#নেশাক্ত_ভালোবাসা
#লেখিকাঃ Tamanna Islam
#পর্বঃ ০৫
আরুশিকে তো তার বিয়ের আসর থেকে ভাগিয়ে নিয়ে এসে রহিতের সাথে আব্রাহাম বিয়ে দিয়ে দিয়েছে। আর এতো বড়ো একটা কান্ড করার পর অবশ্যই কেউ চুপ বা শান্ত হয়ে থাকবে না। আর আরুশির যে বাপ পুরাই কষাই। বিয়ের আসর থেকে এই যে আরুশির মা আরুশিকে নিয়ে ওপরে রুমে গেলো আর তো আসার নাম গন্ধ নেই। এদিকে পাত্রপক্ষরা কানাঘুষা শুরু করে দিয়েছে। আর আরুশির বাপের মাথা গরম। ওপরে রুমে আরুশির মা তো এক চিৎকার দিয়েই শেষ। তিনি দ্রুত নিচে নেমে আসেন। আরুশির বাবা আতাউর আরুশির মা কে এভাবে দ্রুত পায়ে নিচে নামতে দেখে বেশ অবাক হয়। তিনি উঠে গিয়ে আরুশির মায়ের কাছে যান।
আতাউর;; কি হয়েছে কুসুম এমন ঘাবড়ে আছো কেন? আরুশি কোথায়। আরে জলদি ওকে আনো বিয়ের সময় তো চলে যাচ্ছে।
কুসুম;; কোথা থেকে আনবো ওকে। আরুশি পালিয়ে গেছে।
আতাউর;; কিহহহ,, কি বলছো এই সব। কীভাবে পালালো?
কুসুম;; আরে রুমের দরজা খুলছে না দেখে আমি ভাবলাম আমি নিজেই ভেতরে গিয়ে দেখি। গিয়ে দেখি ওরনা নিচে পরে আছে আর বাইরের দিকে বড়ো পর্দা ঝুলছে। পালিয়ে গেছে ও।
আতাউর;; এখন, এখন কি হবে। আমি সবার সামনে মুখ কীভাবে দেখাবো। আমার নাক কাটা গেছে তোমার একমাত্র মেয়ের জন্য।
কুসুম;; শোন ঘরের ছেলেমেয়েদের এত্তো কড়া শাসনে রাখলে এমনই হবে। আরুশি যাকে পছন্দ করতো সে কি খারাপ ছিলো নাকি। নিজের বিজনেস আছে, দেখতে ভালো, পছন্দ করে আমাদের মেয়েকে। সমস্যা টা কোথায় ছিলো। কিন্তু না তুমি মেনে নিলে না। নিজের স্বার্থ, শুধু মাত্র নিজের স্বার্থের কথা ভেবে মাঝবয়স্ক একটা লোকের সাথে আরুশির বিয়ে দিতে চলেছিলে। রহিত যদি একটা লাফাঙা হতো বা বেকার হতো তাহলে একটা কথা ছিলো। সবদিক দিয়েই ভালো ছেলে কে কেউ মানা করে দেয়। নিজের স্বার্থের জন্য বিয়ে দিচ্ছিলে মেয়েটার। আর শুনে রাখো আজ সবার সামনে তোমার মাথা নিচু হবে শুধু তোমার দোষের কারণেই।
আতাউর;; তোমার মেয়েকে পেলে আমি কেটে টুকরো টুকরো করে জলে ভাসিয়ে দিবে।
কুসুম;; তুমি জীবনেও সুধরাবে না। এবার সামলাও সব।
এই বলেই এক রাশ রাগ আর জেদ নিয়ে কুসুম বেগম চলে গেলেন। আর এদিকে তো আতাউর ভেবে পাচ্ছে না যে সবাইকে কি বলবে। এতো বড়ো বিয়ে বাড়ি,এতো গুলো লোকজন সবার সামনে কি করে। ভাবতেই লজ্জা লাগছে তার। আর এদিকে দিয়া আইরাতকে খুজতে খুজতে হয়রান। মেয়েটা কোথায় যে গেলো। গত বিশ মিনিট যাবৎ খুঁজে বেড়াচ্ছে। একদিক দিয়ে যেমন আইরাতের জন্য চিন্তা হচ্ছে তেমন রাগও লাগছে। এতো গুলো মানুষের মাঝে কোথায় চলে গেলো না বলে কয়েই। আর বিয়ের সময় প্রায় শেষ এখন বাড়ি যাবে। দেরি করে বাড়ি গেলে আইরাতের চাচি আইরাতকে আস্তো