রংধনুর_আকাশ #লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ পর্ব-৫৮ (১ম অংশ):

0
685

#রংধনুর_আকাশ
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
পর্ব-৫৮ (১ম অংশ):

৯৪।
“হঠাৎ সে এসেছিলো, রঙিন স্বপ্নের বেশে,
হঠাৎ সে রাঙিয়েছিলো, অন্ধকার কাটিয়ে।
অপলক তার চাহনি, আমি মুগ্ধ তার হাসিতে
বারণ করেছি হয়তো, আজ তাতেই আমি আসক্ত।
তার আশেপাশে থাকাটা আমার অদ্ভুত আবদার,
তার স্নিগ্ধ মুখটা দেখা এখন আমার অভ্যাস।
শাড়িতে আর মন বসে না, ইনফরমালই পারফেক্ট,
ভালোবাসায় শাড়ি-চুড়ি, ফেলে না কোনো ইম্পেক্ট।
আজ লিখছি নতুন কবিতা, ছন্দে নতুনত্ব,
যা ছিল অতীত, ভুলেছি, এখন গিন্নীতেই মত্ত।”

প্রহর কবিতাটি লিখে ভুবন ভোলানো হাসি দিলো। আর মনে মনে বলল,
“মারিয়া, তোমাকে নিয়ে ভাবতেই আমার খুব ভালো লাগছে। এতোদিন পর আমার মনে হচ্ছে আমার মাঝে থাকা গম্ভীর প্রহরটা কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। বই পড়তে এখনো ভালো লাগে। কিন্তু আমার ইচ্ছে হয় তোমার সাথে সমুদ্র বিলাস করতে। তোমার হাত ধরে পাহাড় চড়তে। তোমার উচ্ছ্বসিত মুখটা দেখতে। আমি নিজেই বুঝতে পারছি না, কি হচ্ছে আমার।”

প্রহর রুম থেকে বেরিয়ে উঁকি দিয়ে দেখলো মারিয়া রান্নাঘরে টুংটাং করছে। রান্নাঘরের সামনে যেতেই দেখলো মারিয়া লাল সুতির শাড়ি পরে লেবু কাটছে। আঁচলের শেষ অংশ কোমড়ে গুঁজে দিয়েছে। কিন্তু সুতি শাড়ি হওয়ায় আঁচলের ভাঁজের কারণে হাতটা ভালোভাবে নাড়াতে পারছে না। কিছুক্ষণ পর পর কাঁধে আঁচল তুলে দিচ্ছে। যার ফলে মারিয়ার শরীর বেরিয়ে পড়েছে। প্রহর রান্নাঘরে এসে মারিয়ার শাড়িটা নামিয়ে দিতেই সে চমকে উঠলো। প্রহর ঝুঁকে মারিয়ার কানের কাছাকাছি মুখ নিয়ে বলল,
“তোমাকে শাড়ি পরতে বারণ করেছিলাম। তুমি তো শাড়ি সামলাতেই পারছো না। আর কাজ করার সময় কি কেউ শাড়ি পরে?”

মারিয়া প্রহরের দিকে ফিরে বলল,
“কেন আপনার কি শাড়ি পরা মেয়ে ভালো লাগে না?”

প্রহর কোনো উত্তর না দিয়ে মারিয়ার চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো। মারিয়া বলল,
“আপনার বউ শাড়ি পরে রান্না করবে, আর আপনি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাকে দেখবেন, এটাই তো চেয়েছিলেন আপনি!”

প্রহর চুপ করে রইলো। সে মনে মনে ভাবলো,
“মারিয়ার তো এসব জানার কথা না। এসব তো আমি কাউকে বলি নি। এগুলো তো আমি ডায়েরিতে লিখেছিলাম। তাহলে মারিয়া এসব কিভাবে জানলো?”

