রংধনুর_আকাশ #লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ পর্ব-১৩

0
772

#রংধনুর_আকাশ
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
পর্ব-১৩

২৪।
এলোমেলো ঘর, বিছানায় ঝুলছে কাপড়চোপড় আর সেই কাপড়ের কিছু অংশ মেঝেতেও ছড়িয়ে রয়েছে। সেখানে আরো স্থান পেয়েছে পেপারের টুকরো ও রঙিন কাগজ। টেবিলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখা বইপত্র ও আলনায় ঝুলে থাকা বহুদিনের বাসি কাপড় ঘরটিকে বানিয়ে ফেলেছে একটা শরণার্থী শিবির। আর সেই শিবিরের একমাত্র শরণার্থী স্বস্তিকা তালুকদার। সে বিছানায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কাপড়ের উপরেই হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে। তার ঘরে থাকা সাউন্ড বক্সে চলছে গান।

“তারে ধরি ধরি মনে করি,
ধরতে গেলেম আর পেলেম না।
দেখেছি, দেখেছি রূপসাগরে মনের মানুষ কাঁচা সোনা।
বহুদিন ভাবতরঙ্গে, ভেসেছি কতই রঙ্গে
বহুদিন ভাবতরঙ্গে, ভেসেছি কতই রঙ্গে
সুজনের সঙ্গে হলো দেখাশোনা।
তারে আমার আমার মনে করি
আমার হয়ে আর হইলো না।
দেখেছি রূপসাগরে মনের মানুষ কাঁচা সোনা।।
.
সে মানুষ চেয়ে চেয়ে ঘুরিতেছে পাগল হয়ে
সে মানুষ চেয়ে চেয়ে ঘুরিতেছে পাগল হয়ে।
মরমে জ্বলছে আগুন আর নিভে না,
আমায় বলে বলুক লোকে মন্দ
বিরহে প্রাণ আর বাঁচে না
এখন বলে বলুক লোকে মন্দ
বিরহে প্রাণ আর বাঁচে না
দেখেছি রূপসাগরে মনের মানুষ কাঁচা সোনা।
পথিক কয় ভেবো নারে, ডুবে যাও রূপসাগরে
পথিক কয় ভেবো নারে, ডুবে যাও রূপসাগরে
বিরলে বসে করো যোগসাধনা
একবার ধরতে পেলে মনের মানুষ চলে যেতে আর দিওনা,
একবার ধরতে পেলে মনের মানুষ চলে যেতে আর দিওনা।
দেখেছি রূপসাগরে মনের মানুষ কাঁচা সোনা
দেখেছি রূপসাগরে মনের মানুষ কাঁচা সোনা
তারে ধরি ধরি মনে করি
ধরতে গেলেম আর পেলেম না।
দেখেছি রূপসাগরে মনের মানুষ কাঁচা সোনা
দেখেছি রূপসাগরে মনের মানুষ কাঁচা সোনা।”

হঠাৎ গান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় স্বস্তিকা মুখের উপর থেকে কাপড় সরিয়ে মাথা তুলে দেখলো তার মা, মিসেস ফাতেমা জান্নাত কোমরে হাত দিয়ে তার দিকে ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। স্বস্তিকা মাকে দেখে ঠোঁটে এক চিলতে হাসি নিয়ে বলল,
“আম্মিজান, আপনি এতো কষ্ট করে আমার ঘরে এলেন কেন? আমাকেই না হয় ডাকতেন।”

মিসেস ফাতেমা জান্নাত মুখে হাসি নিয়ে বললেন,
“আম্মিজান, আমি এই মুহূর্তে এই ঘরে না এলে কি আপনার বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে জানতে পারতাম?”

স্বস্তিকা ধরা পড়া চোরের মতো এক গাল হেসে বলল,
“আম্মিজান, আমি আজ অনেক কাজ করেছি। তাই ভাবছিলাম একটু বিশ্রাম নিয়ে এই রুমটা গুছিয়ে নেবো।”

“তা আপনার ভাবনা ক’দিন পর বাস্তবায়িত হতো?”

