#হৃদমাঝারে পর্ব-৭
#দেবারতি_ধাড়া
আয়ান ফ্রেস হয়ে খাওয়া-দাওয়া করে নিজের ঘরে একটু বিশ্রাম নিচ্ছে। সারারাত ট্রেনে জার্নি করে এসে ও ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলো। তাই শোয়ার সাথে সাথেই একটু ঘুমের তন্দ্রাও এসে গিয়েছিলো ওর। ওদিকে রিমলি ওর সব জিনিসপত্র গুলো লিস্ট দেখে মিলিয়ে নিচ্ছিলো এক এক করে। সব জিনিসপত্র ঠিকঠাক থাকায় মনটা বেশ খুশি খুশি হয়ে গেলো রিমলির। আয়ান রিমলির জন্য যে সোয়েটার আর জ্যাকেট গুলো এনেছে সেগুলোও খুব পছন্দ হয়েছে ওর। মনের মতো সব জিনিসপত্র পেয়ে বেজায় খুশি হয়ে গেছে রিমলি। রিমলির ব্যাগের মধ্যে একটা শীতে গায়ে দেওয়ার চাদরও ছিলো, সেটা আয়ান বাসন্তীদেবীর জন্য নিয়ে এসেছে। এই চাদরটা যে আয়ান বাসন্তীদেবীর জন্য এনেছে, সেটা বুঝতে পেরে ওই চাদরটা হাতে নিয়ে ওনাকে দিতে যাবে বলে রিমলি ঘর থেকে বেরোলো। কিন্তু ও ভাবলো মাকে চাদরটা দিতে যাওয়ার আগে মনে করে এতো গুলো জিনিস সব ঠিকঠাক করে নিয়ে আসায় একবার আয়ানের ঘরে গিয়ে ওকে থ্যাংকস বলে আসবে। আর আয়ান ওই চাদরটা মায়ের জন্য এনেছে কিনা সেটা জেনেও নেবে। তাই নাচতে নাচতে “দাদা.. এই দাদা..” বলে ডাকতে ডাকতে নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে আয়ানের ঘরে এসে ঢুকলো রিমলি। ঢুকে ও বললো,
-ওই দাদা? দাদা! কখন থেকে তোকে ডাকছি, সাড়া দিচ্ছিস না কেন তুই?
রিমলির ডাকে আয়ানের আলগা ঘুমটা ভেঙে গেলো। ঘুম চোখেই ও বললো,
-কী হলো বোন? এভাবে চেঁচাচ্ছিস কেন তুই?! ঘুমটা ভাঙিয়ে দিলি তো আমার?
-আমি কী করে বুঝবো তুই ঘুমাচ্ছিলিস বলে? শোননা দাদা, সোয়েটার আর জ্যাকেট গুলো খুব সুন্দর হয়েছে রে.. কালার গুলো জাস্ট চুমু! আর আমার গ্রিনটী, আর ফ্লেভারড-টী গুলোও সব ঠিক আছে! আমি একটা বানিয়ে খেয়েও দেখলাম.. উফ্ দারুণ টেস্ট! শোননা দাদা, নেক্সট বার যখন আবার কলকাতায় আসবি, তখন আমার জন্য কী কী আনবি বলতো?
বলেই রিমলি মাথায় হাত দিয়ে ভাবতে লাগলো। ওকে এভাবে ভাবতে দেখে আয়ান বললো,
-ওই তো তুই আবার একটা লিস্ট বানিয়ে দিবি, সেই লিস্ট মিলিয়ে আমি আবার সব এনে দেবো। ঠিক আছে? এবার খুশি তো?
-হ্যাঁ খুব.. থ্যাংক ইউ দাদা! লাভ ইউ রে! এই দাদা বলছি যে, তোর বৌদিকে পছন্দ হলো?
-মানে? বৌদি? কার বৌদি?
-কার আবার! আমার বৌদি.. মানে তোর হবু বউ!
-তুই কী বলছিস আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না রিমলি! একটু ক্লিয়ার করে বল! তোর মাথার ঠিক আছে তো?