মারিয়া প্রহরের ভাবনায় বিরাম ঘটিয়ে বলল,
“সব ছেলে এমনই চায়, আমি ভাবলাম আপনিও তাই চান। এই জন্যই এভাবে শাড়ি পরেছি।”

প্রহর স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলল,
“তোমার বর তোমাকে ইনফরমাল দেখতে দেখতেই অভ্যস্ত হয়ে গেছে। আর শাড়ি তো মাঝে মাঝে পরলে মানায়, প্রতিদিন তো কেউ শাড়ি পরে না। আর তুমি এমনিতেই সুন্দর। শাড়ি পরে তোমার আলাদা আকর্ষণ নেওয়ার কোনো দরকার নেই৷ যারা প্রকৃতপক্ষে সুন্দর, তাদের সব পরিস্থিতিতেই ভালো লাগে।”

মারিয়া মলিন হেসে বললো,
“থাক না, শাড়িতেই থাকি। বলা তো যায় না, কবে আবার সব হারিয়ে বসে থাকি।”

প্রহর মারিয়ার কথার অর্থ বুঝলো না। মারিয়া প্রসঙ্গ পালটে বলল, “লেবু ভর্তা বানাচ্ছি, খাবেন?”

“তুমি বানাচ্ছ যেহেতু, তাহলে অবশ্যই খাবো।”

প্রহর মারিয়ার পাশে দাঁড়িয়ে লাল মরিচ দিয়ে লেবুগুলো ভালোভাবে কচলে দিলো। মারিয়া বলল,
“আরো কিছু দিতে হবে।”

“তুমি বাটিতে দিতে থাকো, আমি মেখে দিচ্ছি।”

মারিয়া প্রহরের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। প্রহর তার পাশে দাঁড়িয়ে তাকে সাহায্য করছে, অর্থাৎ প্রহর এখন তার যত্ন নেওয়া শুরু করেছে! মারিয়ার এসব ভাবতেই খুব ভালো লাগছে। আর এসব ভাবতে গিয়েই মারিয়ার চোখ ভিজে উঠলো। এটা আনন্দাশ্রু।

দুপুরে ভাত খাওয়ার সময় প্রহর রুমে চলে এলো। মারিয়া প্রহরের পিছু পিছু এসে বলল,
“খেতে ডেকেছি চলে এলেন যে!”

প্রহর হাতের দিকে তাকিয়ে বলল,
“হাত জ্বলছে। হঠাৎ এমন কেন হলো!”

মারিয়া প্রহরের হাতের দিকে তাকিয়ে বলল,
“কাটা তো যায় নি। তাহলে কি মরিচ কচলিয়েছেন তাই এমন হচ্ছে?”

“আমি কিভাবে বলবো! আমি তো প্রথম লেবু ভর্তা বানিয়েছি।”

“এমন হয়। প্রথম প্রথম আমারও হয়েছিল। ঠান্ডা পানিতে হাত ডুবিয়ে রাখলে ঠিক হয়ে যাবে।”

“না, না আমার এতোকিছু করার ইচ্ছে নেই। থাক ভাত খাবো না। তোমরা খেয়ে নাও।”

কথাটি বলে প্রহর মারিয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। তার হাত জ্বালা করলেও ওতোটাও করছে না যে সে ভাত নিজের হাতে খেতে পারবে না। কিন্তু আজ তার মারিয়ার হাতেই খেতে মন চাইছে।

মারিয়া অনেকবার তাকে ভাত খাইয়ে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু প্রতিবারই প্রহর মারিয়াকে সরিয়ে দিয়েছিল। আর আজ সেই অবহেলা করা বিষয়টিই প্রহরের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলো।

মারিয়া কিছুক্ষণ ভেবে বলল,
“আমি মাকে বলি আপনাকে খাইয়ে দিতে?”

প্রহর মারিয়ার কথা শুনেই দমে গেলো। সাথে সাথেই বলে উঠলো,
“না, না। মা হুড়োহুড়ি করে খাইয়ে দেয়। আমার মুখের চেয়ে মায়ের হাতে ভাতের লোকমাটাই অনেক বড় থাকে।”

মারিয়া কথাটি শুনেই হেসে দিলো। এরপর বলল,
“আফরাও আপনার মতোই বলে। আমার ছোট মামার মেয়ে, ও তো মামীর হাতে ভাত খেতে চায় না। মামী নাকি এক গাদা ভাত ওর মুখে ঢুকিয়ে দেয়। কিন্তু মহু..”

মহুয়ার নামটি নিতে গিয়েই মারিয়া থেমে গেলো। সে মহুয়ার নাম প্রহরের সামনে তুলতে চায় না। সে যথাসাধ্য মহুয়াকে তাদের সম্পর্ক থেকে দূরে রাখতে চায়। সে এমন কিছুই বলবে না, যা শুনলে প্রহর এক মিনিটের জন্যও মহুয়াকে কল্পনা করবে।

প্রহর মারিয়াকে বলল,
“এতো কথা না বলে এখন বলো কিভাবে খাবো! অনেক ক্ষিধে পেয়েছে।”

মারিয়া ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
“আমি খাইয়ে দেবো?”

