐশীর সামনে। মোহনীয় গলায় বললো,
” ক্যান আই ড্যান্স উইথ ইউ ? ”
ঐশী যথেষ্টই স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে হাত বাড়িয়ে দিলো। জুভান ঐশীর হাত আলতো করে নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নিল। ” দ্বিতীয় স্পর্শ ” । ঐশীর মন জুড়ে শিহরন খেলে গেলো। কিন্তু ঐশী নিজেকে সামলে নেওয়ার চেষ্টা করে সেসব ভুলে শুধু শুটে মন দিল। জুভান ঐশীর হাত ধরে প্রথমে আঙ্গুল ধরে ঐশীকে ঘুরালো। ঐশী খুব নিখুঁত ভাবে স্টেপ ফলো করলো। অতঃপর জুভান ঐশীর কোমরে হাত দিলো। ঐশী এবার তীব্র অস্বস্থিতে পরে গেলো। ওর পক্ষে আর শুটে মন দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। বারবার নিজের কোমর সংকোচিত করে নিচ্ছে। জুভান ঐশীর মুখের অভিব্যক্তি বুঝতে পারলো। সে হাতের বাঁধন আরো হালকা করে দিলো। যতটা হালকা করলে ঐশীর অস্বস্থি লাগবে না ততটা হালকা করে নিল। ঐশী এবার যেনো একটু রেহায় পেলো। জুভান ড্যান্স করতে করতে ঐশীর কানের কাছে বিড়বিড় করে বললো,
” আমি কখনোই কোনো খারাপ স্পর্শে আপনাকে কলঙ্কিত করবো না, মিস ঐশী । ভরসা রাখতে পারেন। ”
ঐশী চমকে তাকালো। জুভান ঐশীর কানের কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে এনে আবারও স্বাভাবিক ভঙ্গিতে ড্যান্স করতে লাগলো। ঐশী জুভানের কাধের দিকে তাকিয়ে ড্যান্স স্টেপ ফলো করছে। বুকের ভিতর হার্টবিট দৃমদৃম করে শব্দ করছে। একটু আগে এ কি বললো জুভান !
#চলবে..