রংধনুর_আকাশ #লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ পর্ব-১৪

0
508

#রংধনুর_আকাশ
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
পর্ব-১৪

২৬।
আজ মাহাথি ও সূচনার এনগেজমেন্ট। সূচনাদের এক তলার বাসাটিকে আজ ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে। ইলিয়াস হক তার সামর্থ্য অনুযায়ী অতিথিদের আপ্যায়ন করছেন। অনুষ্ঠান উপলক্ষে ঘরে বিশেষ আলোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। ফৌজিয়া ইসলাম আরিয়া ফেরদৌসকে আত্মীয়দের সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন।
এদিকে মাহাথিকে ঘিরে ধরেছে সূচনার ভাই-বোন ও কাজিনরা। আর দূরে বসে মাহাথির বেগতিক অবস্থা দেখতে দেখতে গ্রোগাসে নাস্তা খেয়ে যাচ্ছে মাফিন। অন্যদিকে মহুয়া তার সমবয়সী মেয়েদের সাথে ভাব জমানোর চেষ্টা করছে, আর মারিয়া তাদের সাথে ভাব জমাতে ব্যর্থ হয়ে স্ট্যান্ড ফ্যানের সামনে বসে হাওয়া খাচ্ছে ও ছবি উঠাচ্ছে।

অনুষ্ঠানে মাহাথির আত্মীয়ের মধ্যে শুধু তার বড় খালা-খালু আর ছোট মামা-মামী এসেছেন। সাথে আরিয়ার ছোটবেলার বন্ধু রিদ্ধ সেনও আছেন। কিন্তু আরিয়া ও মারিয়া অবাক হলো নতুন দুই অতিথিকে দেখে। আর তারা হলো নাহিদ হোসেন ও তার বড় ছেলে নিবিড় হোসেন।

আরিয়া রিদ্ধ সেনকে একপাশে দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
“তুই নাহিদকে কেন এখানে এনেছিস? আর নাহিদের সাথে ছেলেটা কে?”

রিদ্ধ ভাবলেশহীন ভাবে বললেন,
“বন্ধু মানুষ তাই এনেছি। আর ছেলেটা নাহিদের বড় ছেলে, নিবিড়।”

“আমার এতো নাম-পরিচয় জানতে হবে না। আমি শুধু নিকট আত্মীয়দের এখানে নিয়ে এসেছি। মেজ আপাও আসেন নি। তোকে বলেছি ত্রয়ীকে নিয়ে আসতে। আর তুই তোর বউকে না এনে বন্ধুকে নিয়ে এসেছিস।”

“আরেহ, আমার মা, এসেই যখন গিয়েছে, এতো চেঁচাচ্ছিস কেন? তোর এতো কি সমস্যা বুঝি না!”

“আমার সমস্যা আছে।”

“জানি তোর সমস্যা কোথায়?”

“কোথায়?”

“সেই কোন কালে তোকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছিল, আর সেই ক্ষোভ এখনো রেখে দিয়েছিস। মেয়ে মানুষের কতো প্রেমের প্রস্তাব আসে-যায়! এই নিয়ে বসে থাকলে জীবন চলবে?”

“হয়েছে। তুই চুপ করে বসে থাক।”

কথাটি বলেই আরিয়া রাগ দেখিয়ে চলে গেলেন। তার ক্ষোভ তো প্রেমের প্রস্তাব দেওয়ার মাঝে নেই। বরং তার নাহিদের প্রতি কোনো ক্ষোভই নেই। মূলত যেই ভালোবাসার প্রতি আস্থা রেখে তিনি নাহিদের প্রেমকে বর্জন করেছিলেন, সেই ভালোবাসায় তার জীবনে দীর্ঘস্থায়ী হয় নি। তাই নাহিদের সামনে দাঁড়াতেই আরিয়া ইতস্ততবোধ করছেন। কারণ তার মনে হচ্ছে, নাহিদ আড়ালে গিয়ে তাকে নিয়ে হাসাহাসি করবেন।

এদিকে নিবিড়কে দেখে মারিয়া বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেলো। সে মনে মনে বললো,
“এই ব্যাটা এখানে কি করছে? এই ছেলে ভাবীর কোনো আত্মীয় নয় তো?”