চিবিয়ে খাবে। দিয়া হন্ন হয়ে আইরাত কে খুঁজে চলেছে তবে তখনই কারো চিল্লানোর আওয়াজে দিয়া থেমে যায়। চিল্লা-চিল্লির শব্দ যেখান থেকে আসছে সেখানে গেতেই দিয়া বেশ অবাক হয়। হবু জামাই একদম আরুশির বাপের সাথে মারামারি লাগার উপক্রম। দিয়ার এমন সিন দেখে হাসি যেন আর সইছে না। এটাই প্রব্লেম সিরিয়াস মোমেন্টে হেসে দেওয়া। অবশ্য আইরাতই শিখিয়েছে তাকে। আইরাতের সাথে থাকতে থাকতে তার প্রভার পরেছে। কিন্তু আশে পাশের মানুষের কথা যখন দিয়া শুনে তখন চিন্তায় তার তো পরাণ পাখি উড়েই গেলো। আরুশি নাকি পালিয়ে গেছে। কিন্তু কীভাবে পালালো, কখন পালালো আর কার সাথেই বা পালালো? তখন দিয়ার মনে পরে আরুশির প্রেমিকের কথা। দিয়া দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এইসব কিছুই ভাবছিলো তখন বিকট শব্দে চমকে উঠে সামনে তাকায় দেখে যে জামাই অনেক বড়ো একটা স্টীলের থালা রাগে চটকিয়ে দিয়েছে। আর আরুশির বাবা সাথে সাথে জামাই এর কলার খামছে ধরে। অবস্থা বেগতিক। সবাই গিয়ে হুড়মুড় করে থামায়। অবশেষে আর কি বিয়ে ভেংে গেলো। পাত্রপক্ষ রাগে দুঃখে চলে গিয়েছে। আস্তে আস্তে বাড়ি থেকে সব মানুষ প্রস্থান করতে লাগলো। আতাউর এক জায়গায় বসে রাগে ফুসছেন। কিন্তু দিয়া তো এখনো আইরাতকে পেলো না। সে গিয়ে আবার সারা বাড়িতে খুজতে লাগলো। খুজতে খুজতে দিয়া কুসুম বেগমের সামনে পরে যায়।
কুসুম;; আরে দিয়া কি হয়েছে, কাউকে খুজছিস নাকি?
দিয়া;; আন্টি আইরাত আছে না আমার সাথে যে এসেছিলো। তাকে কোথাও পাচ্ছি না।
কুসুম;; আরে এখানেই হয়তো আছে কোথায়। ভালো ভাবে দেখ পেয়ে যাবি। চিন্তা করিস না।
দিয়া;; আন্টি আধাঘন্টা ধরে খুজছি। নেই কোথাও। বাসায় জানে আইরাত কাজ করছে এখন যদি ওকে ছাড়া আমি যাই তাহলে ওর বাড়ির লোকজন শেষ। আর আইরাতের একটা চাচি আছে উনি তো আইরাতকে মেরেই ফেলবেন।
কুসুম;; কি বলিস, আচ্ছা আয় তো দেখি কোথায় গেলো মেয়ে টা।
দিয়া আর কুসুম বেগম মিলে আইরাতকে খুজতে লাগলো। কিন্তু আইরাত যখন সেখানেই নেই তাহলে হাজার খুজেও কাজ হবে না। দিয়া আর কুসুম বেগম নিচে হলরুমে এসে থেমে পরেন। আতাউরের চোখ দিয়ে যেন আগুন ঝড়ছে। এত্তো রাগ। তা কুসুম বেগম খেয়াল করেন। আর দিয়া এদিক ওদিক তাকাতাকি করছে আইরাতের জন্য।
তখনই আতাউর রেগে বলে উঠেন…
আতাউর;; এমন মেয়ে থাকার চেয়ে মরে যাওয়া বেশ ভালো। সবার সামনে আমার নাক কাটিয়ে গেলো।
কুসুম;; শোন আমাদের মেয়ে কোন খারাপ ছেলে কে পছন্দ করেনি। এখন তোমার অনেক রাগ কারণ তোমার স্বার্থ হাসিল হয় নি।
আতাউর;; চুপ করো। আরুশি একা কখনোই এই বিয়ে বাড়ি থেকে একা পালিয়ে যেতে পারবে না। ওর পক্ষে সম্ভব না।
কুসুম;; কি বলতে চাইছো তুমি?
