রংধনুর_আকাশ #লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ পর্ব-৪৭:

0
634

#রংধনুর_আকাশ
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
পর্ব-৪৭:

৭৬।
আজ ছুটির দিন। বাইরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে। আরিয়া ফেরদৌস ফজরের নামাজ পড়ে অনেকক্ষণ বৃষ্টি বিলাস করলেন। এরপর সবার জন্য খিচুড়ি রান্না করলেন।
একা নাস্তা করতে তার একদমই ভালো লাগে না। তাই ছুটির দিনে কারো দেরী করে ঘুম থেকে ওঠাটা তিনি পছন্দ করেন না। তিনি মনে করেন, প্রতিদিন সবার একই ধারায় চলা উচিত। একদিন কেন সব ব্যতিক্রম হবে? কিন্তু তার এই ধারা তার কোনো সন্তানই মানতে পারে না। বিশেষ করে মাহাথি, মাফিন আর মারিয়া। এরা তিনজন নাস্তা খেয়ে আবার ঘুমোতে যাবে। তারপর একেবারে জুমার আগেই উঠবে। তবে ইদানীং বন্ধের দিন কোচিংয়ে সাপ্তাহিক পরীক্ষা থাকায় মারিয়া এই ব্যতিক্রমী ধারা পালন করতে পারছে না।

আরিয়া ফেরদৌস রান্না শেষ করে সবার ঘরের দরজায় কয়েকবার কড়া নাড়লেন। মায়ের ডাকাডাকিতে সবাই বিছানা ছাড়তে বাধ্য হলো। স্বস্তিকা সবার শেষে এসে চেয়ারে বসে ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
“দুঃখিত মা, একটু দেরী হয়ে গেছে।”

আরিয়া ফেরদৌস উত্তরে মুচকি হাসি ফের‍ত দিলেন। আর কিছুক্ষণ স্বস্তিকার দিকে তাকিয়ে রইলেন। সেইদিনের ঘটনার পর স্বস্তিকা কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গেছে। তিনি খেয়াল করলেন, মাফিনও স্বস্তিকার সাথে তেমন একটা কথা বলছে না। কিন্তু তিনি এমনটা চান নি। তাই সেদিন মাফিন আর মাহাথিকে বসার ঘরে আসতে বারণ করেছিলেন।

আরিয়া ফেরদৌস মনে করেন, ঘরের সব সমস্যার কথা পুরুষদের কানে না তোলায় ভালো। কারণ একজন মেয়ে বিয়ের পর পুরোনো পরিবেশ ছেড়ে যেই পরিবেশে আসে, সেই পরিবেশের সাথে তার মনের মিল হতে অনেক সময় লাগে, যেখানে একজন ছেলে সেই পরিবেশের সাথে ছোট বেলা থেকেই অভ্যস্ত ছিল। তাই মাঝে মাঝে বেশিরভাগ পুরুষই নারীদের নিজের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিচার করে নিজেদের মধ্যেই ঝামেলা সৃষ্টি করে।

আরিয়া ফেরদৌস মাফিন আর স্বস্তিকাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
“তোমরা দু’জন কয়েক সপ্তাহের জন্য বাইরে থেকে ঘুরে আসতে পারো। তোমাদের বিয়ে হয়েছে। এখন সংসারের চাপ কম। বাচ্চা হয়ে গেলে তো সময়ই পাবে না।”

স্বস্তিকা কথাটি শুনে মনে মনে খুশি হলো। কিন্তু তার খুশি বেশিক্ষণ দীর্ঘস্থায়ী হলো না। কারণ মাফিন বলল,
“না, আমি এখন অফিস থেকে ছুটি নিতে পারবো না।”

আরিয়া ফেরদৌস কিছু বলবেন, তার আগেই মারিয়া বলে উঠলো,
“বড় ভাইয়া আর মিষ্টি ভাবী তো কোথাও যায় নি। ওদের প্ল্যানটা না হয় আগে হোক। ততোদিনে ছোট ভাইয়ার কাজও শেষ হয়ে যাবে৷”

