‘লোডশেডিং’
পর্ব ১৪.
তাবিনা মাহনূর
________________
বেশ কলরব চলছে অনুষ্ঠানে। মাগরিবের আজান দিয়ে দেয়া সত্ত্বেও গানের আওয়াজ বন্ধ হয়নি। এলইডি টিভিতে ইউটিউবে গান ছেড়ে দিয়ে একটু একটু কোমর দুলিয়ে সকলে আনন্দ করছে, তা মহিলা কিংবা পুরুষ হোক না কেন। স্বাধীন আগেই চলে গিয়েছে যার কারণে রাশেক এতোটাই রেগে গিয়েছে যে স্বাধীনের সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। কারণ রুবিনা গান গায়নি, সেও গান গায়নি। পরিশেষে, কামিনীর অনুরোধ রাখা হয়নি দেখে রাশেক লজ্জিত এবং রাগান্বিত।
চৈতি আছরের নামাজ পড়ার জন্য একবার নিজের ঘরে গিয়েছিল। কিন্তু সেখানে মানুষের ভিড় দেখে নামাজ পড়ার জায়গা পায়নি। শিমুলের ঘরে বয়স্ক মানুষ ছিল বেশি যার কারণে সেখানে নামাজ পড়ার স্থান ছিল। ওখানে নামাজ পড়ে এখন মাগরিবের নামাজ পড়ার জন্য নীচে নামলো সে। যাওয়ার পূর্বে শুনতে পেলো, কেউ একজন গান বন্ধ করার তাগিদ দিচ্ছে।
নামাজ শেষে ঘরে ফিরে কোনো মানুষকে না দেখে স্বস্তি পেলো চৈতি। গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান শেষ। তাই আপাতত লোক সমাগম কমেছে। মেহেদী অনুষ্ঠান কাছের মানুষগুলোকে নিয়ে হবে। ঘরের দরজা বন্ধ করে শাড়ি খুলে কামিজ পরলো সে। এতক্ষণ শাড়ি পরে থাকতে অস্বস্তি হচ্ছিলো। বিশেষ করে সৌরভের উক্তি শুনে আরো বিরক্ত লেগেছে।
সৌরভ তাকে দেখে একবারের জন্যও পলক ফেলেনি। শেষে বলেই ফেলেছে, ‘আমার এখনই বিয়ে করতে ইচ্ছা করছে সুচিত্রা! আয় তো, নিজেরা বিয়ে করে ফেলি! এমন ইউনিক সাজ কোথা থেকে শিখলি?’
চৈতি মুখ নামিয়ে রেখেছিল যখন শিমুলকে তার চোখে পরে। শিমুল আপাদমস্তক ঢেকে নিজের বাসায় বসে ছিল। জয়নাব বেগমের সেবা করার নাম করে অনুষ্ঠানেও যায়নি। চৈতির তখন হুঁশ ফিরে আসে, সেও হিজাব পরা ধরেছে অথচ আজ সম্পূর্ণ চুল খোলা অবস্থায় ঘুরে বেড়াচ্ছে কতগুলো পুরুষের সামনে! তখন তার খুব লজ্জা করছিল, তার উপর সৌরভ তার হাত ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছিলো। সৌরভের কাছ থেকে একটু বিরতি পেলে শাড়ির আঁচল মাথায় তুলে ঘুরে বেরিয়েছে। তাকে এ অবস্থায় সারাফ সাহেব দেখে বলেছিলেন, ‘মা শা আল্লাহ! তোকে একজন সৎ পাত্রের হাতে তুলে দিতে পারলেই শান্তি!’
এরপর থেকে তার মন এক দিক থেকে ভালো যে, সারাফ সাহেব সৌরভের নাম নেননি।
_______
দরজা ধাক্কানোর আওয়াজে চৈতির ঘুম ছুটে গেল। বিছানায় গড়িয়ে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল সে জানে না। দ্রুত উঠে দরজা খুলে দেখলো, মাইমুনা হাসিমুখে দাঁড়িয়ে। তাকে ভেতরে ঢুকিয়ে দরজা ভিড়িয়ে দিলো চৈতি। তারপর আলিঙ্গন করে বললো, ‘আসসালামু আলাইকুম আপু! মা শা আল্লাহ! তোমাকে অনেক চকচক দেখাচ্ছে। নজর না লাগুক।’
মাইমুনা লজ্জিত ভঙ্গিতে হেসে উঠলো, ‘ওয়া আলাইকুমুস সালাম চৈতি। তুমি একটু বেশি বলো। কোথায় সুন্দর হলাম?’
