#তুমি_আছো_তুমি_রবে
#পর্বঃ৭ #রেহানা_পুতুল
আর শর্তানুযায়ী বিরোধী নেত্রীর প্রতি আমার কড়া নির্দেশ হলো,আরিশা চলে যাওয়ার পর সে আমার রুমে ঢুকবে। দরজা বন্ধ করবে। বেডে উঠবে। তারপর যা করবে তা হলো,
দুই ঘন্টা আমার পা টিপবে। তারপর অবশ্যই মেঝেতে ঘুমিয়ে পড়বে। আমার পাশে বেডের উপরে ঘুমানো নিষিদ্ধ। আমি আরাম করে ঘুমাতে চাই।
ঝিনুক ধপধপ পায়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। আরিশাও ঝিনুকের পিছন পিছন চলে গেলো।
ঝিনুকের খালা ডিনারের জন্য সবাইকে তাড়া দিলো। সবাই খেতে বসলে, আরশাদ বোনকে ডাকলো খাওয়ার জন্য।
আরিশা গোঁড়ামি করে, তোমার খাওয়া তুমি খাও।
ওহ ঠিক বলছিস। আমরা খাই। এই সবাই খাও খাও।
শায়লা সহ বাচ্চাগুলো পিটপিট করে হাসতে লাগলো। ঘরভর্তি অতিথি। তাই তিন পর্বে নৈশভোজ সমাপ্ত হলো।
আরশাদ খেয়ে উঠানে বের হয়ে গেলো একটু হাঁটার জন্য। এই সুযোগে ঝিনুক আর আরিশা খেয়ে নিলো ঝটপট। কারণ আরশাদকে বোঝাতে হবে। মেজাজ গরম হয়ে আছে তাই খায়নি।
মামী জিজ্ঞেস করলো,কিরে কোন সমস্যা ঝিনুক ?
রাব্বী পাশ থেকে,আম্মু কুচ গড়বড় হোতাহে।
কিসের গড়বড়?
রাব্বি ধারাপাতের নামতার মতো সব গড়গড় করে সবার সামনে বলে দিলো।
ঝিনুকের নানু টেবিলের একপাশ থেকে উৎসুক কন্ঠে হেসে বলল, বিয়ের পর এসব খুনসুটি হওয়া মন্দ না। এতে বন্ধন টাইট হয়। মিঠা হয়। দিলে মহব্বত বাড়ে একজনের আরেকজনের প্রতি।
আরিশা রসালো গলায়, নানুতো পিএইচডি প্রাপ্ত। তাই মনে হয় রাইট ফর্মুলা দিচ্ছে ৷
সত্যই বলছ বইন। মুখভরা হাসি দিয়ে বলল নানু।
খাওয়া শেষে সবাই ডেজার্ট খেলো যার যার পছন্দমতো। কেউ পুডিং, কেউ ছানা,কেউ দই,কেউ পায়েস, কেউ জর্দা,কেউ মোহনভোগ।
ঝিনুকের খালাকে কাজে সাহায্য করতে তার মামী হাত লাগালো। বাচ্চারা কেউ কেউ ঘুমিয়ে গেলো। রাত কম হয়নি বলে খালা সবাইকে ঘুমিয়ে যেতে বললো।
আরিশা ঝিনুককে একা এক রুমে ডেকে নিলো। ভাবী শোন। কোনভাবে আমাদের শাস্তি বানচাল করা যায় কিনা একটু ভাবো।
ঝিনুক বললো, আমি চাইলে এটা ইজিলি পারি। বাট আমি নীতির মানুষ। হোক না এটা মামুলি একটা বিষয়। তবুও আমার কাছে গুরুত্ব আছে আমার ওয়াদার।
তাহলে আর কি করা। তোমার শাস্তির তুলনায় আমারটা নগন্য। ওই এক ঘন্টা পা টিপতে টিপতে এক রোমিওকে কল্পনা করেই পার করে দিতে পারবো। নিরাশ গলায় বলল আরিশা।
রোমিও আছে তোমার? কবে থেকে? রসায়ন কেমন চলছে সখী? ঝিনুক আরিশার চিবুক ধরে রোমান্টিক মুডে জানতে চাইলো।
ঢাকায় গেলে সব তোমাকে জানাবো ভাবী। তোমার অনেক হেল্প লাগবে এ বিষয়ে। এখন চুপ হই। ভাইয়া শুনলে মেরে ফেলবে। প্রেম করেনিতো বেচারা। কি করে বুঝবে প্রেমের স্বাদ।
করতে কেউ মানা করেছে নাকি তোমার ভাইকে?
