লোডশেডিং’ পর্ব ১৫.

0
305

‘লোডশেডিং’
পর্ব ১৫.

তাবিনা মাহনূর

__________

স্বাধীন কর্কশ সুরে বলে উঠলো, ‘চৈতি, তুমি যথেষ্ট বেহায়া আচরণ করছো। একটা ছেলের পেছনে এভাবে নিরলস ঘুরে বেড়ানো কত বড় ছ্যাঁচড়ামি তা যদি তুমি বুঝতে!’

চৈতি আজ সব মিটিয়ে ফেলতেই এসেছে। তার হায়া বোধ ভুলে গিয়ে সে বললো, ‘আর আপনি যদি বুঝতেন একটা মেয়ের এতো বেহায়া হওয়াটা আসলে কি প্রকাশ করে! একটা মেয়ে তখনই বেহায়া হয় যখন সে একজনকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে এবং অন্য কাউকে কল্পনা করতে পারে না!’

স্বাধীন বেশ বিরক্ত, ‘আমি আর একবারই বলবো, তুমি আমাকে ভুলে যাও।’

চৈতির পাল্টা জবাব, ‘কেন বন্ধুর কথা ভেবে আমাকে ফিরিয়ে দিচ্ছেন?’

অবাক হলো স্বাধীন, ‘তুমি কি পাগল চৈতি? আমি কেন সৌরভের কথা ভেবে তোমাকে ফিরিয়ে দিব? আমি তোমাকে কখনোই ভালোবাসিনি। আমার ভালোবাসা স্যাক্রিফাইস করছি, এমন কথা আসবে কোথা থেকে?’

– আপনি একটু হলেও ভালোবেসেছেন আমাকে। কেননা কখনো খারাপ আচরণ করেননি আপনি। আমি শুনেছি, রুবিনা আপুকে আপনি অপমান করেছেন। তবু সে এখনো আপনার পেছনেই পরে আছে। জানি না সে কেমন ভালোবাসে কিন্তু আমার কথা তো আপনি জানেন!
– সৌরভের পেছনে যদি পাড়ার অর্ধেক মেয়ে ঘুরে থাকে তাহলে বাকি অর্ধেক আমার পেছনেই পরে থাকে। আর এটার অনেক কারণ আছে। আমরা দুজনেই জন্ম থেকে একই এলাকায় আছি। ছোট থেকে সবাই আমাদের ভালো ব্যবহার দেখে আসছে। আর মোটামুটি দুজনেই সুন্দর আলহামদুলিল্লাহ। তাই বলে কি আমরা পাড়ার সব মেয়েকে ভাগাভাগি করে বিয়ে করে ফেলবো? তোমার যুক্তি কি সেটাই বলে?

চৈতি তবু বলে উঠলো, ‘আমার যুক্তি কি বলে সেটা আপনি জানেন।’

স্বাধীনের রাগ নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়ছে। কোনোভাবেই চৈতিকে বোঝাতে পারছে না সে।

– শোনো চৈতি, তোমার থেকেও বেশি পাগল হয়েছিল লিমা নামের একটা মেয়ে। চেনো না ওকে? ঐযে, পরের গলির আমজাদ কাকার ছোট মেয়েটা। ও আমার জন্য কি কি করেছে জানো নিশ্চয়ই? তবু বলছি। লিমা এলাকার সবার সামনে আমাকে প্রপোজ করেছিল, আমি রিজেক্ট করেছি। মেয়েটা একটা মেয়ে মানুষ হয়েও ছেলেদের মতো আমার কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতো। এরপরও যখন কাজে দিলো না তখন ও হাত কেটে আমার নাম লিখলো যেটা আমি সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করি। আর শেষে কি হলো জানো? আমি যখন ওর বাবার কাছে বিচার দিলাম তখন ও আত্মহত্যা করতে চাইলো। শেষ পর্যায়ে আমজাদ কাকা আমার কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠালেন। তবু আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল ছিলাম। কেননা অমন হুটহাট পাগলামি করা মেয়ে আমার জীবনের কালো অধ্যায় বলা চলে। শেষ পর্যন্ত কি হয়েছে এটাও জানো তুমি। লিমা এখন অন্য লোকের বাচ্চার মা।