কথা চললো বেশ অনেকক্ষণ। মাইমুনা উশখুশ করছে সৌরভের সম্পর্কে জানার জন্য। কিন্তু চৈতি সেই প্রসঙ্গে কোনো কথাই তুলছে না। মাইমুনা কৌশলে প্রশ্ন করলো, ‘দেখো তো, কোন জামাটা পরলে ভালো লাগবে? দুটো এনেছি, দুটোই লাল কালো রঙের।’
চৈতি তুলনামূলক কম জমকালো পোশাক দেখিয়ে বললো, ‘ভাইয়া জাঁকজমক পোশাক পছন্দ করেন না। এটা পরো আপু!’
থমকে গেল মাইমুনা। চৈতি তখন হেসে বললো, ‘লজ্জা পেও না আপু। তোমার মত একজন সুন্দরী শিক্ষিত মেয়ে সৌরভ ভাইয়াকে পছন্দ করেছে, এটা জানলে আমার চেয়ে বেশি কেউ খুশি হবে না। এর পরেই সবচেয়ে বেশী খুশি হবেন বড় কাকী।’
মাইমুনা ইতস্তত বোধ করে বললো, ‘কিন্তু উনার যদি কোনো পছন্দ থেকে থাকে? চৈতি, আমি জানি না এটা কীভাবে হলো, কিন্তু আমি উনাকে খুব বেশি পছন্দ করে ফেলেছি। ফেসবুকে উনার টোল পরা হাসির ছবি দেখে প্রতিদিন ঘুম হারাম হয়ে যায়। আর উনার প্রতিটা স্ট্যাটাসে উনি ভালোবাসার সংজ্ঞা এতো সুন্দর লিখেন! মুগ্ধ না হয়ে থাকা যায় না!’
চৈতির আফসোস হলো এই ভেবে, মাইমুনা অনেক সহজ সরল মেয়ে। সে বুঝতে পারছে না সে কাকে কেমন ভাবছে। ফেসবুক আর বাস্তব কখনোই সম্পূর্ণ এক হতে পারে না। চৈতি ভাবলো, সৌরভ যে তাকে পছন্দ করে এটা মাইমুনাকে বলবে। কেননা এ সম্পর্কে একদিন না একদিন মাইমুনা জানতে পারবে আর সেদিন সে চৈতিকে ভুল বুঝবে।
– আপু, তোমাকে একটা কথা বলার আছে। আগেই বলছি মন খারাপ করো না।
– কি?
– সৌরভ ভাইয়া একজনকে পছন্দ করেন।
মাইমুনা চুপ হয়ে মাথা নিচু করলো। তারপর বললো, ‘এটা স্বাভাবিক। এমন সুন্দর মানুষের প্রিয় মানুষটাও নিশ্চয়ই বেশ পারফেক্ট হবে। সবাই নিখুঁত হয় না। তার প্রিয় মানুষ নিশ্চয়ই নিখুঁত, তারই মতো।’
চৈতি বললো, ‘তার প্রিয় মানুষ অতি সাধারণ একটা মেয়ে। তুমি যখন জানবে সে কে, তখন খুব অবাক হবে এই ভেবে, এতো সুন্দর ছেলে এত বাজে মেয়েকে পছন্দ করলো কেন!’
