রোদোলা,৪৪,৪৫

0
665

রোদোলা,৪৪,৪৫
লেখা: মাহাবুবা মিতু
পর্ব: ৪৪

থানার যাবতীয় কাজ শেষ করে সবার বাসায় আসতে আসতে সন্ধ্যা। বাদ এশা রোদেলার জানাজার নামাজ। কৃষ্ণচূড়া গিজগিজ করছে মানুষে। যেন মানুষের ঢল নেমেছে। একেকজন একেক কথা বলছে। কেও কেও বলছে নাসিমার উগ্র মেজাজের ব*লি হলো মেয়েটা, কেও কেও বলে আহারে… কত কষ্টেই না প্রাণটা বের হইছে মেয়েটার, কেও আবার বলছে আ*ত্ন*হ*ত্যা করছে গো…
কম সহজে কি কেও এত বড় সিদ্ধান্ত নেয়….

একটা মানুষের জন্য একটা পরিবার কিভাবে ভেঙে গেলো সেসব কথাও শোনা গেলো কারো কারো মুখে। একজন বললো- শোন এই চোপার কারনেই তো স্বামীর ঘর করতে পারলো না, ছোট ভাইটা অতিষ্ঠ হয়ে বৌ নিয়ে চলে গেলো বিদেশে , যু*ব*তী মাইয়্যাডারে রাতবিরেত বাড়ির বাইর করলো, সে ফিরলো লা*শ হয়ে…
এরপর ও যদি এই মহিলার শিক্ষা না হয় তাহলে এই বেডি মরলেও মানুষ হইবো না।

তার কথায় সায় দিলো অনেকেই। সব কথাই রোদেলার পক্ষে। সবাই এই মৃ*ত্যুর জন্য দুষছে নাসিমাকে। একজন বললো মা*র*লে*ই কি খু*নি হয় গো বইন… ঘরের মধ্যে যন্ত্রণা দিয়ে দিয়ে যারা এমন পথের দিকে এগিয়ে দেয় তারাও কিন্তু খুনি। কিন্তু আফসোস তাদের বিচার হয় না। এমন ফুলের মতো মেয়ের মৃ*ত্যু বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে খুব।

লা*শ গোসল করানোর সব আয়োজন করা হলো, কি আর গোসল করাবে একে। এমনি অভাগা পুরো শরীরটা নিয়েও যেতে পারলো না। শেষে গোসল করিয়ে কা*ফ*নে*র কাপড়ে মুড়ে দেয়া হয়েছে ওকে । কাওকে দেখতে দেয়া হচ্ছে না, কি দিবে দেখতে…
কি দেখবে তারা….

নাতাশার শ্বশুরবাড়ির লোক এলো আটটার মধ্যে, শোভনের মা বাড়ির ভিতরে বসে আছে মাথায় হাত দিয়ে, কল্লোলের মা আর বাবাও পাশে বসা। শোভন তার পাশেই বসে, তারা যেন মানতেই পারছে না। কি সান্ত্বনা দিবে, তা খুঁজেই পাচ্ছে না।

কান্না আহাজারিতে ভারী হচ্ছে চারপাশের আকাশ বাতাস। নোভেল সান্ত্বনা দিচ্ছে নাসিমা আর প্রিসিলাকে। রোদেলার নানুর অবস্থা খারাপ। তার শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে এ খবর পাওয়ার পর থেকেই । কথাও বলতে পারছেন না তিনি। রোদেলার খালামনিরা সেখানে ব্যাস্ত। ডাক্তার আনা হয়েছে বাড়িতে। রোদেলার মা মূর্ছা গেছেন দুবার, দাঁতে দাঁত লেগে গিয়েছিলো শেষবারে।

এমন একটা পরিস্থিতি যে কে কাকে সান্ত্বনা দিবে। সবাই কাঁদছে অঝোরে। এমন টগবগ এক মেয়ে যে কিনা জীবণের বড় বড় ঝড় সামলে এতদূর এসেছে, তার এমন করুন পরিনতি কেওই মানতে পারছে না। সবাই ভালোবাসতো ওকে ওর বিনয়ী ব্যাবহারের জন্য। কোনদিন কারো সাথে মুখ কালো করে কথা বলে নি ও। এখনকার সময়ে এমন মেয়ে দেখাই যায় না। যে কিনা পরিবারের কথা চিন্তা করে শোভনের মতো একটা ছেলেকে ফিরিয়ে দিয়েছে।
আল্লাহ কেন এমনি করে ওকে নিয়ে গেলো তার আক্ষেপ কারো মুখে মুখে। ছোট মামীর বাবার বাড়ির লোকও এসেছে, তারাও হতবিহ্বল এমন ঘটনায়। কেওই মানতে পারছে না এমন অকাল মৃ*ত্যু।