নিবিড়ও মারিয়াকে দেখে অবাক হলো। সে মনে মনে ভাবলো,
“মারিয়া কি তাহলে বাবার সেই কলিগের মেয়ে?”

মারিয়া ভ্রূ কুঁচকে কোমরে হাত রেখে বলল,
“তুই এখানে? ব্যাপার কি! ভাবী তোর কি হয়?”

নিবিড় মুচকি হেসে বলল,
“ভাবী তো আমারও ভাবী হয়। কারণ আমি ছেলে পক্ষ থেকেই এসেছি।”

মারিয়া তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো,
“ছেলে পক্ষ! তা তুই আমার ভাইকে কখনো দেখেছিস? মানে ছেলেকেই দেখিস নি বলছিস ছেলে পক্ষ? তা কোন দিক দিয়ে তুই ছেলে পক্ষ হলি?”

“আমার বাবা আন্টির কলিগ। রিদ্ধ আংকেলও আমাদের চেনেন।”

“কলিগ!” এতোদূর? তা তুইও কি কলিগ নাকি? মানলাম আংকেল কলিগ তাই এসেছেন। কিন্তু তোর আসাটা মানতে পারছি না।”

নিবিড় কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,
“মারিয়া, তুমি আমার সাথে একটু সুন্দর করেও কথা বলতে পারো।”

“তোর সাথে আমি অসুন্দর ভাষায় কথা বলতেই সন্তুষ্টবোধ করি।”

কথাটি বলে মারিয়া মুখ বাঁকিয়ে চলে গেলো। এরপর রিং বদল হওয়ার পর সবাই একসাথে খেতে বসলো। কিন্তু নিবিড় খাওয়া বাদ দিয়ে একমনে মারিয়াকে দেখে যাচ্ছে। আর বিষয়টি সকলের চোখ এড়িয়ে গেলেও আরিয়া ফেরদৌসের চোখ এড়ায়নি। তিনি বাসায় ফেরার পর মারিয়াকে আলাদাভাবে তার ঘরে আসতে বললেন।
এদিকে মারিয়া ও মহুয়া দুজনেই চিন্তায় পড়ে গেলো। হঠাৎ মা আলাদাভাবে মারিয়াকে কেন ডেকেছে? মারিয়ার ভয় লাগছে নিজের জন্য। আর মহুয়ার চিন্তা হচ্ছে মারিয়ার জন্য। সে ভাবছে, মা মারিয়ার কোনো ভুল ধরে ফেলে নি তো? আর তাকে সেই ভুলের শাস্তি দেওয়ার জন্য ডাকছে না তো?

স্বাভাবিকভাবেই মারিয়া দিনে ছোটখাটো অনেক ভুল করেই ফেলে। যেমন, দুইদিন আগে কোচিংয়ে বিশেষ ক্লাসের কথা বলে বান্ধবীদের সাথে লিংক রোডে চলে গিয়েছিলো, আর সেখানেই একটা রেস্টুরেন্টে বসে খাওয়া-দাওয়া করেছিল। যদিও বাসায় এসে মাফিনকে সব জানিয়ে দিয়েছিলো। তবুও মা তো জানতো না। এর আগেও একবার বান্ধবীর বাসায় যাওয়ার কথা বলে পতেঙ্গা ঘুরতে গিয়েছিল। এসব ছোটখাটো অনেক কথায় মারিয়া শুধু মহুয়া আর মাফিনকেই জানাতো। তবে মহুয়াকে জানিয়েই মারিয়া এখানে-ওখানে ঘুরতে যেতো। আর বাসায় আসার পরই মাফিনকে জানাতো। তবে মাহাথি আর আরিয়া ফেরদৌসের দৃষ্টিতে মারিয়া চঞ্চল হলেও অনেক বোকা আর দুঃসাহসিক কোনো কাজ করার ক্ষমতা তার মধ্যে নেই।

এদিকে মারিয়া মায়ের ঘরে এসে মাথা নিচু করে বসে রইলো। আরিয়া ফেরদৌস গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলেন,
“নিবিড়কে কিভাবে চেনো?”

