#হলিডে #পর্ব_৭_ও_৮

0
502

#হলিডে
#পর্ব_৭_ও_৮

#পর্ব_৭

দরজায় দাঁড়িয়ে নীরা হাসিমুখে বললো,
—রেডী হয়েছো ভাইয়া?
শফিক মাথা নাড়লো।
—এদিকে আসো ভাইয়া, জুতোর বেল্টটা আমি আটকে দিচ্ছি। শফিক বিছানায় বসে পা বাড়িয়ে দিলো।
—এইসব ডাক্তার ফাক্তার দেখিয়ে কোনো লাভ হবে না, বুঝলি নীরা? আমার অসুখটা এভাবে সারবে না। মাঝখান থেকে কতগুলো টাকা নষ্ট!
—তাহলে কিভাবে সারবে?
—পড়াশোনাটা শুরু করতে পারলেই দেখবি সব সেরে যাবে।
নীরা নিশ্চুপ থাকলো।
—ডাক্তার দেখাবো না নীরা।
—-ডাক্তার দেখাতে ইচ্ছে না করলে দেখাবে না। তবে রেডী হয়েছো যখন চলো ঘুরে আসি। তোমার মেডিকেল কলেজ ঘুরে আসি।
শফিকের চোখ আনন্দে চকচক করে উঠলো। সে ড্রয়ার খুলে এপ্রোনটা হাতে নিতে নিতে বললো,
—চল, তোর সাথে টাকা আছে তো? বন্ধুদের সাথে দেখা হলে খাওয়াতে হবে।

নীরা শফিকের দিক থেকে চোখ সরিয়ে অন্যদিকে তাকালো। তার চোখ ভিজে এসেছে। শফিক অসুস্থ হবার পর থেকে ও’র সব বন্ধুরা ওকে এভয়েড করেছে। এমন অনেক বার ঘটেছে, শফিক তাঁর কোনো কোনো বন্ধুর সাথে দেখা করতে গিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থেকে দেখা না করেই ফিরে এসেছে। জেলে থাকা অবস্থায় একটা কেউ দেখা করতে যায়নি, একমাত্র রনি ভাই ছাড়া। আচ্ছা, সবার রেপুটেশন হারাবার এত ভয় কেন? এই পৃথিবীতে কি রেপুটেশনের দাম সম্পর্কের চেয়ে বেশি? নীরার কাছে যদি পৃথিবীর সিস্টেম বদলাবার কোনো যন্ত্র থাকতো, তাহলে প্রথম যে সিস্টেমটা সে বদলাতো তা হলো মানুষের এই স্বার্থপরতার সিস্টেম। সেলফিশনেস জিনিসটা সে লক করে দিতো।
—কিরে, কথা বলছিস না যে? টাকা নেই?
—যথেষ্ট টাকা আছে ভাইয়া। শরবতের ব্যবসা। পানি বেচে টাকা। তাও ফ্রি পানি। ঢাকা ইউনিভার্সিটির পানি।
শফিক নীরার কাছাকাছি এসে দাঁড়ালো। নীরার মুখটা দু-হাতে তুলে ধরে বললো,
—আমি যদি পড়াশুনায় থাকতাম, এই কাজটা তুই কখনোই করতে পারতি না।
নীরা হাসার চেষ্টা করলো।
—এই কাজটাতে কিন্তু একটুও কষ্ট নেই। তুমি যতটা ইনসাল্টিং ভাবছো ততটা কিন্তু নয় ভাইয়া। আমি বেশ ভালো আছি, ইনজয় করছি কাজটা।
—আমাকে বুঝাতে আসবি না নীরা। আই হ্যাভ এ স্ট্রং সেন্স, একচুয়েলি বেটার সেন্স দেন ইউ! ডোন্ট ফরগেট, আই অলওয়েজ ক্যারি দ্য নরমাল ইমোশান, বাট নট মেন্টালি ফিট। কাজটা যে তুই মোটেও ভালোবেসে করছিস না, আই ক্যান সেন্স ইট। আই ক্যান ফিল ইট।
শফিকের গলার স্বরে প্রচন্ড রাগ ঝরে পড়ছে।
নীরা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে প্রসঙ্গ ঘুরানোর চেষ্টা করলো,
—মেঘ করেছে, ছাতা নেবো ভাইয়া?
শফিক মাথা চুলকাতে চুলকাতে বললো,
—মেঘ করেছে নাকি? বৃষ্টি এলে আমরা বরং ভিজে বাড়ি ফিরবো। ছাতা নেবার কোনো দরকার নেই!