বুঝনা বলদ নামের ভদ্র ছেলে। তাই করেনি তোমার আশায়। সামনের দিকে করবে মনে হয় তোমার সাথে।
তোমার ভাই প্রেম করতে জানে নাকি?
তুমি জানো খুব?
একদম না। তবে চাইলে উড়াধুড়া প্রেম করতে পারি। ক্লাসে এক কপোত-কপোতীর পিয়ন ছিলাম আমি।
তাহলে তোমাকে দিয়ে হবে। কথায় আছেনা গাইতে গাইতে গায়েন।
এই ভাবি ভাইয়া মনে হয় শুয়ে গিয়েছে। যাই। আমার ডিউটির সময় শুরু হলো বলে।
আচ্ছা যাও। শুভরাত্রি আরিশা।
শুভরাত্রি সোনাভাবি।
আরিশা চলে গেলে ঝিনুক গজগজ করে, শুভ না অশুভ তাতো দেখতেই পাচ্ছি। কার বুদ্ধিতে যে সে আমাকে নিতে আসলো। বলে ঝিনুক উষ্ণ নিঃশ্বাস ফেললো।
_____
নিশুতি রাত। সারাদিনের কর্ম ব্যস্ততা শেষে নিদ্রাদেবীর কোলে ঢলে পড়লো সারাঘরের সবাই। বাইরে দমকা হাওয়া বইছে। সে বাতাসে ঘন বাঁশঝাড়ের ভিতর থেকে গা ছমছম করা আওয়াজ ঝিনুককে ভীতসন্ত্রস্ত করে দিচ্ছে।
বহুদিন পরে গ্রামে আসলো। তাই এমন হচ্ছে তার বুকের ভিতর। মাঝে মাঝে কানে ভেসে আসছে রাত জাগা পাখিদের কান্নার শব্দ। আরিশা কিছু সময় ভাইয়ের পা টিপে মাথাব্যথা করছে বলে শায়লার সাথে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো।
আরশাদ ঘুমাচ্ছে না। কিন্তু চোখ বন্ধ করে ঘুম এসে যাওয়ার ভান করে আছে। ঝিনুক দরজা ঠেলে রুমের ভিতরে ঢুকলো। দরজা বন্ধ করে দিলো। বেডে উঠে গিয়ে বসলো। হাত গুটিয়ে বসে আছে।
মনে করলো আরশাদ গভীর ঘুমে তলিয়ে গিয়েছে। লোমশ পায়ে হাত দিতে তার অরূচি হচ্ছে। ফর্সা হলে তাও হয়তো সুন্দর লাগতো কালো লোমে। কিন্তু আরশাদ শ্যামলা বর্নের ছেলে। তবে চেহারার গঠন আকর্ষণীয় । চুলগুলোও সুন্দর। যথেষ্ঠ স্মার্ট। পিতামাতার বাধ্য সন্তান। ঝিনুক ছাড়া সবার সাথেই মার্জিত ব্যবহার তার। মিশুক প্রকৃতির ছেলে। মানুষের বিপদে অর্থ খরচেও দুহাত আকাশের মতো বিশাল।
আরশাদ অনুভব করতে পারলো ঝিনুক বসে আছে। কারণ খাটে উঠার সময় শব্দ হয়েছে।
চোখের পাতা না মেলেই , আমি ঘুমাইনি কিন্তু। নিজের মায়ের পেটের ছোটবোন যেখানে আদেশ মানতে বাধ্য হলো। সেখানে কারো এটা উপলব্দি হওয়ার কথা যে, আমি কেমন মানুষ।
আমার চাওয়ার হেরফের হলে আমি দিগুন শাস্তি দিবো ঢাকায় বাসায় নিয়ে।শীতল গলায় কথাগুলো বলল আরশাদ।
আরশাদের হুমকিমুলক কথা শুনে ঝিনুক দ্বিতীয়বারের মতো ভয় পেয়ে গেলো। ক্ষীনস্বরে জিজ্ঞেস করলো,
শাস্তি চেঞ্জ করার সুযোগ আছে?