চৈতির আঁখি ভরে জলের ফোয়ারা। বহু কষ্টে আটকে রেখেছে তা। রুদ্ধ কণ্ঠস্বরে সে বললো, ‘আপনি এতো কথা বলে কি বোঝাতে চাইছেন, সেটা সংক্ষেপে বলুন।’

নাকের ডগা ফুলে লাল হয়ে আছে স্বাধীনের। তার মাথায় আগুনের মতো ক্রোধ। তার ইচ্ছে করছে চৈতিকে কষিয়ে কয়েকটা চড় মারতে। কপালের রগ ফুলে গিয়েছে, দু হাত মুঠো করে রাখা। চোখ বন্ধ করে বড় এক শ্বাস নিয়ে চোখ খুলে চৈতির দিকে সরাসরি তাকালো সে। কন্ঠ নরম করে বললো, ‘আমি এ কথা হাজারবার বলে ফেলেছি হয়তো। আবারো বলছি, আমি তোমাকে ভালোবাসি না। আমার জন্য তোমার জীবন থেমে থাকবে না।’

এ কথা বলতে গিয়ে চট করে সারাফ সাহেবের বলা কথাটা মনে পড়লো স্বাধীনের। ঠিক এমন একটা কথাই বলেছিলেন তিনি, ‘তোমার ভাইকে সবচেয়ে বেশি শুনতে হবে, জীবন তো থেমে থাকে না।’ বাকি কথা মনে করতে চাইলো না স্বাধীন। মনে পড়লে হয়তো চৈতিকে ফেরানো কষ্টকর হয়ে পরবে।

– চৈতি, তোমার যদি সৌরভের সাথে বিয়ে নাও হয়ে থাকে তবু আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাইবো না। কারণটা খুবই সাধারণ। মেয়ে হিসেবে তুমি বেশ ভালো হলেও তোমার একটা বিষয় আমার অপছন্দ। তুমি খুব তাড়াতাড়ি প্রভাবিত হয়ে পড়ো। ধরো একজন বললো, তোমার পর্দা করা উচিত। এরপর তোমাকে পর্দার বিধান সম্পর্কে জানালে তুমি পর্দা করা শুরু করে দিবে। অন্যদিকে কেউ এসে যদি বলে ‘এখন তো মজা করার বয়স, তুমি এসব ছাড়ো। এগুলো বৃদ্ধ বয়সে করবে।’ তখন তোমার সেটাই মনে হবে। তুমি আবারো হিজাব নিকাব ছেড়ে দিবে। প্রভাবিত হওয়ার এই বিষয়টা আমি পছন্দ করি না।

চৈতির গাল বেয়ে বারিধারা নেমে আসছে। সে কণ্ঠে বিস্ময় প্রকাশ করে বললো, ‘তারমানে আপনি কি বলতে চাইছেন? আমি আপনাকে ভালোবাসি আমাকে কেউ প্রভাবিত করেছে বলে?’

স্বাধীন ভ্রু কুঁচকে বললো, ‘ঠিক তেমনটা নয়। সৌরভ কয়েকদিন তোমাকে পাত্তা না দিলেই হয়তো…’

অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে চৈতি! স্বাধীন অকপটে মনের ভাবনার সবকিছু বলে দিচ্ছে। চৈতি একই সুরে বললো, ‘মানে আপনি আমাকে পাত্তা দেন না বলে আমি ভালোবাসি, এরপর পাত্তা দিলে আমি আপনাকে ছেড়ে সৌরভ ভাইয়াকে ভালোবাসতে শুরু করবো?’

– ঠিক সৌরভ নয়। আমি বোঝাতে চাইছি…
– হ্যাঁ, সৌরভ নয়। কিন্তু যে আমাকে পাত্তা দিবে না তাকেই ভালোবাসবো। সেটা সৌরভ ভাইয়াই হতে হবে এমন নয়, তাই তো?

চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে স্বাধীন। সরাসরি বলাটা ঠিক হয়নি। কিন্তু সে নিরুপায়। মেয়েটা তার পিছু কিছুতেই ছাড়ছে না। লিমার চেয়ে এই মেয়ে হাজার গুণ ভালো হলেও তার কিছু করার নেই। সৌরভ তার প্রানপ্রিয় বন্ধু। বন্ধুর প্রিয়তমাকে কেড়ে নেয়ার মতো প্রতারণা সে করতে পারবে না কখনোই। এছাড়া, চৈতি মেয়েটা অর্ধাঙ্গিনী হিসেবে ভালো হলেও এরকম মেয়ে সে অনেক পাবে। চৈতিকে না পেলে তার কিছু আসে যায় না। সুতরাং অযথা বন্ধুর সাথে সম্পর্ক নষ্ট করবে না সে।

স্বাধীনকে চুপ থাকতে দেখে চৈতি হঠাৎ ক্রোধান্বিত হয়ে পড়লো। ছুটে গিয়ে স্বাধীনের কলার ধরে বলতে লাগলো সে, ‘কি বলছেন আপনি জানেন? অনুভূতি বোঝার আগ থেকে আপনার প্রতি দুর্বল আমি। আপনি আমার ভরসা। দয়া করে ভরসা কেড়ে নিবেন না!’

আচমকা হামলে পড়ায় স্বাধীন কিছুটা পিছিয়ে গেল। তারপর দ্রুত সামলে উঠে সে চৈতির দুই হাত ধরে নিজের কলার মুক্ত করলো। ফিসফিসিয়ে বললো, ‘চৈতি! পাগলের মতো করো না। এটা একটা বিয়ে বাড়ি। কেউ এভাবে দেখে ফেললে কেলেঙ্কারি বেঁধে যাবে।’

পাগলপ্রায় চৈতি বলে উঠলো, ‘দেখুক! আমি চাই কেউ দেখুক!’

– কি বলছো তুমি জানো? ভয়াবহ ঝামেলা হয়ে যাবে।
– হোক! আমাদের বিয়ে দিয়ে দিবে। আমি তো আপনার প্রিয় রঙের জামা পরে আছি। বিয়েতেও এই রং পরতে চেয়েছি। ভালোই হলো তাই না?

স্বাধীন চৈতির দুই হাত মুচড়ে চৈতির পিঠের পেছনে নিয়ে গেল। সাথে সাথে চৈতির গাল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়লো। হিস হিস করে রাগান্বিত কণ্ঠে স্বাধীন বলছে, ‘থাপ্পড় দিয়ে দাঁত ফেলে দিব মেয়ে। মেয়ে মানুষের গায়ে হাত দেয়ার স্বভাব নেই বলে কিছু বলছি না। দ্রুত এখান থেকে চলে যাও নাহলে বিপদ হয়ে যাবে। ভুলে যেও না আমি একটা ছেলে। যতই সাধু হই না কেন, আমি একটা ছেলে!’

চৈতি নিষ্পলক তাকিয়ে আছে। স্বাধীনকে এতো কাছ থেকে কখনোই দেখার সুযোগ মেলেনি। স্বাধীন চৈতির দিকে তাকিয়ে খেয়াল করলো, তার বলা এতোগুলো কথার একটাও মনে হয় চৈতির কানে পৌঁছায়নি। বরং কান্না থামিয়ে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মেয়েটা। স্বাধীন তার হিদায়াত ধরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। নিশ্চয়ই এই কাজ শয়তানের, কেননা শয়তান যখন কোনোভাবেই কোনো দ্বীনদার পুরুষকে দ্বীন থেকে সরিয়ে আনতে পারে না তখন নারীর সাহায্য নিয়ে থাকে। এর কারণ, প্রতিটা পুরুষ নারীর কাছে দুর্বল। এ কথা মনে পড়তেই স্বাধীন তাড়াতাড়ি চৈতিকে ছেড়ে দিলো। কিন্তু বড় ধরনের ঘটনা ঘটে গেল তখনই। চৈতি জাপটে জড়িয়ে ধরলো স্বাধীনকে। স্বাধীন দুই হাত উপরে তুললো সারেন্ডার করার ভঙ্গিতে। আর ঠিক সেসময় সৌরভ এসে হাজির হলো।

সৌরভ এসেই চৈতির হাত ধরে ছাড়িয়ে নিলো স্বাধীনের কাছ থেকে। ছাড়িয়ে নিয়েই হন্তদন্ত হয়ে গ্যারেজের দিকে ছুটতে লাগলো সে। বাসায় গিয়ে বোঝাবে, সৌরভ কাকে বলে!