বাইরে বেরিয়ে নীরা যে খবরটা প্রথম পেলো, তা নীরার জন্য বিরাট দুঃসংবাদ!
শফিক উৎসুক গলায় জিজ্ঞেস করলো,
—কে ফোন করলোরে??
—র….র….নি ভাই….
—রনি কি বলল? আমরা ওর ওখানেই আসছি, বললি না যে? বর্ষা হলে আছে তো?
নীরা রাস্তায় মাটিতে বসে পড়লো। কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,
—কারা যেন আমাদের ভ্যানগুলো আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে ভাইয়া! রনি ভাই গিয়ে দেখে, সব জ্বলছে। এখন কি হবে?
শফিক কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে একদৃষ্টিতে নীরার দিকে তাকিয়ে রইলো। নীরা কাঁদছে, ব্যাকুল হয়ে কাঁদছে। ইশ্! গাল দুটো কেমন লাল হয়ে গেছে। কাঁদলে নীরাকে একদম মায়ের মত দেখায় কেন?

তামিম অনেকক্ষণ ধরে ঘুমোবার চেষ্টা করছে। কিছুক্ষণ জোর করে চোখ বুজে থাকলে তন্দ্রামত আসছে, তারপর আবার শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে ঘুম ছেড়ে যাচ্ছে। সাথে যোগ হয়েছে প্রচন্ড বুক ধড়ফড়। এর কারণ কি? তামিম বিছানা ছেড়ে নামলো। ছাদে কিছুক্ষণ হাঁটাহাটি করে দেখা যেতে পারে। লম্বা শ্বাস নিয়ে খোলা আকাশের নিচে টেন মিনিটস এর একটু মেডিটেশন করা দরকার। মাথা একদম জ্যাম হয়ে আছে।
তামিম ছাদে এসে দেখলো রিতু দাঁড়িয়ে আছে।
—ঘুমোস নি?
রিতু চমকে উঠে ঘুরে তাকালো।
—এত বড় চাঁদ ফেলে ঘুমানো যায়? তুইও তো ঘুমোস নি।
—তুই কি ফোনে কথা বলছিলি রিতু?
রিতু জবাব না দিয়ে মৃদু হাসলো।
—একদম খালি গা হয়ে চলে এসেছিস দেখছি। সিজন চেঞ্জ করছে ভাইয়া, ফট করে ঠান্ডা লেগে যাবে তোর আবার।
—ধুর, এই বয়সে ঠান্ডা! তুই তো দেখি একদম ফ্লাস্ক ট্লাস্ক নিয়ে, কী ব্যাপার বলতো? সারারাত ছাদে থাকবি নাকি?
—সারারাত ছাদে না থাকলেও লং টাইম থাকবো। এজন্য কফি করে নিয়ে এসেছি। কফি খাবি ভাইয়া?
ছাদের রেলিং এ উঠে বসতে বসতে তামিম বললো,
—দে… ঘুমটা ছাড়া ছাড়া হচ্ছে। ডিসগাস্টিং… হার্টের রোগীর মতো বুক দপদপ করছে।
রিতু কফিমগটা এগিয়ে দিতে দিতে বললো,
—ভাইয়া, তোর উল্টো পায়জামাওয়ালীর কি খবর?
তামিম হতচকিত হয়ে তাকালো।
—আমাকে দেখেই তোর উল্টো পায়জামাওয়ালীর কথা মনে হওয়ার মানে কি?
—তোর যা অবস্থা! সব তো আটকে গেছে ওখানেই।
—মানে?
তামিম খুব সাবধানে কফিমগটা রেলিং এর উপর রেখে নেমে দাঁড়ালো।
রিতু হাত দিয়ে ক্রস দেখিয়ে বললো,
