#রংধনুর_আকাশ
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
পর্ব-০৫
১১।
সকালে নাস্তার টেবিলে মাকে না দেখে মাফিন মহুয়াকে বলল,
“মা কি নাস্তা করতে আসবে না?”
মহুয়া ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে বলল,
“মা সকালে উঠেই না খেয়ে অফিসে চলে গেছে।”
মাহাথি মাফিনের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
“গতকাল রাতে তুই ওভাবে রিয়েক্ট না করলেও পারতি।”
মাফিন ক্ষুব্ধ কন্ঠে বললো,
“ভাই, তোমার জন্য আমি মায়ের সাথে ঝগড়া করেছি। এখন তুমিই আমাকে শুনাচ্ছো? প্রেম তুমি করেছো, আমি তো আর করি নি।”
মাফিনের কথাটি শুনে মাহাথি চুপ হয়ে গেল। মহুয়া পরিস্থিতি সামলাতে বলে উঠলো,
“বড় ভাইয়া, তুমি সূচনা আপুকে বাসায় কবে আনছো?”
মাহাথি বলল,
“এখনো সূচনাকে এ ব্যাপারে কিছুই জানাই নি। তবে আজই জানাবো। আর আগামীকাল বাসায় নিয়ে আসতে পারি। এমনিতেও আমার হাতে বেশি সময় নেই। সূচনার বাবা-মা ওর বিয়ে দেওয়ার জন্য অস্থির হয়ে গেছে।”
মারিয়া আনন্দিত কন্ঠে বলল,
“ওয়াও, আমি খুব এক্সাইটেড। ফাইনালি আমার ভাইয়ার বিয়ে হবে। আমি লেহেঙ্গা পড়বো, সাজবো, ছবি উঠাবো।”
মাফিন মারিয়ার মাথায় একটা ঠোকা দিয়ে বলল,
“বান্দরবান কি যাচ্ছিস না?”
মারিয়া কথাটি শুনে নড়েচড়ে বসলো। তারপর ব্যস্ত কন্ঠে বলল,
“তুমি মাকে কবে রাজি করাচ্ছো?”
মহুয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“মা ভাইয়ার উপরই রেগে আছে। আর তুই ভাবছিস, তোর ট্যুরের ব্যাপারে রাজি হয়ে যাবে? কখনোই না।”
মারিয়া চোখ ছোট করে বলল,
“সকাল সকাল তোর মুখ দিয়ে এমন অশুভ কথা কিভাবে বের হয়!”
মারিয়া এবার মাফিনের দিকে তাকিয়ে বলল,
“মেজ ভাইয়া, তুমি মাকে রাজি করাবেই করাবে। আমি এর বেশিকিছু জানি না।”
তারপর মাহাথির দিকে তাকিয়ে বললো,
“ভাইয়া তুমি আর মিষ্টি আপু হানিমুনে কোথায় যাবে? আচ্ছা শুনো, নেপাল, মালেশিয়া, থাইল্যান্ড, কোরিয়া আর সুইজারল্যান্ড এসব দেশে গেলে আমাকে সাথে করে নিয়ে যেও। আমি তোমাদের একদম বিরক্ত করবো না। প্রমিজ।”
মাফিন চাপা স্বরে বললো,
“আগে কবুল বলে বিয়েটা নিশ্চিত করুক, আর এই মেয়ে আছে হানিমুন নিয়ে।”
মহুয়া চেয়ারে বসে গালে হাত দিয়ে মারিয়ার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। মহুয়ার তাকানো দেখে মারিয়া মুখ বাঁকিয়ে বললো,
“ওভাবে কি দেখছিস?”
“দেখছি, আশেপাশে অলীক স্বপ্ন দেখা মানুষও আছে।”
মারিয়া চেঁচিয়ে বলল,
“সোজা বাংলায় বল। তোর এসব কঠিন কথাবার্তা বুঝি না আমি।”
“অলীক স্বপ্ন অর্থ কি জানিস না? তুই স্কুল পাশ করেছিস কিভাবে? বাংলাতে এ প্লাস কিভাবে পেয়েছিস?”
