‘লোডশেডিং’ পর্ব ৫.

0
380

‘লোডশেডিং’
পর্ব ৫.

তাবিনা মাহনূর

__________

বাগদানের আয়োজন করা হয়েছে কমিউনিটি সেন্টারে। কামিনী আজ সাদা আর রুপালি পাথরের কারুকাজ করা লেহেঙ্গা পরেছে। দেখতে অসম্ভব সুন্দর লাগছে। তাকে পর্দার আড়াল থেকে একবার দেখলো চৈতি। সিনেমার নায়িকার চেয়ে কম সুন্দর লাগছে না। পাশে শিমুল দাঁড়িয়ে আছে চিন্তিত মুখে। তাকে দেখে চৈতি কিছুটা অবাক হলো। আজ সারাদিন শিমুলের মুখটা চিন্তিত দেখা যাচ্ছে। পার্লার থেকে মেয়ে এসে সাজিয়ে দিয়েছে কামিনীকে। সাজের কারণে কামিনীর চেহারা চেনাই যাচ্ছে না। খুব ভালো করে দেখলে বোঝা যায় এটা চৈতির বড় চাচার একমাত্র মেয়ে কামিনী। শিমুল সেই সাজ দেখে বলেছে, ‘আল্লাহ! স্কিনের বারোটা বাজালো সেই সাথে বাম কাঁধে তো একজন আছেনই!’

চৈতি এ কথার মানে বোঝেনি। এখন সে প্রশ্ন করলো, ‘আপু, তোমাকে এতো বিব্রত লাগছে কেন? তোমার শরীর ঠিক আছে তো?’

শিমুল আরো বিরক্ত হয়ে গিয়ে বললো, ‘শরীর ভালো আছে। কিন্তু মন কেমন যেন করছে।’

– কি হয়েছে? আমাকে বলতে পারো।
– মনে হচ্ছে আমার বিয়েতে যদি এগুলো সত্যিই করে থাকে তবে আমাকে কত কত গুনাহর ভাগিদার হতে হবে!
– কি বলছো আপু! গুনাহ কেন হবে? মনের মতো খরচ করে বিয়ে করাতে কোনো গুনাহ আছে কি?
– তুই এদিকে আয়।

শিমুল চৈতিকে নিয়ে অন্য ঘরের এক কোণে গিয়ে বসলো। এই ঘরে মানুষের আনাগোনা কম।

– কি যেন বলছিলি?
– বড় করে বিয়ে করা কি গুনাহ?
– ঠিক গুনাহ নয়, তবে না করাই উত্তম। আমাদের প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যেই বিয়ের খরচ কম এবং সহজ সেই বিয়ে বরকতময় বেশি।’ (বায়হাকি : ২৯৬৩) কিন্তু পরিবারের ইচ্ছেতে যদি বেশি খরচ করে বিয়ে করতে চাস তাহলে সেটা হালাল পন্থায় হতে হবে।

চৈতিও চিন্তিত মুখে প্রশ্ন করলো, ‘কামিনী আপুর বিয়ে কি হালাল না?’

শিমুল উত্তরটা বুঝিয়ে বললো, ‘বিয়ে তো হালালই। কিন্তু বিয়েটা যেই আড়ম্বর আয়োজনে করা হচ্ছে এটা জায়েজ নয়। এই বিয়েতে অনেককিছু নাজায়েজ হচ্ছে। যেমন, বাগদান। এটা জায়েজ নয়। আর সামাজিক ইচ্ছে মানতে যদি করেও থাকে তবে এতো বড় করে গুনাহ বাড়িয়ে করা একেবারেই ঠিক নয়।’

চৈতি তবু বুঝে উঠতে পারেনি, ‘ঠিক কেমন বোঝাতে চাচ্ছো?’