একদম নাহ।
ঝিনুক ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে উঠলো। এক পাহাড় বিরক্তি নিয়ে দুই পা টিপলো। টেপা শেষ হলে আরশাদ বলল,আহ কি আরাম! দেখলে বানরের মতো পা দুটোর কি সেবা করতে হলো তোমার। একেই বলে খেলা।
ঝিনুকের এখন মনে হচ্ছে আরশাদ প্রতিশোধ পরায়ন ছেলেও বটে। দুহাত ঝাড়তে ঝাড়তে খাট থেকে নামছে। নিজের অজান্তেই তার মুখ ফসকে
‘ অমানুষ ‘ শব্দটা বেরিয়ে গেলো।
আরশাদ শুনে গেলো । ঝিনুককে হ্যাঁচকা টানে বেডে শুইয়ে গলা চেপে ধরলো। কি বললি তুই? আমি অমানুষ? এই শব্দটা আমার সবচেয়ে অপ্রিয় একটি শব্দ। এই এক জীবনে এই প্রথম কেউ আমাকে অমানুষ বললো।
এইই অমানুষ কাদের বলে বুঝিস? আমি অমানুষ হলে আজ এখানে থাকতাম না। আর বেশি কিছু বলতে চাইনা। এটা আমার বাসা হলে এখন তোর পিঠের চামড়া তুলে ফেলতাম। আর জিন্দেগীর জন্য সুঁচের মতো সোজা করে ফেলতাম।
ঝিনুকের দম আটকে যাচ্ছে বুঝতে পেরে গলা থেকে হাত সরিয়ে ফেললো। ঝিনুক টু শব্দটি ও করলোনা।
অসহায়ের মতো খাট থেকে নেমে গেলো। মেঝেতে গায়ের ওড়না বিছিয়ে তার বালিশ নিয়ে শুয়ে পড়লো। এভাবে শোয়ার অভ্যাস তার পুরোনো। ঢাকায় নিজেদের দুই বেড়ের ভাড়া বাসা। গ্রাম থেকে মেহমান গেলেই তারা দুইবোন ফ্লোরে ঘুমাতো।
ঝিনুকের দুচোখের কোন বেয়ে অবিরাম অশ্রুপাত হচ্ছে নিরবে । যেন দূর পাহাড়ের দুঃখিনী ঝর্ণা। গভীর রাত। তাই শব্দ করে কাঁদতেও পারছেনা। একসময় ঝিনুকের দুচোখ জুড়ে ঘুমদেবী আশ্রয় নিলো।
ঝিনুকের এমন নিঃশ্চুপতা, প্রতিউত্তর না দেওয়া,বোবা কান্না আরশাদকে ভড়কে দিলো। এই মেয়ের অনিয়ন্ত্রিত মুখ নিয়ে কিভাবে কি হবে। একটু চুন থেকে পান খসলেই কি ভয়ানক বিশেষণে বিশেষায়িত করে আমাকে। কথায় কথায় ইগো দেখায়। এমন চলতে থাকলে অতিশীঘ্রই পাবনা হেমায়েতপুরে চলে যেতে হবে আমার।
এমন বিক্ষিপ্ত ভাবনায় আরশাদের ভারি ঘুম হলোনা। শেষ রাতের দিকে সবুজ রঙের ডিম লাইটের আলোতে আরশাদ খাটের উপর থেকে ঝিনুকের দিকে তাকালো। দেখলো নির্জীবের মতো ঘুমিয়ে আছে ঝিনুক। আরশাদ উঠে সন্তপর্ণে রুমের লাইট জ্বালালো। ঝিনুকের ঘুমন্ত মুখের দিকে অনিমেষ চেয়ে রইলো। দেখলো গালের দুপাশে চোখের কোন বরাবর কান্নার গড়িয়ে আসা শুকনো দাগ বসে গিয়েছে।
একা রুম। দুজন যুবক যুবতী। আরশাদের দৃষ্টিতে আটকে গেলো ঝিনুকের আপাদমস্তক। ওড়নাবিহীন ঝিনুকের বুকে চোখ যাওয়াতে সে শিহরিত হয়ে উঠলো। এই প্রথম কোন মেয়ের পোশাকে আবৃত শরীর দেখেও আরশাদের অনুভূতিতে মহাপ্রলয় সৃষ্টি হলো।