—মানে হলো, এসব ব্যাপার আমি খুব ভালো বুঝতে পারি। এই যে যেমন ধর… এখন তোর ঘুম পাচ্ছে না, হঠাৎ হঠাৎ মেমোরি লস করে যাচ্ছে, ছঠফট করছিস, মনোযোগ হারাচ্ছিস, ছোট ছোট ভুল করছিস…. এর মানে হলো… বুঝতেই পারছিস।
—আ… মি! আমি মনোযোগ হারাচ্ছি?
—হুঁ। হারাচ্ছিস…. এই যেমন দ্যাখ, এখন তুই এক পায়ে স্যান্ডেল পরে আছিস। মোবাইল ফোন ভেবে যেটা হাতে করে নিয়ে এসেছিস সেটা হচ্ছে তোর এসির রিমোট।
তামিম অসহায়ভাবে হাতের দিকে তাকালো।ডিসপ্লেতে ১৬ডিগ্রী লেখা এসির রিমোট হাতে সে ছাদে দাঁড়িয়ে আছে।
—-তুই বলছিস, এসব পায়জামাওয়ালীর জন্য হচ্ছে?
—হুঁ ভাইয়া। ইট’স এ ভেরি ইজি ক্যালকুলেশান।কিন্তু এইসব সিচুয়েশানে একটা ছোট্ট সমস্যা আছে, তা হলো অতি বুদ্ধিমান মানুষ ব্যাপারটা ধরতে পারে না। আবার ধর, তুই যদি একটা নিরেট বোকা হতি, এই জিনিসটা সহজেই বুঝতে পারতি। বুঝতে পারতি তোর ব্রেনের কিছু পার্টস কাজ করছে না এবং কেন করছে না।
রিমোটটা তামিম ছাদের এক কোণে ছুঁড়ে ফেললো।
—দ্যাখ রিতু, এরকম ভুল আমার প্রায়শই হয়। নাথিং লাইক সিরিয়াস!
তামিম নার্ভাস ভঙ্গিতে সিগারেট ঠোঁটে গুজলো।
রিতু এগিয়ে এসে তামিমের ঠোঁট থেকে সিগারেটটা হাতে নিয়ে বললো,
—এবং সর্বশেষ তুই সিগারেটটা উল্টো করে মুখে নিয়েছিলি।
তামিম হা করে রিতুর দিকে তাকিয়ে রইলো।
—দেখা হয়েছিলো আবার, তাই না?
—হুঁ। কিন্তু কি জানিস? একবারও জানতে চাইলো না, আমার কাটাছড়ার কি অবস্থা? আমি রিকভার করেছি কিনা? জোর করে দুটো সিঙ্গারা খাইয়ে দিলো, দুদিন ধরে পেট খারাপ।
রিতু খিলখিল করে হেসে উঠলো।
—তুই ইউনিভার্সিটিতে পড়াকালীন তোর একটাও প্রেম হয়নি; কত সুন্দরী মেয়ে তোর পিছু ঘুরলো! আর শীলা আপু… শীলা আপুর কথা তোর মনে আছে ভাইয়া? হাত পা কেটে তোর নাম লিখে হুলুস্থুল অবস্থা আর তুই ফিলিংলেস! এসব দেখে, বাবা কি বলেছিলো তোকে মনে আছে?
তামিম হেসে ফেললো।
—স্টপ ইট রিতু! ইট হার্টস! ডোন্ট রিমাইন্ড মি।
—ভাইয়া, এই জিনিসটা কিন্তু মজার! খুব লাকিলি এসব ঘটে। এসব হওয়া মানে দেখবি, অনেক অদ্ভূত অদ্ভূত কাজ তোর ভালো লাগবে, নিজেকে ফুরফুরে লাগবে। আশেপাশের পৃথিবীটাকে তুচ্ছ মনে হবে। তোর মনে হবে, তোর ভিতরে একজন বাস করে যাকে তুই কখনোই হারাস না। সবকিছু তোর কাছে, বিউটিফুল মনে হবে।

তামিমের গলা শুকিয়ে আসছে, একটা সুইট ফ্র্যাগরেন্স নাকে এসে লাগছে.. কেমন যেন মাথা ঝিমঝিম করা গন্ধটা… মিস নীরার নয়তো?