-সেকী মা তোকে এখনও কিছু বলেনি?
-কেন? কী বলবে মা?
-দাঁড়া আমি আগে মাকে ডাকি, তারপর বলছি! ও মা.. মা… একবার দাদার ঘরে এসোনা….? ও মা…
রিমলির চিৎকার আর ডাক শুনতে পেয়ে বাসন্তীদেবী সঙ্গে সঙ্গে আয়ানের ঘরে এসে বললেন,
-কী হলো রে তোর? ষাঁড়ের মতো চিৎকার করছিস কেন তুই? এই মেয়েটা আমায় একটু শান্তিতে কাজও করতে দেবে না দেখছি! কী বলবি তাড়াতাড়ি বল। আমার কিন্তু কাজ আছে।
-ও মা, তুমি দাদাকে এখনও বলোনি?
-কী বলবো?
-বৌদির কথা!
রিমলির কথা শুনে চুপ করে গেলেন বাসন্তীদেবী। উনি ভেবেছিলেন আয়ান খেয়ে-দেয়ে একটু জিরিয়ে নিয়ে আজকের দিনটা কাটলে, তারপর কাল সকালে সব কথা খুলে বলবেন। কিন্তু রিমলি যে এভাবে এখনই আয়ানকে কথাটা বলে ফেলবে, সেটা উনি বুঝতে পারেননি। বাসন্তীদেবীকে চুপ করে থাকতে দেখে আয়ান বললো,
-ও মা.. বোন কী বলছে গো? কার বৌদির কথা বলছে রিমলি?
-এখন থাক না! তোকে নাহয় আমি পরে সব খুলে বলবো বাবান। তুই বরং এখন বিশ্রাম নে। হ্যাঁরে রিমলি? তোকে এখন এসব কথা বলতে কে বললো? তোর আর কবে বুদ্ধিশুদ্ধি হবে শুনি?
-কী হবে মা? দাদা তো সব জানতেই পারবে! সে এখনই হোক বা পরে! বলেই দাও না মা দাদাকে?
রিমলির কথা শুনে বাসন্তীদেবী একটু ভয়ে ভয়েই আয়ানকে বললেন,
-কী বলতো বাবান? আসলে আমাদের যিনি পারিবারিক ঘটকমশাই আছেন না? তুই তো চিনিসই ওনাকে? আর উনিও তো সেই ছোটোবেলা থেকে তোকে চেনেন, উনি তো জানেন তুই কতো ভালো ছেলে.. তাই উনি তোর জন্য একটা সম্বন্ধ এনেছিলেন। মেয়েটা নাকি খুব ভালো রে বাবান। দেখতে শুনতেও বেশ ভালোই। ঘটকমশাই বললেন মেয়েটি নাকি খুব নম্র, ভদ্রও.. শোননা বাবান.. তুই আর না করিস না বাবা! তোর তো এবার বিয়ের বয়স হয়েছে বল? আর তোর চাকরিটাও তো ভালোই। সেই কবে থেকে আমি তোকে বিয়ের কথা বলছি। কিন্তু তুই কিছুতে রাজীই হচ্ছিলি না! বিয়ে তো একদিন না একদিন সবাইকেই করতে হয় বল? তোর তো আবার নাকি ওসব প্রেম ভালোবাসা করাও পছন্দ নয়। কখনও তো কারোর সাথে সেসব করিসওনি! সেই জন্যই তো আমিই তোর জন্য একটা মেয়ে দেখলাম বাবান। আমি ঘটকমশাইকে কথা দিয়ে দিয়েছি যে তোকে যেভাবেই হোক রাজী করাবো…
-তুমি কী পাগল হয়ে গেছো মা? আমাকে না জিজ্ঞেস করে তুমি এত বড়ো একটা সিদ্ধান্ত নিলে কী করে? মাথা খারাপ হয়ে গেছে নাকি তোমার? আমি কিছুতেই এই বিয়ে করতে পারবো না!