– এই যে দেখ, যার সাথে বিয়ে হবে সে তো এখনো পরপুরুষ। অথচ তার হাত ধরে আংটি পড়ানো হবে। সেখানে কত পুরুষ মানুষ থাকবে যারা কামিনী আপুর এত সাজসজ্জা দেখবে। সেখানে অনেক মেয়ে থাকবে যারা বেপর্দা হবে এবং ফ্রি মিক্সিং এর বিষয়টা তো আছেই। তারপর দেখিস, বাগদান হওয়ার পর কামিনী আপু তার হবু স্বামীর সাথে এমনভাবে মেলামেশা করবে যেন বিয়েই হয়ে গেছে। এটা আরো খারাপ। এতক্ষণে আপুর বাম কাঁধে গুনাহর ভান্ডার লেখা হয়ে গেছে। ক্ষমা না চাওয়া পর্যন্ত সেগুলো মুছবে না।
– তুমি কি এটা নিয়েই চিন্তিত?
– খুব বেশি চিন্তিত। আজকেই সবাই বলছিল, এই বিয়ের পর আমার বিয়ে নিয়ে ভাববে। তখন বাগদানে আমাকে নীল রঙের শাড়ি পরাবে। সেসব ইউটিউবে ডিজাইন সহ দেখেছে তারা। আমি কিছু বলিনি। আসলে বলার সাহস পাইনি। একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কারো কাছেই কিছু বলার নেই।

চৈতি অবাক হয়ে দেখলো, শিমুল কতটা বদলে গিয়েছে! কিছুদিন আগেও ওড়না ছাড়া ফতুয়া পরে ভার্সিটিতে ক্লাস করতে যেতো শিমুল। আর এখন মাথায় ওড়না না দিলে হাঁসফাঁস করে। এই যেমন এখন সে লাল জামার সাথে লাল রঙের হিজাব পরে আছে। দেখতে খুবই ভালো লাগছে। কিন্তু আশেপাশের মানুষের চোখে কেন যে ভালো লাগছে না তা চৈতি বুঝতে পারলো না।

চৈতি আজ গাঢ় নীল রঙের থ্রি পিস পরেছে। ওড়নার ঘের অনেক তাই তারও ইচ্ছে করলো সেটা মাথায় দিয়ে রাখতে। পেছন থেকে ওড়না টেনে মাথায় দিয়ে শিমুলকে বললো, ‘দেখো তো আপু, আমাকে ভালো লাগছে?’

শিমুলের ঠোঁটে হাসি, ‘খুবই সুন্দর দেখাচ্ছে। একটা সত্যি কথা বলি? এভাবে তোকে আরো বেশি সুন্দর লাগছে। ছেলেদের সামনে ঘুরিস না বেশি।’

চৈতি মেকি হাসি হাসলো। তার যাওয়ার প্রয়োজন পরবে না, সৌরভ এসেই তাকে আলাদা করে রাখবে।

চৈতি যা ভেবেছিল তাই হলো। কনভেনশন হলে একটা ঘর আছে যেখানে পর্দানশীন মহিলা সদস্যদের জন্য আলাদা করে ব্যবস্থা করা হয়েছে। ওখানে চৈতিকে রেখে আসলো সৌরভ। তার আগে চৈতির কপালে স্পর্শ দিতে ভুললো না।

চৈতির মনটা বড্ড খারাপ। ভেবেছিল আজ স্বাধীনকে পরিপাটি রূপে দেখবে। স্বাধীন কি রঙের পোশাক পরেছে, কীভাবে চুল সেট করেছে, সবকিছু অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখতে চেয়েছিল সে। তা আর হলো না। এই বন্ধ ঘরে খাবারের আয়োজন করা হয়েছে। সৌরভ ফোনে ম্যাসেজ পাঠিয়ে বলেছে, তার খাবার এই ঘরেই দেয়া হবে।

খাবার খেয়ে হাত ধোঁয়ার জন্য বাহিরে আসতে হলো। এই সুযোগে আশেপাশে নজর বুলিয়েও চৈতি তার মনচোরার খোঁজ পেলো না। হাত ধুয়ে আবারো খুঁজতে লাগলো সে। কিন্তু পেলো না। ঘরে যাওয়ার আগে মাহিয়াকে দেখলো এক কোণে দাঁড়িয়ে অন্য বন্ধুদের সাথে গল্প করছে। সেখানেও স্বাধীন নেই। সে মাহিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য একটু ধীরে ধীরে হাঁটলো। তার কৌশল কাজে লাগলো। মাহিয়া হাসি মুখে ডাকছে।

– মা শা আল্লাহ! তোমাকে অনেক বেশি সুন্দর লাগছে চৈতি। সৌরভ বলেছে, আজই তোমাকে বিয়ে করতে ইচ্ছে করছে ওর। আমরা তো হেসে কুল পাই না!

