‘লোডশেডিং’
পর্ব ১৬.
তাবিনা মাহনূর
___________
দিলারা বেগম বেশ চিন্তিত মুখে তাদের বাসার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। দরজায় তালা ঝুলছে, চাবি সৌরভের কাছে থাকায় খুলতে পারছেন না। কামিনীকে বিদায় দেয়ার সময় সৌরভকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। ভাইকে না দেখে কামিনী উচ্চস্বরে কেঁদে শ্বশুরবাড়ি না যাওয়ার জন্য অন্যায় আবদার করতে শুরু করলে সৌরভকে অসংখ্যবার ফোন করা হয়েছে। কিন্তু ফোনটা বেজে বেজে কেটে গেছে। কামিনী ভাঙা মন নিয়েই বরের গাড়িতে উঠে চলে গিয়েছে তার আপনালয়ে। সেসময় সারাফ সাহেব আর শিমুল চৈতিকে চারিদিকে খুঁজেও যখন পেলো না তখন তারা সবাই সন্দেহ করলো, চৈতি আর সৌরভ হয়তো ঘুরতে বেরিয়েছে।
এ নিয়ে দিলারা বেগম বিয়ের অনুষ্ঠানেই ঝগড়া শুরু করে দিয়েছিলেন। তার বক্তব্য, চৈতি তার ছেলের মাথা খেয়ে পরিবার বিমুখ করে তুলছে। বাজে মন মানসিকতা নিয়েই বাসায় ফিরে আরো বিরক্ত হলেন তালা ঝুলানো দেখে।
– কি ব্যাপার? সৌরভকে ফোন দাও না কেন?
স্বামীর উপর তেঁতে উঠলেন দিলারা। সজীব সাহেব দ্রুত ফোন করলেন ছেলেকে। এখনো ছেলেটা ফোন ধরছে না। দিলারা বেগম মুখ কুঁচকে বললেন, ‘কোন এক বস্তির মেয়ে পেয়েছে যে বোনের বিয়ের কথা ভুলেই গিয়েছে। বেয়াদব ছেলে একটা! খাইসটা কথাকার।’
তখনই জেবিন তিন তলা বেয়ে উপরের দিকে উঠছিলেন। তাকে দেখে সজীব বললেন, ‘জেবিন, সারাফ কোথায়?’
– ভাইজান, উনি তো নীচে। উনার মেয়ে আসছে কিনা দেখছেন।
– ওকে বলো, উপরে আসতে।
ততক্ষণে উপরে চলে এসেছেন সারাফ সাহেব। ভাইয়ের কথা শুনে তিনি বললেন, ‘কি হয়েছে বড় ভাই?’
– কি হয়নি? আমার ছেলে কই?
– সেই প্রশ্ন আমিও করতে পারি। আমার মেয়ে কই?
– বেয়াদবি করবি না। ওরা দুজনে একসাথে বাহিরে গিয়েছে। সব চাবি সৌরভের কাছে। ঘরে ঢুকবো কি করে?
জেবিন বলে উঠলেন, ‘আমার কাছে বাসার বাড়তি চাবিটা আছে। আপনারা চাইলে আমার বাসায় আসতে পারেন। ছেলে মেয়েরা যতক্ষণ না আসে, ততক্ষণ ওখানেই থাকেন।’
দিলারা সজীব সাহেবকে বললেন, ‘আমাদের বাড়তি চাবিটা কই গো?’