বাকিটা বলতে পারল না চৈতি, বা বলতে চাইলো না। নিজেকে সৌন্দর্যের দিক থেকে বাজে বললেও সে জানে সে কেমন মেয়ে। অন্তত সৌরভের নিকৃষ্ট আচরণ তার প্রাপ্য নয়। সে স্বল্পভাষী শান্তি প্রিয় মেয়ে বলে সৌরভ তাকে পিষে মারে।
চৈতি আরো কিছু বলার পূর্বেই সৌরভ এসে হাজির। একটা প্যাকেট হাতে নিয়ে চৈতির দিয়ে তাকিয়ে সৌরভ বললো, ‘নে। তোর জন্য বেছে বেছে এই লেহেঙ্গা কিনে এনেছি। লাল কালো রঙের। তুই নাকি কিছুই কিনিস নি?’
চৈতি স্বাভাবিক স্বরে বললো, ‘কামিজ কিনেছিলাম।’
– সবাই লেহেঙ্গা পরবে তুই কামিজ কেন পরবি? এটা তোর জন্য, তুই পরবি অবশ্যই। আর ভালো কথা, কালকে চুল ছেড়ে না রেখে অন্য সাজ দিস। আজকে রাশেক তোকে দেখে মারডালা বলেছে। আমার কেমন লেগেছে তখন বুঝতে পারছিস? নেহাত বন্ধু বলে কিছু বলিনি। নাহলে এক ঘুষিতে নাক ফাটিয়ে দিতাম।
– ঠিকাছে। অন্য রকম সাজবো।
– আর অন্য কেউ যেন লাল কালো রং না পরে। ওই রঙে আমি শুধু তোকে দেখতে চাই সুচিত্রা!
এরপর চোখ পাকিয়ে ইশারায় বাইরে যেতে বললো সৌরভ। চৈতি বুঝতে পেরেছে, সৌরভ তার কপালে আদরের স্পর্শ দিতে চায়। সে কথা বদলে দিলো, ‘আমার নতুন মেহমান ভাইয়া। আপুর নাম মাইমুনা।’
সৌরভ এতক্ষণে কাউকে দেখতে পেলো যেন। কিন্তু মেয়েটা মুখ নামিয়ে রেখেছে। সে বললো, ‘ভালো থেকো আপু!’
মাইমুনা মাথা দুলিয়ে কি বোঝালো সৌরভ বুঝলো না। অবশ্য বোঝার ইচ্ছে নেই। সে চৈতির দিকে তাকিয়ে চোখ টিপে চলে গেল। চৈতি মাইমুনাকে লক্ষ্য করলো, মেয়েটা চুপ করে বসে আছে। কোনো কথা তুললো না এ বিষয়ে। চৈতি শ্বাস ফেলে বললো, ‘বুঝতে পেরেছো মেয়েটা কে?’
মাইমুনা মুখ শক্ত করে চৈতির দিকে তাকালো, ‘তোমাকে খুব ভালো মেয়ে মনে করতাম। তুমি আসলে একটা দ্বিমুখী!’
চৈতি মাইমুনার কাছাকাছি বসে বললো, ‘আমার কথাগুলো না শোনা পর্যন্ত দয়া করে এগুলো ভেবো না।’
– আমি তোমার কোনো কথা শুনবো না। তুমি আমাকে নিয়ে মজা উড়িয়েছো।
– বিশ্বাস করো…
– চুপ! আমি এখানে থাকবো না। বাবাকে ফোন করে নিয়ে যেতে বলবো এখন।
– আমি ভালোবাসি না সৌরভ ভাইয়াকে।
– তাতে আমি কি করবো? তুমি আমাকে ব্যবহার করেছো চৈতি। এরপরও কথা বলার সাহস কীভাবে পাও তুমি?