আতাউর;; কেউ একজন ওকে সাহায্য করেছে। অবশ্যই করেছে নয়তো এটা একজনের কর্ম নয়।
আতাউর এগুলো বলছিলো তখনই দিয়া তার আন্টি কে ইশারা করে যে আইরাতকে তো এখনো পেলো না। আর এটা আতাউরের চোখ এড়ায় নি। সে বলে উঠে…
আতাউর;; দিয়া…!
দিয়া;; জ্বি আংকেল।
আতাউর;; তোমার সাথে যেই মেয়েটা মানে তোমার বোন এসেছিলো সে কোথায়?
দিয়া;; আংকেল ওকেই কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না। কোথাও যে চলে গেলো না বলেই। প্রায় অবেকক্ষন যাবৎ খুজছি কিন্তু পাচ্ছি না।
আতাউর;; পালিয়ে গেছে।
দিয়া;; কি?
আতাউর;; হ্যাঁ পালিয়ে গেছে। আরুশি পালিয়ে গেছে আর সাথে তোমার ওই বোনও। নয়তো একই সময়ে দু দুটো মেয়ে বাড়ি থেকে কীভাবে গায়েব হয়ে যেতে পারে। তাও আবার একই সময়ে। তোমার ওই বোনই আরুশিকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছে৷
আতাউরের কথা শুনে দিয়ার রাগও হয় আর বেশ চিন্তাও। কিন্তু আইরাত যে জীবনে এমন কোন কাজ করবে না তা দিয়া জানে। আর দিয়ার সাথে আজই আইরাতের প্রথম দেখা আর আজই আইরাত কীভাবে পালিয়ে যেতে সাহায্য করবে তাকে। যেই মেয়ে কখনো একটা মশা পর্যন্ত মানে নি সে কিনা বিয়ের আসর থেকে মেয়ে কে নিয়ে পালাবে। ভাবা যায় এগুলা।
আতাউর;; ওই মেয়ে, ওই মেয়েই আরুশিকে নিয়ে পালিয়েছে। আরুশিকে ওর প্রেমিকের কাছে যেতে সাহায্য করেছে। সব কিছু তারা মিলে করেছে।
এবার যেন দিয়া আর চুপ করে থাকতে পেলো না, প্রচন্ড রাগ হচ্ছে তার।
দিয়া;; ব্যাস আংকেল অনেক হয়েছে। অনেক বলেছেন। আপনার কী মনে হয় আপনি মুখ দিয়ে যা বলবেন তাই শুনে নিবো। অনেক বলেছেন। আর একটা কথা আপনি আইরাতের ব্যাপারে বলবেন না। আইরাত আরুশি আপু কে আজ প্রথম দেখলো। আর আমিই জানতাম না যে আরুশি আপু কাউকে পছন্দ করে সেখানে আইরাত কীভাবে ওকে হেল্প করবে। আইরাত তেমন মেয়েই না। আর এতো লোকজনের ভীড়ে সে আরুশি আপু কে হেল্প করবে প্রশ্নই আসে না। আর কথা রইলো পালিয়ে যাওয়ার তো কোন মেয়েই চাইবে না নিজের বয়সের দ্বীগুণ একজনের সাথে নিজের বিয়ে হোক। আজ নিজের দোষে আপনার এই হাল। আমারই ভুল হয়েছে যে নিজের সাথে আইরাতকে এখানে এনেছিলাম। দয়া করে আইরাতকে আর দোষ দিবেন না। আইরাতের কথা ছেড়ে নিজের মেয়েকে খুজুন। আসলে কি আরুশি আপু পালিয়ে অনেক ভালোই করেছে।
দিয়া রাগে আগুন হয়ে আছে। আর এই কথা বলেই সে বিয়ে বাড়ি থেকে সোজা বের হয়ে পরে। পুরো বাড়ি ৩-৪ বার চক্কর কাটা শেষ তবে আইরাত নেই। এবার যেন দিয়া আইরাতের চিন্তায় আসর হয়ে যাচ্ছে। আইরাতের চাচা আর চাচি কে কি বলবে সে। আর কোন উপায় না পেয়ে দিয়া কাপাকাপা হাতে আইরাতের চাচা ইকবাল কে ফোন দেয়।
দিয়া;; হ হ হ্যালো..