– ওটা তো শিল্পীর ব্যাগে রেখেছিলাম। ও এখনো আসেনি।
জেবিন আবারো বললেন, ‘উনারা না আসা পর্যন্ত আপনারা আমার বাসায় থাকেন।’
দিলারা মুখ বেঁকিয়ে অসম্মতি জানালেন। সজীব সাহেব ইশারায় মান ভাঙানোর চেষ্টা করে বোঝালেন আপাতত ঝামেলা না বাড়াতে। বিয়ের কাজকর্ম করতে গিয়ে শরীর ব্যথা হয়ে আছে। বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব না। মুখখানি খারাপ রেখেই চার তলার উদ্দেশ্যে গেলেন দিলারা।
জেবিন উঠে গিয়ে দরজার সামনে দাঁড়ালেন। তার পিছে সারাফ সাহেব, দিলারা বেগম, সজীব সাহেব, সাদিয়া, সাদিক আর আরো কিছু লোকজন দাঁড়িয়ে। জেবিন মনে মনে একটু বিরক্ত বোধ করলেন এতোগুলো মানুষকে বসতে দেয়ার কথা ভেবে। ভেবেছিলেন এসেই আরাম করবেন। তা আর হলো না।
কিন্তু দরজার তালা খোলা দেখে ঘাবড়ে গেলেন জেবিন। দ্রুত পেছন ফিরে বললেন, ‘শুনছেন? তালা খোলা। চোর ডাকাত ঢুকলো না তো? আমার ভয় করছে।’
সারাফ সাহেব দ্রুত দরজা খুলতে গেলে বুঝলেন, দরজাটা ভেতর থেকে লাগানো। ইতিমধ্যে শিমুল উপরে চলে এসেছে, ‘কি হয়েছে ছোট কাকা? আমাদের বাসার চাবি আমার কাছে ছিল। আপনারা সবাই আমাদের বাসায় আসতে পারেন।’
– মা রে, দরজার তালা খোলা কেন? তুই খুলেছিস?
– আমি কীভাবে খুলবো কাকা? আমার কাছে শুধু আমাদের বাসার চাবি।
জেবিন আনমনে কলিং বেল চাপলেন দুই তিনবার। শিমুল ফোন বের করে ডায়ালে ৯৯৯ লিখে রাখলো। অসঙ্গতিপূর্ণ কিছু দেখলেই কল করবে সেখানে। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে সৌরভ দরজা খুললো।
সবাই অবাক চোখে দেখছে, সৌরভ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে। পরনে এখনো অনুষ্ঠানের জামা কাপড়, তবে অনেকটা কুঁচকে আছে। সে কারো দিকে একবারও না তাকিয়ে সরে দাঁড়ালো সবাইকে ঢুকতে দেয়ার জন্য।
সবাই ধীরে ধীরে ভেতরে ঢুকলো। তবে সজীব ঢুকেই সৌরভকে কষে চড় মারলেন, ‘বেয়াদব! তুই বোনের বিয়ে রেখে এখানে কি করছিস?’
দিলারা ভয়ংকর কিছু আঁচ করতে পারছেন। তিনি ছেলেকে নিরাপদ রাখতে দ্রুত ছেলের পাশে গিয়ে এক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘কামিনীর আব্বু, তুমি আমার ছেলেকে বকা দিও না। ও এমন ছেলে না যে বোনের বিয়ে রেখে ফুর্তি করবে। নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে।’
হঠাৎ চিৎকার ভেসে এলো। শিমুল চিৎকার করে বলছে, ‘চৈতি! চৈতি রে!’ চিৎকার করতে করতে কেঁদে উঠলো শিমুল।
গায়ে একটা কম্বল জড়িয়ে শুয়ে আছে চৈতি। অনুভূতি শূন্য দৃষ্টি, নিস্তেজ নির্বিকার ভাবভঙ্গি। কে এসেছে, কে ডাকছে কোনো খেয়াল নেই। জেবিন দ্রুত চৈতির ঘরের দরজার কাছে এসে থমকে গেলেন। মেয়েটাকে দেখে হঠাৎ মায়া জন্মে উঠলো তার। এমন অনুভূতির শিকার তিনি কখনো হননি। হয়তো তিনি একজন মা বলেই এ বিষয়ে কলুষিত মনটা প্রকাশ করতে পারছেন না।
শিমুলের কান্না দেখে সারাফ মেয়ের ঘরের কাছাকাছি গিয়ে আবার ফিরে এলেন থমথমে মুখে। মনে করতে লাগলেন, এ দৃশ্য দেখার আগে তার মৃত্যু হলো না কেন!