ঘুমন্ত নারীও যে পুরুষের মনে নেশার ঝড় তুলতে পারে তা আরশাদ এই প্রথম টের পেলো।
তুমি এত সুন্দর ঝিনুক। এর আগে তোমাকে এমন পরখ করে দেখার আগ্রহটুকু হয়নি। তোমার উছলে পড়া টগবগে যৌবনের চোরাবালিতে এই মুহুর্তে ডুবে যেতে মন চাচ্ছে। খুউব।
ভাবতে ভাবতে আরশাদের গলা শুকিয়ে যাচ্ছে অনবরত। টেবিলের উপরে থাকা ওয়াটার পট হাতে নিলো। ছিপি খুলল । ঢকঢক করে সব পানি খেয়ে নিলো। পিপাসায় গলা শুকিয়ে চৈত্রের মাঠ হয়ে যাচ্ছে। টিউব লাইট ও ডিম লাইট অফ করে দিলো। গোটা রুম অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে গেলো।
ঝিনুকের পাশে গিয়ে বসলো। চোরের মতো অতি সাবধানে ঝিনুকের মুখের দিকে ঝুঁকলো। বুকের ভিতর ধড়ফড় করছে।
এদিকে ঝিনুকের ঘুম প্রায় ফুরিয়ে এলো। কারো ভারী নিঃস্বাস অনুভব করছে তার অধরের নিকট। সে চোখ মেলেই কে বলে ভয়ে চিৎকার দিবে,
অমনি আরশাদ ঝিনুকের মুখ চেপে ধরলো।
কানের কাছে ফিসফিসিয়ে, আমিই। আল্লারওয়াস্তে শান্ত হ ।
ঝিনুক ভয়ার্ত সুরে , এত অন্ধকার কেন? ডিম লাইট অফ কেন? আপনি আমার কাছে কেন? আমাকে মেরে ফেলার জন্য? এত পানিশমেন্ট দিয়েও মন ভরেনি ?
আরশাদ আস্তে দাঁড়িয়ে ডিম লাইট জ্বালিয়ে দিলো। আবার এসে ঝিনুকের একটি হাত ধরলো শক্ত করে। লাইট আমিই অফ করেছি। মন ভরেনি তাই এলাম আরো শাস্তি দিতে। এটা মধুর শাস্তি বলে আরশাদ তার দুঠোঁট ঝিনুকের অধরে চেপে ধরতে গেলো। ঝিনুক এক ঝাটকায় মুখ সরিয়ে নিলো।
তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো । ঘৃণায় সমস্ত শরীর রি রি করে উঠলো তার । বুক ধপধপ করছে। যেন উম্মনা কিশোরীর চপল নৃত্য। আপনাকে এই পৃথিবীর সবাই ভালোবাসলেও আমি ঘৃণা করি। এটা জেনে রাখুন। আপনার স্পর্শ আমার কাছে বিষাক্ত ছোবল ছাড়া আর কিছুই না।
কারণ শুরু থেকেই যতবার আপনি আমায় ধরেছেন। কেন ? আমাকে শাস্তি দিতে, আমার উপর অত্যাচার করতে ধরেছেন। এর বাইরে কিছুই নয়।
সুতরাং আমার অনুমতি ছাড়া কখনো আমার শরীরে টাচ করার চেষ্টা করলে আমার মরা মুখ দেখবেন আপনি।
আরশাদ থমকে গেলো একথা শুনে। চোরাচোখে চেয়ে থাকা ঝিনুকের বুকের উপর থেকে চাহনি সরিয়ে নিলো।
ঝিনুক মরিচ চোখে আরশাদের দিকে চাইলো। মনে মনে একটা কঠিন ফন্দী এঁটে ফেললো। যা দ্বিতীয় কারো সাথেই শেয়ার করা যাবেনা ভুলেও ।
চলবে…৭
( মন্তব্য করে ও শেয়ার দিয়ে অনুপ্রাণিত করার বিশেষ প্রত্যাশা রইলো। ভালোবাসা অবিরাম। 💚🌷🙋♀️)