শোভন একটু দেখতে চায় রোদেলাকে, লা*শে*র পাশে বসে থাকা মহিলারা বলে কি দেখবা বাবা, দেখার কিছুই নাই। তবুও দাঁড়িয়ে থাকে ও জিদ করে। না দেখে ও যাবে না। পরে পাশে থাকা পুরুষরা বলে মেয়ে মানুষের লা*শ পুরুষের দেখতে নেই….. ও তখন বসে পরে খাটটার সামনে। সেটাকে ধরে রাখে শক্ত করে, ও যেন রোদেলাকে ধরে আছে এমনি ভাব। ওর মা ওকে এ অবস্থায় দেখে কেঁদে ফেলেন, ছেলেটা সারাজীবন কষ্টই পেলো শুধু। রোদেলাকে নিয়ে একটু সুখি হতে চেয়েছিলো। তাইতো ওর বাবার শত অনিচ্ছা সত্বেও রোদেলাকে ঘরের বৌ বানাবে বলে কথা দিয়েছিলো শোভনকে। শোভনের বাইরের আবরনে কোন কষ্টের ছিটেফোঁটা না থাকলোও ওর ভিতরটা যে কত গভীর ক্ষতে পূর্ণ তা কেবল ওর পরিবারের মানুষই জানে। ওর মা ওকে আগলে ধরে বসে পরে ওর পাশেই। শোভন ওর মাকে জড়িয়ে ধরে। খুব চেষ্টা করে কাঁদতে, কিন্তু কান্না যেন পথ ভুলেছে আজ। ওর মা ওকে ভিতরে গিয়ে বসতে বলে, কিন্তু ও সেখান থেকে বেড়িয়ে যায়। পাশের চায়ের দোকানে বসে থাকে। মাথাটা জ্যাম লাগছে ওর, কি হলো ওর সাথে ও যেন বুঝতে পারছে না…. হঠাৎ কান্নায় ভেঙে পরে ও। সবার থেকে এ কান্না আড়াল করতেই ওর এখানে আসা। কষ্ট দেবার বেলায় খোদা কেন ওর সাথে কোন আপোষ করে না।
কেন….
কেন……..
কেন………….

রোদেলার বাবা আসে রাত নয়টায়..
মেয়েকে শেষ বারের মতো দেখতে এসেছে সে। এখানে আসবার মতো মুখ তার নেই যদিও, তবুও মেয়ের এমন খবরে নিজেকে আটকে রাখতে পারেন নি তিনি। তিনি খবর পেয়েছেন তার এক বন্ধুর মারফতে, সেই দুপুরেই। রাজশাহী থেকে আসতে আসতে সন্ধ্যা হয়ে গেলো…
লা*শে*র খাট ধরে কাঁদতে থাকে তিনি। বাবা হওয়ায় কা*ফ*নে*র কাপড় খুলে দেখানো হয় তাকে। পা দুটো কে ছুঁয়ে দেখেন তিনি। মেয়ে বড় হওয়ার পর খুব একটা দেখা হয় নি ওর সাথে। তিনি এমনি বাবা যে জানে না মেয়ের কোন হাতে তিল আছে, চিবুকে টোল আছে কি নাই, চুল বড় না ছোট, মেয়েটা লম্বায় কতটুকু, হাত পায়ের আঙুল লম্বা লম্বা না খাটো খাটো… এসব ভেবে চোখ বন্ধ করে রোদেলাকে কল্পনা করতে চেষ্টা করেন তিনি, কিন্তু বাস্তব এমন কঠিন যে সেই ছোট্ট রোদেলা যে ক্লাস টেইনে পড়তো তার চেহারাটাই ভাসছে চোখের সামনে। এত চেষ্টা করেও মনে করতে পরছে না। পাশে বসে থাকা মহিলা দ্রুত কাপড় বেঁধে দেন। এরপর শুরু হয় তার গগন বিদরী চিৎকার। মাটিতে গাড়াগড়ি খেয়ে কাঁদতে থাকেন তিনি। নিজেকে গালমন্দ করতে থাকেন মেয়ের এমন পরিনতির জন্য। কিন্তু এত সব কথার কি দাম আছে আজ। কোন দাম নেই….

