রোদেলা,৪৬,৪৭

0
680

রোদেলা,৪৬,৪৭
লেখা: মাহাবুবা মিতু
পর্ব: ৪৬

সুফিয়ান রোদেলাকে প্রথম দেখেছিলো ওর মিলের খুপড়ি ঘরে, যেখানে তাসের আড্ডা বসে প্রতিদিন। রাত তখন দেড়টা, সুফিয়ান তখন অর্ধ মাতাল। কারন ওরা আসার কিছুক্ষণ আগেই কয়েক পেগ ম*দ নিয়েছিলো ও। হঠাৎ ঐ ঘরে রোদেলাকে আসতে দেখে ওর অর্ধ গলিত চেতনা যেন ফিরে আসে। রোদেলা সে রাতে কালো একটা বোরকা পরে ছিলো। ভাইকে আটকে রাখার পরিস্থিতিতে কেও সেজেগুজে আসে না। একেবারে সাদামাটা ভাবে এসেছিলো ও। ওকে এত পবিত্র লাগছিলো দেখতে যে সুফিয়ান একেবারে গা ঝাড়া দিয়ে বসে। কেন এমন হয়েছিলো তা আজও ও জানে না।

মেয়েদের প্রতি সুফিয়ানের আগ্রহ শূন্যের কোঠায়। কারন মেয়েদেরকে অস্পৃশ্য মনে হতো ওর। এটা কোন রোগ না ব্যাধি তা ও জানে না। কিন্তু মেয়েদের প্রতি ওর এই অনুভূতিহীনতা কিন্তু সবসময় ছিলো না। ওরও ভালোবাসায় পূর্ণ একটা মন ছিলো।

সে রাতে কফি নিয়ে রোদেলা যখন ব্যাস্ত ছিলো, সুফিয়ান ব্যাস্ত ছিলো রোদেলাকে দেখায়। না, কোন কামুক চোখে না, দেখছিলো যেন এক পবিত্র মানবীকে। এত স্নিগ্ধতা, আর সরলতা ছিলো ওর মাঝে যা সকলের কাছে হয়তে সাধারণ কিছু, কিন্তু ঐ স্নিগ্ধতা, পবিত্রতা ওর ভালো লেগেছিল। কেমন একটা ব্যাথা বুকে চিনচিন করে উঠেছিলো সে রাতে।এটাকেই হয়তো বলে লাভ এট ফার্স্ট সাইট…..

রোদেলা ভুল করে যখন ওর পার্স ফেলে গেলো, অভদ্রের মতো সুফিয়ান পার্স থেকে ওর ছবিটা রেখে সেটা ফেরত দিয়ে আসে নিজে গিয়ে। ও কেন এমন করেছিলো তা নিজেও জানতো না। তবে মনের জং ধরা ধূলোপড়া অন্ধকার ঘরটায় একফালি আলো এসেছিলো যেন সে রাতে, যে আলো কলুষতাহীন, উষ্ণ, পবিত্র।

এরপর নোভেলের মারফতে রোদেলার সব জেনেছিলো সুফিয়ান। ওর জীবণ, অতীত, বর্তমান, পছন্দ, অপছন্দ সব। এত বছরে অবহেলায় যে নিজকে ঠেলে দিয়েছিলো অনিশ্চিত এক জীবণের দিকে, যার দায়িত্ব ছিলো শুধুই মা-ভাই-বোনের প্রতি। নিজের জন্য কোন সময়, ভাবনা ছিলো না সে সুফিয়ান একটু যেন থমকে দাঁড়িয়ে পেছনে তাকায়। নিজের প্রতি করা অন্যায় যেন এত বছরে গোচর হয় ওর চোখে। ও তো কোন অন্যায় করে নি, শুধু ভালোবেসেছিল। ঐ জীবণে যা ছিলো তা ভালোবেসে, তাতে কোন কলুষতা ছিলো না। তাহলে ও নিজেকে কেন শাস্তি দিচ্ছে দিনের পর দিন। ও যেন একটা ঘুমে ছিলো এতদিন, যা ভেঙে দিয়ে গেছে রোদেলা।