#পর্ব_৮

তামিম বসে আছে প্রায় আধঘন্টা ধরে। এ বাড়িতে লোকজন আছে বলে মনে হচ্ছে না। নিস্তব্ধ নিশ্চুপ বাড়ি। লাবণী বলে যিনি আছেন, তিনি এসে একবার এক কাপ চা রেখে গেছেন। এবং অতি বিরক্তিকর কণ্ঠে বলে গিয়েছেন,
—আগামী সাত তারিখ পর্যন্ত মাছের কোনো অর্ডার রাখা যাবে না। এরপরে হলে বসুন। ফিরোজ চাচা ঘুমোচ্ছেন। ন’টার আগে পাবেন না।
জবাবে তামিম কিছু বলেনি। সকাল এগারোটায় তার ফুড মিনিস্টারের সাথে চাঁদপুর যাবার কথা। দশটার মধ্যে গিয়ে রিপোর্ট করতে হবে। মিনিস্টারকে নিয়ে এমনিতেই অনেক রিস্ক আছে। দুদিন আগেও তিনি একটা ভুল বিবৃতি দিয়েছেন। এর মধ্যে যদি আজকের প্রোগ্রামে কোনো ভুল না হয় সেদিকে সতর্ক থাকতে হবে।

তামিম আবার ঘড়ি দেখলো। আটটা বেজে পঁচিশ মিনিট। কারো কোনো সাড়াশব্দ নেই। রান্নাঘর থেকে শুধু আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। বাকিরা কি ঘুমে? নীরাও কি ঘুমোচ্ছে? দুদিন আগেই যে বাড়ির তিন তিনটে জুস ভ্যান পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে, সে বাড়ির পরিবেশ এত স্বাভাবিক কি করে? তামিম কি এবার কাউকে ডাকবে?
মিসেস লাবণী আবার এসেছেন, এবার ট্রে ভর্তি নাশতা। রুটি, ডিমভাজি, আলুভাজি!
লাবণী টি টেবিলে নাশতা রাখতে রাখতে বললো,
—আপনি নাশতা করে নিন। আমি বরং আপনার অর্ডার লিখে নিচ্ছি। বলুন ডেট বলুন।
লাবণী কোলের মধ্যে নোটপ্যাড নিয়ে পাশের সিঙ্গেল সোফাটায় বসলো। তামিম খুকখুক করে কেশে নিলো একটু। তামিম নিজের দিকে আরেকবার চোখ বুলালো। সে পরে এসেছে একটা ব্ল্যাক শার্ট, ব্ল্যাক প্যান্ট সাথে অফ ইয়েলো আর মেরুন স্ট্রাইপের টাই।বাই এনি চান্স তাকে কি মাছের পাইকারের মতো লাগছে?
—কি হলো বলুন?
তামিম ইতস্তত গলায় বললো,
—আমি মিস নীরার সাথে মিট করতে এসেছি। তাকে কি একটু ডেকে দেওয়া যাবে?
লাবণী হেসে ফেললো।
—আগে বলবেন তো… নীরা তো একটা ফটোশ্যূটে গেছে সেই ভোরে উঠে। আপনি তাকে ফোন করে আসেননি কেন?
তামিম ভ্রু কু্ঁচকালো। মিস নীরার সাথে দেখা করতে হলে, ফোন করে আসতে হবে? এত ব্যস্ততা নীরার?
—আপনার কি নীরার সাথে জরুরি কোনো দরকার?
—জি মানে.. তিনি কখন ফিরবেন বলে গেছেন?
—বললো তো, আটটার আগেই ফিরবে। এসে আলুভাজা দিয়ে রুটি খাবে বলে গেল।
—ও.. আচ্ছা। তাহলে আমি আরেকটু অপেক্ষা করি।
—আচ্ছা বসুন, একা একা বসতে খারাপ লাগবে না তো? আমায় রান্না করতে হবে। বুয়া দশটার মাঝেই চলে যায়, বুঝলেন। এর জন্যই সব কাজ গুছিয়ে নিতে হয়।
—না না, একা বসতে আমার কোনো সমস্যা নেই।
তামিম ভদ্রতার হাসি হাসবার চেষ্টা করলো।
—টিভি দেখবেন?
—জি না।
—আচ্ছা, আমি বরং শফিককে পাঠিয়ে দিচ্ছি।
তামিম হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো। লাবণী সেটা বুঝলো না বোধহয়।
—শফিক আমার দেওর, মেডিকেলে পড়ছে। গল্প করার লোক হিসেবে সে খুব ভালো।