-কেন বাবান? কেন করতে পারবি না তুই? ফোনে আমার কথা হয়েছে ওনাদের সাথে। আমি ওনাদেরকে কথাও দিয়ে দিয়েছি.. আমি বলেছি আমার পছন্দই তোর পছন্দ। আমার যখন ওনাদের মেয়ের ছবি দেখে পছন্দ হয়েছে, তাহলে তোরও নিশ্চয়ই খুব পছন্দ হবে। আমি ওনাদের আর অন্য কোনো সম্বন্ধ দেখতে বারণ করে দিয়েছি। আমি বলেছি তুই এলে তোকে নিয়ে ওনাদের বাড়িতে গিয়ে সব কথা বলে আসবো। আর তাই এখন তুই এই বিয়েটা না করলে আমি ওনাদের কাছে খুব ছোটো হয়ে যাবো বাবান.. তুই আর না করিস না সোনা!
-না মা.. আমি বললাম তো এই বিয়ে আমি কিছুতেই করতে পারবো না! তুমি ওনাদেরকে এক্ষুণি না বলে দাও। আর তাছাড়া তুমি আমাকে জিজ্ঞেস না করে কেনই বা কথা দিয়ে দিয়েছো? আমি তো তোমাকে বারণ করেছিলাম আমার বিয়ে নিয়ে এতো ভাবতে! আমি বিয়ে করবো না মা!
রেগে গিয়ে প্রায় এক প্রকার চেঁচিয়েই উঠলো আয়ান। ওকে এভাবে রাগারাগি করতে দেখে বাসন্তীদেবী আয়ানের দিকে এগিয়ে গিয়ে ওর গায়ে, মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,
-তুই এতো রাগারাগি করছিস কেন বাবান? কী এমন করেছি আমি? নিজের ছেলে বিয়ের যোগ্য হয়েছে, তাই ছেলের জন্য একটা সম্মন্ধ দেখেছি। এতে আমি অন্যায়টা কী করেছি শুনি? মা হয়ে কী আমি তোর জন্য এটুকু করতে পারি না বল বাবান? তুই যদি অন্য কাউকে পছন্দ করতিস, সেরকম কিছু হলেও নাহয় আমি ভাবতাম তোর জন্য এই সম্বন্ধ ঠিক করাটা আমার উচিৎ হবে না। কিন্তু তুই তো আমাকে সেরকম কিছুও কখনও বলিসনি। তুই এখনও বল তোর যদি কাউকে ভালো লেগে থাকে, বা পছন্দ হয়ে থাকে, তুই আমাকে বলনা? আমি তাহলে সেখানেই তোর সম্বন্ধ ঠিক করবো। সেরকম কী কেউ আছে? তাহলে বল আমায়…
বাসন্তীদেবী আয়ানকে যখন জিজ্ঞেস করলেন যে, ওর কাউকে ভালো লাগে কিনা তখন আয়ানের চোখের সামনে শুধু জিয়ার মুখটাই ভেসে এলো। সেই ছটফটে, প্রাণোচ্ছল, মুখের ওপর স্পষ্ট কথা বলা, হৈ হুল্লোড় করা, হাসি-ঠাট্টা করা মেয়েটা যেন ওর চোখের সামনে দিয়ে ছুটে-দৌড়ে বেরাচ্ছে! আর আয়ান ওর কান্ড কারখানা দেখে হেসেই খুন হয়ে যাচ্ছে। জিয়ার করা দুষ্টুমি গুলোর কথা ভাবতে ভাবতে আয়ানের ঠোঁটের কোণে যেন এক টুকরা হাসিও এসে যাচ্ছিলো। ঠিক সেই সময়ই আয়ানকে চুপ করে কী সব ভাবতে দেখে বাসন্তীদেবী বললেন,
-কীরে বাবান? তুই চুপ করে আছিস কেন? বল আমায়? তোর জীবনে কী এরকম কোনো পছন্দের মানুষ আছে? বা তুই কী কাউকে ভালোবাসিস? তাহলে আমি তার বাড়ির লোকের সাথে কথা বলবো তোদের বিয়ের ব্যাপারে। এখন বিয়ে না করলে আর কবেই বা করবি?
