রোদেলা,৪৮,৪৯
লেখা: মাহাবুবা মিতু
পর্ব: ৪৮
“কৃষ্ণচূড়ার” মানুষ গুলোর খরাপ সময় যেন পিছুই ছাড়ছে না, রোদেলা চলে যাবার পর নানীও চলে গেলেন ওর পরপরই….
ছোট মামা অনেক চেষ্টার পরও নোভেলকে বাগে আনতে না পেরে সাহায্য নিলেন তার প্রাক্তন স্ত্রী নোভার। অনেক কষ্টে তার নম্বর সংগ্রহ করে তাকে সব খুলে বললেন, স্বীকার করলেন তার করা ভুলের কথা। তার করা অন্যায়ের কথা। এবং খুব অনুরোধ করে বলেছিলেন ছেলেকে বুঝিয়ে তার কাছে পাঠিয়ে দিতে। যাতে বখে যাওয়া ছেলেকে শুধরাতে পারে, সামনের দিনগুলো উজ্জ্বল হয় ওর।
নোভাও সব মায়েদের মতো নিজেও তার ছেলের ভবিষ্যৎ ভালো হোক তাই চাইবেন। এ চাওয়া দোষের কিছু না। তিনি ছেলেকে তার কাছে ডেকে পাঠালেন এত বছর পরে প্রথমবারের মতো অসুস্থতার কথা বলে। নোভেল মায়ের অসুখের কথা শুনে দ্রুত গেলো ওর নানু বাড়ি যশোরে। সেখানে গিয়ে দেখলো ওর মা এখন সুস্থ। নানা-নানি এতদিনে পর ওকে পেয়ে রেখে দিলো কিছুদিন।
এ কয়টা দিন ওর মা তার সংসার জীবনের দুঃখ দূর্দশার গল্প শোনাচ্ছিলেন নোভেলকে। এত বছরে এ, দীর্ঘ ফুরসত কিংবা সুযোগ তার কখনো হয় নি।
দুঃখ করে বললেন- আজ তার কোথায় থাকার কথা ছিলো, আর তিনি কোথায় আছেন। ভাইদের সংসারে আশ্রীত হয়ে থাকার কষ্ট নোভেলকে ব্যাখ্যা করতে হলো না। ও যে তিনদিন ছিলো তাতেই তার বিগত জীবনের দুঃখ গাঁথা পড়া হয়ে গেছে নোভেলের। সবচেয়ে বেশী যা স্পর্শ করেছে ওকে তা হচ্ছে ওর মায়ের এত বছর অব্দি একা থাকা। অজপাড়াগাঁয়ে থেকে হাইস্কুলে মাস্টারি করেন তিনি। তারপর যেটুকু অবসর পান, সংসারের এই কাজ সেই কাজ করেন। তা না হলে এত বছর এখানে থাকা মুসকিল হতো। সবার মন জুগিয়ে চলা চারটি খনি কথা….!
নোভা অত্যান্ত রূপসী । তার বয়স এখন চল্লিশ ছুঁইছুঁই হলেও চেহারার লাবন্য এখনো উবে যায় নি। হঠাৎ দেখায় কেও আঁচ করতে পারবে না তার বয়স।
ডিভোর্সের পর যে তাকে কেও গ্রহণ করতো না কিংবা গ্রহণ করতে চায় নি এ কথা বলা মুশকিল। কিন্তু তিনি পারেন নি নতুন করে শুরু করতে এমনকি চেষ্টা ও করেন নি। তার বাবা মা অনেক বুঝিয়েছিলেন বয়স থাকতে। কিন্তু এখন আর এসব নিয়ে কোন কিছু বললেন না।
জীবণটা তার বলতে গেলে বৃথাই গেলো। কত বছর স্বামীর ঘর করেছিলেন তিনি….? অংকের হিসেবে
চার বছর আট মাস তেরো দিনের দিন তিনি তার স্বামীর পাঠানো ডিভোর্স লেটার পান। যাকে তিনি বিয়ে করেছিলেন
পাগলের মতো ভালোবেসে। যাকে পেতে তিনি তার বড় ভাইকে রেখেই বিয়ে করেছিলেন কিশোরী নোভাকে, যিনি মেট্রিকুলেশন পাস করে কলেজ ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।
বন্ধুর বড় ভাইয়ের বিয়ে খেতে যশোর এসেছিলেন তিনি। সেই অনুষ্ঠানেই প্রথম দেখেছিলেন নোভাকে। পাগলপ্রায় হয়ে বড় ভাই-ভাবীকে কিছুদিনের মধ্যেই নিয়ে এসেছিলেন যশোরে। সবাইকে বুঝিয়ে পরের মাসেই প্রবাসী বড় ভাইকে রেখে বিয়ে হয়েছিল তাদের। কত ভালোবাসা ছিলো ভাবা যায়…..!