মারিয়া চেয়ার ছেড়ে উঠে গিয়ে বলল,
“আমি জিনিয়াস তাই। তোর মতো সারাদিন বই নিয়ে বসে থেকে আমি আমার জীবন নষ্ট করতে চাই না। আর সারাদিন বই পড়লে নিজেকে নিয়ে ভাববি কবে? একটু জানালা খুলে দেখ, প্রকৃতি তোর এসব বইয়ের পাতার চেয়েও সুন্দর।”
মহুয়া শীতল কন্ঠে বলল,
“বইয়ের প্রতি পাতায় যা লেখা আছে, তা বোঝার জ্ঞান তুই রাখিস না। আসলে তুই এখনো বই পড়ার আসল মজাটাই পাস নি। পেলে এসব কথা বলতি না।”
মাফিন এবার চেঁচিয়ে বলল,
“ওহ আল্লাহ। তোদের ঘাড়ে কি জ্বিন চেপে বসেছে? সারাদিন এভাবে টম এন্ড জেরির মতো যুদ্ধ করিস কেন? যা এখান থেকে। শান্তিতে নাস্তাটাও করতে দিচ্ছিস না। আর বেশি চেঁচামেচি করলে কিন্তু ট্যুর ক্যান্সেল।”
মারিয়া বিস্ফোরিত চোখে মাফিনের দিকে তাকিয়ে কাঁদোকাঁদো কন্ঠে বললো,
“তোমরা কেউ আমাকে ভালোবাসো না। সবাই মহুয়াকে ভালোবাসো। কিছু হলেই আমার ট্যুর ক্যান্সেল হয়, কেউ তো একবারো মহুয়াকে বলে না ওর বাতিঘর যাওয়া বন্ধ। ওর বই কেনার টাকা কেটে যাবে! সবাই শুধু আমাকেই শাসন করো।”
মাফিনকে কিছু বলতে না দিয়ে মারিয়া হনহন করে তার রুমে চলে গেল।
১২।
শুকনো কাপড় ছাদ থেকে নামাতে গিয়ে পাশের বাড়ির দুই প্রতিবেশী মহিলার কথোপকথন শুনে থমকে গেল সূচনা।
তারা বলছে,
“ইলিয়াস ভাইয়ের মেয়ের হয়তো কোনো সমস্যা আছে। তা না হলে বুড়ি হয়ে যাচ্ছে এখনো বিয়ে দিচ্ছে না কেন?”
“আরেহ ভাবী, নিশ্চিত কোনো অবৈধ সম্পর্ক আছে। আর ছেলেপক্ষ হয়তো এখন মেনে নিচ্ছে না।”
“একবার দেখেছিলাম, ওকে একটা বড় গাড়ি থেকে নামতে। বড় লোকের ছেলে হাত করেছে, ভাবী।”
তাচ্ছিল্যের সুরে অপরজন বলল,
“এদের নুন আনতে পান্তা ফুরানোর দশা। আবার স্বপ্ন দেখে আকাশ-কুসুম।”
সূচনা চুপচাপ কাপড় নিয়ে নামতে যাবে তখন তাদের মধ্যে একজন মহিলা বললেন,
“আরেহ, সূচনা যে, কি অবস্থা তোমার? বিয়ে-শাদি কি করবে নাকি কোনো সমস্যা আছে?”
সূচনা শীতল কন্ঠে বললো,
“সমস্যা আছে বলতে কি বোঝাতে চাইছেন?”
“ওই যে মেয়েলী কতো সমস্যা আছে না? ভাবলাম, তুমিও হয়তো..”