আয়ান কাউকে ভালোবাসে কিনা জিজ্ঞেস করতেই ওর চোখের সামনে আবারও ভেসে এলো জিয়ার মুখটা। যেন মনে হচ্ছে আয়ান ভুলবশত কোনো একটা কাজ করে ফেলার জন্য জিয়া ওকে খুব মুখ ঝামটা দিচ্ছে! আর আয়ান ওর মুখের দিকে হাঁ করে মুগ্ধতার সঙ্গে তাকিয়ে রয়েছে। আয়ানকে হঠাৎ হঠাৎ করেই এরকম আনমনে তাকিয়ে থাকতে দেখে পাশ থেকে রিমলি বলে উঠলো,
-ও মা, তুমি ঠিকই বলেছো গো! সত্যিই দাদা নিশ্চয়ই কারোর না কারোর প্রেমে পড়েছে! দেখছো না মাঝে মাঝেই দাদা কেমন অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছে! ওই দাদা বলনা রে? হু ইজ দা লাকি গার্ল?
-এই বোন তুই চুপ করবি? খুব বেড়েছিস না তুই? মারবো না এমন!
-ও মা! দেখো না দাদা মারতে আসছে আমাকে! আমি কী এমন ভুল কথা বললাম বলো? প্রেমে পড়লেই তো মানুষ অকারণেই এরকম আনমনা হয়ে পড়ে!
-মা তুমি কিন্তু বোনকে চুপ করতে বলো! নাহলে সত্যি সত্যিই আমি খুব মারবো ওকে!
-আচ্ছা আচ্ছা আমি বলছি দাঁড়া! এই রিমলি তুই একদম চুপ কর! বড়োদের মধ্যে থেকে কথা শোনা হচ্ছে তাই না তোর? যা, তুই নিজের ঘরে যা বলছি!
-ঠিক আছে মা আমি চলে যাচ্ছি। ভালো কথাই তো বললাম আমি! এই দাদা দেখলি তো, আমিই মাঝখান থেকে শুধু শুধু তোর জন্য মায়ের কাছ থেকে ঝাড় খেয়ে গেলাম। হুঁহ!
কথা গুলো বলেই মুখ বেঁকিয়ে ঠোঁট উল্টে রিমলি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। রিমলি চলে যাওয়ার পর বাসন্তীদেবী আয়ানকে বললেন,
-বাবান তুই এবার তো বল তোর কী কাউকে ভালো লাগে? সেই জন্যই কী তুই আমার দেখা পাত্রীর সাথে বিয়ে করতে নাকচ করছিস? আমাকে সবটা খুলে বল না বাবা, আমি তো বলছি, তাহলে তার সাথেই আমি তোর বিয়ের কথা বলবো।
-না মা, সেরকম কিচ্ছু না! কিন্তু আমি এই বিয়েটা করতে পারবো না।
-কেন এমন করছিস বাবা? আচ্ছা শোননা আমার একটা কথা, ঘটকমশাই আমাকে ওই মেয়েটির একটা ছবি দিয়ে গিয়েছেন। তুই একটিবার ছবিটা দেখই না! যদি তোর পছন্দ না হয় তাহলে আর সম্বন্ধটা এগোবো না। আর যদি তোর মেয়েটির ছবি দেখে ভালো লেগে যায়, তাহলে আমি ঘটকমশাইকে কথা এগোতে বলবো..
-তার কোনো দরকার নেই মা। আমি তো তোমাকে বললামই আমি বিয়ে করবো না। তাই এসব ছবি-টবিও আমি দেখতে পারবো না! আমি এখন বুঝেছি বোন কেন আমাকে তোমার অসুস্থতার অজুহাত দিয়ে শিলিগুড়ি থেকে কলকাতায় ডেকে পাঠালো। আগে জানলে তো আমি কলকাতাতে আসতামই না!
-আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে, এতো মাথা গরম করতে হবে না তোকে। আমি তোর টেবিলে মেয়েটির ছবিটা রেখে যাচ্ছি। তোর যদি কখনও ইচ্ছা হয়, তাহলে ছবিটা দেখিস!
বাসন্তীদেবী ওনার ঘর থেকে ছবিটা নিয়ে এসে আয়ানের ঘরের টেবিলে রেখে গেলেন। আয়ান সেদিকে কোনো চোখই দিলো না তখন। ও ভুলেই গিয়েছিলো যে বাসন্তীদেবী ছবিটা রেখে গিয়েছিলেন বলে। কিন্তু রাতে শুতে যাওয়ার সময় নিজের ঘরের টেবিলে জলের বোতলটা রাখতে গিয়ে হটাৎ করেই ওই ছবিটার দিকে চোখ পড়ে গেলো আয়ানের। ছবিটার দিকে চোখ পড়ে যেতেই ও মুখটা ফিরিয়ে নিতে গিয়েও আর পারলো না। সঙ্গে সঙ্গে ছবিটা হাতে তুলে নিলো। বিছানায় বালিশের পাশে ওর চশমাটা খুলে রাখা ছিলো। ছবিটা হাতে নিয়ে বিছানার কাছে এগিয়ে গিয়ে বিছানা থেকে চশমাটা তুলে নিয়েই চোখে পড়ে নিলো আয়ান। চশমাটা পড়ার পর ওর চোখের সামনে আরও স্পষ্ট হয়ে উঠলো ছবিটা। চোখ থেকে একবার চশমাটা খুলে হাতের আঙুল দিয়ে চোখ দুটো একটু রগড়ে নিয়ে ও আবারও চোখে পড়ে নিলো চশমাটা। ভালো করে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো ছবিটা। একটা সবুজ রঙের ব্লাউজের সাথে সবুজ পাড় হলুদ রঙের তাঁতের শাড়ি পরে একমাথা কোমর পর্যন্ত ঢালু চুল নিয়ে আয়ানের দিকেই তাকিয়ে রয়েছে জিয়া। জিয়ার চোখে চশমাটা না থাকায় প্রথমে জিয়াকে চিনতে একটু ভুল হচ্ছিলো আয়ানের। আর জিয়ার তো এখন এতো বড়ো চুলও নেই। ওর চুল গুলো কাঁধের একটু নিচে পর্যন্ত সুন্দর করে কাটা। ছোটো ছোটো চুলে আর চোখে কালো রঙের গোল ফ্রেমের চশমায় বেশ স্টাইলিশ দেখতে লাগে জিয়াকে। তবে কোমর পর্যন্ত লম্বা চুলেও কিন্তু ওকে বেশ সুন্দরই দেখাচ্ছে। জিয়াকে দেখার অগে পর্যন্ত আয়ানের মেয়েদের এরকম লম্বা চুলেই দেখতে বেশি ভালো লাগতো। জিয়ার ছবিটা দেখেই নিজের বুকে জড়িয়ে নিলো আয়ান। মনে মনে ও ভাবলো, “তারমানে মা জিয়ার সাথেই আমার বিয়ের সম্বন্ধ ঠিক করেছে? ওর বাড়িও তো কলকাতাতেই। জিয়ার মা-বাবা জিয়ার বিয়ের ঠিক করছেন? জিয়া কী এটা জানে? নাকি আমার মতো জিয়াও জানেনা যে, আমাদের বাড়ির লোকেরা আমাদের বিয়ের ঠিক করছে! কিন্তু এটা কীভাবে সম্ভব হচ্ছে?” ঠিক তখনই আয়ানের ফোনটা বেজে উঠলো। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো জিয়া কল করছে। কলটা রিসিভ করে কানে দেওয়া মাত্রই অপর প্রান্ত থেকে জিয়া বলে উঠলো,
-কী ব্যাপার প্রফেসর বাবু? নিজের বাড়ি ফিরে তো আমাকে ভুলেই গেছেন দেখছি! বাড়িতে ঢোকা থেকে তো একটাও কল কিংবা টেক্সট পেলাম না! সেই যে ট্রেন থেকে নেমে ট্যাক্সিতে বসে একবার কল করলেন, তারপর তো আর আপনার কোনো পাত্তাই পাওয়া যাচ্ছে না দেখছি!