এখানেই শেষ নয় ঢাকায় এনে কলেজে ভর্তি করে দিয়েছিলেন নতুন বৌ কে । ইন্টারমিডিয়েট পাশ করিয়ে ভর্তি করিয়েছিলেন তৎকালীন জগন্নাথ কলেজে। যদিও অনার্স পাশের আগেই তাদের বিয়েটা ভেঙে যায় ডিভোর্সের মধ্যে দিয়ে।
নজর লেগেছিলো তাদের সম্পর্কে। তার তিন ননাশ এত বড় বাড়ির মেয়ে হওয়া সত্ত্বেও একজনেরও ভালো ঘরে বিয়ে হয় নি। সকলেরই মোটামুটি অবস্থা। খেয়েপড়ে দিন কাটে কোনরকমে। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা ছিলো নাসিমার। তারা জীবনে না পেয়েছে স্বামীর সুখ না টাকার….
তারা মোটের উপর সহ্য করতে পারতো না এসব ভালোবাসা, ভালোথাকা। আদিখ্যেতা মনে হতো এসব তাদের কাছে। উঠতে বসতে কথা শুনাতো বাবার বাড়ির কমজুড়ি নিয়ে। গরিব ঘরের মেয়ের এত কেন ঢং।
তারা বুঝতো না তার ভাই-ই সাজিয়ে গুছিয়ে রাখতে পছন্দ করতো বৌ কে। নোভার মুখ এনেছিলো তারাই। সহ্যের তো একটা সীমা আছে….
এত বছর পর তা ঠিক ধরতে পেরেছিলো রোদেলা। তাই তো আলাদা হয়ে যেতে চেয়েছিলো বেঁচে থাকতে। কিন্তু নোভার যখন সংসার ভাঙলো রোদেলা তখন ছোট্ট একটা মেয়ে। তার কি সাধ্য তিন খালার সাথে যুদ্ধ করে। নোভেলকে ওর ফুফুরা যা বুঝাতো ও অন্ধের মতো তাই বুঝেছিলো। এত বছর ধরে ও শুনে আসছে ওর মায়ের সম্পর্কে নানান বাজে কথা। যা একটা সময় ওকে বাধ্য করে ওর মাকে ঘৃণা করতে। কিন্তু এখানে এসে দেখে চিত্র পুরো উল্টো।
নোভার যে এত কষ্ট তার জন্য কে দায়ী……
নোভেলের বাবা….?
ওর বাবা যত না দায়ী তার চেয়ে বেশী দায় নাসীমার।
তিনিই নিজ হাতে ভেঙে দিয়েছেন সংসারটাকে। তিন বছরের ছেলে রেখে চলে এসেছিলো নোভা । ভেবেছিলো মা ন্যাওটা ছেলে পালতে যখন হিমসিম খাবে তখন ওকে ফিরিয়ে আনা ছাড়া কোন উপায় থাকবে না। আর তিনি তো আলাদা বাসা না নিলে যাবেই না, তা তো বলেই এসেছেন আসার সময়।
কিন্তু বাস্তবে ঘটেছিলো পুরো উল্টো। নাসিমা নিজের ছোট্ট মেয়ে প্রিসিলাকে রেখে আগলে ধরেছিলেন নোভেলকে। কারন ওর মা ওকে ফেলে চলে গিয়েছিল। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছিলো যে সব দোষ গিয়ে পরেছিলো নোভার ঘাঁড়ে। কেমন মা এটুকু ছেলেকে ফেলে চলে গেলো। আরো কত কত কথা….