প্রহর মনে মনে খুশি হলেও মুখে গম্ভীর ভাব নিয়ে বলল,
“হ্যাঁ, তোমার সমস্যা না হলে দিতে পারো। ক্ষিধে না পেলে একটু পরেও খেতে পারতাম। কিন্তু ক্ষুধার রাজ্য পৃথিবী গদ্যময়।”

আজ প্রহর পেট ভরেই ভাত খেয়েছে আর মারিয়া তার বহুদিনের ইচ্ছে পূরণ করেছে। আর এভাবেই অল্প অল্প করে প্রহর মারিয়াকে নিজের কাছে টেনে নিচ্ছে।

একমাস পর-

প্রহর আর মহুয়া বাতিঘরের পাশে একটা ফুচকার দোকানে বসলো। মহুয়া ফুচকা অর্ডার করে প্রহরের দিকে তাকিয়ে বলল,
“ভাইয়া, আমাদের দু’জনের ইচ্ছে পূরণ হতে যাচ্ছে।”

প্রহর ফোন বের করে মহুয়াকে কয়েকটা ছবি দেখিয়ে বলল,
“এগুলো দেখতে কেমন?”

“অসম্ভব সুন্দর। তবে এ বছরটা আমার জন্য অনেক খারাপ ছিল। আর এখন আমাদের পরিকল্পনা যদি ভালো ফল দেয়, তাহলে আমার জন্য এ বছরটা সেরা হবে।”

“তোমার পান্ডুলিপি তো শেষ হয়ে গেলো। এখন বইটা তাড়াতাড়ি বের হোক।”

“বইটা জন্মদিনের আগেই চলে আসবে। তবে একটা কথা অবশ্যই বলবো, এই বইটা লেখার প্রেরণা আমি আপনার কাছ থেকেই পেয়েছি। মারিয়া অনেক ভাগ্যবতী। আপনার মতো একজন বর পেয়েছে।”

“ভাগ্যবান আমি। মারিয়ার মতো লক্ষী বউ পেয়েছি। ও শুধু আমার মনে জায়গা নেওয়ার জন্য অনেক কিছুই করেছে। কিন্তু আমি সবসময় ওকে বকাবকি করি, ওহ সরি, বকাবকি করতাম। ইদানীং একদম বকা দেই না।”

মহুয়া হেসে বলল,
“ও হাজার বকা খেলেও নাছোড়বান্দার মতোই যা মনঃস্থির করবে, তাই করে ছাড়বে।”

প্রহর মনে মনে হাসলো আর বলল,
“তাই হয়তো মেয়েটা আলাদা। আর ওর এই আলাদা বৈশিষ্ট্যগুলোই আমাকে খুব আকৃষ্ট করেছে। তাই হয়তো আমি ওর মাঝেই আসক্ত হয়ে পড়েছি। এখন আর চোখ বন্ধ করলে আমার কল্পনায় মায়াবতী আসে না। সবসময় মারিয়াকেই দেখি।”

প্রহর এবার মহুয়াকে বলল,
“দুই সপ্তাহ পর আমার এতোদিনের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হবে।”

মহুয়া কিছু একটা ভেবে মলিন দৃষ্টিতে বাইরে তাকালো। প্রহর বলল, “কি ব্যাপার!”

মহুয়া বলল,
“মারিয়া হুট করে আমার কাছ থেকে অনেক দূরে চলে গেছে। ওর অনেক অভিযোগ। কিন্তু আমি বুঝি না ওর এমন অভিযোগের কারণটা কি! আমাদের সুন্দর সম্পর্কে ধুলো জমে গেছে। আমি মারিয়াকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি। আমার কাছে ওর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর কেউ নেই।”

এদিকে মারিয়া আজ হুট করেই বাতিঘরে চলে এলো। বাতিঘরে এসেই সে আশেপাশে প্রহরকে খুঁজতে লাগলো। হঠাৎ একটা মেয়ে মারিয়ার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। মারিয়া তার চাহনি দেখে তার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বই ঘাঁটাঘাঁটি করতে লাগলো। মেয়েটি হঠাৎ প্রশ্ন করলো,
“আপু একটা প্রশ্ন করি!”