কলেজে পড়বার সময় ও যখন রাজনীতি করতো তখন একটা মেয়েকে ভালোবাসে ও। এক প্রকার জোর করেই ভালোবাসতে বাধ্য করে মেয়েটাকে। তারপর একে একে পাঁচ পাঁচটা বছর কাটে ভালোবাসায় ডুবে। সম্পর্কের গভীরতা এমন ছিলো যে কেও কাওকে ছেড়ে যাওয়া অসম্ভব। বিয়েতে সুফিয়ানের কোন সমস্যা ছিলো না। এমনকি সুফিয়ানের মা পর্যন্ত জানতে ওদের সম্পর্কের কথা, সম্পা প্রায়ই যেতো ওদের বাসায়। সুফিয়ানের মা ও ভালোমন্দ রান্না করলে ওকে নিয়ে আসতে বলতো। ছোট ভাইবোনরা তো রীতিমতো ভাবীই ডাকতো সম্পাকে। কিন্তু সম্পার বড় বোনের তখনো বিয়ে হয় নি, তাই ওর বিয়ে করা সম্ভব ছিলো না তখন। গোপনে বিয়ে করতেও তাড়া দিয়েছিলো সুফিয়ান অনেকবার। কারন ওকে হারানোর ভয় ছিলো সুফিয়ানের। কিন্তু সম্পা….
ও তো হারিয়ে যেতে চেয়েছিলো, তাই তো বাঁধা পরতে চায় নি বিয়ে নামের বন্ধনে। তাই হয়তো এত গড়িমসি বিয়েতে।

অনার্স যখন শেষ হলো, তখন সম্পা হুট করে কলেজ বদলে ফেললো। ওদের গ্রামের কলেজে মাস্টার্স ভর্তি হলো ও । বাড়িতে কি অসুবিধা হয়েছে এই অযুহাতে। সুফিয়ান মনে নিয়েছিলো সেটা। কিন্তু চোখের আড়াল মানেই তো মনের আড়াল। আস্তে আস্তে সম্পর্কের রঙ কেমন বদলে যেতে শুরু করে। সম্পা নানান বাহানায় ব্যাস্ততায় ওকে এড়িয়ে চলতে থাকে। ব্যাস্ত সুফিয়ান হঠাৎ করেই সম্পাকে ফলো করতে লোক ঠিক করে।

সে জানায় নতুন করে সম্পর্কে জড়িয়েছে সম্পা।
সুফিয়ান বিশ্বাস করে না। ওদের সম্পর্কের গভীরতা এত, এটা অসম্ভব। তবুও মনের কোথায় যেন সুতার টান লাগে। একটা সময় ওর সামনে সব পরিস্কার হয়ে যায়। প্রমান সহ হাতেনাতে ধরে ওদেরকে।

ও প্রায়ই যেতো ঐ ছেলের ফ্ল্যাটে…..
ছেলের বাবা মা দুজনই চাকুরীজীবি, তাই সুযোগ পেলেই ওরা এক হতে সেখানে। এত কিছু জানার পর ঘৃণায় সুফিয়ানের ওর সাথে কথাও বলতে পারছিলো না।

তবুও সম্পাকে জিজ্ঞেস করেছিলো কেন ও এমন করলো ওর সাথে । কোন উত্তর দিতে পারে নি সম্পা….. শুধু কেঁদেছিলো….

পরে সুফিয়ান জেনেছিলো সম্পা ওকে প্রয়োজনে ব্যাবহার করেছিলো। ওর যাবতীয় খরচ সুফিয়ান বহন করতো। সপ্তাহে সপ্তাহে মার্কেটিং, লং ড্রাইভে ঘুরতে যাওয়া, সাজেক, কক্সবাজার, রাঙামাটি, বান্দরবন, সেন্টমার্টিন এমন কোন জায়গা নেই যেখনে ওরা যায় নি এ পাঁচ বছরে। কি না করেছে ও এই মেয়ের জন্য….
আর দিনশেষে কি পেলো….?

অনেক কিছু করতে পারতো সুফিয়ান, কিন্তু কিছুই করে নি, জাস্ট থ মেরে গিয়েছিল, নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলো সবকিছু থেকে। এরপর থেকে মেয়েদেরকে অস্পৃশ্য ভাবতে শুরু করে ও। যারা শুধু শরীরের প্রয়োজনে একজন পুরুষের শরীর খোঁজে….

অনেক ভেঙে পরেছিলো ও, ঘরবন্দী করে ফেলেছিলো জীবণকে। একটা সময় পরে অবশ্য সব ছেড়ে বাবার ব্যাবসায় ঢুকে নিজেকে ব্যাস্ত করে ফেলেছিলে। তাই তো বিয়েও করা হয় নি এই বত্রিশ বছর জীবনে।

যে সুফিয়ান রোদেলার জন্য নিজেকে খুঁজে বের করেছে আতীতের বন্ধ কুঠুরী থেকে সে নাকি ম*রে
গেছে….