সময় গড়াতে গড়াতে দিন পেরিয়ে হয় সপ্তাহ…
নোভার অপেক্ষা স্বামী নিতে আসবে…
সপ্তাহ গড়ায় মাসে…
তখন দুজনেরই অহং এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে কেওই তা ভেঙে সমনে এগুতে পারে না।
অথচ নোভার নিজের সংসার বাঁচাতে নেয়া সিদ্ধান্ত যে ঠিক ছিলো তা-ই কিন্তু শেষ পর্যন্ত সঠিক প্রমাণিত হলো। তার স্বামী অবশেষে বাধ্য হলেন আলাদা বাসা নিতে, এমনকি দেশও আলাদা হয়ে গেলো। মধ্যি খানে নোভা…..
নোভা হলো বলির পাঠা ……
নোভা যখন মানুষের কাছ থেকে শুনেছিলো তার স্বামী আবার বিয়ে করেছে। বিশ্বাস ই করেন নি তিনি। ভেবেছিলেন তাকে কষ্ট দিতে এসব গুজব ছড়াচ্ছে ঐ পরিবার….
কিন্তু নোভেলের মেঝো ফুফুর বাড়িতে একদিন গিয়ে যখন শুনলেন সত্যিই তার স্বামী নতুন বৌ নিয়ে ঘর করছে…
তখন কিন্তু তার মাথায় আকাশ ভেঙে পরে। এরপর আর কোন যোগাযোগ রাখেন নি তিনি। দাবী ছেড়ে দিয়েছিলেন স্বামী আর সংসারের প্রতি। কাগজপত্রের হিসেবে নোভেলের বাবা-মায়ের ডিভোর্স এখনো হয় নি। কারন নোভা সেই ডিভোর্স পেপারে সাইন করে নি।
প্রথম প্রথম ছেলেটাকেও দেখতে দিতো না নাসিমা। ওর ভালোর জন্য নাকি ওর থেকে নোভার দূরে থাকা জরুরী। এসব শোনার পরও লুকিয়ে নোভেলের স্কুলে গিয়ে দেখা করে আসতো। বাবার বাড়ি যশোর হওয়ায় ঘন ঘন দেখাও হতো না মা-ছেলের….
তারপর………
জীবন বয়ে গেছে সেকেন্ড , মিনিট, ঘন্টার হিসেবে। সেসব আবার গড়িয়েছে বছরে….
কিন্তু নোভা একাই রয়ে গেছে স্বামীর ঐ চার বছরকার ভালোবাসা বুকে আগলে রেখে। ছেলেকে দেখাও বাদ দিয়েছে একটা সময়, নাসিমা একদিন অপমান করে বলেছিলো-
ওর ভালো চাইলে কেও যেন ওকে দেখতে না আসে….
তিনি তাই মেনে নিয়েছিলেন।
সেদিন বিকেলে নোভেলকে তিনি বলেন-
এখন আমি ম*রেও শান্তি পাবো নোভেল, তোমার বাবা তার ভুল বুঝতে পেরেছেন। বাকীটা তোমার ভালো ভবিষ্যৎ এর চিন্তা। তুমি তোমার বাবার কাছে ফিরে যাও। যাকে আঁকড়ে ধরে এখানে পরে আছো, একটু ভেবে দেখো সেই কিন্তু আমাদের দূরে থাকার কারন….
সেখান থেকে ফিরে নোভেল একমাসের মধ্যে চলে যায় ইংল্যান্ড, মিথ্যা মায়া ছিড়ে, সব ছেড়ে ওর বাবার কাছে।
এরপর যেন নাসিমার টনক নড়ে, যতটা না রোদেলা নড়াতে পেরেছিলো তার চেয়ে অনেক বেশী। নোভেলের যাওয়া টা সুস্থ স্বাভাবিক ছিলো না। বিশ্রীরকম ঝগড়া হয় ফুফু আর ভাতিজার মধ্যে। অনেক কথা বলে নোভেল-
যার প্রতিটি কথাই ছিলো যৌক্তিক…..