চৈতি মুচকি হাসছে কিন্তু তার মন খুঁজছে চিরচেনা কাছের মানুষটিকে যার অস্তিত্ব তাকে প্রতিনিয়ত পোড়ায়।

গল্পের ছলে জানতে পারলো সে, স্বাধীন আজ আসেনি। খুব অবাক হলো চৈতি। সবচেয়ে কাছের বন্ধুর বোনকে যেদিন পাত্র পক্ষ দেখতে এলো সেদিন সে এসেছিল। অথচ বাগদানের দিন এলো না! এরপর জানতে পারলো, স্বাধীনের বাবা স্ট্রোক করেছেন হঠাৎ। তাকে নিয়ে হাসপাতালে বেশ বিপদ যাচ্ছে। চৈতির মনে বড় অনুতাপ যুক্ত হলো। স্বাধীনের উপর কত বড় চাপ! নিশ্চয়ই দুপুরের খাবার খাওয়ার সময় পায়নি। অথচ সে আরামে বিরিয়ানি আর কোল্ড ড্রিংকসের স্বাদ নিচ্ছে। তার মনে হলো এখুনি বাথরুমে গিয়ে বমি করে ফেলতে পারলে ভালো হতো।

বিকেলে আংটি পরিয়ে কেক কাটা হলো। সেসময় চৈতির হাত ধরে রেখেছিল সৌরভ। বোনের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে ভেবে সৌরভের মন খারাপ। বড় বোন তার মনের সব কথা জানে। শুধু চৈতিকে মেনে নিতে পারেনি কামিনী। নিজের ভাইয়ের সাথে ভাঙা পরিবারের একটা মেয়েকে মেনে নেয়া তার কাছে যৌক্তিক লাগেনি। সৌরভ কোনো কিছুর পরোয়া করে না। সে তার বোনকে খুব ভালোবাসে তবে চৈতির স্থান তার কাছে কোনো অংশে কম নয়।

চৈতির মন অন্যদিকে। মাথায় ঘোমটা দেয়া তাই তার চেহারা দেখতে পারছে না সৌরভ। কেক কাটা শেষে সবাইকে দেয়া হচ্ছে যার দায়িত্বে আছেন জেবিন আর দিলারা। সৌরভ সেদিকে একবার চোখ বুলিয়ে দেখলো, সবাই যার যার কাজে ব্যস্ত। তাই চৈতির হাত ধরে নিয়ে গেল করিডোরের দিকে। সেদিকে দুটো লিফট। সিঁড়ি অন্য পাশে তাই কেউ আসলে লিফট দিয়েই আসবে। যেহেতু এই তলায় কামিনীর বাগদানের অনুষ্ঠান হচ্ছে এবং তা শেষ পর্যায়ে তাই আপাতত এখানে কেউ আসবে না। সেই সুযোগের অশালীন ব্যবহার করলো সৌরভ।

একটা দেয়াল ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে চৈতি। তার দুই পাশে হাত দিয়ে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়ে সৌরভ ঝুঁকে আছে তার মুখের কাছে। চৈতি মুখ নামিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে। তার প্রচন্ড অস্বস্তি হচ্ছে যা সে প্রকাশ করতে পারছে না। মনে মনে খুব চাইছে কেউ এসে পড়ুক আর তাকে রক্ষা করুক। আল্লাহর সাহায্য কামনা করছে প্রতি ক্ষণে ক্ষণে।

– এত কম সেজেছিস কেন? সারাক্ষণ মাথায় ঘোমটা দিয়ে রাখছিস যার জন্য তোর চেহারা দেখাই মুশকিল হয়ে পড়ছে। তাহলে একটু সেজে আসতি? অন্তত আমি দেখতাম।

চৈতি চোখে কাজল আর ঠোঁটে লিপস্টিক দেয়া ছাড়া আর কোনো সাজ নেয়নি। সে ভেবেছে সাজগোজ বিয়ের জন্য, বাগদানে বেশি সেজে নিজে বউ রূপ ধারণ করার প্রয়োজন নেই। সৌরভ চৈতির কপালে চুমু খেলো। চৈতি তার হাত দুটো দিয়ে ধাক্কা দিতে চাইলে হাত ধরে ফেললো সৌরভ।

– এই! একদম দূরে ঠেলবি না। আদর করছি ভালো লাগে না, না? বকা দিলেও তো ফ্যাচ ফ্যাচ করিস।

বকা শুনতে কারো ভালো লাগে না। চৈতিও ব্যতিক্রম নয়। তবে অশ্লীল আচরণের শিকার ও ইচ্ছার বিরুদ্ধে ভালোবাসা গ্রহণ করার তুলনায় তিরস্কার সহ্য করা অনেক বেশি ভালো।

চৈতি বলে উঠলো, ‘ভাইয়া, এখানে কেউ দেখে ফেলবে।’

এখানে কেন, কোনো স্থানেই চৈতি সৌরভের স্পর্শ পেতে চায় না। এ কথা বলার সাহস নেই বলে এখনকার মতো কেটে পড়তে চাইছে সে। কিন্তু সৌরভ দেখলো তার প্রিয়তমার ঠোঁটের সঞ্চালন।

– নীল জামার সাথে গোলাপি লিপস্টিক না দিয়ে লাল দিলে কি হতো? কত সুন্দর রাঙা হয়ে থাকতো!