– আমার পুরো কথাটা শুনবে দয়া করে? এরপর যা ইচ্ছে বলো।
মাইমুনা চুপ করে বসে থাকলো। চৈতি বলতে শুরু করলো, ‘সৌরভ ভাইয়া আমার প্রতি দুর্বল কেন আমি জানি না। ছোট থেকে একসাথে বড় হলে একটা দুর্বলতা কাজ করে। যেমন আমার ছোট কাকীর দুই ছেলে আমাকে পছন্দ করতো। তেমনি সৌরভ ভাইও পছন্দ করেন। কিন্তু সৌরভ ভাইয়া এটাকে বেশি এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন। অথচ আমার তার প্রতি বিন্দুমাত্র অনুভূতি নেই।’
একটু থেমে চৈতি আবারও বললো, ‘বাড়িতে ছোট মেয়ে বলতে শুধু আমি। আমার সাথে মিশতে মিশতে আমার চেয়ে বড় ভাইগুলো আমার প্রতি দুর্বল হবে এটাই স্বাভাবিক। এজন্য ইসলামে ছেলে মেয়ে বেশি মেলামেশা করা নিষিদ্ধ। যাক সেসব কথা, মূল কথায় আসি। আমি একজনকে ভালোবাসি।’
মাইমুনা চৈতির দিকে তাকালো। চৈতি বললো, ‘সৌরভ ভাইয়ার বন্ধু স্বাধীন। আমি উনাকে ভালোবাসি। আমি শুধু উনাকেই চাই। সৌরভ ভাইয়াকে আমি একদম চাই না। পাড়ার সব মেয়েরা স্বাধীন নাহলে সৌরভ ভাইয়াকে পছন্দ করে। স্বাধীন ভাইয়া কখনোই কোনো মেয়ের প্রতি অনুভূতি প্রকাশ করেননি। আর সৌরভ ভাইয়াকে কেউ প্রেমের প্রস্তাব দিলেই সে আমার কথা বলে দিত। কিন্তু বিশ্বাস করো, আমি সবসময় চেয়েছি এমন কাউকে যে সৌরভ ভাইয়ার চেহারা নয়, সবকিছু দেখে ভালোবাসবে। আর সেটা হলো তুমি!’
মাইমুনা চমকে উঠলো। চৈতি আবারও বলছে, ‘প্রথমে তুমি চেহারার আকর্ষণে মোহিত হয়েছো। কিন্তু এরপর উনার ফেসবুক আইডি ঘেঁটে, উনার সম্পর্কে আমার কাছ থেকে অনেক কিছু জেনে তুমি ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়েছো। তুমি স্বীকার করো আর না করো, তুমি সৌরভ ভাইয়াকে ভালোবাসো।’
– তুমি আমাকে এসব বলে নিজের কাজ হাসিল করতে চাইছো? আমি আমার মনের খবর জানবো না? তুমি জেনে গেলে? আজব যুক্তি!
– এটাই সত্যি। প্রতিটা মেয়ে ভাইয়ার রূপ দেখে ভালোবাসে। তুমি ভাইয়ার সবকিছু ভালোবাসো। এজন্য আমি তোমাকে ভরসা করছি, তুমিই পারবে সৌরভ ভাইয়াকে আমার দিক থেকে ফিরিয়ে নিতে।
– উল্টাপাল্টা কথা বলবে না। আমি এখনই চলে যাবো।
চৈতি অনুনয় করে বললো, ‘আমাকে সাহায্য করো আপু। আমি স্বাধীন ভাইয়াকে ছাড়া অন্য কাউকে ভাবতে পারি না।’
– চৈতি! তুমি আমাকে এতটা সস্তা কীভাবে ভাবতে পারো?
– আমি তোমাকে আপন বোন ভাবি। তুমি ছাড়া কেউ সাহায্য করতে পারবে না। দয়া করে আমার উপকার করো।
– আমি এখনই চলে যাবো।
হঠাৎ চৈতি অদ্ভুত এক কাজ করে বসলো। উচ্চস্বরে কেঁদে উঠে মাইমুনার পা ধরে বসলো, ‘কিছু একটা করো আপু! আমি সৌরভ ভাইয়াকে চাই না। আর পারি না এত কষ্ট সহ্য করতে। আম্মু চলে যাওয়ার পর থেকে কোনো সুখ নেই আমার! দয়া করো তুমি!’