প্রিসিলা দূরে দাঁড়িয়ে দেখে বাবার এমন আর্তনাদ। এমন আর্তনাদে ওর মন কেন যেন ভিজছে না আজ। বাবা নামের এই মানুষটাকে মনে মনে একটু ভালোবাসতে চাইতো ও। কিন্তু যখন রোদেলা পেছনের গল্প গুলো বলতো, ওর মায়ের সাথে ওদের সাথে করা অন্যায় গুলোর ব্যাপারে বলতো তখন লোকটাকে ঘৃনা হতো ওর। তার জন্য সবার এই পরিনতি। এই মানুষটা ঠিক থাকলে আজ ওদের এই জায়গায় দাঁড়াতে হতো না। ওদের ও সুন্দর একটা পরিবার থাকতো, সমাজে মাথা উঁচু করে বাঁচার অধিকার থাকতো ।

সবশেষে এগারোটা বাজলো ক*ব*র*স্থা*নে পৌঁছাতে পৌঁছাতে। পরিচিত, অপরিচিত কত মানুষ এসেছে এখানে, কিন্তু সুফিয়ান কোথাও নেই। ও যে নেই তার খবরও কারো নেই। কেন নেই লোকটা…. আজ যে তার প্রিয়তমাকে শেষ বারের মতো দেখার দিন, আর কোনদিন চাইলেও তো দেখা হবে না এই মানুষটাকে। কেমন মানুষ সে….
যে তার ভালোবাসার মানুষটাকে শেষ বারের মতো একটু দেখতেও এলো না…..

এত মানুষ এসেছে জানাজার নামাজে অকল্পনীয়…
পঞ্চায়তের ক*ব*র*স্থা*নে দা*ফ*ন করা হবে ওকে। মাটি খুঁড়ছে দুজন। তারপর একে একে সব কাজ সম্পন্ন করে নামানো হলো ওকে।

আমাদের সবার প্রিয় রোদেলাকে…..
যে সেই ছোট্ট বেলা থেকে নিপিড়ীত, বাবা-মায়ের ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত, সবার কাছে বাবা মায়ের ভুলের জন্য লাঞ্চিত। যার মায়ের ভালোবাসার পরিবর্তে সবসময় অবহেলাটাই জুটেছিলো, আপন পর সবার কথার বাণেও জর্জরিত ছিলো যার অন্তর। যার দিন কেটেছে রাত পার হবার আশায়। যার জীবণে কোন শখই পূরণ করা হলো না, পছন্দের জামা, জুতা, ব্যাগ, কানের দুল কিংবা এক বোতল গাঢ় লাল নেইল পলিশ…., যে ভাবতো অনেক টাকা হবে যখন তখন সব শখ পূরণ করবে, মাকে ভালো সাইকেট্রিক্স দেখাবে, নিজেদের অবস্থার পরিবর্তন করবে, তারপর বিয়েশাদি নিয়ে ভাবার সময় থাকলে ভাববে….

মায়ের ভালোবাসা পাওয়া হলো না, স্বপ্ন পূরণ হলো না,
প্রিয়তমর অখন্ড ভালোবাসা পেয়েও যা ছুঁয়ে দেখা হলো না,
বাঁধা হলো না ঘর…

জীবণ কাটলো যার পরিবারের দায়িত্ব নিয়ে, সেই ছোট্ট বেলা থেকে, যার চিন্তা ছিলো আগামীকাল খাবার কোত্থেকে আসবে, বোনের পড়ার খরচ, কাপড়চোপড় বই-খাতা আরো কত কি….
আজ তার ছুটি….
সকল দায়িত্ব থেকে
সকলের লাঞ্চনা থেকে,
মায়ের অবহেলা থেকে,
নিজেকে লুকিয়ে রাখার থেকে
আজ তার ছুটি……………………….

