#রংধনুর_আকাশ
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
পর্ব-৪২:
৬৭।
প্রহরের সাথে দেখা হবে তাই আজ মারিয়া সকালে উঠেই হালিম রান্না করেছিল। দু’দিন আগে সূচনায় তাকে হালিম রান্না করা শিখিয়েছিল, কিন্তু সে নিজ হাতে একবারো চেষ্টা করে দেখে নি৷ আর আজই সে প্রথম নিজ হাতেই হালিম রান্না করেছে। অথচ হালিমে মশলা আর লবণ বেশি হওয়ায় প্রহর এক চামচের বেশি খেতে পারে নি। এই মুহূর্তে মারিয়া এক দৃষ্টিতে সেই হালিমের বক্সটার দিকে তাকিয়ে আছে। আর মনে মনে বলছে,
“আমি একদমই কোনো কাজের না। একটাই রান্না শিখেছি, তাও ঠিক হলো না।”
এদিকে প্রহরের সাথে দেখা হওয়ার আগে মারিয়া মনে মনে অনেক কিছুই ভেবে রেখেছিল। কিন্তু বাস্তবে তেমন কিছুই হয় নি। উলটো টানা দুই ঘন্টা ধরে তারা একসাথে বসে আছে, অথচ তাদের মধ্যে এমন কোনো কথায় হয় নি, যা আজকের দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখবে।
হঠাৎ মারিয়া কি ভেবে প্রহরকে জিজ্ঞেস করলো,
“আমার মনে হয়, আপনি আমাকে পছন্দ করেন না।আচ্ছা, আমার কোনো কিছু কি আপনার খারাপ লেগেছে?”
প্রহর মারিয়ার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। সে মনে মনে ভাবলো, মহুয়ার কথা জানিয়ে দেবে। কিন্তু যেই কথাটা গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলো, তখনই মাফিন এসে বলল, তার বিশ হাজার টাকা চুরি হয়ে গেছে। মাফিনের চেহারার বিধ্বস্ত অবস্থা দেখে প্রহর তাড়াতাড়ি তাদের বাসায় নামিয়ে দিলো।
এদিকে বাসায় এসে সব শুনে আরিয়া ফেরদৌস কিছুক্ষণ মাফিনকে বকলেন। তারপর নিজেই ড্রয়ার খুলে পঞ্চাশ হাজার টাকা বের করে ছেলের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন,
“যাও, আজই কেনাকাটা করে এসো। অন্তত বিয়ের শাড়ি, চুড়ি এসব কিনে ফেলো। চাপটা আর থাকবে না। দুই সপ্তাহ পর বিয়ে, দেখা যাবে শাড়িই কেনা হলো না। তুমি বিকেলে গিয়ে শাড়ি কিনে নিয়ে আসবে।”
মাফিন মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। মায়ের কথা শুনে তার মনে অপরাধবোধ জন্ম নিয়েছে। কারণ সে আজ স্বস্তিকার জন্য মায়ের সাথে মিথ্যে কথা বলেছে। বিষয়টা খুবই সাধারণ ছিল। আর মাফিন সেই সাধারণ বিষয়টাকেই জটিল করে ফেলেছে। সাথে তার ভাই-বোন সবাইকেই সেই জটিল কাজটি করতে বাধ্য করেছে।
বিকেলে কেনাকাটা শেষ করে বাসায় ফিরলো মাফিন। স্বস্তিকার সাথে সে আর তেমন একটা কথা বলে নি। তবে স্বস্তিকা বিয়ের বাজার করতে পেরে খুব খুশি হয়েছে। সে তখন বার বার একটা কথায় বলছিল,
“শুধু শুধু বিশ হাজার টাকার চিন্তায় কেন মাথা নষ্ট করছেন? বিশ হাজারের পরিবর্তে এখন তো পঞ্চাশ হাজার টাকা পেয়েছেন।”
স্বস্তিকার কথাগুলো মাফিনের মগজে কাঁটার মতো বিঁধেছে। বাসায় আসার পরও তার মাথায় স্বস্তিকার কথাটিই ঘুরপাক খাচ্ছে। নিজের আয় করা একটা টাকাও খুব মূল্যবান। আর সেখানে এতোগুলো টাকা! তার উপর স্বস্তিকার কথা শুনে মনে হচ্ছে, সে মায়ের কাছ থেকে লাভ করেছে। মা-ছেলের সম্পর্কে কি লাভ-ক্ষতি থাকে? মাফিনের মনে পড়ে গেল, ছোটবেলায় সে কতোবার মায়ের ব্যাগ থেকে না বলে টাকা নিয়ে ফেলেছিল। আর মা হন্যে হয়ে সেই টাকা খুঁজেছে। অথচ সে কখনোই স্বীকার করে নি।
মাফিনের কাঁধে এখনো সংসারের দায়িত্ব আসে নি। এমনকি আরিয়া মাহাথির কাছ থেকেও সংসারের কোনো খরচ নেন না। কারণ তার এক মাসের বেতনে মারিয়া-মহুয়া আর নিজের খরচটা হয়ে যায়৷ আত্মীয়-স্বজন না থাকায়, তাদের কোনো আলাদা খরচ নেই। নিজস্ব ফ্ল্যাটে থাকায় বাড়ি ভাড়ার খরচ থেকেও তারা মুক্ত। তবে মাহাথি আরিয়া ফেরদৌসের নিষেধাজ্ঞার পরও যেই খরচটা দেয়, তার এক ভাগও কখনো মাফিন দেয় নি। অথচ তার ব্যাংক ভর্তি অনেক টাকা জমেছে।
রাতে সে মায়ের ঘরে এসে দাঁড়িয়ে রইলো। আরিয়া ফেরদৌস তাকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন,
“কিছু বলবে?”