মাইমুনা হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে দ্রুত চৈতিকে ধরে উঠিয়ে বিছানায় বসালো। তার মনের মাঝে ঝড়, সে বুঝতে পারছে ভালোবাসা হারানোর কষ্ট। সত্যি বলতে সে সৌরভকে নিয়ে বেশি ভেবে ফেলেছে। কখনো ভাবতে পারেনি সৌরভের প্রিয়তমা বলে কেউ থাকতে পারে।
চৈতি কাঁদছে। সে আশঙ্কা করছে স্বাধীনকে চিরতরে হারিয়ে ফেলার। মাইমুনা চৈতির মতো কাঁদতে পারছে না, কিন্তু তার মনে অশান্তির ঢেউ। সে চৈতিকে বললো, ‘কান্না বন্ধ করো। আমি কিছু কথা বলবো।’
চৈতি দুই চোখ মুছে কান্না থামানোর চেষ্টা করলো।
– তুমি যদি স্বাধীন ভাইয়াকে না পাও, তাহলে সৌরভ ভাইয়াকে বিয়ে করতে বাধ্য। তাই তো?
– হয় স্বাধীন ভাইয়াকে বিয়ে করবো নয়তো আত্মহত্যা করবো।
– চৈতি! তুমি কি পাগল? আত্মহত্যা মহাপাপ। এরজন্য তুমি জাহান্নামী হবে যদি এই কাজ করো। তুমি নামাজ কালাম পড়া মেয়ে, এসব কথা কীভাবে বলতে পারো?
আবারো কেঁদে উঠলো চৈতি, ‘আমি কি করবো তাহলে? আমি চাই না এমন কারো সাথে থাকতে যাকে আমি মন থেকে মেনে নিতে পারবো না কখনোই! আল্লাহ আমাকে এমন কষ্ট কেন দিলেন!’
মাইমুনা চৈতির কাঁধে হাত রেখে বললো, ‘আমি তোমাকে সাহায্য করবো।’
চৈতি কান্না থামিয়ে তাকালো মাইমুনার দিকে।
– সাহায্য বলতে, তোমাকে স্বাধীন ভাইয়ার সাথে যোগাযোগ করিয়ে দিতে পারি।
– উনি অনেক ধর্ম কর্ম করেন। আমার সাথে বিয়ের আগে যোগাযোগ করবেন না।
– তুমি সরাসরি বলো না কেন যে তুমি সৌরভ ভাইয়াকে বিয়ে করতে চাও না?
– এটা যেদিন বলবো, সেদিনই ধরে বেঁধে বিয়ে দিয়ে দিবে আমাকে।
– হায় আল্লাহ! তোমার পরিবার এমনটাই চায়?
চৈতি চোখ মুছে বললো, ‘আমার দাদি, বাবা আর শিমুল আপু ছাড়া কেউ আমার মতকে প্রাধান্য দেয় না।’
– এটা খুব খারাপ। আচ্ছা শোনো, আমি তোমাকে অন্যভাবে সাহায্য করতে পারি। যেমন, সৌরভ ভাইয়া যেন তোমার প্রতি আকৃষ্ট না হয় এমন কাজ করতে পারি। ধরো, কালকে লাল কালো রঙের জামা আমি পরলাম। এরপর তোমার থেকেও বেশি গুন ও যোগ্যতা আমার আছে, এগুলো উনার সামনে তুলে ধরা প্রয়োজন। কিন্তু একটা শর্ত আছে।
– কি?
– আল্লাহ চাইলে তোমার আর স্বাধীন ভাইয়ার মিল হওয়ার পর আমি কিন্তু সৌরভ ভাইয়ার সাথে কোনো রিলেশনে যাচ্ছি না।
– মানে!
মাইমুনা মুখ নামিয়ে বললো, ‘দেখো চৈতি, আমার একটা আত্মসম্মান আছে। আমি কখনোই চাই না নিজেকে কারো কাছে ছোট করতে। আমি শুধু তোমার সৌরভ ভাইয়াকে একটু দ্বিধায় ফেলতে চাই যে তুমি তার জন্য আদৌ পারফেক্ট কিনা এটা নিয়ে সে ভাববে। সেই সময়ে তুমি তোমার পরিবারকে বোঝাবে, এমন দ্বিধাজড়িত ছেলের সাথে সংসার করে তুমি সুখী হতে পারবে না। আর স্বাধীন ভাই যেহেতু ধার্মিক মানুষ তাই তিনি তোমার মত একটা মেয়ে পেলে খুব ভালো সংসার হবে। কিন্তু, আমি কখনোই এটা বোঝাবো না যে আমি সৌরভ ভাইয়াকে পছন্দ করি।’
– তাহলে এটা সম্ভব কীভাবে হবে?