স্বাধীন দীর্ঘশ্বাস ফেললো। আপাতত আর কোনো চাপ নেয়ার শক্তি তার নেই। ভবিষ্যতে কি ঘটবে, সব আল্লাহর উপর ভরসা করেই চিন্তামুক্ত হলো সে। ভালো হলে আলহামদুলিল্লাহ, আর ভালো না হলে আল্লাহর কাছে ধৈর্য শক্তি চাওয়ার দুআ করে সে। নিশ্চয়ই আল্লাহ যা করেন, ভালোর জন্যই করেন। তাছাড়া সে একটা বিষয় সবার কাছে গোপন করেছে। অনার্স পাশ করে সে রাশিয়ায় মাস্টার্স করার সুযোগ পেয়েছে। সেখান থেকে পিএইচডি ডিগ্রি নেয়ারও সম্ভাবনা আছে। মোট মিলিয়ে তার তিন চার বছর চলে যাবে সেখানেই। তার উপর রাশিয়া গিয়ে পড়াশোনা করলে প্রথম দুই এক বছর রাশিয়ান ভাষা শিক্ষার কোর্সে কেটে যায়। বিদেশে চলে গেলে এদেশে ফিরতে বেশ সময় লাগবে। এ বিষয়টা কাউকে বললে হয়তো তাকে আটকে রাখবে এদেশে। কিন্তু সে থাকতে চায় না। এখান থেকে দূরে পালাতে পারলেই শান্তি। বিশেষ করে বাবার স্বপ্ন পূরণ অনেকখানি এগিয়ে যাবে রাশিয়া চলে গেলে।

_________

বাসার গ্যারেজে তালা ঝুলিয়ে রাখা। বাসার দারোয়ান বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়েছে। সৌরভ চাবির দায়িত্বে থাকায় গ্যারেজের দরজা খুলতে সমস্যা হলো না। সারা রাস্তা দুজনে একটা কথাও বলেনি। চৈতি অবশ্য ভুলেই গিয়েছে সে কোথায় যাচ্ছে, কি করছে। সে ঘোরের মাঝে আছে। বারবার স্বাধীনের নির্দ্বিধায় বলা কঠিন কথাগুলো মনে পড়ছে। মানতে পারছে না সে, স্বাধীন তাকে সত্যিই ভালোবাসে না! তাই তাকে নিয়ে সৌরভ বাসায় এসেছে এতে সে কোনো তর্ক করেনি।

সৌরভ গম্ভীর মুখে সারা রাস্তা গাড়ি চালিয়েছে। এখন গ্যারেজের দরজা খুলে গাড়ি ঢুকিয়ে চৈতির হাত ধরে চার তলায় গেল সে। বাসার প্রতিটা ফ্ল্যাটের চাবি তার কাছে। সে আমানতের খেয়াল রাখতে পারে। চৈতিদের বাসার দরজা খুলে এক ধাক্কায় চৈতিকে ঢোকালো সে। তারপর দরজা বন্ধ করে চৈতির ঘরে গেল সৌরভ। এতক্ষণে চৈতির হুঁশ ফিরে এলো। সে মৃদু আর্তনাদ করে বলে উঠলো, ‘কি করছেন ভাইয়া? ফাঁকা বাসায় নিয়ে এলেন কেন?’

সৌরভ কোনো কথা বলছে না। সে ধাক্কা মেরে চৈতিকে ঘরে ঢুকিয়ে বিছানার দিকে আঙ্গুল তুলে বললো, ‘দুই মিনিট সময় দিব তোকে। এক্ষুনি এই লেহেঙ্গা পরে বের হবি। ওটা না পরা পর্যন্ত তোকে নিয়ে বিয়ের অনুষ্ঠানে যাবো না। ওটা পরবি, তারপরই যাবো। নাহলে পুরো সময় এভাবেই কাটবে। দুই মিনিটের এক ন্যানো সেকেন্ড সময় খরচ করবি না! জলদি!’

শেষের কথাটি বেশ ধমক দিয়ে বললো সৌরভ। চৈতি খেয়াল করলো, বিছানায় সৌরভের দেয়া লেহেঙ্গাটা পরে আছে। তৈরি হওয়ার সময় মাইমুনাকে একবার পরতে বলেছিল কিন্তু মাইমুনা রাজি হয়নি। এরপর চৈতি সেটা আলমারিতে রাখার সময় পায়নি।