চৈতির কাছে লাল লিপস্টিক একটুও ভালো লাগে না। তার সবসময় ঠোঁটের আসল রঙে রাঙাতে বেশি পছন্দ। কোমল ঠোঁটে গোলাপি রঙের ছোঁয়া কোমলতা কমিয়ে শুষ্কতা বাড়িয়েছে। কম দামী লিপস্টিক দিয়েছে চৈতি। শুষ্কতা সৌরভের মাদকময় চাহনীকে আরো মাতাল করে তোলে। চৈতি অনুভব করলো উত্তপ্ত শ্বাস। এতদিন যেই স্পর্শকে সে রক্ষা করে এসেছে আজ বুঝি সেই স্পর্শের রক্ষা করা সম্ভব হলো না। চৈতির গাল বেয়ে বড় বড় কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো। ‘আল্লাহ!’, বলে মনে মনে কয়েকবার জপে নিলো যেন বিপদ থেকে উদ্ধার পেতে পারে সে।

– পাবলিক প্লেসে এতো খোলামেলা হওয়াটা কোনো ভদ্র ছেলের কাজ?

শব্দ করে একবার কেঁদে উঠলো চৈতি। সাথে সাথেই কান্না বন্ধ করে এক ধাক্কা দিয়ে সৌরভকে সরিয়ে সেন্টারে ঢুকে পড়লো সে। বাথরুমে গিয়ে অঝোরে কাঁদতে লাগলো চৈতি।

সৌরভ বিস্ময় নিয়ে চেয়ে আছে স্বাধীনের দিকে। এসময় স্বাধীনের আসার প্রশ্নই ওঠে না! কোন অলৌকিক সত্তা স্বাধীনকে এখানে এনে হাজির করলো তা ভেবে পাচ্ছে না সৌরভ।

স্বাধীন একবার দেখলো তার বন্ধুর অবাক চাহনি। সেই সাথে উত্তেজনায় ঘেমে যাওয়া সৌরভের ঠোঁটের উপরের অংশ দেখে স্বাধীন তার চোখ নামিয়ে ফেললো।

স্বাধীন বললো, ‘অবাক হওয়ার কিছু নেই। রাশেকের রক্ত এবি নেগেটিভ। বাবার রক্তের প্রয়োজন তাই ওকে নিতে এসেছি।’

ঠিক সেসময় রাশেক এসে উপস্থিত, ‘সরি রে স্বাধীন। আমার ফোন সাইলেন্ট করা তো তাই তোর ফোনকল শুনতে পাইনি। এই মাত্র ফোন ঘেঁটে দেখলাম।’

– সমস্যা নেই। তুই তাড়াতাড়ি আয়।

সৌরভ বলে উঠলো, ‘আমিও যাবো।’

স্বাধীন পেছন ঘুরে ভ্রু কুঁচকে বললো, ‘কেন?’

– আঙ্কেলকে দেখতে চাই। আমার খুব খারাপ লাগছে।

স্বাধীন হেসে উঠলো। মুচকি হাসি ধরে রেখেই বললো, ‘উহু। তোর অনেক কাজ। এখানে থাক তুই। আর অসুস্থ মানুষকে দেখে এমন আনন্দময় অনুষ্ঠানে এসে যদি অমঙ্গল দেখা দেয়? আসি।’

কিছু মানুষ আছে যারা ইঙ্গিতপূর্ণ কথার অর্থ তাৎক্ষণিকভাবে ধরতে পারে না। সৌরভ এসব ব্যাপারে মাথা মোটা স্বভাবের। এবারও সে বুঝতে পারলো না স্বাধীনের অপমানমূলক কথাটির মর্মার্থ।