স্বস্তিকা মনে মনে বললো,
“সবখানেই মিষ্টি ভাবী! মারিয়া তো আমাকে ছোট ভাবী বলেই ডাকে। তাহলে বড় ভাবীর জন্য এই স্পেশাল নাম কেন? শুধু কি বড় ভাইয়া ভাবীকে খুব ভালোবাসে তাই তারা ভাবীকে ভালোবাসে? তাহলে মাফিন কি আমাকে ভালোবাসে না? হয়তো বাসে না। মাফিন আমাকে ভালোবাসলে সবাই আমাকে গুরুত্ব দিতো। যেখানে আমার বরই আমাকে অপছন্দ করে, সেখানে আমি বাকীদের থেকে কি আশা করবো? মা হয়তো নিজের পছন্দে আমাকে ছেলের বউ করে এনেছেন, তাই একটু গুরুত্ব দেন।”

আরিয়া ফেরদৌস মাহাথি ও সূচনাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
“তোমাদেরও ঘুরতে যাওয়া উচিত। বিয়ের পর তো তোমরা কোথাও যাও নি।”

সূচনা মাহাথির দিকে এক নজর তাকিয়ে বলল,
“মা, মাহার যদি সময় হতো, তাহলেই তো যেতে পারতাম। ও তো বাইরে ঘুরাঘুরি করার চেয়ে বাসায় ঘুমিয়ে থাকতেই বেশি পছন্দ করে। যেমন এখন নাস্তা করেই দৌঁড়ে ঘুমোতে চলে যাবে।”

মারিয়া বলল,
“বড় ভাইয়া, তুমি একদম বোরিং। তবে ছোট ভাইয়া ঘুরাঘুরি করতে অনেক পছন্দ করে। ছোট ভাবী তুমি জানো, বিয়ের আগে ভাইয়া তার বন্ধুদের সাথে কতোশত জায়গায় গিয়েছিল।”

স্বস্তিকা মলিন মুখে বলল,
“তাহলে কি তোমার ভাইয়ার সাথে ঘুরতে যাওয়ার জন্য আমার ছেলে হয়ে যেতে হবে?”

মারিয়া ভ্রূ কুঁচকে বললো, “ছেলে কেন হতে হবে?”

“তুমিই তো বললে শুধু বন্ধুদের সাথেই যায়।”

মারিয়া কিছু একটা ভেবে বলল,
“বন্ধু না, বান্ধবীও আছে। আমি তো কমন জেন্ডার হিসেবে বন্ধু শব্দটা ব্যবহার করেছিলাম।”

মাফিন চোখ বড় বড় করে মারিয়ার দিকে তাকালো। আরিয়া ফেরদৌস একটু জোরেই বলে উঠলেন,
“মারিয়া, তুমি কিন্তু বেশি বেশি বলে ফেলছো। কার সামনে কতোটুকু বলতে হয়, সেটা তোমার জানা উচিত।”

মহুয়া মারিয়ার হাতে চিমটি কেটে মুচকি হেসে ফিসফিস করে বলল,
“ছোট ভাবী যদি অদ্রি আপুর কথা জানে তখন কি হবে! শুধু মেয়ে বান্ধবী আছে শুনেই দেখ কেমন রেগে যাচ্ছে।”

মারিয়া ফিসফিস করে বলল,
“আমি নিজেই ভাবীকে বলতাম, যদি ভাইয়া একটু হলেও অদ্রি আপুকে পছন্দ করত। কিন্তু ভাইয়া তো আরেক নিরামিষ। অদ্রি আপুকে পাত্তাও দেয় না।”

