বৃষ্টির_রাতে #রূবাইবা_মেহউইশ (২৭)

0
335

#বৃষ্টির_রাতে
#রূবাইবা_মেহউইশ
(২৭)

প্রেমের বর্ষণ হতে হাজারো বাঁধা বিপত্তি থাকতে পারে কিন্তু প্রেমে পড়তে! তাতে নিশ্চয়ই কোন বাঁধা নেই? বরং কে কখন এই প্রেম পথে হোঁচট খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়বে তার ঠিক ঠিকানা নেই। সত্যিই নেই নয়তো একই সময়ে তিন দিকে তিন তিনজন মানুষ হঠাৎই প্রেমের ভরাডুবিতে ডুবলো কি করে! পুলিশ অফিসার এহসান হঠাৎ করেই হাঁটুর বয়সী এক মেয়ের প্রেমে নাক মুখ ডুবিয়ে পড়ে গেল। সে সময়েই তারই ফুপাতো বোন সুপ্রভাও পড়লো ঝড় বাদলের রাতে তাকে জ্বালিয়ে মারা ছেলেটির প্রেমে আছড়ে পড়লো। যা তা পড়া নয় সেই প্রেমে সে আজকাল পাগলের মত একা একাই নানান প্রলাপ বকে। আবার এই পাগল ঝড় তুফানের মত মেয়েটির প্রেমে পড়লো সেই হুটহাট ধমকে ওঠা কিছুটা মুডি ছেলেটা। ঋতুটা জৈষ্ঠ্যমাস অথচ এই তিনজন মানুষের মনে একটানা শ্রাবণ চলছে যেন বাতাসে বসন্তকে জড়িয়ে। এ কেমন মাতাল অনুভূতিতে ছেয়ে গেল তাদের মন! বহুকষ্টেই সুপ্রভা তাসিনের নাম্বারটা জোগাড় করেছিলো পনেরো দিনের মাথায়। বড়দাকে অনেক বলে কয়ে মায়ের মতের বিরুদ্ধে গিয়েই একটা নতুন স্মার্ট ফোন কেনা হলো সুপ্রভার। ডান হাতের প্লাস্টারটাও উতরে গেল পনেরো দিনে আর ডান হাতের আঙ্গুল গুলোও মোটামুটি সচল ছিলো বলেই প্রথমে ফেসবুক আইডির পাসওয়ার্ড রিকভার এবং পরে টিয়াকে নক করে টিয়ার ফোন নাম্বার নিলো। কল দিয়ে এক ঘন্টা বারো মিনিট নিজেদের আলাপ আলোচনার মাঝেই ইনিয়েবিনিয়ে বাহানা দাঁড় করিয়ে তাসিনের নাম্বার চাইলো। দিনের বেলায় মুরাদ অফিসে থাকায় রাত অব্ধি অপেক্ষার পরই টিয়া তাকে পাঠালো তাসিনের ফোন নম্বরটা। দ্বিধায় ভরা বুক নিয়েও সসংকোচে ছোট্ট একটা বার্তা লিখে পাঠিয়ে দিলো তাসিনের নম্বরে। পরীক্ষার বেশি দিন নেই তারওপর পড়ালেখায় লম্বা গ্যাপ পড়ে গেছে। দু দিনের ভেতরই তো ঢাকায় যেতে হবে তখন তার প্রথম কাজই তাসিনের পক্ষ থেকে ডিনার ট্রিট অথবা অন্যকিছু তবুও একটাবার দেখা হওয়া চাই।

ছটফটে মন নিয়ে আয়না দিনভর এখন ঘরে বন্দী পাখির মতো পড়ে থাকে। গত চারদিন ধরে সে তুহিনের সাথে কলেজেও যায় না লজ্জায়। তার করা বেহায়াপনাটা এখন তাদের দু পরিবারের সবাই জেনে গেছে। মাইশা তো কাল এসে মজাও করে গেছে সে তাকে ভাবী বলবে না কখনোই। সে তো ছোট থেকেই আনা আপু বলতো পরেও তাই বলবে। তার ভাষ্যমতে আয়না আপু বেশ বড় হয়ে যায় তাই সে একটা বর্ণ সরিয়ে আনা আপু বানিয়েছিলো আর সারাজীবন তাই ডাকবে। আয়না খুব লজ্জা লাগছিল মাইশার কথা শুনে। বাড়িতে আজকাল আয়নার মা খুব রুদ্রমূর্তি ধারণ করে থাকেন মেয়ের সামনে। খুব বড় নির্লজ্জতা করে ফেলেছে আয়না এটা ভেবেই সে এত রেগে থাকে তার ওপর লজ্জায় দেড় সপ্তাহের মত হলো বাপের বাড়ির দিকে পা বাড়ায়নি। মাঝে অবশ্য মাছুমা নিজেই এসেছিলো বৃষ্টির দিনে ভুনাখিচুড়ি আর গরুর মাংস নিয়ে। তবুও কোথাও একটা লজ্জার কাঁটা বিঁধে আছে গলায়। তাসিনকেও এজন্য এবার এতদিন পেরিয়ে গেলেও ফোন করেনি।