নাসিমা এখন একা….
তিনি নোভেলকে আঁকড়ে ধরে তার মেয়েদেরকে দূরে সরিয়ে রেখেছেন, দিনের পর দিন অবহেলা করে গিয়েছেন, মায়া ভালোবাসা ও ওরা কোনদিন পাননি তার কাছ থেকে, কারন তিনি ভাবতেন ওরা দুই-বোনেই তার এই দূর্দশার কারন। এই অবহেলা, ভালোবাসাহীন সম্পর্ক একটু একটু করে রোদেলাকে নিশ্চিত মৃ*ত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে । আজ তিনি শোকে পাথর…
কারন যাকে আঁকড়ে তিনি তার পৃথিবী গড়েছিলেন, সে তার কক্ষপথ বদলে ফেলেছে। তিনি এখন নিঃস্ব, নিঃসঙ্গ….
দুনিয়া বড়ই নির্মম জায়গা….
এমন নাসিমারা ভালোবাসা না পায়, না কাওকে দেয়…
সন্তানেরা হয়তো মা বলে একটা সময় মেনে নেয় সব, ভয়ে, লজ্জায়, পরিস্থিতির শিকার হয়ে। কিন্তু মন থেকে আসা অকৃত্রিম ভালোবাসা হয়তো তারা কখনো পান না…
না নিজের লোকেদের কাছ থেকে না তাদের কাছ থেকে যাদের আঁকড়ে ধরে আপনদের দূরে রেখে দেয় অবহেলায়।
নোভেল তার হিসেব বুঝে নিলো, তার হিসেবটাও বুঝিয়ে দিলো, কিন্তু নাসিমা….
তার হিসেব কে মিলাবে এখন…
রোদেলা
লেখা: মাহাবুবা মিতু
পর্ব: ৪৯
এত এত খারাপ খবরের ভীড়ে একটা ভালো খবর হচ্ছে নাতাশা আর কল্লোলের ঘর আলো করে ফুটফুটে এক ছেলে এসেছে। দুই পরিবারের সবাই ভীষণ খুশি একে নিয়ে। সাতদিনের মধ্যেই আকীকা দিয়ে নাম রাখা হয়েছে। বিষাদের ঘন অন্ধকার যেন কাটতে শুরু করেছে ওই ছোট্ট সোনামণিরই মধ্য দিয়ে। এ্যামী সিলেট যেতে যে উদ্যোগ নিয়েছিলো তা চুলোয় গেলো। এমন পরিস্থিতিতে যাওয়াটা ঠিক হবে না, তার উপর ও নিজেও গিয়ে শান্তি পাবে না।
কল্লোলের ছেলে এ বংশের প্রথম সন্তান। তাকে নিয়ে সবার আমোদ তাই একটু বেশীই….
এতদিনে যেন একটু সুযোগ পেয়েছে মানুষগুলো হাসবার…
আনন্দ করবার…
এ্যামী তাই শ্বাশুড়িকে কোনমতে কনভেন্স করেন আরো কয়েকটা দিন থাকতে। সব পরিস্থিতি বিবেচনা করে তিনি অমত হন নি। সত্যি বলতে এ্যামীর শ্বাশুড়ি ওকে অনেক ভালোবাসে। কারন এ্যামী যেমনি বড় ছেলের বউ তেমনি নিষ্ঠার সাথে সব দায়িত্ব হাসিমুখে পালন করে এসেছে এত বছর ধরে। বিয়ে কিংবা অনুষ্ঠান ছাড়া তেমন আসা হয় না ওর বাবার বাড়িতে। তাই হয়তো….
শোভন এ আমেজে নিজে যোগ না দিলেও যারা নতুন বাবুকে দেখতে আসে তারা একটু সময় শোভনকেও দিয়ে যায়। সকাল বিকেল মানুষের এমন আসা-যাওয়ায় বাড়িটা গমগম করতো সারাদিন। এসব শোভনের ভালো লাগতো না। ও একা থাকতেই ভালোবাসতো….