________

রাতের আকাশে আজ অমাবস্যা। এই আকাশ আর কারো ভালো লাগে কিনা চৈতি জানে না তবে তার খুব প্রিয়। এই আকাশে চাঁদ দেখা যায় না, চাঁদের আলোও নেই। তাই অসংখ্য তারকারাজি অনন্য আকাশের সাথে সাক্ষাৎ করিয়ে দেয়। আজকে এই আকাশকে মলিন লাগছে চৈতির। তারার আলো তার মনে কোনো ভালোবাসা, শান্তি ও সুখের সৃষ্টি করছে না। বরং আজকের আকাশে চাঁদ নেই, অমাবস্যা যেন তাকেও ঘিরে রেখেছে। চৈতির সাথে সৌরভ আবারো দেখা করতে এসেছিল। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, সৌরভ তাকে পড়া ধরে আর কোনো আলাপ কিংবা প্রতিদিনের কৃতকর্মে ফিরে যায়নি। চৈতি ভেবেছিল সৌরভকে ধাক্কা দেয়ার কারণে হয়তো তাকে বহু ঝামেলা পোহাতে হবে। কিন্তু সৌরভ আজ গম্ভীর ছিল। চৈতি সব পড়া ভালোভাবে শেষ করে রেখেছিল বলে সৌরভ তাকে বকা দেয়নি। বলতে গেলে, চৈতির দিনের শেষটা মন্দ কাটেনি।

তার মন খারাপ স্বাধীনের জন্য। এসেই তার আর সৌরভের বাজে মুহূর্ত দেখেছে স্বাধীন। এমনিতে স্বাধীনের উপর অনেক চাপ। এমন বাজে ঘটনা নিজ চোখে দেখে তার মনে চৈতির প্রতি কেমন ধারণা জন্ম নিচ্ছে চৈতি জানে না।

লোডশেডিং হয়েছে। ঘরে জেনারেটর চালিত লাইট আর ফ্যান চলছে। শৈশবের স্মৃতি মনে পড়ে গেল চৈতির। কুহু থাকাকালীন জেনারেটর ছিল না। তখন কারেন্ট চলে গেলে রাতের বেলা ছাদে এসে আড্ডা দিতো সবাই। বাচ্চারা খেলা করতো ছাদের এক কোণে বসে। অন্ধকারে নিজেদের বানানো কিছু খেলা খেলতো আর গল্পে মেতে উঠতো। সবই কাল্পনিক গল্প। সেসময় কার গল্প বেশি আকর্ষণীয় সেটা নিয়ে লড়াই চলতো। তাই বানিয়ে বানিয়ে চৈতি অনেক গল্প বলেছে। এবং বেশিরভাগ সময় সে জয়ী হতো। তার কল্পনাশক্তি প্রখর ও অনন্য। কারেন্ট চলে গেলে পড়াশোনা করতে হতো না, গল্প আর গল্প! এমন মজার সময় এখন আর পাওয়া যায় না।

চৈতি নিঃশব্দে ছাদে গেল। ঘরে থাকলে কারেন্ট চলে যাওয়ার অনুভুতিটা অনুভব করা যায় না। ছাদে গিয়ে স্বাধীনের ছাদে চোখ গেল বরাবরের মতো। চিলেকোঠার ভেতর একবার সে যেতে চায়। কিন্তু তা সম্ভব নয়। হতাশ মনে আকাশের দিকে তাকিয়ে মেঝেতে শুয়ে পড়লো চৈতি।

ক্ষুদ্র আলোকবিন্দু মিটমিট করে জ্বলছে। চৈতির জীবনেও আজকাল আলোক বিন্দু মিটমিট করে জ্বলে। চৈতির ভয় হয়, কবে না সেই আলোক বিন্দু একেবারেই নিভে যায়! ফোনে ম্যাসেজের আওয়াজ শুনে কল্পনার ঘোর থেকে বেরিয়ে এলো সে। শিমুল ম্যাসেজ করেছে, ‘দাদি তোকে দেখতে চাইছে চৈতি। একা নীচে আসতে পারবি?’