আজ সকাল থেকে কড়া রোদ আর হালকা ঝিরঝিরে বাতাস বইছে। এহসানের ডিউটি থাকায় সে তার ইউনিফর্ম গায়ে দিয়ে নাশতা করতে বসলো। এক হাতে ফোন আর অন্য হাতে পানির গ্লাস। রায়হানের ব্যাপারটা তার বাবার কাছে জানানোর পর আইনি কোন ইস্যু যেন না বানানো হয় সে অর্ডারই পেয়েছিলো এহসান। একজন পুলিশ অন্য একজন সিনিয়র পুলিশের মতের বিরুদ্ধে এমনিতেই যাওয়ার কথা না। রায়হানের বাবা নিজে কথা দিয়েছেন তার ছেলেকে নিয়ে আর কোন অভিযোগ আসবে না। এহসান কথাটা মেনে নিয়েই আফছার মীর আর আয়নার বাবার সাথে কথা বলে ব্যাপারটা মিটিয়েছিলো। কিন্তু সেই মিটিয়ে নেওয়া ঘটনা যে এখন এহসান নিজেই নতুন করে শুরু করতে চাচ্ছে তা ভাবতেই কেমন নিজের প্রতি অসহ্যকর একটা রাগ হচ্ছে। আজ কতগুলো দিন হয়ে গেল সে বখাটেদের মত আয়নার পেছনে পড়ে আছে যদিও সে রায়হানের মত উত্যক্ত করে না। বরং লুকিয়ে চুরিয়ে দৃষ্টিসীমানায় বন্দী করে রাখে আয়নাকে। অদৃশ্য সে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আয়না অগোচর হলেই আবার এহসান ছটফটিয়ে পুনরায় সীমানার ভেতর নিয়ে আসে৷ আয়না অবগত নয় তার এই মনের টানাপোড়েন নিয়ে শুধু দু চারদিন দেখেছে সে এই পুলিশটাকে৷ পুলিশটার আচরণ রুক্ষ লাগলেও চোখের দৃষ্টি তার কাছে বড্ড ন্যাকা লেগেছিলো। নাশতা করতে করতেই এহসান আজও ঠিক করলো কলেজের দিকে যাবে৷ নিয়ম শৃঙ্খলায় কঠোর থাকা এহসান আজকাল ঘুষখোর, নিয়ম না মানা পুলিশের মতোই আচরণ করছে। চাকরিজীবনে এই তার প্রথম নিয়ম ভাঙা। নয়াগঞ্জ থানায় বদলি হয়ে আসার খুব বেশিদিন হয়নি তবুও এলাকায় তার পরিচিত বেশ। কিন্তু বর্তমান করা ঔদ্ধত্য ভাব না জানি তার সম্মানের ওপর ঘা দেয়! তারই’বা কি করার আছে? মন বড্ড বেপরোয়া হয়ে উঠেছে তার পুঁচকে একটা মেয়ের জন্য । কে জানে কি করে এমন হলো চোখের তারায় জ্বলজ্বল করে সেই পুচকে মেয়েটার মুখ। খেতে, বসতে, ঘুমোতে সব অবস্থাতেই কেমন টিকটিক করে কানে বাজে মেয়েটার বলা, “অন্ধউলুশ” শব্দটা। গত সপ্তাহের ঘটনা , এহসান প্রতিদিনকার সেদিনঔ গিয়েছিলো কলেজের সামনে। সেদিনও সে আয়নাকে লুকিয়ে দেখবে বলে কলেজের সামনের লাইব্রেরি শপে ঢুকেছিলো। কিছু কেনার নেই তবুও সে এদিক ওদিক তাকিয়ে শপটাকে দেখার ঢং করেই আবার বাইরে নজর রাখছিলো। সে কি জানতো আয়না সেদিন কলেজে ঢোকার আগেই লাইব্রেরিতে ঢুকবে! তুহিন তাকে গেইটের কাছে রেখে নিজের কলেজের দিকে চলে যেতেই আয়না তার এক বান্ধবীকে দেখতে পেল। একটা খাতা কেনার ছিলো বলেই বান্ধবীটিকে বলল, “চল তো তৃষা একটা খাতা কিনবো।”