নিবিড়ের নাম শুনে মারিয়ার চোখ দুটি গোল হয়ে গেলো, যেন এখনই কোটর থেকে বেরিয়ে আসবে। আরিয়া ফেরদৌস মারিয়ার সামনে এসে বসলেন। তারপর আবার বললেন,
“আজই কি তোমাদের প্রথম দেখা হয়েছে?”

মারিয়া মনে মনে ভাবলো, মা যেহেতু প্রশ্ন করছে তাহলে অবশ্যই সব তথ্য নিয়েই জিজ্ঞেস করতে বসেছে। হয়তো মা জানতে চাইছে, সে কোনো উত্তর গোপন করে কি না।

মারিয়া মনে মনে বলল,
“এটাই সুযোগ মায়ের চোখে ভালো মেয়ে হওয়ার। এখন আমি যদি নিবিড়ের সব তথ্য মাকে সঠিকভাবে জানিয়ে দেই, তাহলে মা ভাববে আমার মেয়ে কতো ইনোসেন্ট। একদম লক্ষী বাচ্চা একটা! আর যদি গোপন করি, তাহলে ওই ব্যাটার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক না থাকলেও মনে করবে সম্পর্ক আছে।”

মারিয়া বোকা বোকা হাসি দিয়ে বলল,
“প্রথম কেন দেখবো? ওই ছেলেটা তো আমাদের ক্লাসেরই। আমি তো মিষ্টি ভাবীর বাসায় ওকে দেখে উলটো অবাক হয়েছিলাম। আর জানো মা, ও একদম অসুস্থ একটা ছেলে! যদিও পড়াশুনায় অনেক ভালো।”

আরিয়া গম্ভীরমুখে বললেন,
“তোমাদের কলেজের ট্যুরে ছেলেটা গিয়েছিল?”

মারিয়া এবার ভয়ে ভয়ে বলল,
“কলেজ তো আমার একার না। ওরও তো কলেজ, তাই গিয়েছিল।”

“ছেলেটা কি তোমাকে বিরক্ত করে?”

“না, তবে সেধে সেধে কথা বলতে আসে। তোমাকে তো বললামই ও একটা অসুস্থ ছেলে। কথা বলতে না চাইলেও কথা বলতে আসবে। অপমান করলেও গায়ে মাখে না।”

আরিয়া আবার ভ্রূ কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন,
“তোমাকে কখনো প্রেমের প্রস্তাব দেয় নি তো!”

মারিয়া এবার বিস্ফোরিত চোখে মায়ের দিকে তাকালো। মনে মনে বলল,
“এই উত্তর যদি দিয়ে দেই, মা বলবে আগে কেন বলি নি। আর ভাববে হয়তো আমিও ওই ব্যাটার প্রস্তাব গ্রহণ করেছি। না, না এবার মিথ্যে বলতেই হবে। এতো গভীর তথ্য মায়ের কাছে এমনিতেই থাকবে না।”

মারিয়া এবার বলল,
“না, এতো সাহস আছে? একবার বলে দেখুক, আমার ভাইয়াদের দিয়ে পিটুনি খাইয়ে ছাড়বো।”

আরিয়া ফেরদৌস রহস্যময় হাসি দিলেন। মায়ের হাসি দেখে মারিয়ার গলায় কথা আটকে গেল। রুম থেকে বের হতে হতে বিড়বিড় করে বলল,
“এ যেন মা নয়, একজন সিআইডির লোক, আর এটা তো বাড়ি নয়, একটা জেলখানা। আর মায়ের রুমে ঢুকে প্রশ্নের উত্তর দেওয়া মানেই রিমান্ডে অবস্থান করা।”

মারিয়া রুমে ঢুকতেই মহুয়া তার কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো,
“কি রে, মা কি বলেছে? কেন ডেকে নিয়ে গিয়েছিল?”