“কয়েক মিনিটের মধ্যেই।”

মিসেস ফাতেমা এবার মাথা নাড়াতে নাড়াতে বললেন,
“থাক মা, আর মিথ্যে বলতে হবে না। এতো মিথ্যে কথা বললে মিথ্যে কথা বলাটাই অভ্যাস হয়ে যাবে। তারপর শ্বশুড় বাড়িতেও তোমার মিথ্যে কথাগুলোই রটবে।”

“আম্মিজান, আপনি বার-বার শ্বশুড় বাড়ির কথা কেন বলতে থাকেন? আমি কিন্তু বিয়ে করছি না। এটাই আমার বাবার বাড়ি। আর এটাই…”

মিসেস ফাতেমা জান্নাত স্বস্তিকাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন,
“এটাই যে তোমার শ্বশুড় বাড়ি হবে, তা নিয়ে স্বপ্ন দেখো না। তোমার আব্বা যতোই বলুক তোমাকে এই বংশে বিয়ে দেবে, মেয়েকে নিজের কাছে রেখে দেবে। তা আমি কখনোই মেনে নেবো না। আপনজনদের মধ্যে আত্মীয়তা করা আমি মোটেও পছন্দ করি না। জা, ননদ, ভাই-বোন তারা তাদের নিজ নিজ স্থানে ঠিকই আছে, তাদের বেয়াই-বেয়াইনের স্থান দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়।”

“আম্মিজান, আমি আপনার একমাত্র মেয়ে। আমার কোনো ভাই-বোনও নেই। আমার কিছু হলে আপনারাই কষ্ট পাবেন।”

“হয়েছে হয়েছে। আর আহ্লাদী সুরে কথা বলতে হবে না। বিছানা ছেড়ে উঠো। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই রুম পরিষ্কার করে রান্নাঘরে আসবে। আজ নয় কাল বিয়ে তো হবেই। রান্নাবান্না শিখতে হবে তো নাকি? শাশুড়ী কিন্তু তোমাকে রান্না শেখাবেন না। উলটো কথা শুনিয়ে দেবেন।”

স্বস্তিকা বিছানা ছেড়ে উঠে মায়ের হাত ধরে বলল,
“আর সেই শাশুড়ি আম্মা যদি আমার বড় খালাম্মা হোন, তাহলে তো আমাকে রোজ রোজ আদর করে ডাকবেন, “ছোট আম্মু উঠো, সকাল হয়েছে।” আর যদি মামীজান হোন, তাহলে প্রতিদিন আমায় আদর করে ভাত মেখে খাইয়ে দেবেন। আর যদি ফুপুজান আমার শাশুড়ি আম্মা হোন, তাহলে তো আমাকে ঘরের একটা কাজও করতে দেবেন না। আর সৌভাগ্যবশত যদি বড় আম্মি বা চাচ্চী আমার শাশুড়ি আম্মা হয়ে যান, তাহলে তো আপনার রাজকন্যা রানী হয়ে থাকবে। আম্মিজান, আপনি কি চান না আমি রানী হয়ে থাকি?”

“তোমার মতো সুখী মানুষগুলোই বিয়ে বা সংসারের মর্ম বুঝে না। এতো সুখ চিন্তা করো না। তাদের একজন যদি তোমার শাশুড়ি আম্মা হয়ে যান তবেই বুঝবে। ছোট আম্মু বলে ঘুম ভাঙানো, ভাত মেখে খাইয়ে দেওয়া এসব রোজ রোজ হয় না, মা। বড় মন থাকলে অতিথিদের আপ্যায়ন দুই মাসও করা যায়, কিন্তু ঘরের বউদের আহ্লাদ এক মাসেই শেষ। তাদের অনেক দায়িত্ব। তুমি এমন সুখী মানুষ হলে সংসারের দায়িত্ব নিতে পারবে না। তখন তোমার ঘর তুমিই নষ্ট করবে। আমরা এর দায়ভার নিতে পারবো না। তাই এখনো সময় আছে। কিছু কাজকর্ম শেখো। নিজের ঘরটা অন্তত গুছিয়ে রাখতে পারো। মা, তুমি এখন বড় হয়ে গিয়েছো। ভার্সিটিতে পড়ছো। দুই বছর পর তোমার পড়াশুনাও শেষ হয়ে যাবে। এরই মধ্যে তোমার বিয়েও হয়ে যেতে পারে। একসাথে পড়াশোনা করা ও সংসার সামলানোর মতো দায়িত্ব নেওয়ার মন-মানসিকতা তোমার থাকতে হবে। তারপরই তো তুমি সুখী হবে।”