চৈতি হেসে উঠলো। একা একা ছাদে অন্ধকারের মাঝে বসে থাকে সে, অথচ নীচে নামতে পারবে না! শিমুল তো আর জানে না, চৈতির জীবনে মানুষ রুপি পশু ছাড়া ভয়ের আর কিছুই নেই।

চৈতির দাদি জয়নাব বেগম দোতলায় থাকেন। বয়সের ভারে উপরের তলায় থাকার সাহস পান না। এই বাসায় লিফট নেই। মাঝে মাঝে উপরে আসেন থাকতে তবে চৈতির ঘরে আসেন না। সেই ঘরে গেলে নাকি কুহুর স্মৃতি তাকে তাড়া করে।

চৈতি শিমুলের বাসার দরজায় নক করলো। ছোট চাচী নিরা দরজা খুলে তাড়াতাড়ি নিজের ঘরের দিকে গেলেন। সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। শিমুল এসে চৈতিকে সাথে নিয়ে জয়নাব বেগমের ঘরে গেল। বিছানার এক কোণে নেতিয়ে আছে অসার দেহ। চৈতিকে দেখতে পেয়ে মৃদু কণ্ঠে ডেকে উঠলেন জয়নাব, ‘ছোট কুহু!’

চৈতি এই ডাকটা শুনতে খুব ভালোবাসে। এজন্যই দোতলায় আসা হয় তার। সৌরভ আসতে দেয় না ছোট চাচার দুই ছেলে আসাদ আর আনাসের জন্য। তারা দুই ভাই পিঠাপিঠি আর চৈতির চেয়ে যথাক্রমে দুই ও তিন বছরের বড়। তাই ছোটবেলায় চৈতির সাথে তাদের বনিবনা বেশ ভালো ছিল। এখন সৌরভ তাদের কাছে তাকে ঘেঁষতে দেয় না। ছেলে দুটোর মাঝে ছোটজন অর্থাৎ আনাস নাকি তার মাকে একবার চৈতিকে ভালো লাগার কথা বলেছিল। নিরা তখন কষিয়ে এক থাপ্পড় মেরেছিলেন। ছেলেরা মায়ের ভক্ত। বেশ মান্য করে চলে। তাই দ্বিতীয়বার এ নিয়ে কথা তুলেনি।

তবে সৌরভের ধারণা, দুই ভাই চৈতিকে পছন্দ করে। শুধু আনাস নয়। তাই এ বাসায় চৈতির আসা সম্পূর্ণ নিষেধ। শুধুমাত্র দাদিকে দেখতে আসতে পারবে সে।
দাদির হাত ধরে বিছানায় মাথা পেতে আছে চৈতি। দাদি অনেক গল্প বলছেন।

– তোর আম্মারে আমি কতই না অবহেলা করসি! তারে পরথম পরথম (প্রথম প্রথম) দুই চক্ষে সহ্য করবার পারতাম না। হ্যারপর (এরপর) হ্যায় (সে) কি জাদু করসিল আল্লাহই জানে! আমার তো অহন তারে খুব দ্যাখতে মন চায় সুনা (সোনা)। তাই তোরে দেখি। তুই হইছস এক্কেরে তোর আম্মার মতন। হ্যায় কি করতো জানিস? আমারে তেল মালিশ কইরা দিতো, মাঝে মাঝে চুলে মেহেদী লাগায় দিতো। বাতের ব্যথার লাইগগা গরম পানি কইরা দিত। অহন এরা সব বুয়া দিয়া করায়। এরা যদি চাকরিবাকরি করতো তাইলে না একখান কথা আছিল। কিন্তু বাসায় বইসা থাইক্কাও আমারে দ্যাখতে আহে না।

চৈতির শুনতে ভালো লাগছে। ছোট বেলায় দাদির সাথে মায়ের সখ্যতার রূপ দেখেছে সে, মনোমালিন্য তার চোখে পড়েনি। সেসময় চৈতি যদি দাদিকে জ্বালাতন করতো গল্প শোনার জন্য কুহু এসে তখন তাকে রাতে গল্প শোনানোর প্রতিশ্রুতি নিয়ে সরিয়ে আনতো।

জয়নাব বললেন, ‘তোর সবচেয়ে মিল কুনটা (কোনটা) জানিস?’

চৈতি মুচকি হেসে প্রশ্ন করলো, ‘কোনটা?’

– তোর মায়ের চোখ আর তোর চোখ একদম মিইল্লা যায়। তুই যখন হাসছ তখন তোর চোখ দুইটা পানিতে ভইরা যায়। দ্যাখতে তোর মায়ের মতো লাগে।

এখনো চৈতির ঠোঁটের কোণে বিষাদের হাসি আর চোখের কোণে সুখের জল।

____________

চলবে ইন শা আল্লাহ….

[এই গল্পটা আরো এক বছর আগে লিখে রেখেছি। তাই প্রতিদিন দুটো করে পর্ব দিব ইন শা আল্লাহ। দুআয় রাখবেন।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here