লাইব্রেরি শপটা খুব লম্বাটে আর বেশ বড়। ভেতরে ঢুকে দাঁড়ানোর মত জায়গা আছে বেশ খানিকটা তাই আয়নারাও একটু ভেতরে ঢুকলো। কথা বলতে বলতে ঢুকতে গিয়েই খেয়াল করেনি সামনে থেকে কেউ একজন আসছে৷ এহসানেরও দৃষ্টি ছিলো কলেজ গেইটের দিকটাতে আর তাতেই ঘটলো দূর্ঘটনা। দুজনের বেখেয়ালিপনায় জোর এক ধাক্কা লাগলো দুজনে। আয়নার কপাল গিয়ে ঠেকলো এহসানের বুকের ওপর পকেট বরাবর তার ছোট্ট নেম কার্ডটাতে৷ পাতলা ধাতবের মত নামের ওপর কপাল লেগেই একটুখানি চোট পেয়ে আর্তনাদ করে উঠে আয়না । এহসানও আকস্মিক ধাক্কায় হতচকিত হয়। দুজনেই তাকায় দুজনার দিকে৷ কপাল কুঁচকে নাক ফুলিয়ে আয়নাই প্রথমে ধমকে উঠে, “চোখে দেখেন না!”

এহসান বোধহয় বুকের কাছে আয়নাকে দেখতেই তব্দা খেয়েছে। সে কোন জবাব না দিয়ে বোকার মত তাকিয়ে আছে আয়নার দিকে৷ একটু একটু টের পাচ্ছে তার হৃদযন্ত্রের ধকধকানি প্রবল হচ্ছে৷ তার উনত্রিশ বছর বয়সী জীবনে প্রেমে পড়তে গিয়েও ঠিকঠাক পড়া হয়নি তার। এখন কোথায় প্রাপ্ত বয়স্ক মেয়ে দেখে বিয়েশাদি করে সংসারী হবে তখন কিনা এমন এক বাচ্চা মেয়ের প্রেমে দিওয়ানা হয়ে লাফাঙ্গাগিরি করছে!

আয়না তার ধমকানির কোন জবাব না পেলেও এহসানের তাকানো দেখে বেশ বিরক্ত হয়েছিলো। তাকে পাশ কাটিয়ে যেতে যেতেই উচ্চারণ করেছিলো, “অন্ধউলুশ।”

এহসান শুনলেও কিছু বলেনি তবে ফিরে এসে মনে পড়েছিলো অন্ধউলুশ মানে কি! ভাবছে একদিন সময় সুযোগ করে সে জিজ্ঞেস করবে এর অর্থ কি?

মুড তো আজ অনেকদিনই হলো ঠিক থাকে না তাসিনের। কিন্তু আজ সকাল থেকে থাকা খারাপ মুডটাই হুট করে ভালো হয়ে গিয়ে আবার খারাপ হলো। সকালে ফোনটা চেক করেনি। অফিসে এসেও ইচ্ছে ছিলো না চেক করার। মূলত মা আর সুপ্রভা দুজনের জন্যই তো মনের আবহাওয়া এতোটা খারাপ তার তাই আর ফোনটাতে নজর বুলায়নি। কিন্তু এখন লাঞ্চ ব্রেকে একটুখানি ফেসবুকে ঢু মারতেই ফোনটা হাতে নিয়েছিলো আর তখনি চোখে পড়লো সুপ্রভার নাম্বার থেকে একটা মেসেজ। মেসেজ এসেছে দেখেই মুড ভালো হয়েছে এবং তা পড়তেই মনটা খারাপ হয়েছে। সুপ্রভা লিখেছে, হাতের প্লাস্টার আর দু দিন পরই উঠে যাবে তখন কি আমার পূর্ব পাওনা ট্রিট অফারটা পুনরায় পেতে পারি?”

‘হাতের প্লাস্টার’ এই দুটো শব্দই যেন পাহাড় পরিমাণ ওজন নিয়ে বুকে ভর করলো। মুহূর্তেই দমবন্ধ অনুভূতির আভাস। এ কেমন যন্ত্রণা! তাসিনের পুরো দিন কাটলো অস্থিরতায়। সুপ্রভাকে তখনি সে ফোন করলো না। মন বলছিলো দু এক মিনিটের কথা বলায় বুকের ভার নামলো না। তাই রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করে রাতেই রুমে বসে কল দিলো। কিন্তু ফোনকলটি পৌঁছুলো না সুপ্রভার কাছে৷ রাতভর ছটফট করে প্রথম দেখার বৃষ্টিময় রাতটা কল্পনা করেই কাটিয়ে দিলো। পরেরদিনও শ্রান্ত চোখমুখে অফিস করে আবারও একরাশ মন ভার করা পাথর বুকে নিয়ে রুমে ফিরলো। সুপ্রভার মেসেজের পর দুদিন কেটে গেলো আবারও তাসিনের প্রচণ্ড অসুস্থ মন নিয়ে। রাতে মায়ের আবারও ফোন এলো সে চুপচাপ এড়িয়ে গেল কলটা। ঘুমানোর আগ মুহূর্তে মামীর ফোন এলো। সে সালাম দিয়ে মামীর হাল জিজ্ঞেস করতেই মামী বলল, “তাসিন একটা প্রশ্ন করবো সত্যি জবাব দিবি?”