মহুয়া কিছু বলতে যাবে তখনই আরিয়া ফেরদৌস মারিয়া আর মহুয়ার সামনে হাত নাড়িয়ে বললেন,
“তোমাদের দু’জনকে আমি একটা কথা আর কতোবার বলবো? আজ শেষবার বলছি, আমার সামনে আর ফিসফিস করবে না।”

মহুয়া আর মারিয়া দু’জনই মাথা নেড়ে চুপ হয়ে গেল। এবার আরিয়া ফেরদৌস বললেন,
“গুরুত্বপূর্ণ কথাটা তো বলাই হয় নি। দুই দিন পর আমি এক সপ্তাহের জন্য দেশের বাইরে যাবো। কোম্পানি থেকে একটা অফিসিয়াল কাজে আমাকে বাইরে যেতে হবে। মারিয়া আর মহুয়ার পরীক্ষা না থাকলে আমি ওদের আমার সাথেই নিয়ে যেতাম। কিন্তু এখন সেটা তো সম্ভব হচ্ছে না। তাই মাহাথি আর মাফিনের দায়িত্ব মারিয়া আর মহুয়ার খেয়াল রাখা। আমার অবর্তমানে যাতে ওদের কোনো অসুবিধে না হয়। আমি চাইলে ওদের ভাইয়ার বাসায় পাঠিয়ে দিতে পারতাম, কিন্তু ওখানে গেলে তো আর পড়াশোনা হবে না।”

স্বস্তিকা বলে উঠল,
“মা, আপনি নিশ্চিন্ত মনে যেতে পারেন। মহুয়া আর মারিয়ার খেয়াল রাখার দায়িত্ব আমার।”

মাফিন কথাটি শুনে হেসে উঠলো। মাফিনকে হাসতে দেখে স্বস্তিকা ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“আপনি হাসছেন কেন?”

মাফিন বলল,
“যার মধ্যে বুদ্ধির অভাব সে কারো খেয়াল রাখার দায়িত্ব নিতে পারে, এটা খুব হাস্যকর ব্যাপার। তাই হাসছি।”

মাফিনের কথা শুনে মারিয়া এবার খিলখিল করে হেসে উঠলো। স্বস্তিকা মলিন মুখে আরিয়া ফেরদৌসের দিকে তাকিয়ে বললো,
“আমার খাওয়া শেষ। আমি উঠি।”

মাফিন তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
“না, আরেকটু খেয়ে যাও। নয়তো তোমার ভাগের খাবার অন্য কেউ খেয়ে ফেলেছে মনে করে আরেকটা যুদ্ধ বাঁধিয়ে দেবে।”

আরিয়া ফেরদৌস দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,
“মাফিন, তোমার স্ত্রীকে তোমার কিছু বলতে ইচ্ছে করলে বেডরুমে গিয়ে বলো। এভাবে সবার সামনে নিজের স্ত্রীকে অপমান করবে না। যেই পুরুষ নিজের স্ত্রীকে সম্মান দিতে জানে না, তাকে কাপুরুষ বলে। এখানে তুমি সবার সামনে এসব কথা বলে খুব মহান হচ্ছো না। নিজেই ছোট হচ্ছো। তোমাদের এতো বছর আমি নৈতিকতার শিক্ষা দিয়েছি, কিন্তু দিনশেষে বাবার মতো হয়েছো।”

মাফিন চেঁচিয়ে বললো, “মা!”

মাহাথি মাফিনকে থামিয়ে দিয়ে রাগী কন্ঠে বললো,
“মাফিন, তুই যা এখান থেকে। আরেকটা কথা বলবি না।”

মাফিন উঠে চলে যাওয়ার সময় স্বস্তিকার দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকালো। এরপর সবাই যার যার মতো চলে গেলো। মহুয়া যাওয়ার আগে স্বস্তিকার হাত ধরে বলল,
“ভাবী, ভাইয়া একটু রাগী স্বভাবের। তুমি কিছু মনে করো না।”