তাকে আজ শায়িত করা হলো চির নিদ্রায়। রোদেলার জীবণে সব কষ্ট হয়তো এরিমধ্যে শেষ হলো। এর পরে পরকালের জীবণে ইশ্বর হয়তো ওর সব না পাওয়ার হিসেবটা ঠিক করে করবেন। সকলের এই দোআ ওর প্রতি।

রাত একটা বাজতে চললো, বাড়ির সবাই কেমন চুপ মেরে গেছে। কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়তো সবাই…
সবাই আজ শান্তিতে ঘুমাবে। এ কয়দিন কেওই ঠিকঠাক ঘুমুতে পারে নি রোদেলার চিন্তায়। কোথায় আছে, কি করছে, কি খেয়েছে এসব ভাবনা ছিলো সবার মনে। আজ সবাই নিশ্চিন্ত। নিখোঁজ রোদেলার খোঁজ হয়েছে আজ। যেখানে রয়েছে সেখান থেকে কোথাও আর হারিয়ে যাবার ভয় নেই।
আহারে রোদেলা………
আহারে জীবণ…..
কত যন্ত্রণার……
কত বেদনার..
কত নির্মম…

চলবে……

রোদেলা
লেখা: মাহাবুবা মিতু
পর্ব: ৪৫

আজ একমাস হলো রোদেলা নেই। রোদেলার মৃ*ত্যুতে সবচেয়ে বেশী ভেঙে পরেছে নাতাশা। একে তো শরীর এমনিতেই খারাপ তার উপর বাবার মারণ অসুখের চিন্তা, বরটাও প্রবাসে গেলো এই তো সেদিন তার সাথে যোগ হলো রোদেলার এমন আকস্মিক মৃ*ত্যু। এসবের জন্য নিজেকে দায়ী ভাবে ও। ও মনে করে ওর উচিত ছিলো রোদেলার সাথে এসব নিয়ে খোলামেলা আলাপ করা। ও আসলে রোদেলার রংহীন জীবণে একটু রঙের পসরা সাজাতে চেয়েছিল। ওর বোনটি যে কত অভাগা তা ওর চেয়ে বেশী কে জানে।

নিজের বোন না হলেও বাবা মায়ের পর সবচেয়ে বেশী ভালো ও রোদেলাকে বেসেছে। কিছুতেই মানতে পারছে না রোদেলা নেই। খাবার সময় আপা আপা করে ডাকছে, খেতে আসার জন্য তাড়া দিচ্ছে। অদৃশ্য রোদেলার সাথে কথা বলছে কলোলের বিষয়ে, রান্নার বিষয়ে, নতুন যে আসছে তার বিষয়ে….

একটা সময় পর যখন বাস্তবে ফিরে আসে….
তখন কেঁদে কেঁদে বলে-
: আপা তুই না বলছিলি বাবু হওয়ার পর যাবি আমাদের বাড়িতে, বাবুকে তো তোরই দেখাশোনা করার কথা ছিলো, কেন এত জলদি চলে গেলি তুই….
কিসের এত তাড়া ছিলো তোর…………

নাসিমার সেদিন পর থেকে খাওয়া দাওয়া বন্ধ। শুকিয়ে কঙ্কাল হয়ে গেছে প্রায়। নানীর অবস্থা ও এখন যায় তখন যায়। সবাই বিমর্ষ, প্রিসিলার ও পড়ায় মনোযোগ নেই, বোনের এমন প্রস্থান মানতে পারছে না ও নিজেও। কিন্তু ওর আবেগ প্রকাশ ক্ষমতা কম। সবার মতো কাঁদতে পারে না, বলতে পারে না বোনকে কত মিস করছে। দিনটা কোনমতে কেটে যায় সবাই দেখে স্বাভাবিক প্রিসিলাকে কিন্তু বোনের স্মৃতি হাতড়ে প্রতিটি রাত ওর কাটছে নির্ঘুম…

সেই ছোট্ট বেলা থেকে ওর স্মৃতিতে নেই যে ওর মা ওকে আদর করে ঘুম পাড়িয়েছেন, গোসল কিংবা খাবার খাইয়েছেন। মা তো তখন নোভেলের দখলে। কত কত দিন আমার মা আমার মা বলে কেঁদে কেঁদে ঘুমিয়ে গেছে।
মা রূপি এই বোনটিই সেগুলো করেছে পরম মমতায়। ছোট্ট বোনের সব কথার একমাত্র ধৈর্যশীল স্রোতা ছিলো সে, চুল বেঁধে দেয়া, পছন্দের নাশতা টিফিনের জন্য তৈরী করে দেয়া, যে কোন আবদার মেটানো সব সব মনে পরে ঐ রাতটা এলে।

প্রিসিলার মনে আছে একবার শবেবরাতে ও তারাবাতি চেয়েছিল বোনের কাছে। বোন ওকে জমানো টাকা দিয়ে এক বাক্স তারাবাতি কিনে দিয়েছিলো। জীবণে সবচেয়ে বেশী খুশি ও সেদিন হয়েছিল।

কে এখন ওর কথা শুনবে, কে ওর আবদার রাখবে, কে ওকে ভালোবাসবে এখন….? কারো সাথে সহজে মিশতে না পারা প্রিসিলা যে বড্ড একা হয়ে গেলো এই বিশাল পৃথিবীতে। বড্ড একা…..!

