#রংধনুর_আকাশ
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
পর্ব-১০
২০।
কাঠের ব্রিজে হেলান দিয়ে মনোযোগ দিয়ে সমরেশ মজুমদারের সাতকাহন বইটি পড়ছে মহুয়া। মৃদুমন্দ বাতাসের তালে তার খোলা চুলগুলো দোল খাচ্ছে। মারিয়া দূর থেকে মহুয়ার একটা ছবি তুলে ফেইসবুকে আপলোড করে দিলো। আর ক্যাপশনে লিখলো, বই যখন হয় বালিকার প্রথম প্রেম।
মহুয়ার আলাদা কোনো ফেইসবুক একাউন্ট নেই। সে মারিয়ার ফেইসবুক একাউন্টাই ব্যবহার করে। আর মহুয়া তার কিছু কাছের বান্ধবীদের সাথেই এই একাউন্টে যুক্ত। তারা অবশ্য জানে এটা মারিয়ার একাউন্ট। তবে দুই বোনই তাদের শখের ছবিগুলো পাব্লিকে পোস্ট করে। কিন্তু ব্যক্তিগত ছবিগুলোতে প্রাইভেসি থাকে।
এদিকে বাস আবার নীলগিরির উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলো। তবে তারা মাঝপথে আধাঘন্টার জন্য বাস থামিয়ে চিম্বুক পাহাড় ঘুরে আসলো, আর সেখানের কাছাকাছি একটা ক্যাফেতে বসে দুপুরের খাওয়া দাওয়া সারলো। এরপর আবার তাদের যাত্রা শুরু হলো। এবার নীলগিরির কিছু আগে ভিউ পয়েন্ট নামক একটা জায়গায় তারা নামলো।
জায়গাটা সবারই খুব পছন্দ হয়েছে। সেখানে দাঁড়িয়ে দেখা যায় সবুজের মাঝে সাদা মেঘের হাতছানি।
মারিয়া ভিউ পয়েন্টের এক কোণায় দাঁড়িয়ে হঠাৎ চিৎকার করে উঠলো। তারপর দুই হাত প্রসারিত করে উঁচু গলায় বলল,
“এই মুহূর্তটাই আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্ত।”
এদিকে নিবিড় একটু দূরে দাঁড়িয়ে এক দৃষ্টিতে মারিয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। আর মনে মনে বললো,
“আমার কাছেও এই মুহূর্তগুলো সবচেয়ে সুন্দর। কারণ যেখানে তুমি আছো, সেখানে কোনো কিছুই অসুন্দর নয়।”
বিকেলে তারা নীলগিরি এসে পৌঁছালো। এখানে ভীড়ের পরিমাণ একটু কম। তাই জায়গাটা মহুয়ার খুব পছন্দ হয়েছে। সে বসে বই পড়ার জন্য একটা জায়গা খুঁজে নিলো। এদিকে মারিয়া তার বান্ধবীদের সাথে নীলগিরির সৌন্দর্য দেখায় ব্যস্ত হয়ে গেলো।
এখান থেকে মেঘগুচ্ছ আরো ভালোভাবেই বোঝা যাচ্ছে। পাহাড় থেকে নিচের দিকে তাকালো শুধু মেঘ আর মেঘ। অন্য কিছুর চিহ্নও বোঝা যাচ্ছে না। হয়তো বিকেল হয়ে যাওয়ায় জায়গাটা অনেকটা কুয়াশার মতো ধোঁয়াশা মনে হচ্ছিলো। ঠিক দুপুরে এই স্থানের অন্য রূপও থাকতে পারে।
মারিয়া শুনেছে প্রকৃতি তার রূপ পালটায় প্রতি ঘন্টায়। কথাটা সে আগে বিশ্বাস না করলেও, এখন বিশ্বাস করে। কারণ সে আগের দিন বিকেলে নীলাচলের এক রূপ দেখেছে, আর আজ ভোরে অন্য রূপ দেখেছে। ঠিক তেমনি এই স্থানেরও ভিন্ন রূপ থাকতে পারে। আর মারিয়া চাইছে সেই ভিন্ন ভিন্ন রূপগুলো দেখতে। অথচ তার পক্ষে এটা একদমই অসম্ভব। কারণ আজই তাদের হোটেলে ফিরতে হবে।