সূচনা ভদ্র মহিলাকে থামিয়ে দিয়ে বললো,
“অন্যের ঘরে কান না পেতে নিজের ঘরে চোখ রাখুন। আপনার ছোট মেয়েটাকে সেদিন দেখলাম স্কুলের বাইরে থেকে কোথায় যেন চলে গেছে। কার সাথে গেছে তা তো জানি না। তবে ছেলেটা দেখতে ভালো। ওর বয়সী মেয়েদের আবার সুন্দর ছেলে দেখলে মাথা খারাপ হয়ে যায়! সেই মাথা খারাপটা না আবার আপনার ঘর খারাপ করে দেয়, সেদিকে কিন্তু খেয়াল রাখবেন।”
মহিলাটি কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। তারপর তার পাশের মহিলাটির দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করে বলল,
“আরেহ, তুমিও না খুব সন্দেহ করো। আমার বোনের ছেলে রিমন আছে না? ও গেছে হয়তো মিতুকে আনতে। আসলে আমিই পাঠিয়েছিলা ওকে।”
সূচনা অবাক কন্ঠে বলল,
“তাই? তা আপনি স্কুল ছুটির আগেই কেন পাঠালেন? তখন তো মাত্র স্কুল শুরু হয়েছিল! একটু দেরী করে পাঠাতেন! প্রথম ক্লাসটা করে যেতে পারতো।”
ভদ্র মহিলা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। সূচনাও উত্তর না পেয়ে সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে ছাদ থেকে নেমে পড়লো।
যতোই নিজেকে শক্ত রাখুক, কিন্তু মন থেকে সূচনা একেবারেই ভেঙে পড়েছে। রুমে এসে কাপড়গুলো বিছানায় ফেলে সে ধপ করে মেঝেতে বসে পড়লো। আজ দুই দিন হয়ে যাচ্ছে মাহাথি একটা কলও দেয় নি। মাহাথি কি সত্যিই তার মাকে জানাবে, নাকি শুধু শুধুই তাকে আশা দিয়ে যাচ্ছে? কেন জানি এখন আর মাহাথির কথা সূচনার বিশ্বাস হচ্ছে না? আশেপাশের মানুষগুলো যখন তাকে বলে, মাহাথি তার মতো নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়েকে কেন বিয়ে করবে? সে তো বড় ঘরের ছেলে, তার কিসের অভাব? সে হয়তো ভালো ঘরের মেয়েকেই বউ করে আনবে, তখন সূচনার বুক ফেটে কান্না চলে আসে। কিন্তু কাঁদতে পারে না। নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে হলেও আত্মসম্মানবোধ তার যথেষ্ট আছে। তাই এভাবে কান্নাকাটি করে সে কারো সামনে নিজেকে ছোট করতে চায় না।
মাহাথির কথা মনে পড়তেই সূচনার চোখের কোণা ভিজে গেল। সে ফোন হাতে নিয়ে একবার দেখলো মাহাথির কল এসেছে কিনা। কিন্তু সে হতাশ হলো।ফোন দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে সে বিছানা থেকে একটা বালিশ নিয়ে মেঝেতে শুয়ে পড়লো।
সূচনা মেঝেতে বিছানা করেই ঘুমায়। এক বছর হচ্ছে তার খাটের দুই পায়া ভেঙে গেছে। এখনো মেরামত করা হয় নি। সংসারের যে এতো খরচ, এসব ছোটখাটো মেরামত করানো সেখানে বিলাসিতা। ছোট ভাইকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে হচ্ছে, যার ফলে অর্ধেক টাকা সেখানেই খরচ হয়ে যাচ্ছে। এতো কিছুর পর যা বাকী থাকে তা মায়ের হাতে তুলে দেয়। নিজের জন্য কিছুই অবশিষ্ট রাখে না। খুব প্রয়োজন হলে মায়ের কাছ থেকে চেয়ে নেয়। কিন্তু সূচনার মা-বাবা এসব চান না। তাদের একটাই ইচ্ছে মেয়ে বিয়ে করে সংসারী হোক। কিন্তু তাদের সেই ইচ্ছেটা সে পূর্ণ করতে পারছে না।