তামিম আবার ঘড়ি দেখলো। এভাবে বসে থাকার মানে হয় না। যেতে দেরি হয়ে গেলে সমস্যা। ফুড মিনিস্টারের মেজাজ এমনিতেই সবসময় হাই থাকে। হয়তো সবার সামনেই একটা কঠিন কথা বলে বসবেন। মিস নীরার সাথে ফোনে কথা বলে আসতে হবে। তামিম উঠে দাঁড়ালো এবং সাথে সাথেই বসে পড়লো। শফিক এসেছে কিন্তু বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, শফিকের চেহারা মোটেও ছবির মতো নয়। এর থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। মেয়েদের ক্ষেত্রে অতি সুন্দরীদের কি বলা হয়, স্বর্গপরী। আর ছেলেদের ক্ষেত্রে সেরকম হলে… তামিম ভাবতে লাগলো। শুভ্র চেহারা… না,
না স্বর্গীয় চেহারা! একজন মানুষের মুখ দেখতে এত মায়াময় হয় কি করে?
—হ্যালো…….
তামিম বিস্ময়ভরা দৃষ্টি নিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়েই রইলো।
—হ্যালো… এক্সকিউজ মি… আমি শফিক। নীরার ভাইয়া।
—ওহ, ইয়েস ইয়েস.. আমি তামিম…
—নীরা একটা ফটোশ্যূটে গিয়েছে, প্রথম আলোর নক্শার জন্য। ট্যাবলয়েডে ফ্রন্ট পেজে আসবে নাকি।
ক্যাপশন হলো “শীতের শুরুতে ত্বকের যত্ন”! ভোরের সূর্যের রেডিশ লাইটেই ফটোশ্যূটটা হবে। হুট করেই ও অফারটা পেয়ে গেল বুঝলেন।
শফিক আরাম করে সোফায় বসলো। ট্রে থেকে নাশতার বাটিগুলো নামিয়ে তামিমের দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বললো,
—আপনি নাশতা খেয়ে নিন। রুটি ঠান্ডা হয়ে গেলে খেতে বিরক্ত লাগে।
তামিম একটা রুটি নিয়ে ছিড়তে ছিড়তে বললো,
—আপনিও নিন….
—আমার খাওয়া হয়ে গেছে। আমাকে সাতটার মাঝে নাশতা খেতে হয়। তারপর ঔষধ.. সবকিছু টাইম টু টাইম না হলে নীরা খুব রাগ করে। আপনি খবরের কাগজ পড়বেন?
তামিম না সূচক মাথা নাড়লো।
—ব্রেকফাস্ট করতে করতে অনেকে আবার খবরের কাগজ পড়ে তো তাই বললাম।
শফিক উঠে গিয়ে টিভি ছাড়লো। কিন্তু সে টিভির দিকে তাকালো না। তাঁর মনোযোগ বইয়ে। বইয়ের নাম ক্লিনিক্যাল নিওরোলোজি। তামিমের হঠাৎ মনে হলো, এই শফিক ছেলেটার ডাক্তার হওয়া খুবই প্রয়োজন। ভীষণ প্রয়োজন!
শফিক বই থেকে চোখ সরিয়ে তামিমের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাঁসলো।
—আপনি কি আমায় কিছু বলতে চান মি. তামিম?
তামিম এক মুহূর্ত ভাবলো।
—মি. শফিক আপনি কি জানেন এই পৃথিবীর ইতিহাসে যে কয়জন ভালো চিকিৎসকের নাম আমরা জানি, তাদের বেশিরভাগেরই ছাত্রজীবন মসৃণ ছিল না। কেউ কেউ তো বদ্ধপাগল ছিলেন বলে ধারণা! আবার আমরা এমন একজনকে জানি যিনি কথাই বলতে পারতেন না। তাই না?
শফিক জবাব না দিয়ে হাসলো। তাঁর চোখে হতবিহ্বল ভাব।
তামিমের বুকে ধাক্কার মতো লাগলো। এরকম একজন কারো শিশুদের ডাক্তার হওয়া দরকার। যে অসুস্থ শিশুর দিকে তাকিয়ে এমন ভালোবাসাময় পবিত্র হাসি হাসবে।
—মি.শফিক, কিন্তু এরকম প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও তাঁরা ভালো চিকিৎসক হয়েছেন। নানা রকম ঔষধপাতি আবিষ্কার করে গিয়েছেন। এবং আমার মনে হয় কি জানেন? এইসব প্রতিবন্ধকতাগুলো ছিল বলেই তাঁরা জীবনে এত ভালো কিছু করতে পেরেছেন! মি. শফিক, আপনি যে পৃথিবীটাতে আটকে আছেন, তার বাইরেও একটা চমৎকার পৃথিবী আছে। কিন্তু আপনার ছোটবোন মানে মিস নীরা, উনার জন্য এই চমৎকার পৃথিবীটা ভয়ংকর স্ট্রাগলের! আর সেটা শুধু আপনার জন্যই।