মারিয়া ক্লান্ত কন্ঠে বলল,
“চান্দু আগে এক গ্লাস পানি খাওয়া। রিমান্ড থেকে ফিরেছি। না জানি আদালতে এখন কি রায় হয়!”

মহুয়া পানি নিয়ে গ্লাস এগিয়ে দিতে দিতে বলল,
“এক গ্লাস পানি নিয়েও খেতে পারিস না। আচ্ছা, এখন বল, মা কেন ডেকেছে?”

“নিবিড়ের কথা জিজ্ঞেস করছিলো।”

“তারপর?”

“তারপর আবার কি? আমি তো এমন ভাব দেখিয়েছি, যেন মায়ের মনে হয় নিবিড়কে মেরে ফেললেও আমার কিছুই যাই আর আসবে না।”

মহুয়া মারিয়ার গাল টেনে দিয়ে বলল,
“আচ্ছা, তাই?”

মারিয়া নিজের গাল ছাড়িয়ে নিয়ে গালে হাত ঘষতে ঘষতে বললো,
“কি তাই? অবশ্যই আমার কিছু যাই-আসে না। বরং নিবিড়কে আমার ভালোই লাগে না। ও বাচ্চা একটা ছেলে। আমার বয়সী। আমি তো প্রেম-বিয়ে যা-ই করবো আমার চেয়ে বয়সে বড় ছেলেকের সাথেই করবো। এসব বাচ্চাকাচ্চা আমার মন-মানসিকতা বুঝবে না।”

“আর যদি এই বাচ্চাটাই তোকে বুঝতে পারে?”

মারিয়া আড় চোখে মহুয়ার দিকে তাকালো। তারপর নিজের কাজে মনোযোগ দিলো।

২৭।

কয়েক সপ্তাহ পর-
মাফিন হঠাৎ বাসায় এসে ঘরের জিনিসপত্র ভাংচুর করতে শুরু করলো। শব্দ শুনে মারিয়া ও মহুয়া তাদের রুম থেকে বেরিয়ে এসে দেখলো, মাহাথি মাফিনকে শান্ত করার চেষ্টা করছে, আর আরিয়া ফেরদৌস বুকে হাত গুঁজে শক্তমুখে দাঁড়িয়ে আছেন।

মাফিন ডায়নিংয়ে রাখা একটা কাঁচের প্লেট ছুঁড়ে মারার সাথে সাথে সেটি আরিয়া ফেরদৌসের পায়ের কাছে এসেই ভেঙে গেলো।

আরিয়া এবার রাগী কন্ঠে বললেন,
“একটা মেয়ের জন্য যদি আমার বাসায় অশান্তি হয়, তাহলে সেই মেয়ে এই ঘরে কখনোই ঢুকতে পারবে না।”

মাফিন এবার জোর গলায় চেঁচিয়ে বলল,
“সেই মেয়ের জন্য বাসায় অশান্তি হচ্ছে না। একমাত্র তোমার জন্য বাসায় অশান্তি হচ্ছে।”

মাফিন মায়ের দিকে আঙ্গুল তাক করে কথাটি বলছিল। তখনই মাহাথি এসে মাফিনের গালে একটা চড় বসিয়ে দিয়ে বলল,
“আল্লাহর দোহাই লাগে তোমরা এসব ঝগড়াঝাটি বন্ধ করো। আমি আর কোনো মানসিক চাপ নিতে পারছি না।”