ইকবাল;; আরে দিয়া যে কেমন আছো মা?
দিয়া;; আংকেল আসলে আপনার সাথে কিছু কথা ছিলো জরুরী।
ইকবাল;; হ্যাঁ হ্যাঁ বলো।
দিয়া;; আসলে আংকেল আইরাত আজ হোটেলে যায় নি।
ইকবাল;; মানে?
দিয়া;; আসলে আংকেল ভার্সিটি শেষে আইরাত আমার সাথেই ছিলো। হোটেলে কাজে যেতে চেয়েছিলো কিন্তু আমিই যেতে দেই নি। আমার এক কাজিনের বিয়ে ছিলো তো তাই সেখানে আইরাতকে নিয়ে এসেছিলাম। তবে দূর্ভাগ্যবশত বিয়ে টা হয় নি। ভেংে গিয়েছে। তবে একটা সমস্যা হয়েছে।
ইকবাল;; কি হয়েছে? (চিন্তিত হয়ে)
দিয়া;; আইরাতকে না কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মানে আমি সবাইকে জিজ্ঞেস করেছি, সব জায়গায় খুজেছি কিন্তু আইরাতকে কোথাও পাচ্ছি না। জানি না কোথায় চলে গেলো।
ইকবাল;; কি, এইসব কি বলছো দিয়া। আইরাত তো তাহলে সারাদিন তোমার সাথেই ছিলো তাই না। তাহলে না বলেই কোথায় যাবে। আইরাত তো মনে হয় সেখানে কাউকে চিনেও না তাহলে কোথায় গেলো মেয়েটা?
দিয়া;; সেটাই তো বুঝে উঠতে পারছি না আংকেল। আর আমাকে মাফ করবেন আমি আসলে আপনাকে না বলেই আইরাতকে নিজের সাথে নিয়ে এসে পরেছি। আংকেল আই এম সরি।
ইকবাল;; না না দিয়া এভাবে বলো না মা। আমি জানি তুমি আইরাতের কতো ক্লোজ। তুমি আইরাতের মন্দ চাইবে না। এতে দোষ নেই তোমার। কিন্তু কথা হচ্ছে মেয়েটা কোথায়। আইরাতের চাচি এমনিতেই মেয়েটাকে কথা শুনায় আজ তো শেষ করে দিবে।
ইকবাল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে রাত বেজে চলেছে এগারো টা।
ইকবাল;; এগারো টা বাজে। এতো রাত অচেনা একটা জায়গা। চিন্তা হচ্ছে। খারাপ কিছু হলো না তো।
দিয়া;; না আংকেল আপনি চিন্তা করবেন না। দেখি কি করা যায়।
ইকবাল;; আচ্ছা।
ইকবাল ফোন কাটতেই পেছন ঘুড়ে দেখে যে কলি দাঁড়িয়ে আছে৷ ওইযে বলে না যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যাে হয়। কলি নিজের কোমড়ে দুইহাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ইকবাল তাকে এক রকম ইগনোর করেই পাশ কেটে চলে আসে। আস্তে আস্তে ঘড়ির কাটা বারো টার ঘরে গিয়ে আটকে পরে। হলরুমে আইরাতের চাচা চাচি বসে আছে, একদম চুপ। আর এই নীরবতায় ঘড়ির কাটা টা বারো তার ঘরে গিয়ে ঢং ঢং আওয়াজ করে উঠলো। চিন্তায় অবস্থা খারাপ সবার। ইকবার বসে ছিলো, নিজের সামনে এক কাপ চা রাখা। সেটাও ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে। হঠাৎ ফোন বেজে ওঠে ইকবাল জলদি করে ফোন টা রিসিভ করে। দিয়ার ফোন।
ইকবাল;; হ্যালো দিয়া পেয়েছো আইরাত কে?