মাফিন মায়ের কাছে এসে বলল,
“আমাকে মাফ করে দাও, মা।”
আরিয়া ফেরদৌস অবাক কণ্ঠে বললেন,
“হঠাৎ কি হয়েছে তোমার? এমন কথা বলছ কেন?”
“আমি জীবনে অনেক ভুল করেছি। তাই ক্ষমা চাইছি।”
“মা কি কখনো সন্তানদের উপর রাগ করে থাকতে পারে? যখন যা-ই হয়েছে আমি সাথে সাথেই তোমাকে ক্ষমা করে দিয়েছি।”
মাফিন মায়ের কোলে মাথা রেখে বলল,
“আমি ছোটবেলায় তোমার ব্যাগ থেকে অনেক টাকা চুরি করেছিলাম। কিন্তু তোমাকে কখনো বলিনি। আজ আমার খুব খারাপ লাগছে।”
“কত টাকা চুরি করেছিলে?”
“কখনো দশ, কখনো বিশ, কখনো বা একশো, দুইশো এমনই।”
আরিয়া ফেরদৌস হাসলেন। বললেন,
“আমি একদিন তোমার নানীর ব্যাগ থেকে দুই হাজার টাকা চুরি করেছিলাম। আমি জানতাম না যে সেই দুই হাজার টাকা দিয়েই আমাদের সংসার চলতো। মাস শেষে দেখলাম ভালো তরকারি রান্না হয়নি। আমি ভাত খেতে পারছিলাম না। ফায়াজ ভাইয়া তার বন্ধুর কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে আমার জন্য বাজার থেকে মুরগি কিনে নিয়ে এসেছিল। সেদিন বুঝলাম টাকার কত মূল্য। মানুষ যতদিন নিজে আয় করবে না ততদিন টাকার মূল্য বুঝবে না। কাল আমি বুঝেছিলাম, আর আজ তুমি বুঝতে পারছ। তবে বুঝতে তো একদিন সবাইকেই হবে।”
“তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছো তো?”
“হ্যাঁ। আর যেই টাকা তুমি চুরি করেছিলে, তা তো তোমাদের জন্যই আয় করেছিলাম। হয়তো তোমার এমন কোন ইচ্ছা ছিল যে আমি পূরণ করব না, তাই তুমি বাধ্য হয়ে আমার কাছে না চেয়ে চুরি করেছিলে। কিন্তু একবার অনুরোধ করতে পারতে। মিষ্টি অনুরোধ পাথরকেও নরম করে দেয়। আর আমি তো মা। মা তো সন্তানদের জন্য পাথর মনের হয় না।”
এরপর পাঁচ দিনের মধ্যে মাফিন আর স্বস্তিকার বিয়ের কেনাকাটা শেষ হলো। এখন বিয়ের যাবতীয় তোড়জোড় চলছে। কেউ নাচের অনুশীলন করছে, কেউবা ফটোগ্রাফার আর ক্লাব ঠিক করার দায়িত্ব নিয়েছে৷ কিন্তু এসবের মধ্যে আরিয়া ফেরদৌসের দায়িত্ব নিয়েছেন নাহিদ হোসেন। ইদানীং আরিয়ার চলাফেরা, উঠা বসা, খাওয়া-দাওয়ার সব চিন্তা যেন একা নাহিদের৷ হঠাৎ কেন যে বুড়ো বয়সে তার পুরোনো প্রেম মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো তা তিনি বুঝতে পারছেন না।
চলবে-