নাতাশার মা আসতে পারে নি অসুস্থ স্বামীকে রেখে।হসপিটালে তাই নাসিমারা তিন বোন ভাগাভাগি করে ছিলো নাতাশার সাথে। বড় মামী যদিও প্রতিদিনই আসেন মেয়েকে দেখতে। প্রিসিলা ততক্ষণ মামাকে দেখে রাখে। ওদেরকে বাসায় আনার পর প্রিসিলা একদিন বড় মামীর সাথে আসে নাতাশার বাচ্চাকে দেখতে। প্রিসিলা শোভনের সাথে দেখা করতে যায়। সেখানে ও শোভনের এমন অবস্থা দেখে হতবাক হয়ে যায় । শোভন তখন বারান্দার মেঝেতে বসে ছিলো। চেয়ার টেবিলে সাজানো এত সুন্দর একটা বেলকনিতে শোভন কিনা বসে আছে মেঝেতে…!
প্রিসিলার ঘরে ঢোকার শব্দ শুনে সেদিকে তাকায় শোভন…
প্রিসিলাকে দেখে একটা মলিন হাসি হাসলো শোভন।
থমকে দাঁড়িয়ে থাকে প্রিসিলা শোভনের এ হাল দেখে , যেন ওর পুরো পৃথিবীটা থেমে গেছে। শোভন দেখতে খুবই সুদর্শন একজন পুরুষ। এ কয়দিনের ব্যাবধানে কি অবস্থা হয়েছে তার…! মুখ ভর্তি খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি, উস্কো খুস্কো চুল…
শোভনের এমন অবস্থার কথা প্রিসিলা জানতো না। তাই ওর অবাক হওয়াটা একটু বেশীই…
মেঝেতে শোভনের পাশে বসে ওকে জিজ্ঞেস করে –
: এমন অবস্থা কেন আপনার….?
উত্তরে আবার একটা মলিন হাসি হাসে শোভন…, এটাই যেন ওর প্রশ্নের উত্তর….
: কেন এমন কষ্ট দিচ্ছেন নিজেকে…
এবার প্রিসিলার চোখে চোখ রাখে শোভন…
কিছু সময় চেয়ে থেকে চোখ ফিরিয়ে নেয়..
: যা হওয়ার তা হয়েছে, তাতে তো আপনার কোন হাত ছিলো না, খোদা হয়তো এতেই আপনার মঙ্গল লিখে রেখেছেন…
কিছুক্ষণ মৌন থেকে শোভন বলে-
: তাকে কে বলেছে আমাকে নিয়ে এত ভাবতে, খুব তো ছিলাম আমি অপেক্ষায়, রোদেলাকে পাবো, পাবো….
পরিবারের সাথে যুদ্ধ করে যখন সব গুছিয়ে নিলাম, তিনি…….
তিনি…. রোদেলাকেই উঠিয়ে নিলেন। এই হচ্ছে তোমার খোদা, যিনি সারাটা জীবন আমার সাথে একটার পর একটা অন্যায় করেই গেছেন, করেই গেছেন…..
: ভাইয়া প্লিজ এসব আর ভাববেন না আপনি..
আয়নায় দেখেছেন নিজের চেহারা….
: আয়না….
তোমার বোন আমার জীবনের আনন্দ, সুখ, ভালোবাসা সব সাথে করে নিয়ে গেছে….
কাঁদতে থাকে প্রিসিলা….
: একটা মজার কথা শুনেছো….? বাড়ির সবাই আমাকে বিয়ে দিবে ভাবছে….