মাইমুনাও ততক্ষণে চলে এসেছে। এসেই বাড়ির পরিবেশ এমন দেখে কিছুই বুঝতে পারছিল না সে। শিমুলকে কাঁদতে দেখে সেদিকে গিয়ে পুতুলের ন্যায় নির্জীব এক কন্যাকে বিছানায় পরে থাকতে দেখে সে বুঝতে পারলো, ঘটনা কি ঘটেছে।
সবার চোখ এখন সৌরভের দিকে। দিলারা বেগম খুব করে চাইছেন ছেলে বলুক, এ ঘটনা দুজনের সম্মতিতে হয়েছে। কিন্তু সৌরভ ডুকরে কেঁদে উঠলো। দুই হাত দিয়ে মুখ ঢেকে মেঝেতে বসে পড়ে সে বললো, ‘আমি জানি না এসব কীভাবে হলো! আমি জানি না!’
সজীব সাহেব এক লাথি মেরে ছেলেকে মেঝেতে শুইয়ে দিলেন। দিলারা দ্রুত ছেলেকে জড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘বাবা তুই বল, এটা ওই বাজারী মেয়ে করেছে তাই না? তোর কোনো দোষ নেই না?’
সৌরভ সব স্বীকার করছে, ‘আমার দোষ! আমার দোষ! কিন্তু আমি জানি না আমি কীভাবে এসব করলাম। আমি আমার চৈতিকে কখনো কষ্ট দিতে চাইনি মা! ওকে আমি ভালোবাসি!’
সারাফ সাহেব মেঝেতে বসে আছেন চুপচাপ। তিনি কিছুই বলতে পারছেন না, বলার ভাষা হারিয়েছেন তিনি। দিলারা একাই বলছেন, ‘আমি জানি আমার ছেলে এগুলো করেনি। ওই মেয়ে এসব করতে বাধ্য করেছে! আমার ছেলের মাথা ও খেয়েছে।’
আজ যেন অবাক করার দিন। সব ঘটনার শুরু হচ্ছে বিস্ময় দিয়ে, সমাপ্তি ঘটছে বিস্ময় দিয়ে। তেমনি ভাবে জেবিন বলে উঠলেন, ‘চৈতিকে আমি পছন্দ করি না। কিন্তু ওর চরিত্রের দোষ আমি দিতে পারবো না। চৈতি অন্তত এই কাজ করতে চাইবে না।’
শিমুল উঠে দাঁড়িয়ে বললো, ‘অসম্ভব! চৈতি কখনোই নিজের সম্মান বিসর্জন দিবে না। আমি ওকে চিনি। সৌরভই ওকে জোর করেছে। সব স্বীকার করে নে সৌরভ!’
দিলারা ক্রোধ মিশ্রিত কণ্ঠে বললেন, ‘একদম বাজে কথা বলবে না আমার ছেলেকে। আমি জানি ও কিছু করেনি। ওকে বাধ্য করা হয়েছে।’
শিমুলের রাগও কম নয়, ‘বড় কাকী, আপনি যেটা জানেন না সেটা নিয়ে কথা বলবেন না। আমি জানি চৈতি সৌরভকে ভালোবাসে না। যেখানে ভালোবাসা নেই সেখানে কীভাবে! ছি সৌরভ, ছি!’
সৌরভ এবার শিমুলের দিকে রক্তচক্ষু নিয়ে তাকালো, ‘তারমানে তুমিও সব জানতে আপু? ও স্বাধীনকে পছন্দ করে এটা তুমিও জানতে?’
সবাই একবার সৌরভের দিকে তাকাচ্ছে, আরেকবার শিমুলের দিকে। শিমুল তেজ মাখা স্বরে বললো, ‘হ্যাঁ। আমি সব জানি। স্বাধীনকে চৈতি পছন্দ করে কিন্তু স্বাধীন একজন ধার্মিক ছেলে বলে ওকে প্রশ্রয় দেয়নি। এখন তো দেখছি তুইও এটা জানিস। তারপরও জঘন্য কাজ করতে তোর একটুও খারাপ লাগলো না? পিশাচ হয়ে গিয়েছিলি নাকি?’
– তুমি চৈতিকে উসকে দিয়েছো স্বাধীনের পিছে পরে থাকার জন্য?
– আমি? আমি কেন ওকে উসকে দিব?
– তা নাহলে ও স্বাধীনকে সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দিতে লজ্জা পায় না কেন? আর আমি ছুঁলেই ওর সম্মানহানি হয়ে যায়! কেন?