সারা দুনিয়ায় এখন রোদেলার মৃ*ত্যু প্রতিষ্ঠিত, একমাত্র আবু সুফিয়ানই মানে না যে রোদেলা নেই। তাই ও ঐ বাড়িতে যায় না। যে বাড়িতে সবাই মেনে নিয়েছে রোদেলা মৃ*ত, ও ভাবে ওখানে গেলে হয়তো ও নিজেও মেনে নিবে এটাই সত্য। যেখানে কাছের মানুষেরা এত বছর চোখের সামনে দেখে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো আর ও কয়দিন দেখেছে রোদেলাকে….?
সুফিয়ানের এই চিন্তা যদি মিথ্যা ও হয়, ও তাই নিয়ে বেঁচে থাকতে চায়। তাইতো ও সেদিন রোদেলার নামবাহী লা*শ*টার জানাযায় যায় নি।

তবে ওর ভীষণ আফসোস হয় রোদেলাকে মনের কথা বলতে না পারায়। নোভেলের কাছে শোভনের ব্যাপারটা জানার পর ও পিছিয়ে গিয়েছিল। ও মনে প্রাণে চেয়েছিলো রোদেলা ভালো থাকুক, সুখী হোক। তাই তো কাওকে কিছু না বলেই ফিরে এসেছিলো সেন্টমার্টিন থেকে।

কিন্তু পরে যখন জানলো যে ওর আর শোভনের বিয়ের ব্যাপারে রোদেলার অমত ছিলো তাই মা-মেয়ের কথা-কাটাকাটির এক পর্যায়ে রোদেলাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয় ওর মা, তা জানার পর সুফিয়ান যেন অন্ধকারে একটু আলো দেখতে পায়। ভাবে রোদেলাকে খুঁজে আর কালবিলম্ব না করে বলে দিবে মনের কথা। কিন্তু কি হলো…..

খোঁজাখুঁজি ঐ নাতিদীর্ঘ সময়ে একটি বারের জন্য ও ওর মনে হয়নি রোদেলা মা*রা যেতে পারে। অভিমানে কোথাও আত্নগোপনে আছে এটাই ছিলো ওর একমাত্র চিন্তা। কিন্তু কি হলো হঠাৎ করে….

তবে ওর মন বলছে রোদেলা আছে, তা না হলে মানুষ অপরিচিত মানুষের জানাজায় ও তো যায়, ওর কেমন যেন দ্বিধা লেগেছিল তখন। মন মানছিলো না যেতে। আয়রণ মিলের অফিসে ঘরে বসে কেমন ঘোরের মধ্যে ছিলো সে সময়টায় ।

হসপিটালের মর্গে যখন লা*শ*টাকে প্রথম দেখানো হলো ও একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো সেটার পায়ের পাতার দিকে। আর কিই বা দেখর ছিলো লা*শ নামের সে শরীরটার। পায়ের আঙুল গুলো কেমন অপরিচিত লেগেছিলো ওর।

রোদেলা যখন গান গেয়েছিলো সেন্টমার্টিনের দ্বীপে তখন দুই হাত দিয়ে হাঁটু ধরে হাঁটুর উপর থুতনি রেখে উবু হয়ে বসে গানটা গেয়েছিলো। তখন সুফিয়ান দেখেছিলো রোদেলার পা দুটো। সুফিয়ানের স্পষ্ট মনে আছে…. রোদেলার পায়ের আঙুলে মেহেদী পরা ছিলো, এ নিয়ে অনিমার সাথে কথাও হয়েছিলো একবার, এত সুন্দর রঙ দেখে অনিমা জিজ্ঞেস করেছিলো নেইল পলিশ কি না…?
রোদেলা তখন বলেছিলো সেটা পাতা মেহেদীর রং ছিলো। ও পাশ থেকে শুনেছিলো ওদের সেই আলাপ।

আর মর্গের ঐ পা গুলোর নখ ছিলো সাদা, পাতা মেহেদীর রঙ যেতে অনেকটা সময় লাগে, সেন্টমার্টিন থেকে ওরা এসেছে একমাসও হয় নি। এর মধ্যেই নখের মেহেদী চলে গেলো….?