স্বস্তিকা মুচকি হেসে চুপচাপ মেঝে থেকে কাগজের টুকরোগুলো ওঠাতে লাগলো। মিসেস ফাতেমা মেয়েকে আর কিছুই বললেন না। তিনি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আবার স্বস্তিকার ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লেন। তিনি বের হওয়ার সাথে সাথেই স্বস্তিকা হাতে থাকা কাগজের টুকরোগুলো হাওয়ায় ছুঁড়ে মারলো। তারপর বিছানা থেকে একটা উড়না নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মাথায় বউদের মতো উড়না টেনে দিয়ে গাইতে লাগল,
“আমি রূপনগরের রাজকন্যা রূপের যাদু এনেছি
ইরান তুরান পার হয়ে আজ তোমার দেশে এসেছি
আমি রূপনগরের রাজকন্যা রূপের যাদু এনেছি।”

গান গাইতে গাইতেই সে আবার গান চালিয়ে দিয়ে বিছানায় ধপ করে শুয়ে পড়লো।

২৫।

আরিয়া ফেরদৌসের মুখোমুখি বসে আছেন ইলিয়াস হক ও ফৌজিয়া ইসলাম। আরিয়া মূলত বিয়ের কথা পাকাপোক্ত করতেই সূচনার বাড়িতে এসেছেন। ইলিয়াস-ফৌজিয়া দম্পতির চোখেমুখে খুশির আমেজ দেখা যাচ্ছে কারণ তাদের বহুদিনের ইচ্ছের পূর্ণতা পেতে যাচ্ছে। এদিকে সূচনা পর্দার আড়ালে লুকিয়ে তাদের কথোপকথন শুনছে। তার মুখেও প্রশান্তির হাসি। সে এক মুহূর্তও দেরী না করে নিজের ঘরে এসে মাহাথিকে ফোন করলো।

এদিকে মাহাথি সূচনার কল দেখেই দোটানায় পড়ে গেল। সে বুঝতে পারছে না সূচনা কেন কল করছে। সে কি তাদের বিয়ের সম্পর্ক পাকাপাকি হওয়ার খুশিতে কল করছে নাকি বিয়ের তারিখ ঠিকঠাক না করাই অসন্তুষ্ট হয়ে কল করছে?
শেষমেশ অনেক দ্বিধা নিয়েই কলটা রিসিভ করলো মাহাথি। কিন্তু ওপাশ থেকে সূচনার আনন্দ ভরা কন্ঠের স্বর শুনে সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।

সূচনা বললো,
“মাহা, জানো আজ বাসায় আন্টি এসেছে আমাদের বিয়ের কথা বলতে। আমার অনেক খুশি লাগছে। শেষমেশ আমাদের এতো বছরের সম্পর্ক পূর্ণতা পেতে যাচ্ছে।”

সূচনা অনেক কথায় বলছে আর মাহাথি উত্তরে শুধু হুম, হ্যাঁ করছিল। তাই এবার সূচনা বিরক্তির সুরে বলল,
“কি হলো? তুমি কি খুশি হও নি?”

মাহাথি হাসার চেষ্টা করে বললো,
“হ্যাঁ, খুশি হবো না কেন? আমি অনেক খুশি হয়েছি। বরং আজ আমি অনেকটাই চিন্তামুক্ত। অন্তত তোমাকে হারানোর চিন্তাটা আর নেই।”

সূচনা নেশা লাগানো হাসি দিয়ে বলল,
“তা মিস্টার মাহাথি ইবনে উম্মী, আপনি কখন পুরোপুরি আমার হবেন?”

মাহাথি সূচনার এমন প্রশ্নে মলিন হাসলো। তবুও গলার স্বর পরিবর্তন করে বলল,
“তা আপনি কখন আবার আমার লজ্জাবতী হবেন?”