স্বস্তিকা মহুয়ার হাত সরিয়ে দিয়ে বললো,
“এখন এতো সিমপ্যাথি দেখাতে হবে না। তোমরা সবাই যে আমাকে অপছন্দ করো, তা আমি ভালোভাবেই জানি। আর শুনো, যেহেতু তোমরা আমাকে পছন্দ করো না। তাই আমার কাছ থেকেও কোনো আশা রেখো না।”

স্বস্তিকা চলে যাওয়ার পর মারিয়া পেছন থেকে মহুয়াকে হালকা ধাক্কা দিয়ে বলল,
“চান্দু, তুমি ছেঁকা খেয়েছো? আহা চান্দু! সিরিয়াসলি আই এম ফিলিং ভেরি ব্যাড ফর ইউ।”

“থ্যাংক ইউ ফর ইউর কনসোলেশন। বাট আই এম ওকে।”

“ওহ, রিয়্যালি।”

“ইয়েস, সিস্টার।”
এরপর দু’জনই হেসে উঠলো।

দু’দিন পর-
আজ প্রথম আরিয়া ফেরদৌস দেশের বাইরে যাচ্ছেন। এর আগেও একবার অফিসের কাজে বাইরে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কাজটাই বাতিল হয়ে যাওয়ায় তার আর যাওয়া হয় নি।
তিনি এয়ারপোর্টে এসে অফিসের দু’জন সিনিয়র অফিসারকে দেখলেন। তার সাথে এই দু’জন অফিসার ছাড়া রিদ্ধ সেন ও তার পারসোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট যাচ্ছেন। আর যাচ্ছে একজন মহিলা কর্মচারী। কিন্তু তিনি এয়ারপোর্টে নাহিদ হোসেনকে দেখেই চমকে উঠলেন। ভ্রূ কুঁচকে বললেন,
“তুমি কোথায় যাচ্ছো?”

নাহিদ হোসেন মুচকি হেসে বললেন,
“বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি!”

“অদ্ভুত! তোমার তো যাওয়ার কথা ছিল না।”

রিদ্ধ সেন নাহিদ হোসেনের পিঠে হালকা চাপড় মেরে বললেন,
“কিন্তু আমি এখন বলছি, তাই নাহিদ আমাদের সাথে যাচ্ছে।”

“কিন্তু রিদ্ধ, ও তো জুনিয়র। বয়সে সিনিয়র হলেও আমাদের সেক্টর থেকে আমার পরে অনিলাকেই এই কাজের সাথে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত ছিল না। এটা তো অন্যায় হয়েছে।”

আরিয়ার কথা শুনে রিদ্ধ আর নাহিদ দু’জনেই বলে উঠলেন,
“উফ! সারাদিন কাজ আর কাজ।”

রিদ্ধ সেন বললেন,
“নাহিদ অফিসের কাজে যাচ্ছে না। যদিও আমাদের সাথেই যাচ্ছে, কিন্তু ওর উদ্দেশ্য তো আরেকটা।”

“কি উদ্দেশ্য?”

নাহিদ বললেন,
“তুমি এসব বুঝবে না। তোমার মস্তিষ্কে এখন কাজের পোকা ধরেছে।”

রিদ্ধ সেন মুচকি হাসলেন। আরিয়া ফেরদৌস রিদ্ধের হাসি দেখেই এবার বিষয়টা বুঝতে পারলেন। তার মনে মনে ভালো লাগলেও তিনি মুখে কঠোরভাব রেখে বললেন,
“তোমার ছেলেদের কোথায় রেখে এসেছো? ওরা একা একা কি করবে?”