মাহাথি এবার মাফিনের কাঁধ ঘুরিয়ে তাকে নিজের মুখোমুখি এনে বলল,
“তোকে বিয়ে করতে হবে না, মাফিন। আমি তো তোকে এমনিই বলেছি মায়ের শর্তের কথা। আমি তোকে জোর করি নি। সূচনা বারবার বিয়ের তারিখ ঠিক করার কথা বলছিল, তাই আমি তোকে বলেছি তুই বিয়ের জন্য রাজী হলে আমার বিয়ের তারিখটা ঠিক হবে। আরেহ ভাই, তোর তো কোনো পছন্দের মেয়ে নেই। তাই বলে ফেলেছি কথাটা। থাক, অপরাধ যেহেতু আমি করেছি, আমারই শাস্তি পাওয়া উচিত। আমি আজই সূচনাকে জানিয়ে দেবো এই বিয়ে আর হবে না। আমার জন্য তার গায়ে যদি দাগ লেগে থাকে, তাহলে আমিই সেই দাগ মুছে দেবো। আমি নিজেই সূচনার জন্য ভালো ছেলে খুঁজবো, ওকে বিয়ে দেবো। কিন্তু আমি আর এই বিয়ে করবো না।”

মাফিন এবার আরিয়ার দিকে ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
“খুব ভালো লাগছে না আমাদের দুই ভাইয়ের মধ্যে ঝামেলা বাঁধিয়ে? তুমি তো এটাই চেয়েছিলে। তুমি চেয়েছিলে সূচনা ভাবীর জন্য আমাদের ঘরে অশান্তি হোক। আর ভাইয়া শেষমেশ তোমার পছন্দে বিয়ে করুক।”

মাফিনের কথাটি শুনে আরিয়ার চোখ দুটো ছলছল করে উঠলো। তবুও তিনি এক দৃষ্টিতে মাফিনের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

মাফিন আবার চেঁচিয়ে বলল,
“কি চাইছো তুমি? চুপ করে আছো কেন? আমাকে তোমার পছন্দে বিয়ে করিয়ে তোমার পুতুল বানিয়ে রাখবে, তাই তো? নানীও তো তার বড় ছেলেকে নিজের পছন্দে বিয়ে দিতে পারেন নি, তাই সেও আর ফিরে তাকায় নি। আর ছোট মামাকে তিনি নিজের পছন্দে বিয়ে করিয়ে ঘরে জায়গাটা করে নিয়েছেন৷ তোমার কি খুব সন্দেহ হচ্ছে? কি মনে হচ্ছে তোমাকে আমরা রাস্তায় ফেলে রাখবো? বুড়ো বয়সে দেখবো না? এটার জন্য তুমি আগে থেকেই প্রস্তুতি নিচ্ছো, তাই না?”

মাহাথি মাফিনকে এরই মধ্যে অনেকবার ধাক্কা দিয়েও চুপ করাতে পারলো না। এবার আরিয়া ফেরদৌস কাঁপা কন্ঠে বললেন,
“মাফিন, আমার মৃত মাকে এর মধ্যে কেন টানছো?”

মাফিন চেঁচিয়ে বললো,
“তুমি আমাকে বাধ্য করেছো।”