অন্যদিকে প্রিয়াও সেই মুহূর্তে নীলগিরিতেই ছিল। আর ভাগ্যক্রমে সে মেয়েটিকে খুঁজেও পায়, যাকে সে মেঘলাতে দেখেছিল। প্রিয়া আর এক মুহূর্তও দেরী করলো না। সে তাড়াতাড়ি মেয়েটির কাছাকাছি এসে দাঁড়ালো। কিন্তু কিভাবে কথা বলা শুরু করবে সে বুঝতে পারছিলো না। সে মনে মনে কথা গুছিয়ে নিতে লাগলো। কিন্তু যখনই সে কথা বলতে যাবে তখনই মেয়েটিকে দুটি মেয়ে টেনে নিয়ে গেলো অন্যপাশে। তবে প্রিয়া এতোটুকু বুঝেছে মেয়েটিও তার মতো কলেজ থেকেই এসেছে। কারণ তাদের সবার মাথায় একই রঙের ক্যাপ। তাই সে মনে মনে ভাবলো,
“আজ যদি ভাইয়ার মায়াবিনীর সাথে কথা বলতে নাও পারি, তবুও আমাকে তার নাম-পরিচয় জানতেই হবে। নয়তো ভাইয়া আশাহত হবে। আর সরাসরি কথা বলতেও একটা বিশেষ কারণ দরকার। আর এখন যদি সেই কারণটা খুঁজে পাওয়ার আগেই সে আবার হারিয়ে যায়? তাই এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি ভালো হবে, তাদেরই একজনকে মায়াবিনীর পরিচয় জিজ্ঞেস করা।”
মূলত কোনো এক অজানা কারণে প্রিয়ার সাহস হচ্ছিলো না তার ভাইয়ের মায়াবিনীর সাথে কথা বলার। যখন থেকেই প্রহর তাকে বলেছে বাতিঘরে গিয়ে সুযোগ বুঝে তার মায়াবিনীর পরিচয় জেনে আসতে, তখন থেকেই প্রিয়া মানসিক চাপে ছিল। তাই হঠাৎ বান্দরবান এসে প্রহরের মায়াবিনীকে খুঁজে পাওয়া তার কাছে অলৌকিক ঘটনা মনে হয়েছে। সে ধরে নিয়েছে, সৃষ্টিকর্তা তার কাজ সহজ করতেই মায়াবিনীর সাথে তার এখানেই দেখা করিয়ে দিয়েছে।
প্রিয়া অনেক কিছু ভাবার পর তার কাছেই দাঁড়ানো একটি মেয়েকে দেখলো যে এতোক্ষণ একপাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছিল। আর মেয়েটিও মায়াবিনীর মতোই একটি ক্যাপ পরেছে।
প্রিয়া এবার মনে সাহস নিয়ে মেয়েটির কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“হাই আপু, একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে পারি?”
মেয়েটি তার ফোন থেকে চোখ সরিয়ে প্রিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, “জি, বলুন।”
“আমি প্রিয়া। আমাদের এখানে কলেজ থেকে এনেছে।”
মেয়েটি ভ্রূ কুঁচকে বললো, “আচ্ছা!”
প্রিয়া এবার বলল,
“আপনারাও কি কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে এসেছেন, নাকি নিজেরাই এসেছেন?”
“না, আমরাও কলেজ থেকে এসেছি।”
প্রিয়া তার কলেজের নাম বলার পর জিজ্ঞেস করলো,
“কোন কলেজ থেকে এসেছেন?”