“ওরা এই কয়েকদিন ওদের মামার বাসায় থাকবে।”

৭৭।

আরিয়া ফেরদৌস ও তার সহকর্মীগণ তুর্কির ইস্তাম্বুল শহরে পৌঁছে গেলেন। সবাই একটা হোটেলে উঠলেন। ডুপ্লেক্স হোটেলটিতে সাতটি বেডরুম আছে। নিচে ডায়নিং আর লিভিং রুমের সাথে তিনটি রুম। সিঁড়ির পাশে দুইটা করিডোর। আর প্রতিটি করিডোরের শেষে মুখোমুখি দুইটা রুম। নিচের তিনটি রুম দু’জন অফিসার আর মহিলা কর্মচারী নিয়েছেন। উপরের বাম পাশের একটিতে রিদ্ধ সেন ও আরেকটিতে তার অ্যাসিস্ট্যান্ট উঠেছে, আর ডান পাশের রুমটির একটিতে আরিয়া ফেরদৌস, অন্যটিতে নাহিদ হোসেন উঠেছেন। নাহিদ হোসেন রিদ্ধ সেনকে অনেক অনুরোধ করার পরই আরিয়া ফেরদৌসের মুখোমুখি রুমটি পেলেন। নয়তো সেই রুমে তাদের সাথে আসা মহিলা কর্মচারীটির থাকার কথা ছিল।

পরের দিন তারা অফিসিয়াল মিটিং শেষে, ইস্তাম্বুল শহর ঘুরে দেখার সিদ্ধান্ত নিলো। আরিয়া ফেরদৌস হোটেল থেকে বের হয়ে নাহিদ হোসেন ছাড়া আর কাউকেই দেখতে পেলেন না। তিনি অবাক কন্ঠে বললেন,
“বাকীরা কোথায়?”

নাহিদ হোসেন বললেন,
“ঘুরতে গেছে। তুমি আমার সাথে চলো।”

“আমরা একসাথে এসেছি, একসাথেই তো ঘুরবো। আলাদা কেন? বিষয়টা সুন্দর দেখাচ্ছে না। বাকীরা কি মনে করবে?”

“কেউ কি মনে করলো বা না করলো সেটা নিয়ে ভাবার মতো মেয়ে তো তুমি নও! তুমি তো এসব পরোয়া করো না। তাহলে আমার বেলায় কেন এতো ভাবছো?”

“কি বলতে চাইছো তুমি?”

নাহিদ হোসেন আমতা-আমতা করে বললেন,
“বলছি কি বন্ধুর সাথে ঘুরার অনুমতি কি হবে?”

আরিয়া ফেরদৌস কোনো উত্তর না দিয়ে গাড়িতে উঠে বসলেন।

ইস্তাম্বুল শহরটা অনেক পরিচ্ছন্ন। রাস্তার পাশে সাজানো ফুলের বাগান। আশেপাশে অনেক দোকান।কোথাও কোথাও একটা মানুষকে ঘিরে কিছু মানুষের ভীড় চোখে পড়ছে। কেউ গিটার বাজাচ্ছে, কেউ বা বাঁশি। সংস্কৃতির প্রভাবটা বোধহয় এখানে একটু বেশি। আমাদের দেশে সংস্কৃতির চর্চাটা এমন উন্মুক্ত পরিবেশে হয় না। শুধু বাৎসরিক উৎসবগুলোতেই দেশ সংস্কৃতির সাজে সজ্জিত হয়। বাকী সময়ে কোথায় থাকে সেই সংস্কৃতি? দেশটা তাদের সভ্যতা যেন দিন দিন হারিয়ে ফেলছে। নিজেদের সংস্কৃতি ভুলে ভিন্ন সংস্কৃতিকে ধারণ করার চেষ্টা করছে।

আরিয়া ফেরদৌসকে ভাবনায় দেখে নাহিদ হোসেন বললেন,
“কি ভাবছো?”

“ভাবছি, এরা সংস্কৃতির ব্যাপারে অনেক সচেতন। দেখতেও খুব পরিপাটি লাগছে। মাঝে মাঝে আমাদের বাইরের সংস্কৃতি দেখে ভালো কিছু শেখা উচিত। নিজেদের সংস্কৃতিকে ভালোবাসা উচিত। কিন্তু আমরা কি করি? তাদের সংস্কৃতিগুলোই নিজেদের মাঝে ধারণ করি। অনুভূতিটা নেই না।”

“অনুভূতি বলতে?”

