#রংধনুর_আকাশ
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
বোনাস পর্ব-০১
৭১।
মাসুমা আকতার রান্নাঘরের কাজে ব্যস্ত। হঠাৎ প্রিয়াকে দেখে বললেন,
“প্রিয়া, তোর ভাইয়ের সাথে কথা হয়েছে?”
প্রিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“তোমার ছেলে কি সোজাসুজি কিছু বলছে? শুধু শুধু কথা ঘুরিয়ে ফেলছে। কিন্তু মা, আমার কি মনে হয় জানো?”
“কি মনে হয়?”
“ভাইয়া ভাবীকে মেনে নিতে পারছে না, অথচ ভাবীর বোনকে মেনে নিয়েছে।”
মাসুমা আকতার রাগী কন্ঠে বললেন,
“এগুলো কেমন কথা!”
“এমনিই বলছি। আজ দেখলাম ভাবীর সাথে দেখা করতে গেলো। ওদের মধ্যে সব ঠিকই আছে। নয়তো কি দেখা করতে গেছে?”
“তাহলে একটু আগে এটা কি বলেছিস?”
“বোঝাতে চাইছি। তোমার ছেলে যা করছে মনের বিরুদ্ধে করছে। ভাইয়ার মন তো সেই বাতিঘরের মায়াবিনীর মাঝেই আটকে আছে।”
মাসুমা আকতার চুপ করে রইলেন। প্রিয়া আবার বলল,
“ভাইয়া যা করছে একটু বেশি বাড়াবাড়ি করছে। সবারই কি তাদের পছন্দের মানুষের সাথে বিয়ে হয়? মাঝে মাঝে একটা দুইটা ব্যতিক্রম হয়েই যায়।”
মাসুমা আকতার বললেন,
“প্রহরের সাথে এখন যা হচ্ছে তার জন্য পরিস্থিতি দায়ী। আর এই পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার উপায়ও আছে।”
“কি উপায়?”
“মারিয়াকে আনুষ্ঠানিকভাবে নিয়ে আসা। বিয়ে যেহেতু হয়েই গেছে, তাহলে এখন ঘরের বউমাকে বাসায় নিয়ে এলে ঘরে শান্তি ফিরে আসবে। মারিয়া যখন সারাদিন প্রহরের আশেপাশে থাকবে, তখন প্রহর আপনা-আপনি মারিয়াতে অভ্যস্ত হয়ে যাবে। এখন দূরে আছে, তাই বুঝতে পারছে না। আর পুরোনো আবেগও কাটাতে পারছে না।”
“মা, সত্যিই কি সম্ভব? ভাইয়া কি পারবে ভাবীকে মেনে নিতে?”
“সেটাই তো আশা রাখছি। আমার এক বান্ধবী ছিল মুনিরা, তার সাথেও অনেকটা এমনই ঘটেছিল। মুনিরার স্বামী আনিস ভাই তার চাচাতো বোনকে ভালোবাসতেন। কিন্তু পারিবারিকভাবে তাদের প্রেমের সম্পর্কে কেউই মেনে নিচ্ছিলো না। আনিস ভাইয়ের বাবা এক মাসের মধ্যে মুনিরার সাথে তার বিয়ে দিয়ে দেন। আনিস ভাইকে জোর করা হয়েছিল। তিনি বাধ্য হয়েই মুনিরাকে বিয়ে করেছিলেন। বিয়ের পর তিনি মুনিরার যত্ন নিতেন না, কথা কম বলতেন। তখন তোদের বাবার সাথে আমার বিয়ে হয়েছিল। তোদের বাবা আমার অনেক যত্ন নিতো। এসব দেখে মুনিরার খারাপ লাগতো। সে প্রথমে মেনে নিয়েছিল, আনিস ভাই এমনই। পরবর্তীতে বুঝতে পারলো উনি তার কাজিনকে পছন্দ করেন।”
“কিভাবে বুঝেছিল?”
“ওই যে কাজিন ছিল। একই পরিবারের মধ্যে, দেখা সাক্ষাৎ তো হয়। তখনই তাদের চোখাচোখি, একে অপরের প্রতি যত্ন দেখেই মুনিরা বুঝতে পেরেছিল। কিন্তু আর যা-ই বলিস না কেন, বিয়ের পর পৃথিবীর সব ভালোবাসা শুধু বিয়ে নামক সম্পর্কের কাছে হারতে বাধ্য। কারণ এই ভালোবাসা পাওয়ার অধিকার তৃতীয় নারীর নয়, সেই পুরুষের বৈধ স্ত্রীর।”
“এরপর কি মুনিরা আন্টি আর আনিস আংকেলের সম্পর্ক ঠিক হয়েছিল?”