-আরে না না জিয়া। তোমাকে কী করে ভুলে যাই বলো? এতোক্ষণ তো আমি তোমাকে বুকে নিয়েই…
বলতে গিয়েই থেমে গেলো আয়ান। সঙ্গে সঙ্গে জিয়া বললো,
-কী বললে তুমি?
-না না, ও কিছু না! কী করছো তুমি? তুমিও তো একটাও কল করোনি সকাল থেকে!
-আসলে অফিসের ভীষণ চাপ বুঝলে! একদম সময় বের করতে পারছি না এই কদিন। সেই কবে থেকে ভাবছি কলকাতায় গিয়ে মা-বাবাকে একটু দেখে আসবো। বাট যেতে আর পারছি না! তুমি তো বেশ ভালোই বাড়ি চলে গেলে। মায়ের হাতের ভালো ভালো রান্নাও নিশ্চয়ই খুব জমিয়ে খাচ্ছো ওখানে?
-হ্যাঁ সেতো খাচ্ছি বটেই! তুমিও কলকাতায় চলে আসো না? তুমিও মায়ের হাতের বানানো ভালো-মন্দ খেতে পারবে।
-সবার কী আর তোমার মতো সুখের সরকারি চাকরি নাকি? যে বছরে বেশিরভাগ দিনই অফিসের কাজ করার থেকে ছুটি বেশি পাবো? আমাদের অফিসের বস্ যা! ছুটির কথা শুনলেই ওনার মাথা খারাপ হয়ে যায়।
-হ্যাঁ সে তো এতোদিনে আমিও বেশ ভালোই বুঝে গেছি! আচ্ছা জিয়া শোনো না?
-হুম বলো?
-তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?
-হ্যাঁ বলো না? জিজ্ঞেস করার কী আছে?
-বলছি যে…
-আরে বলবে তো?! এতো হেয়ালি যে আমার পোষায় না, সেটা তো তুমি খুব ভালো করেই জানো!
-আচ্ছা আচ্ছা বলছি। আচ্ছা জিয়া তুমি কী সত্যিই কোনো দিন বিয়ে করতে চাও না?
-এতোদিনে তুমি কী সেটা বুঝতে পারোনি প্রফেসর বাবু? আমি এসব বিয়ে, রিলেশন কিছুতেই বিশ্বাস করি না। একটা মানুষকে নিয়ে যে সারাজীবন কী করে সবাই কাটায়, আমি তো বুঝতেই পারি না! আমার পক্ষে তো একটা মানুষের সাথে এতো গুলো দিন, সরি সরি, দিন কী বলছি এতো গুলো বছর ধরে একসাথে থাকা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। আমি তো বোরড হয়ে যাবো!
-আচ্ছা ধরো যদি তোমার বাবা-মা হঠাৎ করে তোমাকে না জানিয়েই তোমার বিয়ের ঠিক করেন?
-না না, এটা কখনোই সম্ভব নয়! তবে আমার বাবা অবশ্য মাঝে মাঝেই ইয়ার্কি করে আমাকে এটা বলে যে, হঠাৎ করেই নাকি একদিন আমার বিয়ের ঠিক করে আমাকে কলকাতায় ডেকে পাঠাবে, আমাকে বিয়ের কথা না জানিয়েই। তাই আমিও বলে দিয়েছি, ওরকম হলে আমি আর আমার বাবা-মায়ের কাছে কোনো দিন ফিরবোই না! ওই বিয়েটাতে হয়তো না করতে পারবো না, কারণ সেখানে আমার বাবা-মায়ের সম্মান নষ্ট হবে। তাই চুপচাপ মুখ বুজে কোনো কথা না বলে বিয়েটা করে নেবো। দরকার হলে বিয়ের পরেই আমি ডিভোর্স ফাইল করবো। কিন্তু আমার অমতে আমার বিয়ে দিয়ে দিলে আমি আর সম্পর্কই রাখবো না আমার মা-বাবার সাথে!