যদিও একটুতেই এত বড় সিদ্ধান্তে আসা যায় না, যে ওটা রোদেলা না, তবুও ওর দৃঢ় বিশ্বাস রোদেলা আছে। এটা ওর মস্তিষ্ক কল্পনা প্রসূত ভাবনা নাকি সত্য তা ও জানে না। তবে ও যেটা জানে তা হচ্ছে রোদেলা আছে…..
এবং ও রোদেলাকে খুঁজে বের করবেই….

চলবে….

রোদেলা
লেখা: মাহাবুবা মিতু
পর্ব: ৪৭

নাতাশার কাগজপত্র তৈরী হয়ে গেছে। শরীরের যা অবস্থা তাতে যাওয়াটা ঠিক হবে কিনা সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না কেওই । প্রবাসে একলা এ অবস্থায় কি করবে তা ভেবেই দিশেহারা সবাই। তার উপর ওর বাবার এ অবস্থা, কখন কি হয়। একমাত্র মেয়ে নাতাশা। সব মিলিয়ে হযবরল অবস্থা।

কল্লোল কিন্তু এসব কথা পাত্তা দিচ্ছে না।
ও বলেছে এখানে সবাই সবকিছু একাই হ্যান্ডেল করে। কিন্তু কল্লোলের মা ওকে বলেছে এ অবস্থায় নাতাশাকে তাঁরা ছাড়বে না। কল্লোল আর কথা বাড়ায় নি। কারন ও জানে কথা যতই চালাচালি হোক শেষমেশ সিদ্ধান্ত মায়েরটাই অটল থাকবে। পরিস্থিতি বিবেচনায় তা মেনে নিলো।

তারা জানে যে বাচ্চাটা ঐ দেশে জন্ম নিলে বাই বর্ন ঐ দেশের নাগরিক হয়ে যাবে। তবুও তারা নাতাশাকে ছাড়ে নি। কারন তারা চায় ছেলেও দেশে চলে আসুক। তাদের সাথেই থাকুক।

রোদেলার মৃ*ত্যুতে এই পরিবারটাও কেমন যেন দুঃসময় পার করছে। দূর্দশা যেন পিছুই ছাড়ছে না। শোভনকে নিয়ে সবাই চিন্তিত। কখন কি করে বসে।
সেদিন ছাদে উঠে একেবারে কিনারায় চলে গিয়েছিল শোভন, বুয়া কাপড় শুকাতে গিয়ে ওকে ডেকে সরিয়ে আনে। ও নিজেও হয়তো জানতো না কি হতে যাচ্ছিল।

শোভনের মা তাই ছেলেকে একলা ছাড়ে না, এ্যামি ও ভাইকে সময় দিতে এখানেই এসে থাকছে কিছু দিন ধরে। ও ওর ভাইকে ভীষণ ভালেবাসে।

যদিও সেন্টমার্টিন থাকতেই ভাইয়ের সাথে রোদেলাকে নিয়ে বিশাল কথা-কাটাকাটি হয় দুই ভাই বোনের মধ্যে। এ নিয়ে কথাও বন্ধ ছিলো বেশ কিছু দিন।

কারন এ্যামী রোদেলাকে পছন্দ করতো না।
এ কথার উত্তরে সেদিন শোভন এ্যামিকে একটা মাত্র কারন বলতে বলেছিলো ওকে পছন্দ না করার। জাস্ট একটি…..

এ্যামী বলেছিলো রোদেলা একটা ব্রোকেন ফ্যামেলীর মেয়ে। ওদের সাথে আমাদের স্যাটাসে যায় না।

এ কথা শুনে শোভন হেসে গড়িয়ে পরার অবস্থা। এমন একটা পরিস্থিতিতে শোভনকে হাসতে দেখে এ্যামী হতবাক হয়ে যায়, রাগান্বিত কন্ঠে ওকে বলে-
: এভাবে হাসার কি হলো…? আমি কি ভুল কিছু বলেছি, ও কি এই পরিবারের বউ হবার যোগ্য, তোর যোগ্য…?
: আপু হাসালে তুমি আমাকে, পরের দোষ ত্রুটির কথাই আমরা কেবল ভাবি, নিজেদের দোষ, ত্রুটির কথা একদম ভুলে যাই, তুমি কি বললা…
রোদেলা আমার যোগ্য কি না…..?
যার জন্মেরই কোন বৈ*ধতা নেই, তার যোগ্য অযোগ্য হওয়ার কি আছে….?