“প্রশ্ন!”

“হ্যাঁ বাবা। তুই তো আমায় কিছু লুকাস না আজ একটা কথা জানতে চাইবো না লুকিয়ে জবাব দিবি?”

“ওরে বাবাহ্! এভাবে বললে তো ভয় লাগছে মামী!”

“ভয় পাওয়ার কিছু নেই শুধু সঠিক জবাবটা দিবি আমি কাউকে কিছু বলবো না।”

ব্যস, মামীর এ কথাতেই তাসিন বুঝতে পারলো মামী কি জিজ্ঞেস করবে। এই সহজ সরল মানুষটাকে সে এমনি এমনি বলে নাকি! ঠিক বাবার মত করে সবটা বুঝে যায় এই মানুষটার মনের কথা, ইচ্ছে আর কখনো কখনো করা আবদারগুলো তাইতো সাধ করে মেয়ে বলে সম্মোধন করে আর মামীও আহ্লাদে তাকে আব্বা বলে। মামীর প্রশ্নের আগেই সে সরাসরি জবাব দিলো, “আমার কারো সাথে প্রেমের চক্কর নেই সত্যিই। আয়নাকে আমি তার জন্মের পর থেকেই আপন বোনের মত ভেবে এসেছি। মা বললেই তো আর আমার পক্ষে তাকে বউ বলে ভাবা সম্ভব নয় মামী। বিয়েটা কি ছেলে খেলা নাকি সবাই মিলে বলল আর আমিও বিয়ে করলেই তাকে বোন থেকে বউ ভেবে নেব!”

তাসিন কিছুটা রুদ্ধশ্বাসেই সবটা বলে দিলো। মামী ওপাশ থেকে শুনলো চুপচাপ তারপরই দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।

“মাছুমা খুব করে ধরেছে আমায় তোমাকে রাজী করানোর জন্য। কিন্তু আমি জোর করতে নয় তোমার মুখে শুধু সত্যটা জানতে চাইছিলাম। আচ্ছা দেখি কি বলা যায় তোমার মাকে তবে একটা কথা রইলো…”

“আমি জানি কি কথা। আমি যদি কখনো নিজেই কাউকে পছন্দ করি তবে অবশ্যই আমার মেয়েকেই আগে জানাব।”

মামী হাসলেন এবং বিশ্বাসও করলেন তাসিনের কথা। আরো কিছু সময় কথা বলে ফোন রাখলে তাসিন ঘুমিয়ে পড়লো। পরেরদিন আবার যথারীতি অফিস শেষ করে এপার্টমেন্টে ফিরছিলো। কি মনে করে হঠাৎই মোড়ে এসে তিন গলির মাথায় অন্য গলিতে ঢুকে গেল। সে গলি দিয়ে বের হলেই সেই ফার্নিচার শপ সামনে পড়ে এবং তার পেছন দিকেই সুপ্রভার হোস্টেল। অবচেতন মন ক্লান্ত দেহটা টেনে চলেই গেল সে গলি পেরিয়ে হোস্টেলের সামনে কৃষ্ণচূড়া গাছটার নিচে। কি মনে করে চোখ তুলে হোস্টেলের দেয়ালের ওপারে দোতলা আর তিন তলার করিডোরে তাকালো। কি খুঁজলো সে আদৌ বুঝতে পারলো কিনা কে জানে! লম্বাটে পুরো করিডোরটাতে চোখ বুলিয়ে আবারও দৃষ্টি নিচু করলো। আকাঙ্ক্ষিত মুখটির দেখা মিলল না বলেই হয়তো আবারও মন খারাপের মেঘগুলো জমাট বাঁধলো তাসিনের সৌম্য মুখটাতে। এলোমেলো পা ফেলে সে ফিরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো আর তখনি কানে এলো রিনরিনে সেই কণ্ঠস্বর যা শুনতে তার কান প্রায় আজ কতগুলো দিন ধরে উদ্বেগে নির্ঘুম অর্ধরাত কাটায়।

“আমাকে দেখতেই এসেছিলেন তাই না?”

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here