নোভেল সবচেয়ে দ্রুত এ শোক কাটিয়ে উঠেছে। কাজ করছে নিয়মিত। রোদেলা যেন নিজের বিনিময়ে ওর অগোছালো জীবণকে ঠিকঠাক করে গেলো। এত বড় শোকে ওর জীবণ অমূল বদলে গেছে।

কাজকর্মে ওর নিষ্ঠা এবং একাগ্রতা দেখে সুফিয়ান ওকে নতুন এক প্রোজেক্টে ম্যানেজারের সহকারী হিসেবে কাজ দিয়েছে। বলেছে ঠিকঠাক কাজ শিখে নিলে ওকেই ম্যানেজার হিসেবে নিয়োগ দিবে। আসলে সুফিয়ান চাইলেই ওকে এখনি এ পদে বহাল করতে পারতো। কিন্তু কাজের পারদর্শিতা আর একাগ্রতা তৈরীতেই তার এই সময় নেয়া। উনি চান নোভেল নিজেকে ভেঙে গড়ে তুলুক।

এদিকে ওর বাবা ওকে তাড়া দেয় চলে আসার, সেই সুন্দর নিশ্চিত জীবণ ওকে আকর্ষণ করে না। এখানকার কাজে অনেক কষ্ট, এই রোদ মাথায় করে মালামাল চেক করা, এগুলো আপলোড, আনলোড করা, তাছাড়া পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকায় অনেক কাজই নিজ হাতেই শিখতে হচ্ছে ওকে।
কষ্ট হলেও ও এখানেই থাকবে।

রোদেলার মৃ*ত্যু*র পর এ বাড়িতে আর আসে নি আবু সুফিয়ান। ঐ যে ওর লা*শ পৌঁছে দিয়ে গেলো এরপর আর আসে নি এদিকে। এমন কি জানাজায় ও দেখা যায় নি ওকে। তবে সুফিয়ান ঐ পরিবারে ছায়ার মতো পাশে আছে । নিয়মিত খোঁজ রাখছে সবার। পূর্বাচলের আফজাল হোসেনের কাছ থেকে কিছু টাকা ও তুলে দিয়েছেন একজনের সাহায্য নিয়ে। বাকী টাকা তিনি আস্তে আস্তে শোধ দিবেন তাও জানিয়েছেন। সে টাকা দিয়েই তৃতীয় দফায় চিকিৎসা শুরু হয় বড় মামার। তার এ বাড়িতে না আসাটা রহস্যজনক।

এ ঘটনায় যার জীবণ এলোমেলো হয়ে গেছে সে হচ্ছে শোভন। খাওয়া নেই নাওয়া নেই গৃহবন্দী জীবণ যাপন করছে ও। ওর জীবণের ছন্দ যেন রোদেলার মতোই হারিয়ে গেছে।

সেন্টমার্টিনের দিন গুলোই আওড়াচ্ছে স্মৃতির পাতা থেকে।
কল্লোলের কাছে একটা গিফট পাওনা ছিলো শোভনের, সেন্টমার্টিনে যাবার সময় শোভন বলেছিলো সময় হলে ও চেয়ে নিবে। রোদেলার হাত যে রাতে ও কেটে ফেললো সে রাতেই কল্লোলের কাছে ও আত্মসমর্পণ করেছিলো। আর বলেছিল ভাই – রোদেলাকে আমার করে দে….

তাই তো নাতাশা-কল্লোল এত তাড়াহুড়ো করে সব ম্যানেজ করে। কথা বলে সবার সাথে। প্রপোজ করার জন্য একটা প্ল্যানও করে। কত খুশি ছিলো ও তখন, আর এখন….? অনুতাপে দগ্ধ হচ্ছে সারাক্ষণ। কেন ও এমন করতে গেলো, কেন একটু অপেক্ষা করলো না, আজ ওর জন্য রোদেলা এই পৃথিবীতে নেই। নিজেকে কোন মতেই ক্ষমা করতে পারে না ও। নিজেকে তাই ঘরে বন্দী করে রেখেছে এর দায়ে। একবার নিজেকে শেষও করতে গিয়েছিল ও। ওর মা ভয়ে ওর সাথেই থাকছে, রুমের দড়জার নক ভেঙে দিয়েছে। কখন কি করে বসে। তারা ওকে নিয়ে খুবই চিন্তিত।

ওর জীবণটা অনেক জটিল আর এলোমেলো , ভেবেছিলো রোদেলাকে নিয়ে অগোছালো এই জীবণটা গুছিয়ে নিবে। এমন লক্ষ্মী মেয়ে ছাড়া আর কে ভালো পারতো এমন জীবণটাকে গুছাতে….