সজোরে এক থাপ্পড় মারলেন সজীব। সৌরভ পাগলের মতো বলছে, ‘আমার সাথে চৈতির বিয়ে দিয়ে দাও তোমরা। আমি আর কিছু চাই না। তোমরা বললে আমি ওর পায়ের কাছে পরে থাকবো। তবু আমাকে আমার চৈতি দাও!’
সজীব চোখ রাঙিয়ে আঙ্গুল তুলে বললেন, ‘চুপ! একদম চুপ। আমার ঘেন্না হচ্ছে যে তুই আমার ছেলে! চৈতির জায়গায় যদি তোর বোন কামিনী থাকতো তাহলে কেমন লাগতো তোর?’
এই পর্যায়ে দিলারা ধমক দিয়ে উঠলেন। আজীবন স্বামীকে নিজের শাসনে রেখেছেন তিনি। এবারও তাই তার গলা উঁচিয়ে তিনি বললেন, ‘কামিনীর আব্বু! তুমি চুপ করো। ওই মেয়ের কুকীর্তি শুনোনি? আমার কামিনী ওর মতো? শুধু ছেলের দোষ দেখছো কেন?’
কিন্তু সজীব সাহেব আজ কোনো কথাই শুনছেন না, ‘তুমি চুপ করে থাকো দিলারা। নাহলে তোমার গায়ে হাত তুলতেও দ্বিধা করবো না আমি।’
দিলারা এ কথার পৃষ্ঠে কিছু বলার ভাষা পেলেন না। সজীব সাহেব কখনোই এমন কথা বলেন না, যা আজ তিনি বলেছেন।
হঠাৎ মাইমুনা জোরে জোরে ডেকে উঠলো শিমুলকে, ‘শিমুল আপু! ও আপু! চৈতির ব্লিডিং হচ্ছে। ওকে হসপিটালে নাও, নাহলে ও মারা যাবে!’
জেবিন দ্রুত ঘরে ঢুকে কম্বল সরিয়ে দেখলেন চৈতির গায়ে জামা আছে কিনা। এলোমেলো করে লেহেঙ্গার ব্লাউজ অংশ পরিয়ে রাখা আর নীচে শুধু ঘাগড়া। হয়তো সৌরভ জোর করে পরিয়েছে। জেবিন লেহেঙ্গার ওড়না দিয়ে চৈতিকে ঢেকে দিলেন ভালো করে। শিমুল আর মাইমুনা মিলে চৈতিকে ধরে বিছানায় বসালো। চৈতির রক্তপাতের কথা শুনে সৌরভ দ্রুত সেই ঘরের দিকে যেতে গেলে আনাস সৌরভের কলার চেপে ধরে বললো, ‘পশু একটা! তুই কি করেছিস দেখ! চৈতির সর্বনাশ করে দরদ দেখাচ্ছিস?’
সৌরভ এক ধাক্কায় আনাসকে সরিয়ে ঘরে ঢুকে চৈতিকে কোলে নেয়ার চেষ্টা করলো। কিন্তু ততক্ষণে আসাদ ওকে কোলে নিয়ে সরে দাঁড়িয়েছে। আসাদ আর আনাস চিৎকার চেঁচামেচি শুনে আগেই উপরে উঠে এসেছিল। আসাদকে কোলে নিতে দেখে সৌরভ আরো পাগলামি শুরু করেছে। আনাস সৌরভের সাথে মারামারি বাধিয়ে দিয়েছে। অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে দেখে নীরা এবং তার স্বামী সাজিদ এলেন ছেলেকে থামাতে। ওদিকে সজীব এলেন সৌরভকে থামাতে। সৌরভ কেমন যেন পাগলের মতো করছে। মাথার চুল ছিঁড়ছে, বুকে হাত দিয়ে বাড়ি দিচ্ছে বারবার। এক পর্যায়ে সে জ্ঞান হারিয়ে ফেললো।
চৈতিকে নিয়ে নীচে নামতেই সবাই দেখলো বহু লোকজন জড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে নীচে। খবর পাচার হয়ে গিয়েছে এতক্ষণে। দুঃখের খবর আলোর গতিতে ছড়িয়ে পড়ে। এখন এসব ভাবার সময় নেই কারো। চৈতির জীবন বাঁচানো সর্ব প্রথম কাজ।