শফিক ঘামতে লাগলো। কপাল বেয়ে তার দরদর করে ঘাম পড়ছে। সে দিশেহারা গলায় বললো,
—কিন্তু আমি তো অসুস্থ! অনেক সময় আমি রিয়েলিটি আর কল্পনার ফারাক ধরতে পারি না। সামটাইমস ইট সিমস টু মি, আই এম নট হিউম্যান কাইন্ড; আই এম নাথিং। আমার কোনো অনুভূতিই কাজ করে না। আমি পার্থক্য করতে পারি না কোনো কিছুই…
তামিম গ্লাসে পানি ঢালতে ঢালতে বললো,
—আপনি মোটেও অসুস্থ নন মি.শফিক। আপনি সুস্থ এবং বেশ চমৎকার সুস্থ। শুধু প্রবলেমটা হচ্ছে, আপনি আপনার নিজের অনুভূতি, দুঃখ কষ্টের ঘোরটাকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। আপনার এই ভ্রমটাকে আপনি এত গুরুত্ব দিয়েছেন যে, আপনার মেন্টাল স্টেবিলিটি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আপনি বাস করছেন শুধু আপনার ভাবনা চিন্তা দিয়ে তৈরি করা পৃথিবীতে। ইলিউশান…. অথবা ভ্রম। এর থেকে বের হবার উপায়ও কিন্তু আপনার কাছেই আছে। আপনাকেই সেটা খুঁজে বের করতে হবে।
—আমি অসুস্থ নই?
—ইয়েস, অসুস্থ নন। শুধু মাঝে মাঝে আপনার আশপাশটা গুলিয়ে যায়। রিয়েলিটি ছাপিয়ে আপনার ইমাজিনেশন প্রবল হয়ে উঠে, আর তখনি আপনার আশেপাশের সব জড় বস্তু আপনার কাছে জীবন্ত মনে হয়।
শফিক শার্টের হাতায় চোখ মুছলো। ন’টা দশ বাজে। এবার তামিমের উঠা উচিত। এখন না বেরোলে পৌছুতে সত্যিই দেরি হয়ে যাবে।
—আপনি এতসব কথা কিভাবে জানেন? আপনি কি মনোরোগ বিশেষজ্ঞ?
—না, না সেরকম কিছুই না। একটা কোরিয়ান মুভি দেখেছিলাম, যেখানে এরকম কিছু ডায়ালগ ছিল।
মুভির নামটা আপাতত মনে আসছে না, মনে পড়লে আপনায় বলবো। দেখে নিবেন, চমৎকার মোটিভেশনাল মুভি। প্রেমে ছ্যাঁকা খেয়ে মানসিক ভারসাম্য হারানো এক মেধাবী যুবকের ঘুরে দাঁড়ানোর গল্পের ছবি। আজ চলি মি. শফিক। আমার একটু তাড়া আছে।
শফিক কাতর গলায় বললো,
—আপনার সাথে আমার আবার দেখা হবে তো?
তামিম হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো।
—তবে সেদিন, যেদিন আপনার মনে হবে আপনি মুভিটা দেখতে চান আমার সাথে বসে।
—কোনো মুভি কি কারো জীবন পাল্টে দিতে পারে মি. তামিম?
—কারো জীবন পাল্টে দিতে পারে কিনা জানি না, তবে জীবন পাল্টানোর মতো ঘটনা দেখাতে পারে…
দেখুন আপনি আপনার জীবনটাকে পাল্টাবেন কিনা, ইট’স কমপ্লিটলি আপ টু ইউ। ভালো থাকবেন, আসি।
—নীরা এলে কি কিছু বলতে হবে?
—না। নীরা এলে কিছুই বলতে হবে না। বাই… তবে আপনার ভাবী মানে মিসেস লাবণীকে বলবেন, এই চমৎকার নাশতার জন্য ধন্যবাদ।