দিয়া;; না আংকেল এখনো পায় নি। আমি গাড়িতে। সব জায়গারই খোজ রাখছি। কিন্তু আইরাতকে পাচ্ছি না।
ইকবাল;; আচ্ছা দিয়া পুলিশে জানালে কেমন হয়?
দিয়া;; আংকেল ২৪ ঘন্টার আগে পুলিশ কোন মিসিং কেস ফাইল করবে না। আমাদের একটু ওয়েট করতে হবে।
আইরাতের চিন্তায় তার চাচার যেন প্রেসার বেড়ে গেলো। দিয়া কোন রকমে আইরাতের চাচাকে শান্ত করে ফোন টা রেখে দেয়। আর তখনই আইরাতের চাচি চিল্লিয়ে ওঠে….
কলি;; পালিয়ে গেছে তাই না, আমাদের মুখে চুন কালি মেখে পরের এক পোলার সাথে পালিয়ে গেছে তোমার এই আদরের লাডলি আইরাত। আগেই বলেছিলাম কোন ছেলে টেলে দেখে বিয়ে দিয়ে দাও কিন্তু না উনি পড়াশোনা করবেন। বাইরে কাজে পাঠালে। না জানি কেমন কেমন ছেলেদের সাথে ঘুড়ে বেড়ায়। এবার ফল ভোগ করো।
ইকবাল;; আহা, কলি। থামো তো একটু। মেয়েটাকে পাওয়া যাচ্ছে না কোথায় একটু শন্তির কথা বলবে তা না সব আজাইরা কথা।
কলি;; এখন না সবাই ছি ছি করবে আমাদের ওপর। তখন শান্তির বাণি শুনো বেশি করে।
ইকবাল;; চুপ করো কলি। বাবা-মা মরা মেয়েটা। যখন থেকে মেয়েটা আমাদের সাথে থাকা শুরু করেছে মেয়েটাকে কোন না কোন ভাবে তুমি কথা শুনাও। মেনে নিতে পারো না। আর আইরাত পালাবে। এটা কি বললে তুমি নিজেই একবার ভেবে দেখো তো। গায়েব হয়েছে আইরাত। আচ্ছা আইরাতের কথা বাদই দাও আজ যা হয়েছে তা যদি তোমার ছেলে রনিতের সাথে হতো তাহলেও কি তুমি এই ধরনের কথা বলতে যে রনিত একটা মেয়ে কে নিয়ে পালিয়েছে। আল্লাহ’র ওয়াস্তে চুপ করো কলি। যত্তসব।
এই কথা বলেই ইকবাল উঠে পরে চলে যায়। আর কলি মুখকে বিষ বানিয়ে দিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে থাকে।
।
।
।
ক্লোরোফোমের ডোজ টা অনেক বেশিই তীব্র ছিলো তাই সহজে আইরাতের জ্ঞান ফিরে নি। আরুশি আর রহিতের বিয়ে হয়ে যাওয়ার প্রায় আরো এক ঘন্টা পর আইরতের জ্ঞান ফিরে। ধীরে ধীরে আইরাতে চোখ মেলে তাকায়। মাথাটা আগের থেকে অনেকটাই ভার ভার লাগছে। চোখের সামনে সব ঝাপসা হয়ে আসছে। তবুও কোন রকম করে নিজের চোখ মেলে তালায়। মাথা টা তুলতে যাবে তখন একটু ঘুড়ে ওঠে। নিজের এক হাত দিয়ে মাথার এক পাশে খানিক ধরে চোখ মুখ সব কুচকে ফেলে। আরেক হাতের ওপর ভর দিয়ে কোন রকমে উঠে বসে। চুল গুলো এলোমেলো হয়ে গেছে। মাথা চেপে ধরে। আইরাত একটা বিছানার ওপর আছে আর তখন সেই হুট করেই সারাঘরে অন্ধকার হয়ে যাওয়া, কারো তার মুখ শক্ত ভাবে চেপে ধরা সবই যেন আইরাতের সামনে ভেসে ওঠে। আর তখনই আইরাতের হুশ আসে। চোখ গুলো বড়ো বড়ো হয়ে যায়। নিজের