________
কেবিনে শিমুল আর জেবিন বসে আছেন। বাহিরে আসাদ ডাক্তারের সাথে কথা বলছে। আনাসের রক্ত বি পজেটিভ হওয়ার কারণে চৈতিকে রক্ত দিতে পেরেছে সে। তার শরীরের যত্ন নেয়ার জন্য তাকে বাসায় পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। হাসপাতালের যাবতীয় সব কাজ করছে আসাদ। তবে তার একজন সাহায্যকারী খুব প্রয়োজন। সারাফ সাহেব নিস্তব্ধ চিত্তে কেবিনের বাহিরের চেয়ারে সেই যে বসে আছেন, আর উঠেননি। তাকে দেখে মনে হচ্ছে তিনি কিছুই বুঝতে পারছেন না। তার মেয়ের সাথে কি হচ্ছে, মেয়েটা কি পরপারে চলে যাচ্ছে কিনা, সেই খেয়াল তার নেই। আসাদ তাকে সাথে নিয়ে এসেছিল কাজের জন্য, কিন্তু তার নিস্তেজ অবস্থা দেখে আসাদ বুঝতে পারছে না কি করবে। সে শিমুলের কাছে গেল।
– আপু, ছোট কাকা তো কোনো কথাই বলছেন না। ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ওষুধ নিয়ে আসতে পারবো আমি। কিন্তু টাকা পয়সার ব্যাপার আমি কীভাবে দেখবো?
শিমুল চিন্তিত। এক দিকে চৈতির পরিস্থিতি তাকে ব্যথিত করেছে, অন্যদিকে চৈতির পাশে কেউ নেই দেখে তার মনে কষ্টের বন্যা বইছে। সে প্রশ্ন করলো, ‘কেন? আব্বু আসেনি? অন্যদের আসার কথা আমি আশা করি না। আব্বুকে আসতে বল।’
– আপু, তুমি তো জানো বড় কাকার কাছে আমরা কত ঋণী। তাই আম্মু আব্বুকে আসতে দেননি।
– তুই কি বলতে চাইছিস? আম্মু আর আব্বু ওই পিশাচের পক্ষ নিবে শুধু কিছু টাকার জন্য?
আসাদ মাথা নিচু করে ফেললো। সাজিদ সাহেব চাকরি ছেড়ে একটা ব্যবসা শুরু করেছিলেন। সেখানে নিজের কিছু টাকার পাশাপাশি চল্লিশ লাখ টাকা ধার নিয়েছিলেন সজীব সাহেবের কাছ থেকে। এরপর ব্যবসায় লাল বাতি দেখা দিলে সজীব সাহেবের টাকা ফেরত দেয়ার মতো ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন তিনি। বাড়ি ভাড়া আর গ্রামে থাকা জমি থেকে আয় হওয়া টাকায় সংসার চলে। ব্যবসায় অল্প স্বল্প লাভ আসে এখন। সজীব সাহেব বলেছেন, সেটা ধীরে ধীরে ফেরত দিলেই হবে। মাত্র দশ লাখ দেয়া হয়েছে। বাকিটা না দেয়া পর্যন্ত তারা সজীব সাহেবের অলিখিত দাস।
জেবিন দুই ভাইবোনের কথোপকথনে বুঝলেন, তার স্বামীর পাশে দাঁড়ানোর কেউ নেই। তিনি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘দাঁড়াও বাবা। আমি দেখছি।’
বাইরে গিয়ে প্রিয় মানুষের মুখের দিকে তাকিয়ে তার মন ভার হয়ে গেল। তিনি সারাফ সাহেবের পাশে বসে বললেন, ‘মেয়ের বিপদে এভাবে নীরবতা পালন করলে কি বিপদ কমবে? উল্টো মেয়েরই ক্ষতি হবে।’
সারাফ সাহেব চুপ করে থাকলেন। জেবিন ছলছল চোখে বললেন, ‘অন্তত আপনার কুহুর কথা ভাবুন। তার মেয়ের বিপদে আপনি চুপ করে বসে আছেন। পরকালে তাকে কি জবাব দিবেন?’