“হ্যাঁ, মুনিরা সব জানার পর নিজের যত্ন নেওয়া ছেড়ে দিয়েছিল। আর ভাইয়া এসব মেনে নিতে পারে নি। ও অনেক অসুস্থ হয়ে গিয়েছিল। তখন আনিস ভাই পাগলের মতো ছোটাছুটি করেছিলেন।”
“এরপর?”
“এরপর মুনিরা মারা যায়!”
“কি!”
“হ্যাঁ, ওর লিভারে সমস্যা হয়েছিল। বেশি দেরী হয়ে যাওয়ায় বাঁচানো যায় নি।”
“মা, আর ওই আনিস লোকটা বিয়ে করে ফেলেছিল, তাই না?”
“না, উনি আর বিয়ে করেন নি। শুনেছি, উনার কাজিনের সাথেই আবার বিয়ে ঠিক করতে চেয়েছিল। কিন্তু উনি না করে দেন।”
এরপর মাসুমা আকতার দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। আর বললেন,
“প্রহর আমার ছেলে। আমি বুঝি ওর কষ্টটা। কিন্তু এই কষ্টের সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা মারিয়ার উপরই যাবে। একটা মেয়ের যখন বিয়ে হয়ে যায়, সে বিবাহিতা। কিন্তু বিয়ে ভেঙে গেলে, তাকে ডিভোর্সি বলার চেয়েও তার চরিত্রের উপর আঙ্গুল উঠানো হয়। মেয়েটার তো কোনো দোষ নেই। একটা মিথ্যে আবেগের জন্য আমি একটা মেয়ের জীবন নষ্ট হতে দেবো না।”
“তুমি কি করবে মা?”
“কিছু করবো না। শুধু মারিয়াকে খুব শীঘ্রই বাসায় নিয়ে আসবো। আর যদি মহুয়ায় প্রহরের ভাগ্যে থাকতো, তাহলে তো এতো বড় গন্ডগোল বাঁধতো না। শুরুতেই সব ঠিকঠাকই হতো।”
“সব বুঝলাম কিন্তু মারিয়া ভাবী যদি কখনো জানতে পারে, খুব কষ্ট পাবে। কারণ ভাইয়া তো ভাবীর বোনকেই পছন্দ করে। আর ভাইয়া তো শান্ত শিষ্ট মেয়েই পছন্দ করে। মারিয়া ভাবী কি তাহলে পারবে ভাইয়ার মনে জায়গা নিতে?”
“মানুষের ব্যক্তিত্ব আলাদা। মহুয়া আর মারিয়া আলাদা ব্যক্তিত্বের দুটি মানুষ। মারিয়াকে পরিবর্তন করা সম্ভব না। আবার এটাও সত্য যে মানুষ অনুকূল পরিবেশে তাড়াতাড়ি খাপ খাইয়ে যায়। যেমন মহুয়ার স্বভাব প্রহরের অনুকূলে। তাই এটাকে ভালোবাসা বলা যায় না। ভালোবাসা অনুকূল পরিস্থিতি দেখে হয় না৷ এটা শুধু হয়ে যায়। আর মারিয়া প্রহরের বিপরীতমুখী চরিত্র। তাই প্রহর ওর সাথে খাপ খাওয়াতে পারছে না। বরং সে তার মনকেই পুরোপুরি বোঝাতে পারছে না যে মারিয়ার সাথে সে থাকতে পারবে। প্রহরের ধারণা ও একজন শান্ত-চিন্তাশীল স্বভাবের মেয়ের সাথেই সুখে থাকবে। তাই মহুয়া ওর আবেগ। ভালোবাসা নয়। আর প্রহর এখনো ভালোবাসতে শেখে নি। মানুষের অনুকূল-প্রতিকূল যেই স্বভাবই থাকুক না, তা মেনে নেওয়ায় ভালোবাসা। যা প্রহরের মাঝে নেই।”
“তাহলে কি ভাইয়া এবার ভাবীর প্রেমে পড়বে?”
“যদি প্রহর তার কাম্ফোর্ট জোন থেকে বের হতে পারে। তখনই সম্ভব হবে। আর এটা একমাত্র প্রহরের দ্বারাই সম্ভব। কারণ প্রহরকেও বুঝতে হবে সে চাইলে পারবে। যদি তাও না পারে, তাহলে বুঝে নিতে হবে..”
প্রিয়া মায়ের মুখের কথা ছিনিয়ে নিয়ে বলল,
“ভাইয়া সেই অনুকূল স্বভাবকেই মনে গেঁথে ফেলেছে।”
“হুম।”
চলবে–