“আমি আর লজ্জাবতী হচ্ছি না। এসব লজ্জা পাওয়া-পাওয়ির বয়স শেষ। বিয়ে যেহেতু কচি খুকিকে করছো না, সেহেতু এসব আশাও করতে পারবে না। একটা গান আছে শুনেছো?”

“কোন গান?”

“পরাণের বান্ধব রে বুড়ি হইলাম তোর কারণে..”

মাহাথি হেসে বলল, “তুমি এসব গান শুনো?”

“আরেহ এইটা তো কম-বেশি সবাই শুনেছে।”

“আচ্ছা, আমিও তো শুনেছি। তা তুমি বলতে চাইছো, আমার কারণেই তুমি বুড়ি হয়েছো?”

“হ্যাঁ, আমার কতো স্বপ্ন ছিলো বিয়ে নিয়ে। আর এখন এই বয়সে এসব স্বপ্ন দেখা খুব হাস্যকর।”

“স্বপ্নের কোনো বয়স নেই। আমি আরো এক যুগ পরও তোমাকে নিয়ে সেই পুরোনো স্বপ্নটাই দেখবো। যেই স্বপ্নে তুমি লাল পাড়ের সাদা শাড়ি পরে সবুজ গালিচায় নগ্ন পায়ে হাঁটবে। তোমার মাথায় থাকবে বেলীফুলের মালা আর কানে থাকবে সাদা ঝুমকো। আর আমি তোমার স্নিগ্ধতায় মুগ্ধ হয়ে তোমাকেই দেখতে থাকবো।”

এবার সূচনা মাহাথিকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“আমার স্বপ্নে তুমি রোজ আসবে সাদা পাঞ্জাবি আর পাজামা পরে। আর তোমার হাতে আমার দেওয়া সেই পুরোনো কম দামী ঘড়িটি বাঁধা থাকবে।”

মাহাথি মুচকি হেসে বলল,
“তুমি যখন আমার কাছাকাছি এসে পড়বে, আমি হাত বাড়িয়ে দেবো তোমার হাতের স্পর্শ পাওয়ার লোভে। হঠাৎ তোমার শাড়ির ভাঁজ তুমুল হাওয়ায় এলোমেলো হয়ে যাবে। আর আমি হাঁটু গেড়ে বসবো সেই এলোমেলো শাড়ির কুচি ঠিক করার জন্য।”

সূচনা নেশাখোর কন্ঠে বলতে লাগলো,
“মাহা, আমরা কিন্তু ষাটের পরও এমন স্বপ্ন দেখবো। নাতি-নাতনীদের কিন্তু একদম লজ্জা পাবো না। তুমি তো আবার সাংঘাতিক লাজুক। শুধু আমার প্রেমে পড়ার আগেই লজ্জা হারিয়েছিলে।”

সূচনার নেশালো কন্ঠ যেন মাহাথিকে উন্মাদ করে তুলছিল। ইচ্ছে করছিলো এখনই সেই স্বপ্নগুলো পূরণ করতে, সূচনাকে নিজের করে নিতে। কিন্তু মায়ের সেই শর্তের কথা মনে পড়লেই তার সূচনাকে নিয়ে ভাবতেই অস্বস্তি লাগে। সে তার নিজের প্রেমকে পূর্ণতা দেওয়ার জন্য ছোট ভাইকে বিয়ের জন্য জোর করবে, এটা কেমন যেন বড় ভাই হিসেবে তার নিজেকে ছোট প্রমাণ করার মতো। সে বুঝতে পারছে না, মা কেন এমন শর্ত রেখেছে? এটা কি মাফিনকে বিয়ে দেওয়ার জন্য, নাকি তার প্রেম করার ফলে সেই ভুলের মাশুল দেওয়ার জন্য? মা কি তাকে সূচনার চোখে অপরাধী প্রমাণ করার জন্য এই শর্ত দিয়েছে নাকি মাফিনের দৃষ্টিতে স্বার্থপর প্রমাণ করার জন্য?
মাহাথি আনমনেই হিসেব মেলাতে ব্যস্ত হয়ে গেলো।

চলবে–

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here