– দুটো মেয়ের মাঝে তুলনা করা হয় বিয়ের ক্ষেত্রে। সে তোমাকে আমার তুলনায় ছোট করে দেখলে এটাকে ইস্যু করে তুমি পরিবারকে বোঝাতে পারবে। কিন্তু এর মানে এই নয় যে, আমি সৌরভ ভাইয়ার প্রতি আগ্রহী। আমি তোমাকে সাহায্য করছি শুধু। এতে কাজ না হলে আমার কিছু করার নেই। এমনিতেই তুমি আমাকে যথেষ্ট ছোট করেছো, এক প্রকার অপমানিত বোধ করেছি আমি। তবু সাহায্য করছি শুধুমাত্র তোমার কান্না আর ইয়াতিম অবস্থা দেখে।
চৈতি মাথা নিচু করে বললো, ‘আমাকে তুমি ক্ষমা করে দিও আপু। আমি খুব খারাপ কাজ করেছি।’
মাইমুনা কিছুই বললো না। মনে মনে শুধু বললো, ‘তুমি আমার মন নিয়ে খেলেছো চৈতি!’
_______
সকাল থেকে সবাই খুব ব্যস্ত। আজ কামিনীর বিয়ে। মাগরিবের নামাজের পর কমিউনিটি সেন্টারে বিয়ের আয়োজন করা হয়েছে। কিন্তু বাড়িতে সকাল থেকেই বিয়ের তোড়জোড় শুরু হয়ে গিয়েছে। চৈতির হাত ব্যথার কারণে ফজরের নামাজ পড়তে পারেনি সে। রাতে বাড়ির সব মেয়েদের মেহেদী লাগিয়ে দিতে গিয়ে নিজেই লাগাতে পারেনি। তবে সবাইকে মেহেদী দিতে দিতে হাতে কিছু মেহেদী লেপ্টে নিরাকার রূপ ধারন করেছে। এতে চৈতি কষ্ট পায়নি, বরং আগের কথা মনে পড়ে হেসেছে। স্বাধীনের বলা কথাগুলো মনে পড়ে তার ভালো লাগছিল, আবার কষ্ট লাগছিল এই ভেবে, এখন স্বাধীন তার সাথে কোনো কথা বলে না।
আছরের নামাজ শেষে সবাই তৈরি হতে শুরু করলো। চৈতির ঘরভর্তি মেয়ে মানুষ। তারা আয়নার সামনে জড়ো হয়েছে। চৈতির আলমারির সাথে একটি আয়না আছে। আবার ড্রেসিং টেবিলের আয়না আছে। দুটো আয়না থাকায় এ ঘরে মেয়েদের ভিড় বেশি। বাকিরা শিমুলের ঘরে। শিমুল কোনো প্রসাধনী ব্যবহার করে না বলে মেয়েরা বেশ বিরক্ত। বারবার চৈতির ঘর থেকে সাজগোজের জিনিসপত্র আনা নেয়ার প্রয়োজন পড়ছে। শিমুলকে রিয়ানা এই নিয়ে কথা শুনিয়েছে, ‘তুমি বয়স্কদের মতো চাল-চলন শুরু করেছো কেন আপু? তোমার ঘরে কিচ্ছু নেই। কি দিয়ে সাজবো?’
শিমুল রাগ চেপে রাখতে পারেনি। উত্তরে বলেছে, ‘সাজগোজের জিনিস সঙ্গে করে নিয়ে আসলি না কেন? অন্যের উপর ভরসা করা উচিত হয়েছে?’