সৌরভ বেশ শব্দ করে দরজা বাহির থেকে আটকে দিলো। চৈতি এখন শান্ত, ক্লান্ত। তার তর্ক করার মতো শক্তি নেই। সৌরভ যা বলবে এখন তাকে তাই মেনে চলতে হবে। জামা খুলে লেহেঙ্গা পরার মতো ক্ষমতাটাও শরীরে নেই। মনের জোর না থাকলে শরীরে কীভাবে জোর আসবে? সে মেঝেতে বসে হিজাব পিনগুলো খুলতে খুলতে কেঁদে ফেললো। তার আঙুলে একটা পিন ঢুকে গেল, তবু তার যেন কোনো কষ্ট অনুভূত হলো না। মনের কষ্টের চেয়ে বড় কষ্ট আর কি হতে পারে? নিঃশব্দে কাঁদতে কাঁদতে হিজাব খুললো সে। খোঁপা খোলার সঙ্গে সঙ্গে এলোমেলো চুল ছড়িয়ে পড়লো পিঠ জুড়ে।

বিছানা থেকে আনমনে লেহেঙ্গার উপরের অংশ নিলো চৈতি। গায়ে থাকা কামিজ খুলতে গিয়ে শব্দ করে কেঁদে উঠলো সে। তার জীবনের শান্তি আজ সম্পূর্ণ খুইয়ে গিয়েছে। শান্তি নামক সুখপাখি তার আঙিনায় কখনো গান গাইবে না। আগে দুই একবার উড়ে এসেছে, কিন্তু গান গায়নি। এবার আর উড়েও আসবে না। সারাজীবনের জন্য শান্তি হারিয়ে গিয়েছে। তার মনচোরা তাকে আজ চিরতরে সরিয়ে দিয়েছে। স্বাধীন নামের যেই মুক্তপাখিটা সে মনের আকাশে ছেড়ে দিয়ে রেখেছিল, আজ সেটা খাঁচায় বন্দি করে রাখলো। খাঁচার মাঝে সে পাখিটার যত্ন নিবে। ওড়ার মতো ক্ষমতা আর নেই।

হঠাৎ খুট খুট আওয়াজে পেছনে তাকালো চৈতি। আশ্চর্য হয়ে দেখলো সে, সৌরভ ঘরে ঢুকছে। কান্না আর বেদনার মিশ্রণে বাস্তব জীবনের কথা ভুলে গিয়েছিল চৈতি। তাই সৌরভ বাহির থেকে আটকে দিলেও সে ভেতর থেকে দরজা আটকে দেয়নি। সৌরভকে আসতে দেখে লেহেঙ্গার উপরের অংশ দ্রুত পরে নিলো সে। সেটা অনেক ছোট হওয়ায় তার মেদহীন কোমর দৃশ্যমান হয়েছে। তড়িঘড়ি করে ঘাগড়ার অংশটি গায়ে জড়িয়ে সে বললো, ‘ভেতরে এসেছেন কেন? বাইরে যান!’

সৌরভ হয়তো শুনতে পায়নি। উল্টো দরজা আটকে দিলো সে। চৈতির মনে যেই আশংকাটা আসছে সেটা ভাবতে তার মোটেও ভালো লাগছে না। যতবার ভাবছে, ততবার দূরে সরিয়ে দিচ্ছে ভাবনাটা। সে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে আবারো বললো, ‘ভাইয়া, আপনি এখন হুঁশে নেই। হুঁশ ফিরলে নিজেই কষ্ট পাবেন।’

সৌরভের শীতল কন্ঠ, ‘তুই স্বাধীনকে বিয়ে করবি?’

সম্মান বড়ই বিস্ময়কর সম্পদ! মানুষ পৃথিবীতে যত ধরনের সম্পদ গড়ে তুলে তার প্রতিটা এই সম্পদকে ঘিরে গড়ে ওঠে। আর তাই, এই সম্পদকে রক্ষা করতে প্রয়োজনে মিথ্যা বলতে দ্বিধা হয় না। ঠিক তেমনি চৈতি উত্তরে বলে উঠলো, ‘নাহ! আমি কাউকে বিয়ে করবো না ভাইয়া।’

কিন্তু সৌরভ আজ বেপরোয়া। তার কণ্ঠে ক্রোধ নাকি মাদকতা, কিছু বোঝার উপায় নেই। বরং আজ সে ঠান্ডা কণ্ঠে কথা বলছে যা চৈতি আজ পর্যন্ত শুনেনি।

– কাউকেই বিয়ে করবি না?