এ কথার উত্তরে এ্যামী হতবাক হয়ে রেগে শোভনকে চড় দিয়েছিলো, এ্যামী এসব শোনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলো না। এ বিষয়ে এ যাবৎ ওদের মধ্যে কোন কথা হয় নি। এ্যামী ভুলেই গিয়েছিল শোভনের কুৎসিত অতীতের কথা। হঠাৎ এসব শুনে যেন ধাক্কা খেলো ও।

চড় খেয়ে শোভন গাল ঘষতে ঘষতে হাসিমুখে বলেছিলো- কি আপু সত্যি বলায় রেগে গেলে। তুমি রাগলেই কি আমার জন্মকুণ্ডলী বদলে যাবে,
এ্যামী রাগান্বিত কন্ঠে বলেছিলে-
চুপ, একদম চুপ, আর একটা কথা বলবি না তুই,

: আমি কিছু না বললেই কি সব মিথ্যে হয়ে যাবে, বদলে যাবে আমার জীবণ ইতিহাস…..
বদলাবে না আপু, আমি যতটুকু বলছি তা আমার কুৎ*সিত অতীতের ধোঁয়া মোছা, আর খন্ডিত একটি অংশ মাত্র। পুরোটা তো আরে ভয়ংকর…. !

আমি সবকিছুতে এত তাড়াহুড়ো কেন করছি জানো… আমি ভয় পাচ্ছি রোদেলা যদি জেনে যায় আমার নোং*রা অতীত, যদি জেনে যায় আমি আমার বাবার লা*ল*সার শিকার হয়ে জন্মানো অ*বৈ*ধ সন্তান, আমার জন্ম…..

কথাটা শেষ না করতে দিয়েই এ্যামী শোভনের মুখ চেপে ধরে কাঁদতে থাকে,
শোভন এ্যামীর হাত সরিয়ে হাসতে থাকে উন্মাদের মতো। সেদিন কাঁদতে কাঁদতে ও বের হয়ে গিয়েছিলো শোভনের হোটেল রুম থেকে। এরপর ভাইয়ের সাথে কথা বলেনি আর, এমনকি ঢাকায় ফিরে ও না।

কিন্তু এ্যামী এখন বুঝেছে রোদেলার প্রতি শোভনের ভালোবাসা কত গভীর। কিন্তু এখন তো সে বুঝার কোন দাম নেই। এসব ভেবে কাঁদে এ্যামী। ভাবে হয়তো এসব মেনে নিলে ব্যাপারটা আজ এ জাশগায় দাঁড়াতো না।

ভাইয়ের এমন পরিস্থিতি জেনে এ বাড়িতে আসার পর ও ভাইয়ের সাথে গল্প করে, মুভি দেখে, বাইরে বের হতে চায়, ওর বন্ধুদেরকে আসতে বলে, ওরাও আসে গল্প করতে চেষ্টা করে, ভাইকে স্বাভাবিক জীবণে ফিরিয়ে আনতে। কিন্তু ঐ আড্ডাটা ঠিক যেন জমে না। কারন ওর ভাইয়ের তো এসবে মন নেই, সে যেন পৃথিবী বহির্ভূত কোন দ্বীপের একক বাসিন্দা। কে কি বলছে, কি করছে সেদিকে খেয়াল নেই। এক মনে বসে সারাক্ষণ কি যেন ভাবছে।

বাইরে কোথাও যাওয়ার কথা বললেই শোভন কেবল রোদেলাকে দেখতে ক*ব*রস্থানে যেতে চায়। বার দুয়েক নিয়েও গিয়েছিল এ্যামী। কিন্তু সেখান থেকে এসে ও যেন আরো ভেঙে পরে। তাই এখন আর বাইরে যেতে সাধে না ও। ডাক্তার বলেছেন ট্রমা কাটিয়ে উঠতে একটু সময় লাগবে। তবে ওকে সবাই মিলে প্রচুর কোয়ালিটি টাইম দিন। আর ওর ভাবনাকে ডায়ভার্ট করুন।

এরি মাঝে এক শুক্রবারের দুপুরে এ্যামী খাবার টেবিলে ওর মাকে বলে- মা আমার আর থাকা সম্ভব না, তোমাদের পক্ষে একা ওকে দেখে রাখাও অসম্ভব। এভাবে চলতে থাকলে ও পাগল হয়ে যাবে, কিছু একটা করার দরকার বলে আমার মনে হয়।

কল্লোলের বাবা বলেন-
: আমরা চেষ্টার তো কোন ত্রুটি রাখছি না।
: চাচা, আমি চিকিৎসার কথা বলছি না….
শোভনের বাবা বলে-
: তুমি কি বিদেশে নিয়ে যেতে চাচ্ছো…?
: না বাবা, আমি ওকে বিয়ে দিতে চাচ্ছি….