এরপর মনঃযুদ্ধ চলেছে। রিয়ানা শিমুলের সাথে আর কোনো কথা বলেনি, উল্টো শিল্পী গিয়ে নীরাকে বলেছেন শিমুল কোনো জ-ঙ্গি গোষ্ঠীর সাথে যুক্ত কিনা খেয়াল রাখতে।
বাড়ি থেকে বের হয়ে দলে দলে কমিউনিটি সেন্টারের দিকে রওনা হয়েছে। সৌরভ সবার দিকে খেয়াল রাখছে। কেউ গাড়ি পেলো কিনা, কেউ বাদ পড়লো কিনা। এর মাঝে তার সুচিত্রাকে খুঁজে চলেছে সে বারেবারে। কিন্তু কোথাও মেয়েটাকে না দেখতে পেয়ে মন উদাসী হয়ে পড়ছে। কিছুটা দূরে একটা মেয়েকে দেখলো লাল কালো রঙের স্যালোয়ার কামিজ পরে আছে তার উপর কালো রঙের চাদর জড়িয়ে। মেয়েটাকে চৈতির মতো লাগছে না, তবু সে এগিয়ে গিয়ে বললো, ‘চৈতি নাকি?’
মাইমুনা ঘুরে দাঁড়ালো। সৌরভ একটু চমকে উঠলো। এই মেয়ের সামনে সে আর চৈতি জামা কাপড় নিয়ে আলোচনা করেছে, তবু মেয়েটা এই রঙের জামা কেন পরলো সৌরভ বুঝতে পারলো না। বেশ বিরক্ত হয়ে মাইমুনাকে সে ছ্যাঁচড়া প্রকৃতির মেয়ে ভেবে বসলো। মাইমুনা তাকে সালাম দিলে সে উত্তর দিয়ে বললো, ‘চৈতিকে দেখেছো?’
মাইমুনা দুই পাশে মাথা নাড়িয়ে বোঝালো সে দেখেনি। সৌরভ চিন্তিত মুখে চলে গেল। ঠিক তখনই অফ হোয়াইট রঙের জামা পরে চৈতি দৌড়ে এলো মাইমুনার কাছে। এসেই বললো, ‘তাড়াতাড়ি চলো আপু। এই পোশাকে দেখলে এখনই বদলে ফেলতে বলবে।’
তারা একটা রিকশা ভাড়া করে বিয়ের অনুষ্ঠানে চলে গেল। গাড়িতে গেলে সৌরভ ঠিক দেখে ফেলতো।
বিয়েতে মানুষের ভিড়ে চৈতি একজনকে খুঁজে চলেছে। আজ সকল বোঝাপড়া মিটিয়ে নিবে সে। স্বাধীনকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। ছেলেটা মেয়ে মানুষের মাঝে থাকতে অপছন্দ করে বলে বাহিরে বাহিরে ঘুরছে। শুধুমাত্র সৌরভের বোন বলে এই বিয়েতে এসেছে। তা নাহলে সে আজ কখনোই আসতো না।
বেশ কিছুক্ষণ পর স্বাধীনের দেখা মিললো। অফিসার্স ক্লাবের বিশাল স্থান জুড়ে অনুষ্ঠান। চৈতি খুঁজতে খুঁজতে ক্লাবের পেছনের অংশে গিয়ে দেখে স্বাধীন কারো সাথে ফোনে কথা বলছে। সে ধীরে ধীরে এগিয়ে স্বাধীনের পিছে দাঁড়িয়ে থাকলো। ফোনে কথা বলা শেষে স্বাধীন পেছন ঘুরে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে ফেললো।
সৌরভ এখনো খুঁজে বেড়াচ্ছে চৈতিকে। তার মনে অশান্তি সৃষ্টি হয়েছে। নিজের চোখে একবার সুচিত্রাকে দেখতে না পেলে তার শান্ত হবে না। সে বোনের বিয়ের কথা ভুলেই গিয়েছে মনে হলো। এসময় মাইমুনাকে দেখে সে তার কাছে গিয়ে বললো, ‘আপু, তুমি কি চৈতিকে দেখেছো? আমি কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না ওকে।’
মাইমুনা বোকার মতো একটা কাজ করে ফেললো, ‘চৈতি মনে হয় বাইরে ভাইয়া।’
________
চলবে ইন শা আল্লাহ….