চাপা চিৎকার করে উঠলো চৈতি, ‘করবো, শুধু আপনাকেই করবো! এখন পাগলামি করবেন না।’

– আমাকে করবি এখন বলছিস। পরে যদি মত পাল্টে ফেলিস?
– আল্লাহর কসম! আপনি আজ কোনো অন্যায় না করলে আমি আপনাকেই বিয়ে করবো।
– কোনো কথা বিশ্বাস করি না আমি। তোকে দুই মিনিটের মধ্যে তৈরি হতে বলেছিলাম।

এ পর্যায়ে সৌরভ চৈতির দুই গাল চেপে ধরে বললো, ‘আর তুই তোর নাগরের জন্য কেঁদে বুক ভাসাচ্ছিস? কেন রে? আমার আদর কম হয়ে গিয়েছিল? নাকি স্বাধীনের কথাই ঠিক? আমি বেশি পাত্তা দিয়ে ফেলেছি!’

সৌরভ সব কথা শুনেছে। চৈতি দুই হাত দিয়ে সৌরভের হাত ছাড়ানোর বহু চেষ্টা করলো। কিন্তু বলিষ্ঠ হাত ততক্ষণে চৈতির কোমল ত্বককে বন্ধনে আবদ্ধ করে ফেলেছে। চৈতির জীবন যায় যায়!

– বিয়ে করবি না আমাকে? ব্যবস্থা করছি আমি। দেখবো তোকে কে বিয়ে করে!

_______

শীতের শুষ্কতা সুখ জলকে স্বাগতম জানায় না। বরং মেঘের আনাগোনা থাকলে যেন বিরক্তি মাখা আহবান জানিয়ে শিশির বিন্দু হয়ে ঝরে পড়ে। ধীর গতিতে শিশির স্পর্শ করে ভূতল। বিছিয়ে দেয় কুয়াশার চাদর। বৃষ্টির মতো আনন্দ ধ্বনি তুলে আলোড়ন সৃষ্টি করে না শিশির কণা। আলতো স্পর্শে তা ঝরে পড়ে, কোনো আন্দোলন সৃষ্টি ছাড়াই। তাই জাগতিক হাহাকার কিংবা হৃদয় ভাঙা তোলপাড় করা মলিন সুর ঝংকার দিয়ে বেজে উঠে কর্ণকুহরে প্রবেশ করে।

তবু আজ ললনা নিরুপায়। তার বাঁধ ভাঙা চিৎকার কুয়াশার চাদর দ্বারা ঢেকে দিয়েছে রাত্রির তিমিরাচ্ছন্ন প্রকৃতি। আজই বাড়ির সব মানুষকে অনুষ্ঠানে যেতে হলো? না না, সাত তলায় রেবেকা ভাবি অন্তঃসত্ত্বা। তিনি আর তার স্বামী নিশ্চয়ই অনুষ্ঠানে যাননি। মাঝে মাঝে তারা রাত্রিবিলাস করতে ছাদে সময় কাটান। আচ্ছা, ছাদে কি আর্তনাদের বুকফাটা চিৎকার পৌঁছায় না? নাকি তা চার দেয়ালে বদ্ধ হয়ে জমা থাকে প্রতিটি সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম ফাঁকে?

আজ সবাই যেন সুস্থ! অসুস্থ দাদি আজ পায়ে হেটে সিঁড়ি বেয়ে নেমেছেন। তিনিও নেই আজ! আজই তার বাতের ব্যথা সেরে গেল? সামনের বাসার মর্জিনা আপা দিন রাত বাসায় থাকেন। আজকেই তার মায়ের বাড়িতে বেড়াতে যেতে হলো? অন্যদিন গেলে খুব ক্ষতি হতো কি? অতিপ্রাকৃত বলে একটা জীব বসবাস করে ধরণীর বুকে। তাদের মাঝে কি কোনো ভালো দল নেই? অলৌকিক শক্তি দ্বারা তারা ললনাকে সাহায্য করতে পারে না? নাকি তারাও হাসছে বিনোদনের নিকৃষ্ট দৃশ্য দেখে?

প্রশ্নের উত্তর খুঁজে লাভ আছে কি? পারবে কেউ সম্মান নামক সম্পদ ফিরিয়ে দিতে?

________

চলবে ইন শা আল্লাহ….

[দিয়েই দিলাম। মন্তব্য না করলে কিন্তু খুব কষ্ট পাবো।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here