সারাফ সাহেব স্ত্রীর দিকে তাকালেন, ‘আমি একজন ব্যর্থ বাবা, তাই না জেবিন?’
জেবিন জড়িয়ে ধরলেন তাকে। সারাফ হতাশাগ্রস্ত ব্যর্থ বাবার মতো আর্তনাদ করে বলছেন, ‘আমি বাবা হওয়ার যোগ্য না! আমি যোগ্য না! আমার মেয়েটা আজীবন কষ্ট পেয়ে গেল। আমি কিছুই করতে পারলাম না।’
আসাদ এসে ছোট কাকার কাঁধে হাত রেখে সান্ত্বনা দিলো, ‘কাকা, আপনি ভেঙে পড়লে চৈতি কখনোই এই দিন ভুলতে পারবে না। আপনি দয়া করে শান্ত হন। আপাতত চৈতির জন্য একটু শান্ত হন। ওর সেবা যত্নের প্রয়োজন।’
সারাফ অশ্রু ভেজা চোখে বললেন, ‘কি করতে বলছো আমাকে?’
– আমার সাথে থাকুন কাকা। ওকে এখানে দুই দিন থাকতে বলা হয়েছে। ডাক্তারদের বলেছি আমাকে একটু সময় দিতে আমি টাকা ম্যানেজ করছি। আর এখন রাত সাড়ে বারোটা বাজে। তাই কোনো সাংবাদিকের ভিড় নেই। বেশি ভেঙে পড়লে চৈতির এই খবর চারিপাশে ছড়িয়ে পড়বে। আপনি শান্ত হন কাকা।
– আমার ওই বাসায় যেতে ইচ্ছে করছে না। তুমি গিয়ে টাকা পয়সা নিয়ে এসো। জেবিনের কাছে আলমারির চাবি আছে।
– আমি গেলে এদিকটা কে দেখবে? আপনি পারবেন সামলাতে?
সারাফ উদ্ভ্রান্তের মতো বললেন, ‘না। আমার মনের জোর নেই। আমি এখান থেকে উঠতে পারবো না।’
– মনের জোর বাড়ান কাকা।
– আনাসকে ডাকো।
– ও তো চলে গিয়েছে। ও খুব দুর্বল হয়ে পড়েছে।
জেবিন বললেন, ‘আমি যাই, আমিই টাকা নিয়ে আসি।’
আসাদ বলে উঠলো, ‘কাকী, আপনার একা যাওয়া ঠিক হবে না। এতোগুলো টাকা নিয়ে এতো রাতে আসা, আপনি মেয়ে মানুষ হিসেবে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যায়।’
সারাফ এবার অদ্ভুত কথা বলে বসলেন, ‘তোমার কোনো বন্ধুকে ডাকো বাবা। আর নাহলে স্বাধীনকে ডাকো। আমার শরীর চলছে না।’
আসাদ চুপ করে রইলো। এই রাতে তার বন্ধুদের ফোন করলে কেউ না কেউ আসবে নিশ্চিত। কিন্তু তার পরিবারের সম্মান চলে যাবে। তাই বন্ধুদের ডাকা যাবে না। কিন্তু সে স্বাধীনকে কীভাবে ডাকবে? জেবিনের মুখের দিকে তাকালে তিনি বললেন, ‘সেটাই করো বাবা। তোমার বন্ধু নাহলে স্বাধীনকে ডাকো। স্বাধীন ছেলেটা খুব ভালো মা শা আল্লাহ।’
আসাদ শিমুলের কাছে গিয়ে স্বাধীনের কথা বললো। শিমুল ঘুমন্ত চৈতির দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, ‘একটু অপেক্ষা কর। আমি দেখছি কি করা যায়।’
আনাসকে ফোন করলো শিমুল। কিন্তু সে ফোন ধরে বললো, সৌরভ অজ্ঞান হয়ে যাওয়ায় তাকে নিয়ে অন্য এক হাসপাতালে যেতে হয়েছে। হাসপাতালে যাওয়ার প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু দিলারা বেগম পাগল করে দিচ্ছিলেন ছেলের নাকি হার্ট এটাক হয়েছে এই বলে। আনাস সেখানে গিয়েছে। শিমুল বুঝতে পারলো, আনাসের সাহায্য নেয়া সম্ভব না। আনাসকে সে বললো সৌরভের ফোন থেকে স্বাধীনের নাম্বার বের করে তাকে বলতে। কিন্তু সে জানালো, সৌরভের ফোন বাসায় রেখে আসা হয়েছে।
এখন মাইমুনাই ভরসা। মাইমুনাকে ফোন করলো শিমুল। ফোন ধরতেই সে বললো, ‘মাইমুনা, তুমি এখন কোথায়?’