চারিপাশে ভালোভাবে তাকিয়ে দেখে একটা বড়সড় বিছানার ওপর সাদা চাঁদরে মুড়ে রয়েছে সে। নিজের দিকে তাকিয়ে ফট করে চাদর টা সরিয়ে ফেলে। এ কোথায় সে, বিয়ে বাড়িতে না ছিলো। তাহলে এখানে কি করে। এবার আইরাত পুরো ঘরে একবার চোখ বুলায়। সাদা কালারের জিনিস সব থেকে বেশি। দেওয়াল গুলো সাদা, জালানার পর্দা গুলো সাদা। অর্থাৎ বেড সিড থেকে শুরু করে একদম কার্পেট পর্যন্ত সব কিছুই সাদা। আর তার ওপর খুব এক্সপেন্সিভ জিনিসপত্র ঘরের সবদিকে। দেখেই বুঝা যায় যে যেই এখানে থাকে সে খুব শৌখিন প্রকৃতির একজন। যাই হোক আইরাত উঠে পরে। উঠে নিজের দিকে একবার তাকায়। নাহ, সব ঠিকই আছে। তারপর আইরাত সোজা দরজার কাছে চলে যায়, দরজায় ধাক্কাতে থাকে কিন্তু তা বাইরে থেকে বন্ধ করা। আইরাত গলা ছেড়ে অনেক বার দিয়া দিয়া বলে ডাক দেয় কিন্তু কোন সাড়াশব্দ নেই। মাথাটা হ্যাং মেরে আছে। আইরাত গিয়ে জানালার কাছে দাঁড়ায়। জানালার পর্দা টা সরিয়ে বাইরে তাকাতেই আইরাতের মাথা টা যেন আরেক দফা চক্কর দিয়ে ওঠে। জানালার বাইরে মানুষ গুলো কে নিতান্তই ক্ষুদ্র পিপড়ের মিতো লাগছে। তার মানে এই যে আইরাত খুব সুউচ্চ একটা বিল্ডিং এ আছে। আইরাত তা বুঝতে পেলো। তখনই আইরাতের কানে কারো পায়ের শব্দ আসে। যেন কেউ ভারি ভারি কদম ফেলে ঠক ঠক শব্দ করে এইদিকেই আসছে। না চাইতেও আইরাতের ভেতর একটা ভয় কাজ করছে৷ আইরাত জানালা থেকে এসে আবার বিছানার ওপর গিয়ে বসে। দুই হাত দিয়ে নিজের মাথা চেপে ধরে। আশে পাশে কোন ঘড়িও নেই যাতে দেখতে পারে যে আসলে কটা বাজে। অনেক রাত, বাসায় হিলয়তো সবাই চিন্তায় মরছে আর দিয়া ও না জানি কোথায় কোথায় তাকে খুজছে আর বকছে। এগুলো ভাবছিলো আইরাত হঠাৎ তার কানে সিটি বাজানোর শব্দ আসে। আইরাত কপাল কুচকে এই শব্দের উৎস খুজছে। কিন্তু আওয়াজ যেন বেড়েই চলেছে। অর্থাৎ সিটি দিয়ে কেউ কোন গানের সুর তুলছে। আইরাত দরজার দিকে এক নয়নে তাকিয়ে আছে।
—- বাহার ছে কোয়ি আন্দার না আ সাকে, আন্দার ছে কোয়ি বাহার না যা সাকে। ছোচো কাভি এছা হো তো ক্যায়া হো, ছোচো কাভি এছা হো তো ক্যায়া হো। হাম-তুম এক কামড়ে ম্যা বান্দ হো ওর চাবি খো যায়ে~~।
এমন অদ্ভুত মার্কা গান শুনে আইরাতের কপালে যেন চিন্তার ভাজ আরো কয়েক গুণ বেড়ে যায়। তখনই দরজা খুলে ভেতরে কেউ একজন প্রবেশ করে। ব্যাক্তিটিকে দেখে আইরাতের মুখ হা হয়ে গেলো আর চোখ গুলো রসগোল্লা।
আব্রাহাম;; হে হায় বেইব… (হাত টা কে একটু ওপরে তুলে)
আইরাত;; আ আ আপনি, এখানে মানে কী করে। আপনি এখানে কি করছেন?