মেয়েটিও তাদের কলেজের পরিচয় দিলো। এরপর প্রিয়া একটার পর একটা প্রশ্ন করে মেয়েটিকে সহজ করে ফেললো। প্রথমে সে তাদের কলেজের বিভাগ ও বর্ষ জেনে নিলো। তারপর নিজের কলেজ নিয়ে অনেক কথাবার্তা বলার পর, কলেজ থেকে কিভাবে বান্দরবান আসার পরিকল্পনা করেছিলো সেটি বললো। অন্যদিকে মেয়েটিও অনেক মনোযোগ দিয়ে প্রিয়ার কথা শুনছিলো। পাশাপাশি কিভাবে তারা এই জায়গাটিই পিকনিকের জন্য নির্বাচন করেছিলো, সেই গল্পটিও বললো।
মোটামুটি অনেক কথা বলার পর প্রিয়া একজনকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“আচ্ছা আপু ওই মেয়েটাও কি আপনাদের সাথে?”
মেয়েটি বলল,
“হ্যাঁ, ও আমাদেরই ক্লাসের।”
“কি নাম আপুটার?”
“মারিয়া নাওয়াল।”
“আচ্ছা।”
প্রিয়া মুচকি হেসে মেয়েটির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলো। আর মনে মনে বললো,
“কি ভাগ্য! ভাবীর নামটাও জেনে এলাম, আর ভাবীর মুখোমুখিও হতে হলো না। এখন তো সেদিনই ভাবীর মুখোমুখি হবো, যেদিন ভাইয়ার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যেতে পারবো।”
প্রিয়ার আর তর সইছে না। সে সাথে সাথেই প্রহরকে ফোন দিয়ে বললো,
“ভাইয়া, আমি তো একটা মিশন কমপ্লিট করে ফেলেছি!”
কথাটি শুনেই প্রহরের বুকটা ধক করে উঠলো। উত্তেজনায় বলে উঠলো,
“তাড়াতাড়ি বল! ওর নাম জানতে পেরেছিস?”
প্রিয়া আক্ষেপের সুরে বলল,
“শেষমেশ বোনের বয়সী একটা মেয়েকেই তোমার পছন্দ হলো!”
“মানে!”
“ভাইয়া, ভেবে দেখ। ভাবীর পড়াশোনা শেষ হতে হতেই তুই বুড়ো হয়ে যাবি। আর আজকালকার মেয়েরা চার-পাঁচ বছরের বেশি বড়ো ছেলেদের বিয়ে করতে চাই না।”
প্রহর এবার রেগে গিয়ে বলল,
“আমার কিন্তু এবার মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে। সোজাসাপটা কথা বল।”
“ভাইয়া, শান্ত হ। তোর মায়াবিনী এখনো কলেজে পড়ে। আর নাম কি জানিস? মারিয়া নাওয়াল। মিষ্টি না নামটা?”