তামিম বেরিয়ে এলো। তার মনটা হঠাৎ করেই বেশ হালকা লাগছে। নীরার সাথে দেখা না হয়ে ভালোই হলো। তামিম গাড়িতে বসে স্টার্ট করতেই সাইড মিররে দেখলো পেছনে নীরা রিকশা থেকে নামছে। সাদা পাড়ের হালকা নীল আর গোলাপী শেডের শাড়ি পরনে। একহাতভর্তি চুড়ি। আরেকহাত খালি। আধখোলা চুলটা এলোমেলো হয়ে আছে! একটু গুছিয়ে নিয়ে বেণী করলে কি হয়? ভাড়া মিটিয়ে গেটে ঢুকতে ঢুকতে পিছন ফিরে একবার দেখলোও না, আশ্চর্য মেয়ে!
নীরা হেঁটে যাচ্ছে মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে। তার মানে সে গুণগুণ করে গান গাইছে। কি গান? তামিমের ভীষণ শুনতে ইচ্ছে করলো। তামিম কি গাড়ি থেকে নেমে গিয়ে একবার কথা বলবে? নাকি গাড়িতে বসেই পিছু ডাকবে? না থাক্… কি দরকার!
তামিম একদৃষ্টিতে নীরার যাবার দিকে তাকিয়েই রইলো। শাড়ির পাড় পেছনে অনেকটা নেমে গিয়ে কোমর আর ব্লাউজের মাঝামাঝি… ফর্সা পিঠ বেরিয়ে আছে। ইশ্….. মেয়েটা এত দুষ্টু করে শাড়ি পরেছে কেন? এরকম শাড়ি পরার অপরাধে মেয়েটার যাবজ্জীবন হওয়া উচিত।

এবার তামিম গুণগুণ করে গান ধরলো,
“এ পৃথিবী ছেড়ে চলো যাইইইই…
স্বপ্নের সিঁড়ি বেয়ে সীমাহীন…”

(চলবে)

#তৃধা_আনিকা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here