এ কথা শুনে সবাই একসাথে এ্যামীর দিকে তাকায়,
এ্যামী সবার দৃষ্টি উপেক্ষা করে বলে- ওকে সারাক্ষণ চোখেচোখে রাখা আমাদের পক্ষে সম্ভব না, ওর এখন এমন কাওকে দরকার যে ওর পাশে ছায়ার মতো থাকবে । এভাবে থাকলে ও সত্যি পাগল হয়ে যাবে….

কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে এ্যামী আবার বলে-

: জানি ব্যাপারটা ততোটাও সহজ না, কিন্তু আমি আর ওকে এভাবে দেখতে পারছি না, ছয় ছয়টা মাস হয়ে গেলো। কোন পরিবর্তন নেই, সেদিন ডাক্তার বললে এই ট্রমার পিরিয়ড লম্বা হলে এখান থেকে বের করা কঠিন হয়ে যাবে। অনেক ভেবে এসব বললাম আমি, এটাই একমাত্র সমাধান যা আমাদের হাতে আছে,
বাকিটা তোমরা ভেবে দেখো-
কথাটা বলেই খাবারের প্লেট হাতে নিজের ঘরে চলে যায় ও।

টেবিলে থাকা সবাই-ই বুঝলো কথাটার গুরুত্ব, কিন্তু
এ পরিস্থিতিতে কারোই সাহস হলো না শোভনকে এসব ব্যাপারে বলার। তাছাড়া ওর জন্য এমন একটা মেয়ে দরকার যে ওর এই ট্রমা সম্পর্কে জানবে, এবং আন্তরিকতার সাথে ওকে এখান থেকে বের করে আনবে। কে এমন আছে যে সব জেনে দায়িত্ব নিয়ে ওকে স্বাভাবিক জীবণে ফিরিয়ে আনবে। বিয়ের পর স্বামী কিংবা স্ত্রীর কিছু হলে সেটা ঠিক করা তাদের দায়িত্ব থাকে, কিন্তু এমন কে আছে যে বিয়ের আগেই ওর দায়িত্ব নিয়ে ওকে স্বাভাবিক জীবণে ফিরিয়ে আনবে…….

ভালোবাসার মানুষ ছাড়া কার এত দায় এসবে জড়ানোর। মোটের উপর এটা একটা বিশাল রিস্ক।। বলতে গেলে জীবণ নিয়ে জু*য়া খেলা। কারন মেয়েটাকে শোভন কিভাবে নিবে তা কে জানে………

রাতে সবাই আবার এ ব্যাপারে বসলো। আগামী সপ্তাহে এ্যামীর চলে যেতে হবে ওর শ্বশুরবাড়ি সিলেটে। সেখান থেকে চাইলেই হুট করে আসা সম্ভব না। তার উপর এ্যামীর শ্বশুরও অসুস্থ। তাই সেখানে সিদ্ধান্ত হলো আপাততঃ একজন ফুলটাইম নার্স রাখা হবে শোভনের জন্য। এরপর সময় নিয়ে ওর বিয়ের জন্য মেয়ে খুঁজতে শুরু করতে হবে।

এখন এ্যামীর কোন ডিমান্ড নেই ভাইয়ের বৌর জন্য।
গরীব, ব্রোকেন ফ্যামেলি কিচ্ছু না…
ও শুধু খোদার কাছে এমন একটা মেয়েকে ভাইয়ের বৌ হিসেবে চায় যে ওর ভাইকে ভালোবেসে আগলে রাখবে, আর বের করে আনবে এই ঘোরে থাকা জীবণ থেকে…..

একেই হয়তো বলে ভাগ্যের পরিহাস….
এসব ভেবে সেদিন রাতে নামাজের বিছানায় অনেক কাঁদে এ্যামী। ক্ষমা চায় আল্লাহর কাছ থেকে। আর মন ভরে দোয়া করে রোদেলার জন্য। ওকে যেন আল্লাহ ভালো রাখেন…
বেহেশত নসীব করেন…….

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here