অশ্রু মিশ্রিত কণ্ঠে মাইমুনা বললো, ‘আমি চৈতির ঘরে বসে আছি। এখানকার অবস্থা ভালো না আপু। চৈতি কেমন আছে?’
– ওকে ঘুমের ওষুধ খাওয়ানো হয়েছে। আলহামদুলিল্লাহ, ও এখন ভালো আছে। তুমি একটা কাজ করতে পারবে?
– বলুন আপু।
– ওই পিশাচের ফোন জোগাড় করে স্বাধীনের নাম্বার বের করতে পারবে?
– আপু, স্বাধীন ভাইয়া এখানেই আছেন। তাকে কিছু বলতে হবে?
শিমুল দ্রুত বলে উঠলো, ‘স্বাধীন বাসায়? ও কি শুনেছে কিছু?’
– পাড়ার সবাই শুনেছে আপু। স্বাধীন ভাইয়া আসার পর সৌরভ ভাইয়াকে নিয়ে হাসপাতালে গিয়েছিলেন। এখন ফিরে এসেছেন কি যেন নেয়ার জন্য।
– দ্রুত ওকে ধরো। নাহলে চলে যাবে। বলবে আমি কথা বলবো।
মাইমুনা কলে থেকেই স্বাধীনকে ডাকাডাকি করতে লাগলো। স্বাধীন তাকে চিনতে পারেনি। কিন্তু প্রয়োজন হতে পারে ভেবে কাছে এসে সে বললো, ‘কিছু বলবেন?’
– শিমুল আপু আপনার সাথে কথা বলবে ভাইয়া।
– শিমুল কে?
– চৈতির চাচাতো বোন।
চৈতির নাম শুনে বুকটা ধক করে উঠলো স্বাধীনের। এই ঘটনা শোনার পর থেকে সেও সারাফ সাহেবের মতো ঘোরের মাঝে আছে। তার কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না যেই মেয়ের সাথে সে শেষবেলায় ঝগড়া করেছে সেই মেয়ে এখন হাসপাতালে পরে আছে জঘন্য ঘটনার শিকার হয়ে। সে যন্ত্রমানবের মতো ফোন কানে নিয়ে বললো, ‘আসসালামু আলাইকুম।’
– ওয়া আলাইকুমুস সালাম স্বাধীন। তুমি কি ব্যস্ত ভাইয়া?
– কিছুটা। হাসপাতালে যাওয়ার পরই ফ্রি আছি।
– ওই পিশাচকে নিয়ে এত ব্যস্ততা কিসের?