সূচনা আর মাহাথির প্রেমের সম্পর্ক শুরু হয়েছিল দশ বছর আগে। তবে তারা একে অপরকে আরো আগে থেকেই চিনতো। মাহাথি তখন মাত্র কলেজে ভর্তি হয়েছিল। সে খুব ভালো ছাত্র হওয়ায় তার বন্ধুর এক বোনকে পড়ানোর দায়িত্ব পড়েছিল তার উপর। আর সেই মেয়েটির বান্ধবী ছিল সূচনা।
একদিন পড়ার ফাঁকেই তার বন্ধুর বোন, রিম তাকে বলল, তার এক বান্ধবীর নাকি গণিতে কিছু সমস্যা আছে। কিন্তু সামর্থ্য না থাকায় সে বাসায় শিক্ষক রাখতে পারছে না। আর স্কুলেও তাদের ভালোভাবে পড়ানো হয় না। কোনো শিক্ষকের কাছে বুঝিয়ে নিতে গেলেই তারা বলে ব্যাচ পড়তে। আর ব্যাচে গেলে বলে আগে টাকা দিয়ে ভর্তি হতে। যার ফলে তার পড়াশুনাও আগাচ্ছে না।
মাহাথি সব শুনে রিমকে বলল, সূচনাকে তার কাছে নিয়ে আসতে। আর সে কোনো বেতন নেওয়া ছাড়াই সূচনাকে পড়াবে। সূচনা তখন সপ্তম শ্রেণিতে পড়তো।
প্রথম প্রথম মাহাথি রিমের বাসায় সূচনাকে পড়িয়েছিল। কিন্তু রিমের বাবা-মার এটা পছন্দ হচ্ছিল না। তাই এরপর থেকে মাহাথি সূচনাকে তার বাসায় গিয়ে পড়াতো। কয়েকদিন পড়ানোর পর সূচনার বাবা ইলিয়াস হোক জানিয়ে দেন, সে এভাবে বিনা টাকায় মেয়েকে পড়াশুনা করিয়ে ঋণগ্রস্ত হতে চান না। মাহাথি যখন বলল, তার এতে সমস্যা নেই। তখন ইলিয়াস সাহেব মাহাথিকে সন্দেহ করা শুরু করলেন। তাই শেষমেশ সূচনাকে পড়ানোও সেখানেই থেমে গেল। তবে সূচনা মাঝে মাঝে মাহাথির কলেজের সামনে চলে আসতো পড়া বুঝিয়ে নেওয়ার জন্য। আর মাহাথি পাশের ছোটখাটো রেস্তোরাঁয় বসিয়ে তাকে পড়া বুঝিয়ে দিতো। এভাবেই ধীরে ধীরে তাদের সম্পর্কটা বন্ধুত্বে পরিণত হয়ে যায়। আর স্বভাবতই ছেলে মেয়ে কখনো বন্ধু হতে পারে না।
বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ বলেছিলেন,
“ছেলে আর মেয়ে বন্ধু হতে পারে কিন্তু তারা অবশ্যই প্রেমে পড়বে। হয়তো খুবই অল্প সময়ের জন্য অথবা ভুল সময়ে। কিংবা খুবই দেরিতে, আর না হয় সব সময়ের জন্য। তবে প্রেমে তারা পড়বেই।”
এমনটা শেক্সপিয়রও বলেছিলেন,
“একজন ছেলে কখনো একজন মেয়ের বন্ধু হতে পারে না, কারণ এখানে আবেগ আছে, দৈহিক আকাঙ্খা আছে।”
ঠিক তেমনি তাদের কথা সত্য প্রমাণ করে দিয়েছিল মাহাথি আর সূচনা। তারা একে অপরের প্রেমে পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু কখন প্রেমে পড়েছিল, সেটা আর তাদের খেয়াল ছিল না।
তবে সূচনার তখন আবেগের বয়স ছিল। আর মাহাথির মস্তিষ্কে গেঁথে ছিল তার মায়ের উক্তি, যা-ই করো, প্রেম করতে পারবে না। কারণ তিনি প্রেমের সম্পর্ক মেনে নেবেন না।
কিন্তু প্রেম নামক রোগটা যখন কাউকে পেয়ে বসে, তখন এতো সহজে এর পিছু ছাড়া যায় না। হয় এই রোগ রোগীদের সব অসুখ চিরতরে সারিয়ে দেবে, নয় সবকিছু নিয়েই ডুবে মরবে।
এদিকে অতীতের ভাবনা থেকে বের হয়ে সূচনা মেঝে থেকে উঠে বসলো। একটু ঘুমাবে ভেবেছিল, সেখানেও মাহাথির ভাবনা তার পিছু নিয়েছে। সে মনে মনে আক্ষেপের সুরে বলল,
“মাহা, তুমি কেন আমার জীবনে এলে?”
চলবে-