বলেই হাসতে থাকে শোভন…
আমি ভেতর থেকে আগেই ভাঙাচোরা, আর রোদেলা আমাকে গুড়িয়ে দিয়ে গেছে… এই গুড়িয়ে দেয়া মানুষকে কিভাবে…. ধ্যাত বাদ দাও…
প্রিসিলা শোভনকে বলে- আমি শুনেছি এ কথা… তারা আপনার ভালোই চায়…. বিশ্বাস করুন আমি যদি আরেকটু বড় হতাম, আমিই আপনাকে বিয়ে করতাম…
আপনি রাজি না থাকলেও জোর করে আপনাকে বিয়ে করতাম…,
কথা শুনে ফিক করে হেসে দেয় শোভন, চোখ মুছতে মুছতে হাসে প্রিসিলাও…
আপনি নিজের জীবণকে কেমন এলোমেলো করে রেখেছেন, আমি এতদিন শুনেছি শুধু আপনার শরীর ভালো না, আজ দেখলাম কি করেছেন নিজেকে। এসব বাদ দিয়ে স্বাভাবিক হন, আপনি কি চান আপা কষ্ট পাক….
: মানে…
: তাকে কষ্ট দিতেই তো এসব করছেন আপনি….
তা না হলে কেন এমন করবেন নিজেকে….
: তুমি অনেক ছোট্ট, এসব জটিল ব্যাপার তুমি বুঝবে না…
: এতটাও ছোট আমি নই….
: মুচকি হাসে শোভন…
: ভাইয়া প্লিজ আপনি এসব ভাবা বন্ধ করুন, আপনাকে ভালো থাকতে হবে… আপনার চিন্তায় চিন্তায় সবাই অসুখী…
আপনি তা জানেন….?!
: যদি এতটাই সহজ হতো, যতটা সহজে তুমি বলছো আমাকে স্বাভাবিক হতে….
অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে উঠে আসে প্রিসিলা….
শোভন পেছন থেকে ডাকে ওকে…
কিছু একটা বলতে চায় হয়তো… আবার চুপ হয়ে যায় ও বলে-
: কিছু না তুমি যাও, ভালো থেকো….
সেখান থেকে বের হয়ে যায় প্রিসিলা। নতুন বাবুকে দেখা হলে ফিরে যায় বাড়িতে…..
এদিকে সেদিনই হঠাৎ করে বেশ অসুস্থ হয়ে যায় শোভন, হসপিটালে এডমিট করতে হয় ওকে। হঠাৎ প্রেশার ফল করায় কেমন যেন অচেতন হয়ে যায় ও। অতিরিক্ত চিন্তাই হয়তো এসবের কারন। একদিন থেকে পরদিন ই রিলিজ করে দেয় ডাক্তার। কিছু ঔষধ দেয় প্রেসার কন্ট্রোলের জন্য। ওর বন্ধুরা বাসায় আসে ওকে দেখতে। কাছের কিছু বন্ধুরা খুব জোড় করে ব্যাপারটা জানতে… কি হয়েছে ওর, কেন এই অবস্থা… সেখানে এ্যামী সব খুলে বলে শোভনের সম্পর্কে।
ওরা ওর খুব কাছের বন্ধু তাই তিনি আর কিছু লুকান না।
সব শেষে ওদেরকে বলে শোভনের জন্য একটা মেয়ে দেখতে। যতদ্রুত সম্ভব ওকে বিয়ে দিতে চায় সবাই….
এ কথা শুনে চোখ চাওয়া চাওয়ি করে ওরা।
এ্যামী বলে তারা এমন একটা মেয়ে চায়- যে সব জেনে শুনে ওকে ভালোবেসে আগলে রাখবে…
আর কোন চাহিদা নেই তাদের…
সেদিনকার মতো রাতে সব বন্ধুরা চলে যায়।
পরদিন এ্যামীও গুছগাছ করে সিলেটে যাওয়ার জন্য। ওর একাই যেতে হবে সিলেটে, ওর বর শুক্রবারের আগে আসতে পারবে না নতুন প্রোজেক্টের কাজের চাপে। তাই ওর বাবাই ওকে পৌঁছে দিবে সিলেট। এমন কথাই তিনি বলেছেন সকালে। মা হয়তো অনেক কষ্টে রাজি করিয়েছিলেন তাকে। কিন্তু হঠাৎ তারও কাজ পরে যাওয়ায় তিনি ভীষণ বিরক্ত, এ্যামীকে ফোনে সে কথা বলতেই খুবই শান্ত ভঙ্গিতে কোন উত্তর না দিয়েই মোবাইল রেখে দেয় ও। তিনি অবশ্য এ্যামীর মামাতো ভাইকে পৌঁছে দেবার দায়িত্ব দিলেন । কিন্তু এ্যামী বলল কাওকে যেতে হবে না আমি একাই পারবো যেতে…..