-তাই বলে এরকমটা করবে?!
-হ্যাঁ! আর তাছাড়া তুমি তো জানোই ওই ন্যাকা ন্যাকা ঘর সংসার আমার দ্বারা কখনোই হবে না!
-কিন্তু তোমার এরকম মনোভাবের কারণ কী জিয়া?
-আসলে আমি সারাজীবন মুক্ত হয়ে থাকতে চাই। কোনো বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে আমি থাকতে পারবো না। বিয়ে মানেই তো একটা বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে যাওয়া। আর নিজের ইচ্ছে গুলোকে গলা টিপে হত্যা করা! শ্বশুর বাড়ির সবার ইচ্ছে মতো চলতে হবে, কথা শুনে চলতে হবে, সবার পছন্দ মতো এক একরকমের রান্না করতে হবে, তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে রান্না ঘরে ব্রেকফাস্ট বানাতে ছুটতে হবে। সংসার, ছেলেমেয়ে সামলাতে গিয়ে তো আমার সমস্ত ইচ্ছে গুলো শেষ হয়ে যাবে। আমার বহুদিনের ইচ্ছে, আমি বহু জায়গায় ঘুরে ঘুরে ফটোগ্রাফি করবো। অনেক অনেক এক্সিবিশনে যাবো.. যদি আমি বিয়ে করে ফেলি, তাহলে তো সেইসব কিছুই আমি করতে পারবো না! আমার নিজস্বতা, নিজের স্বাধীনতা বলেই কিছু তো আর থাকবে না তখন। আমি জানি, কোনো শ্বশুর বাড়ির লোকই আমার ইচ্ছে গুলো পছন্দ করবে না।
-আর যদি করে?
-কী?
-যদি তোমার শ্বশুর বাড়ির লোক তোমার ইচ্ছে গুলোকে পছন্দ করে? তোমার হাজব্যান্ড এই সবটা মেনে নেয়?
-এরকম কখনোই সম্ভব নয় প্রফেসর বাবু! সবাই তো তাদের বাড়ির বউ মানেই বাড়ির দাসী মনে করে।
-কে বলেছে তোমায়? সবার মানসিকতা তো একরকম হয় না জিয়া! কেউ তো তোমার মনের মতো হতেও পারে। তোমার ইচ্ছে গুলোতে সম্মতি জানিয়ে তোমার মতো তোমার ইচ্ছে গুলোকে ভালোবাসতে, সম্মান করতেও পারে…
-হয়তো! কিন্তু আমার ভাগ্য তো আর অত ভালো হবে না প্রফেসর বাবু!
-যদি আমি এরকম কোনো শ্বশুর বাড়িই তোমাকে খুঁজে দিতে পারি? আর তোমার মনের মতো এরকম কোনো মানুষকেই তুমি তোমার জীবনসঙ্গী হিসেবে পাও?
-ওহ তাই নাকি? তাহলে তো আমি এককথায় সেই ছেলেকে বিয়ে করে নেবো… আর তাকে সঙ্গে নিয়ে আমার স্বপ্ন গুলো পূরণ করবো…
কথাটা বলেই হেসে ফেললো জিয়া। বেশ কিছুক্ষণ কথা বলে ফোন রাখার পর আয়ান ওই ছবিটা বুক থেকে সরিয়ে নিজের মুখের সামনে নিয়ে এসে ছবিটায় ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো আলতো ভাবে। তারপর ছবিটা ওর বালিশের নিচে রেখে জিয়ার কথা ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে পড়লো…
ক্রমশ…
পড়ছেন? কেমন লাগছে?
অষ্টম পর্বের লিংক-
https://www.facebook.com/101048758811830/posts/260414999541871/