মারিয়া মুচকি হেসে বলল, “হ্যাঁ, অবশ্যই।”

“তুমি তো একটু আগে অন্যভাবে বের হয়েছিলে। এখন ভিন্ন লাগছে কেন?”

মারিয়া পালটা জিজ্ঞেস করলো,
“তুমি আমাকে চেনো!”

“কেন চিনবো না। তুমি তো এখানে মাঝে মাঝে বই পড়তে আসো। আমি তোমাকে দেখেছি। আর ওদিকটাই একটা ভাইয়া বসে বসে তোমার দিকে তাকিয়ে থাকতো। এখন তো দেখছি তার সাথে তোমার কথাবার্তা হয়। কিছু মনে করবে না আপু, তোমাদের একসাথে অনেক ভালো লাগে।”

কথাটি শুনে মারিয়ার গলার পানি শুকিয়ে গেলো। মেয়েটা আবার বলল,
“কিন্তু তুমি তো এই মাত্র বের হয়েছিল। জামা কোথায় পাল্টালে?”

মারিয়া মেয়েটিকে বলল,
“আচ্ছা, এতোদিন আমার সাথে যে কথা বলতো সে কি আজকে এসেছিল?”

মেয়েটি কিছুক্ষণ চুপ করে মারিয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর বলল,
“আপু, তোমার সাথেই তো বের হয়েছিল দেখলাম।”

মেয়েটি মারিয়ার প্রশ্ন শুনে তাকে হয়তো পাগল ভাবছিলো। কিন্তু মেয়েটির কথা শুনে মারিয়ার এখন নিজেকে সত্যিই পাগল মনে হচ্ছে। তার ইচ্ছে করছে হাত-পা ছুঁড়ে কান্নাকাটি করতে। সে তাড়াতাড়ি বাতিঘর থেকে বের হয়ে আশেপাশে প্রহর আর মহুয়াকে খুঁজতে লাগলো।

তারা একটু আগে বের হয়েছে! তারা একসাথে কোথায় গিয়েছে! প্রহর তো বাইক নিয়ে বের হয়েছিল। তাহলে কি মহুয়া প্রহরের বাইকের পেছনে বসেছে! এসব ভাবতে ভাবতেই মারিয়া অস্থিরভাবে হাঁটতে লাগলো। হঠাৎ প্রহরের বাইকটা দেখে সে থমকে গেলো। সে প্রহরের বাইকে একটা মুচকি হাসির স্টিকার বসিয়ে দিয়েছিল। সেই স্টিকারটি দেখেই সে চিনে ফেলেছে প্রহর আশেপাশেই আছে। মারিয়া ভালোভাবে এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখলো মহুয়া ফুচকা খাচ্ছে আর প্রহর তার সাথে কথা বলেই যাচ্ছে। কথা বলার এক পর্যায়ে প্রহর হাসছে, আবার ফোনে মহুয়াকে কি যেন দেখাচ্ছে। মহুয়াও খুব সাবলীলভাবে প্রহরের সাথে কথা বলছে। তার মধ্যে কোন জড়তা নেই। এই মুহূর্তে তাদের দেখলে যে কেউ মনে করবে, তারা প্রেমিক-প্রেমিকা।

মারিয়া কয়েক পা সামনে এগিয়ে যেতেই একটা লোকের সাথে ধাক্কা খেয়ে রাস্তায় পড়ে গেলো। দু’জন মাঝ বয়সী ছেলে মনে করলো মারিয়া অসুস্থ। তাই তারা মারিয়াকে উঠিয়ে বসিয়ে দিলো। মারিয়া তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে সেখান থেকে চলে গেলো। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, এতোকিছু তাদের সামনের রাস্তায় হলো, অথচ তারা খেয়ালই করলো না। দোকান যেহেতু খোলামেলা ছিল, তাদের ঘটনাটি অন্তত চোখে পড়া উচিত ছিল। কিন্তু তারা এতো মনোযোগ দিয়ে কথা বলছিল যে তাদের আশেপাশে কি হচ্ছে সেই খেয়াল তাদের নেই।

মারিয়া মনে মনে ভাবছে,
“তারা একে-অপরকে এতো ভালোবাসে? ওদের জীবনে আমার তো কোনো অস্তিত্বই নেই।”

চলবে-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here