আব্রাহাম;; আমার গেস হাউজে থেকেই আমাকেই বলছো আমি এখানে কিভাবে এলাম..!
আইরাত আবার নিজের চারিপাশে তাকায়।
আইরাত;; এটা আপনার গেস্ট হাউজ?
আব্রাহাম;; অবশ্যই।
আইরাত;; তো আমি এখানে কি করছি। আমি কীভাবে এখানে এলাম?
আব্রাহাম;; আহা, তুমি আসো নি তোমাকে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে।
আইরাত;; নিয়ে আসা হয়েছে মানে…!
আব্রাহাম;; হ্যাঁ আসলে ভুলবশত।
আইরাত;; মানে কি?
আব্রাহাম;; ক্লিয়ার করছি। মানে নিয়ে আসতে গিয়েছিলো এক মেয়ে কে আর ভুল করে নিয়ে এসেছে আরেক মেয়ে কে।
আইরাত;; আশ্চর্য তো, ভুল করে আমাকে কেন আনবেন। আর এক্সিউজ মি ওটা একটা বিয়ে বাড়ি ছিলো। বিয়ে বাড়িতে কাকে তুলে আনতে গিয়েছিলেন। আর আরুশি আপু, আপুর তো আজ বিয়ে তাহ……..
আব্রাহাম;; আরুশিকেই নিয়ে আসতে গিয়েছিলো কিন্তু ভুলে তুমি এসে পরেছো। আর আরুশির বিয়ে হয়ে গেছে। ওকে নিয়ে এসেছি আমি আর বিয়েও অনেক আগেই শেষ।
আইরাত;; কার সাথে বিয়ে হলো আর কীভাবে হলো?
আব্রাহাম;; আমার ফ্রেন্ড রহিতের সাথে। কেননা আরুশি আর রহিত একে ওপর কে ভালোবাসে৷
আইরাত;; তার মানে আরুশি আপু যাকে ভালোবাসে সে আপনার ফ্রেন্ড হয়?