এ্যামি আর শোভনের বাবা একজন হলেও মা কিন্তু দুইজন। এ্যামির যে মা তিনি একে একে তিনটি মেয়ের জন্ম দেন। তারা বাঁচতো না, রহস্যজনক ভাবে মা*রা যেত এক বছর বয়সের মধ্যে। এ্যামির মা হুজুর বাড়ি, পানি পরা, আর তাবিজ কবজ করে ওকে জমের হাত থেকে কেড়ে এনেছিলো। তারপর ও আরো দুইটি মেয়ে হয়েছিল তার। তারা অবশ্য একটু বড় হতেই মা*রা গিয়েছিল। কিন্তু শোভন…..

শোভনের জন্ম হয় এক গণিকালয়ে। তার বাবার এক রক্ষিতার গর্ভে। তার বহুগামী পিতা এমন কত সন্তান কত জনের গর্ভে দিয়ে আসছে তার হিসেব কে জানে। এই যে এ্যামির মা, তার যে এত কষ্ট তার জন্য দায়ী এই স্বামী নামের লোকটা। তিনি নামমাত্র স্বামী ছিলেন তার পুরো জীবণে। আর ঐ লোকটার জীবণ ছিলো ব্যাবসা, ম*দ আর নারী নিয়ে। পুত্র সন্তান হওয়ায় তিনি শোভনকে এ বাড়িতে নিয়ে আসলেও মর্যাদা পান নি শোভনের জন্মদাত্রী মা। কে ওর মা, দেখতে কেমন তা ও জানে না। এই এক লোকের জন্য ওদের পরিবারটায় আনন্দ নেই, সুখ নেই। এত যে বয়স হয়েছে তার সেই স্বভাব এখনো ছাড়েন নি তাকে।

শোভনের ব্যাপারটা এ পরিবারে ওপেন সিক্রেট। সবাই জানে আবার কেও জানে না। শোভন ওর জন্মের ইতিহাস ও জেনেছিলো ওর বাবার কাছ থেকেই, একবার ঝগড়া হয়েছিল তাদের স্বামী স্ত্রীর মধ্যে। কথাবার্তার এক পর্যায়ে ঐ লোকটা খোঁটা দিয়েছিলো তার পুত্র সন্তান জন্মদানে অক্ষমতা নিয়ে। তার ছেলের দরকার ছিলো তাই নাকি তিনি…..

ছোট্ট বয়সে এসব না বুঝলেও আশেপাশের মানুষের ব্যাবহার ওকে ধীরে ধীরে বুঝতে শিখায় ও এই পরিবারের একজন হলেও সবার থেকে আলাদা। যদিও এ্যামি আপু কিংবা তার মা কখনই ভালোবাসায় কার্পণ্য করেন নি। আপনের মতোই আগলে রেখেছ। শোভনও মা কিংবা বোনকে ভালোবাসে আপনের মতোই। শোভনের যত রাগ, ক্ষোভ তার বাবার প্রতি। এমন একটা ঘটনা শোভনের জীবণে ছোটবেলা থেকেই ওকে কোনঠাসা করে রেখেছে। এই গাঢ় ক্ষত ও বয়ে বেড়িয়েছে ছোট্ট বয়স থেকেই। কে ওর মা, কোথায় আছে, বেঁচে আছে কি নাই… এসব প্রশ্ন ওকে খুব তাড়া করে। তাইতো নিজে এক কাঙাল হয়ে ধরতে চেয়েছিলো আরেক কাঙালের হাত। যে ওর কষ্টটা খুব করে বুঝবে। কিন্তু কি হলো……..

জীবণ কোন আপোসই করলো না কষ্ট দেবার বেলায়….
দুঃখ কত যত্ন করে কানায় কানায় ভরিয়ে দিলো ওর জীবণটাকে….

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here