“যেমন এদের পোশাক-পরিচ্ছদ আর চাল-চলন এদের সংস্কৃতিকে প্রকাশ করে। আমরা তাদের দেখে বুঝতে পারি তাদের ঐতিহ্যটা কি! যদি এই অনুভূতিটা তাদের থেকে আমরা নিতে পারতাম, তাহলে আমরা আমাদের সংস্কৃতিকে ভালোবাসতাম। কিন্তু আমরা তাদের সংস্কৃতির প্রতি যেই অনুভূতি আছে, সেটা না নিয়ে, তাদের সংস্কৃতিটাই নিজেদের সংস্কৃতিতে যুক্ত করি। এভাবে তো আমরাই হারিয়ে যাচ্ছি। আমাদের সংস্কৃতি হারিয়ে যাচ্ছে। আমাদের পরিচয় হারিয়ে যাচ্ছে। আমাদের দেশীয় মেয়েদের দেখলে কি মনে হবে তারা বাংলাদেশী? এমন একটা সমাজেই আমি আমার মেয়েদের বড় করেছি। কতো চিন্তা ছিল মাথায়!”

“এখন এসব চিন্তা ফেলে ঘুরতে এসেছো ঘুরো।”

কথাটি বলেই নাহিদ হোসেন বিড়বিড় করে বললেন,
“কখনো সংসার! কখনো কাজ! কখনো মেয়ে! এর মাথায় তো আর কিছুই আসে না। আমি তো তার পাশে জড় পদার্থ হয়ে বসে আছি।”

আরিয়া ফেরদৌস ভ্রূ কুঁচকে বললেন,
“কিছু বলছো?”

“না, তো।”

এরপর তারা একটা পার্কের সামনে নামলেন। এখানে মানুষের ভীড় থাকলেও কোনো বিশৃঙ্খলা নেই। হয়তো জায়গাটা পরিচ্ছন্ন তাই। তারা এক পাশে বসলেন। অনেকক্ষণ গল্প করলেন। আজ তাদের দিনটা ভালোই কাটলো। আরিয়া ফেরদৌস হয়তো আজ অনেক বছর পর কারো সাথে মনের সব কথা ভাগ করতে পেরেছেন। এতোটা শান্তি তিনি আগে কখনোই পান নি।

জীবনে একজন উত্তম সঙ্গী প্রয়োজন। আর হয়তো সেই উত্তম সঙ্গীটি তার জীবনে কয়েক যুগ পর এসেছে। এই মানুষগুলো সঠিক সময়ে আসে না কেন? তাদের আসতে এতো দেরী হয় কেন?

আরিয়া ফেরদৌস মনোযোগ দিয়ে নাহিদ হোসেনকে দেখছেন। বয়সের ছাপ তার চোখে-মুখে স্পষ্ট। চুল পেকেছে, তবে দাঁড়ি রাখেন নি। নয়তো সাদা দাঁড়িতে আরো বয়ষ্ক লাগতো। বয়স পঞ্চাশের একটু নিচে। জীবনটা বোধহয় ফুরিয়েই যাচ্ছে। হয়তো বেশি হলে বিশ বছর বাঁচবেন। বাকীটা সৃষ্টিকর্তা যতোদিন বাঁচিয়ে রাখেন। কিন্তু তারা সোনালি সময়টা হারিয়ে ফেলেছেন। এখন কি আর ভালোবাসার সময় আছে? তবে অনেক বছর পর আরিয়া ফেরদৌসের মন বসেছে একটা অদ্ভুত লোকের হাসিতে। যাকে তিনি বেশিরভাগ সময় অদ্ভুত মানুষ বলেই সম্বোধন করেন। কিন্তু এই অদ্ভুত মানুষটা সত্যিই অদ্ভুত। নয়তো এই বয়সে এসে এতো ধৈর্য দিয়ে একটা মানুষের মন আকর্ষণ করতে পারছে, এর চেয়ে বড় অদ্ভুত ব্যাপার তো আর দ্বিতীয়টা হয় না।