স্বাধীন মৃদু কণ্ঠে বললো, ‘সজীব আঙ্কেল হাসপাতালে যাননি। আন্টির অনুরোধে উনাকে জোর করে নিয়ে যাচ্ছি। এরপর বাসায় চলে আসবো। সৌরভের কাছে থাকার কোনো ইচ্ছে নেই।’
– তাহলে বড় কাকাকে হাসপাতালে রেখে তুমি মনোয়ারা হাসপাতালে আসতে পারবে? তোমাকে আমাদের প্রয়োজন ভাই।
– জি আসছি।
স্বাধীন তার ফোনে শিমুলের নাম্বার নিয়ে নিলো। তারপর সে চলে যেতে চাইলে মাইমুনা বললো, ‘আমিও যেতে চাই। আমি চৈতির কাছে যেতে চাই।’
স্বাধীন মাইমুনার দিকে তাকালো না। শুধু বললো, ‘আপনি একজন মেয়ে মানুষ আপু। রাত করে আমার সাথে বের হওয়ার দরকার নেই।’
স্বাধীন চলে গেল। মাইমুনা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছে, চৈতি মানুষ চিনতে ভুল করেনি।
সজীব সাহেবকে সৌরভের কেবিনে ঢুকিয়ে স্বাধীন বেরিয়ে এলো। সৌরভ অতিরিক্ত রাগের কারণে মাথা ঘুরে পরে গিয়েছে। এছাড়া তেমন কোনো সমস্যা নেই তার। তবু দিলারা কাঁদছেন, কিন্তু সজীব সাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে পারছেন না। সাহস হারিয়ে ফেলেছেন।
মনোয়ারা হাসপাতালের সামনে এসে শিমুলকে ফোন করলো স্বাধীন। আসাদ নীচে নেমে স্বাধীনকে ফ্লোর নম্বর ও কেবিন নম্বর বলে দ্রুত গাড়ি নিয়ে বাসার উদ্দেশ্যে গেল। স্বাধীনের পা চলছে না। ধীর পায়ে হেঁটে হেঁটে তিন তলায় গিয়ে কেবিন নম্বর ৩০৮ এ গিয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকলো সে। ভেতরে ঢোকার সাহস নেই। অনুভব করলো, তার হাত পা কাঁপছে। সে দ্রুত চেয়ারে বসে দুই হাত দিয়ে মুখ ঢাকলো। বারবার চৈতির হাসি হাসি মুখটা আর গায়ে হলুদের দিনে এলোমেলো চুলের সাজ চোখের সামনে ভেসে আসছে। হাত দিয়ে কয়েকবার চুল এলোমেলো করে পাশে তাকাতেই দেখলো, সারাফ সাহেব নিষ্পলক তাকিয়ে আছে তার দিকে। সে দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে বললো, ‘আসসালামু আলাইকুম আঙ্কেল।’
‘ভালো আছেন?’, এই কথাটা বলার ভাষা নেই তার। সারাফ সাহেবের মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে তিনি কতটা কষ্ট পেয়েছেন। সারাফ উঠে দাঁড়িয়ে স্বাধীনের কাঁধে হাত রেখে কেঁদে ফেললেন। স্বাধীন তাকে এক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলে তিনি দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন। জেবিন এসে এই দৃশ্য দেখে বললেন, ‘বাবা তুমি এসেছো? তোমার আঙ্কেলকে নিয়ে কি করবো আমি বুঝতে পারছি না। চৈতির থেকে এই মানুষটার অবস্থা আরও বেশি খারাপ।’
সারাফ চোখ মুছে বললেন, ‘আমার চৈতালি মায়ের কষ্টের কোনো তুলনা নেই।’
– আমি কি এমনি বলছি? আমি এটাই বলতে এসেছি, চৈতির জ্ঞান ফিরেছে। আশ্চর্যের বিষয়, ও খুব স্বাভাবিক স্বরে কথা বলছে।
‘জ্ঞান ফিরেছে আমার মায়ের?’, এই বলে সারাফ কেবিনে ঢুকে পড়লেন। স্বাধীন এক পা এগিয়ে কেবিনে যেতে গিয়েও থেমে গেল। জেবিন তাকে এভাবে দেখে বললেন, ‘তুমি দেখবে না চৈতিকে?’
– না আন্টি। সে আমার জন্য মাহরাম নয়।
– কে?
নাম বলতে দ্বিধা হচ্ছে স্বাধীনের। বারবার মনে হচ্ছে, এই নাম বলার আগে নিজেকে একশবার বকে দেয়া উচিত। মেয়েটাকে আজ বেশ কথা শোনানোর কারণেই মেয়েটা তখন অবুঝপনা দেখিয়ে জড়িয়ে ধরেছিল। এটা দেখেই সৌরভ এই নিন্দনীয় কাজটা করেছে। পরক্ষণেই তার মনে হলো, তাকদীরে থাকলে নিজেকে দোষ দেয়া অবশ্যই বোকামি। সে খুব কষ্টে উচ্চারণ করলো, ‘চৈতি!’
________
চলবে ইন শা আল্লাহ……