আব্রাহাম;; একদম ঠিক।
আইরাত;; আচ্ছা যাই হোক। বিয়ে তো হয়েই গিয়েছে এবার প্লিজ আমাকে যেতে দিন। বাসায় হয়তো সবাই আমার জন্য চিন্তা করছে। কাউকে বলে আসিনি। বাসায় যেতে হবে নয়তো অনেক ঝামেলা হয়ে যাবে প্লিজ যেতে দিন আমায়।
আব্রাহাম;; ন্যাহ, এতো সহজেই কি করে যেতে দেই বেইবি।
আইরাত;; লিসেন আমার নাম আছে একটা আইরাত। এইসব আজগুবি নামে আমায় ডাকবেন না। আর যেতে দিন আমায় আমি বাড়ি যাবো।
আব্রাহাম;; এখন কি গাছ তলায় আছো নাকি।
আইরাত;; আমি এখানে থাকবো না, বাড়ি যাবো।
এই কথা বলেই আইরাত পাশ কাটিয়ে দরজার দিকে যেতে ধরে। বেশি দূর যেতে পারে নি তার আগেই আব্রাহাম খপ করে আইরাতের হাত ধরে ফেলে তাকে ঘুড়িয়ে নিজের কাছে আনে। আইরাত হুট করেই এমন কান্ডে অবাক, কি থেকে কি হয়ে গেলো সব মাথার ওপর দিয়ে গেলো। আইরাতের পিঠ আব্রাহামের সাথে ঠেকে আছে। আর আব্রাহাম আইরাতের দুই হাত এক করে নিজের এক হাত দিয়ে চেপে ধরে আছে। আব্রাহাম আইরাতের কানের কাছে এসে ধীর গলায় বলে…
আব্রাহাম;; আমার এখানে আমার অনুমতি ছাড়া একটা পাতা পর্যন্ত নড়ে না আর তুমি এখান থেকে পালিয়ে যাবে। ভাবলে কীভাবে। তুমি আমার কাছে থাকবে। যতক্ষন না আমি বলছি ততক্ষণ তুমি এখান থেকে কোত্থাও যেতে পারবে না।
আব্রাহামের এমন কান্ডে আর এমন গলায় আইরাতের শিরদাঁড়া গুলো যেন দাঁড়িয়ে পরলো। মুখের আওয়াজ আপনা আপনিই থেমে গেছে। আব্রাহাম আইরাতের অবস্থা খেয়াল করতে পেরে মুচকি হাসে। আইরাত এবার নড়াচড়া শুরু করে দেয় ছাড়া পাওয়ার জন্য।
আব্রাহাম;; তুমি এখানেই থাকবে আমার কাছে।
আব্রাহাম আইরাতের এলোমেলো চুল গুলোর দিকে এক নজর দেয় তারপর তাতে নিজের নাক মুখ সব ডুবিয়ে দেয়। আইরাত কাপছে পুরো। আব্রাহাম তো আইরাতের চুলের ঘ্রাণ নিতে ব্যাস্ত। আইরাত বুঝলো যে আব্রাহামের বাধন তার হাত গুলোর ওপর থেকে ঢিলা হয়ে এসেছে তাই সে ধাক্কা দিয়ে আব্রাহামের কাছ থেকে দূরে সরে আসে। আব্রাহামের দিকে তাকিয়ে বড়ো বড়ো দম ছাড়ছে সে। আব্রাহাম ব্যাপার টা বুঝতে পেরে বাকা হাসে। তারপর কয়েক কদম এগিয়ে গিয়ে একটা ড্রয়ারের সামনে যায়, সেখান থেকে একটা রিভলবার বের করে তাতে বুকেট লোড করতে থাকে। আইরাত হা হয়ে তাকিয়ে আছে। বুলেট লোড করে একবার চেক করে নেয় আব্রাহাম তারপর আইরাতের উদ্দেশ্যে বলে ওঠে…
আব্রাহাম;; এখানেই থাকো আমি তোমার প্রয়োজনীয় সব পাঠিয়ে দিচ্ছি। আর হ্যাঁ ভুল করেও এখান থেকে পালানোর চেষ্টা তুমি করবে না কারণ তুমি তা পারবে না।
এই বলেই আব্রাহাম দ্রুত পায়ে রুম থেকে চলে গেলো। যাওয়ার সময় দরজা টা লাগিয়ে দিয়ে গেলো। দরজা লাগিয়ে দিচ্ছে তা টে পেয়ে আইরাত দৌড়ে দরজার কাছে গিয়ে ধাক্কাতে থাকে কিন্তু লাভ হয় না কোনো। আইরাত আবার চিন্তা মাখা মুখ নিয়ে বিছানার ওপর ধপ করে বসে পরে। মাথা তো নয় যেন চিন্তার পাহাড় হয়ে আছে। না জানি বাড়িতে সবাই কি করছে। তার চাচা চাচি, দিয়া কি করছে। আইরাতের রাগ লাগছে অনেক এই আব্রাহামের ওপর। রাগ সামলাতে না পেরে আইরাত কেদে দেয়। তার রাগ গুলো যেন কান্নায় পরিণত হয়েছে।
।
।
।
।
চলবে~