এদিকে বিকেলে সূচনার ফোনে ফৌজিয়া ইসলামের কল এলো। মায়ের নম্বর দেখেই সূচনা হাসিমুখে কলটা রিসিভ করলো। কিন্তু ওপাশ থেকে মায়ের কথা শুনেই সূচনার চোখে-মুখে চিন্তার রেখা ফুটে উঠলো। সে সাথে সাথেই মাহাথিকে ফোন করে বলল,
“মাহা, বাবা খুব অসুস্থ। মা আমাকে যেতে বলেছে!”

মাহাথি চিন্তিত কন্ঠে বলল,
“আমি তো এখন আসতে পারবো না। একেবারে সন্ধ্যায় আসতে পারবো। একটা কাজ করো, বাসায় মারিয়া-মহুয়া আছে?”

“হ্যাঁ, আছে।”

“ওদের কাউকে সাথে নিয়ে তোমার বাবার বাসায় যাও। আমি অফিস থেকে সোজা ওখানে চলে যাবো।”

এরপর সূচনা এসে মারিয়া আর মহুয়াকে এই কথা বলল। আর তখন মারিয়া তার সাথে যেতে রাজী হলো। এদিকে তারা বের হওয়ার সময় স্বস্তিকা জিজ্ঞেস করলো,
“কোথায় যাচ্ছেন ভাবী?”

সূচনা বলল,
“বাবার বাসায় যাচ্ছি।”

“মা গেল দু’দিনও হয় নি, আর আপনি তো ঘুরাঘুরি শুরু করে দিয়েছেন। মা এলেই না হয় যাবেন। আমারও তো বাবার বাসায় যেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু আমি তো সংসার ফেলে যেতে পারি না।”

“আমার বাবা অসুস্থ। আমি তাকে দেখতে যাচ্ছি।”

“তাহলে মারিয়াকে কেন নিচ্ছেন? ওর তো পরীক্ষা। ওদের পড়াশোনার ক্ষতি হবে, তাই মা ওদের মামার বাসায় রেখে যান নি। অথচ আপনি এমন পরিবেশে ওকে নিয়ে যাচ্ছেন? কার অনুমতি নিয়েছেন আপনি?”

মারিয়া এবার একটু জোর গলায় বলে উঠলো,
“বড় ভাইয়ার অনুমতি নিয়েছে। আর আমাদের একমাত্র পুরুষ অভিভাবক আমাদের ভাই। বরং ভাইয়া আমাদের বাবার মতোই। তাই এটা নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না। আপনি রুমে গিয়ে বরং টিভি দেখুন।যেটা আপনি বেশিরভাগ সময় করেন।”

স্বস্তিকা চেঁচিয়ে বললো,
“তুমি আমার সাথে বেয়াদবি করছো?”

সূচনা তাদের থামিয়ে দিয়ে বলল,
“আমি যাচ্ছি। মারিয়া, বেশি কথা বললে, কথা বাড়বে। তাই কম কথা বলা ভালো। এখন চলো।”

তারা চলে যাওয়ার পর স্বস্তিকা মহুয়াকে তাদের দু’জনের বিরুদ্ধে অনেক কথা বলল। আর মহুয়া মনে মনে বলল,
“এরা আমাকে কোন বিপদে একা ফেলে গেল! আর কতোক্ষণ ভাবীর অভিযোগ শুনবো? আমার তো আজকেই ফিজিক্সের দুইটা বই রিভিশন করতে হবে। কালকে পরীক্ষা। ইয়া আল্লাহ, আমাকে সাহায্য করো।”

চলবে-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here