প্রহর মনে মনে হাসলো। আর বলল,
“হুম, খুব মিষ্টি একটা নাম।”
আজ প্রহরের মনে আনন্দ বয়ে যাচ্ছে, কারণ আজ সে তার প্রেয়সীর নাম জানতে পেরেছে। প্রহর এখন ভাবছে,
“মায়াবিনী, আমি এখন তোমার এই পরিচয় ধরেই তোমার কাছে যাবো।”
এদিকে সন্ধ্যার আগেই সবাই আবার হোটেলের উদ্দেশ্য যাত্রা করলো। হোটেলে ফিরতে ফিরতেই তাদের অনেক রাত হয়ে গেলো।
আর এর পরেরদিনই তারা সকালে নাস্তা করেই দেবতাখুমের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। আনুমানিক দুই ঘন্টার মধ্যেই তারা তাদের গন্তব্যে পৌঁছে গেল।
এই জায়গায় এসে মহুয়া বুঝতে পারলো এখানে তার বই পড়ার পরিবেশ নেই। তাই সে এবার মারিয়ার পিছু পিছু হাঁটতে লাগলো। দুই একজন মহিলা শিক্ষক ছাড়া বেশিরভাগই তাদের সাথে আসেন নি। মহুয়া চাইলে তাদের সাথেই থেকে যেতে পারতো। কিন্তু মারিয়াকে এমন জায়গায় একা ছেড়ে দেওয়ার জন্য তো সে এখানে আসে নি। তাই বোনের দিকে নজর রাখতেই সে এই জায়গায় এসেছে।
তারা সবাই খালিপায়ে ঝিরিপথ পাড়ি দিয়ে সামনে এগুতো লাগলো। শীতল হওয়া, শান্ত পরিবেশের পাশে যোগ হয়েছে ঝিরিপথ ধরে বয়ে চলা পানির কলকল ধ্বনি।
একদিকে সবাই যার যার গন্তব্যে যাওয়ার দিকেই মনোযোগী। অন্যদিকে মহুয়া সেই কলকল ধ্বনি শুনতে ব্যস্ত।
ঝিরিপথ পাড় করে, তারা উঁচু নিচু রাস্তা ধরে একটা পাড়ায় চলে এলো। এখানে এসে তারা দুপুরের খাওয়া-দাওয়া সারলো।
মহুয়া অবাক দৃষ্টিতে তার চারপাশ দেখতে লাগলো। বেড়া ও মাটির তৈরী ঘর, সাথে বাঁশ-বেত ও খড়ের ছাউনি দেওয়া বাড়িগুলো তাকে খুব আকর্ষণ করছে।
সে মারিয়ার কাছে এসে বললো
“মারু, মনে হচ্ছে আমি এক স্বপ্নের দেশে এসেছি। এতো সুন্দর এখানের পরিবেশ!”
মারিয়া হেসে বললো,
“দেখেছিস, তাই তো এখানে আসার জন্য এতো যুদ্ধ করেছিলাম। আর এটা তো কিছুই না। একটু পর এমন এক জায়গায় যাবো, যা দেখে তোর চোখ ঝলসে যাবে।”
মহুয়া হেসে বললো,
“ভাবছি কি আমি বাসায় ফিরে একটা ভ্রমণ গল্প লিখবো।”
“কি লিখবি সেই গল্পে? পুরো সময় তো চাঁদের পাহাড় আর সাতকাহন নিয়েই বসে ছিলি।”
“এর মাঝেও আমি প্রকৃতিকে দেখেছি। আর সেটাই লিখবো। আর সাথে তোর ফোনের ভিডিওগুলো দেখে কিছু আইডিয়া নিবো।”
“বেশ তো! এখন চল।”
দুই পাশে পাহাড় আর মাঝখানে ভেলায় ভাসছে মারিয়া ও মহুয়া।
মহুয়া মুগ্ধ দৃষ্টিতে তার চারপাশ দেখছে। আর মারিয়া গান ধরলো কন্ঠে।
“ভাগ্য আমায় ছোবল মারে
রক্তে বিষের জ্বালা,
তুমি আমার আঁধার রাতে
একশো তারার মালা
তোমার আমার এই কাহিনি।
হাজার বছর ধরে
ভালোবাসার গান শোনাবে
প্রাচীন কোনো সুরে।
ও বেহুলা, আমি মরলে
আমায় নিয়ে ভাসাইও ভেলা।”
মারিয়ার গান শুনে তার বান্ধবীরা হাসতে লাগলো। তারা বারবার মারিয়াকে চুপ করতে বলছিল। কারণ মারিয়ার কন্ঠ ভালো হলেও সে ভালোভাবে সুর দিতে পারে না। কিন্তু অন্যদিকে নিবিড় সেই সুরহীন গানটিও খুব মনোযোগ দিয়েই শুনছিল। বরং তার ভালোই লাগছিল শুনতে।
চলবে-