এসব ব্যাপারে এ্যামীও বিরক্ত, ও জানতো শেষ পর্যন্ত তিনি যাবেন না ওকে দিয়ে আসতে, এত বছরের জীবণে একবারও এমন হয় নি যে বাবা দিয়ে এসেছেন কিংবা আনতে গিয়েছে এ্যামীকে। এটা মেনে নিয়েছে ও। ওর অতি ব্যাস্ত বাবার জীবনে ওদের জন্য সময় খুবই কম। বাড়ি ভর্তি ছিলো মেহমানে। তারা চলে গেছে এইতো কিছুক্ষণ….
ড্রইং রুমের সোফায় বসে কাঁদছে এ্যামী….
নিজেকে বকছে ও…
কেন কাঁদছে তাই…
ওর বাবা তো শুরু থেকেই এমন…
তাহলে নতুন করে কাঁদার কি আছে….
এ্যামী এখনকার ঘটনায় কাঁদছে না কাঁদছে ছোটবেলার এক ঘটনা মনে করে। এ্যামী যখন ক্লাস টুতে পড়তো তখন একদিন ওর মায়ের হঠাৎ পা কে*টে যায় বটিতে। তাই তিনি ওর বাবার অফিসে ফোন করে দেয় যে মেয়েকে যেন বারোটার সময় স্কুল থেকে নিয়ে আসে…
সেদিন স্কুলে ছিলো বড়দের কি এক অনুষ্ঠান, ঠিক মনে পরছে না ওর। স্কুলের টিচার, স্টাফ সবাই ভীষণ রকমের ব্যাস্ত। সেদিন এ্যামী বারোটা থেকে চারটা অব্দি দাঁড়িয়ে ছিলো স্কুল গেইটের বাইরে। ওর অসুস্থ মা যখন ঘুম ভেঙে দেখে তার মেয়ে এখনো ফিরে নি স্কুল থেকে, তিনি ফোন করেন এ্যামীর বাবার অফিসে, তখন তো টেলিফোনের যুগ, হাতে হাতে ফোন ছিলো না। পিওন বলে স্যার অফিসে নেই, জরুরি মিটিং এ গেছেন…
উপায়ন্তর না দেখে কাটা পা নিয়েই তিনি স্কুলের উদ্দেশ্যে রওনা হন, গিয়ে দেখেন তার মেয়ে স্কুলের বাইরের একটা গাছের বেদীতে মুখ গোমড়া করে বসে আছেন….
এ ঘটনাটা খুব গাঢ় ভাবে দাগ কাটে ছোট্ট এ্যামীর মনে। এরপর বেশ কিছু দিন কথাও বলে নি সে বাবার সাথে…
সময়ের আবর্তনে এসব কথা কোথায় হারিয়ে গেছে, কিন্তু জীবণে যখনই বাবার কাছ থেকে কোন কষ্ট পায় ও, এখনো ওর মনে পরে ঐ দিনটার কথা….
ঐ কষ্টের কথা।
এমন সময় কলিং বেল বাজে…
একবার…
দুইবার……
গেইটের বাইরে থাকা ব্যাক্তি কলিং বেলের শব্দের মধ্যে দিয়ে নিজের ভেতরকার অস্থিরতা ছড়িয়ে দিচ্ছে, উঠে দাঁড়িয়ে চোখ মুছে, বিরক্ত মুখে এ্যামী দরজা খুলতে যায়…
দড়জা খুলে অবাক হয়ে যায় এ্যামী….
এত রাতে গেইটের বাইরে যাকে দেখলো তাকে দেখে হতবাক এ্যামী, দ্রুত ঘড়িতে তাকায় ও, দেখে এগারেটা বেজে পয়ত্রিশ মিনিট….
দড়জায় দাড়িয়ে থাকা মেয়েটি বললো-
: কেমন আছেন আপু…?
চলবে…
Next part gulo tara tari deben please