আরিয়া এবার শাড়ির আঁচলে চোখ মুছে বললেন,
“তুমি আজ প্রমাণ করেই দিলে তোমার রক্ত মিরাজ জামান নীরেরই৷ তার চোখ-মুখের যে ভয়ংকর রূপটা আমি আমার সংসার জীবনে দেখেছি, আজ সেটা তোমার মধ্যেও দেখলাম। থাক, বাবার ছেলে, বাবার মতোই তো হবে। আর কি বললে তুমি? আমি নিজের জায়গা করে রাখার প্রস্তুতি নিচ্ছি? মোটেও না। এটা আমার বাড়ি। আমার ঠিকানা। আমি এখানেই থাকবো। যার ইচ্ছে হবে, সে এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে। আমি কাউকে থাকতে বলবো না। আমি কাউকে পুতুল বানাতে চাই না। আমি শুধু তোমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তায় আছি। একা চারটা সন্তান মানুষ করেছি। এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে এতো বড় দায়িত্ব নিয়েছি। আমার মাথায় অনেক চাপ। তোমাদের কিছু খারাপ দিক চোখে পড়লে, সবাই আঙ্গুল তুলে বলবে, বাবা নেই তাই সন্তানদের এই পরিণতি। আমার বুকের মধ্যে যে চাপা কষ্ট আছে, তোমরা কি কখনো বুঝতে পেরেছো? আমি সংসার ভাঙতে দেখেছি। প্রেমে কাউকে সুখী হতে দেখি নি। আমি তো বলছি না সূচনা খারাপ। আমি বলছি এসব বিয়েতে শান্তি নেই৷ আমার বড় ভাবী সাহেদা, তিনি আর বড় ভাইজান ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন। কিন্তু ভাইজান একটা বাচ্চার জন্য ভাবীকে ছেড়ে আরেকটা মেয়েকে বিয়ে করে ঘরে তুলেছিলেন। আর এখন ভাবী পরিবারের পছন্দে বিয়ে করে আরিফ ভাইজানের সাথে অনেক সুখে আছে। আমার মেজ আপা, তোমাদের খালা, ভালোবেসে পালিয়ে দুলাভাইকে বিয়ে করেছিলেন। দুলাভাই আপাকে পাগলের মতো ভালোবাসে। কিন্তু তাদের সম্পর্কও একটা বাইরের মেয়ের জন্য শিথিল হয়ে গিয়েছিল। আপাও কিন্তু দুলাভাইকে পাগলের মতো ভালোবাসতো। কিন্তু এখন তার মধ্যে সেই ভালোবাসা আর দেখা যায় না। আর আমার ছোট ভাই আমারই বান্ধবী, মিথিকে ভালোবেসে কষ্ট পেয়েছিল। তাই আমি কি বলতে পারবো মিথি ভালো মেয়ে নয়? পরিস্থিতি খারাপ ছিল। এসব প্রেমের সম্পর্কে মাঝে মাঝে পরিস্থিতি ভালো থাকে না। প্রেম, প্রেমিকের প্রতি টান মানুষকে এতোটা দুর্বল করে দেয় যে তার ছোটখাটো ভুলগুলোও চোখে পড়ে না। বিয়ের আগে একে অপরকে কাছে পাওয়ার যে তীব্র ইচ্ছা থাকে, সেটা যখন বিয়ে হয়, তখন শেষ হয়ে যায়। তাদের মাঝে সম্পূর্ণ সংসারে মনোযোগ দেওয়া ছাড়া আর কিছুই বাকী থাকে না। আর কি বা বাকী দেখবে? একে অপরের ভালো দিক, খারাপ দিক, নিজেদের দুর্বলতা সবই তো আগে থেকেই জানা থাকে। তাই মানুষকে কম জানা ভালো। ধীরে ধীরে জানা ভালো। কিন্তু প্রেমের ভূত মাথায় চড়লে কে এসব না জেনে থাকে? সবাই জেনে নেয়, আর তখন অবশিষ্ট থাকে শুধু ঝামেলা। আর এসব সমস্যা আমার দুই ছেলের জীবনে আসুক তা আমি কখনোই চাই না। তাই ভেবেছি মাহাথি ভালোবেসে বিয়ে করুক, কিন্তু মাফিন এই ভুল না করুক। মা তো চায় তার ছেলেরা সুখে থাকুক। যদি পরিস্থিতি কোনোভাবে মাহাথির জীবনের গতিপথ পালটে দেয়? তখন আমারই নিজেকে অপরাধী মনে হবে। কারণ আমি ভুল প্রেমে সম্মতি দিয়েছি।”

কথাগুলো বলে আরিয়া ধীর পায়ে হেঁটে নিজের ঘরে চলে গেলেন। আর মাফিন মাথায় হাত দিয়ে ধপ করে সোফায় বসে পড়লো।

চলবে-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here