লোডশেডিং’ পর্ব ১৭.

0
320

‘লোডশেডিং’
পর্ব ১৭.

তাবিনা মাহনূর

__________________

– চৈতালি, মা আমার। এখন কেমন লাগছে?

বাবার প্রশ্নে চৈতির উত্তর, ‘বাসায় যাবো।’

সারাফ বললেন, ‘এখানে দুদিন থাকতে বলেছে ডাক্তার। তোর আগে থেকেই হিমোগ্লোবিন শর্ট। তাই দুদিন এখানে থেকে রেস্ট নে।’

চৈতির একই উত্তর, ‘বাসায় যাবো।’

সারাফ বুঝলেন না কি বলবেন। মেয়েটা নাকি জ্ঞান ফিরেই বলেছে সে বাসায় যাবে। এই দুটো শব্দ ছাড়া আর কোনো কথা বলছে না সে। শিমুল চৈতির মাথায় হাত বুলিয়ে আদুরে কণ্ঠে বললো, ‘জেদ ধরছিস কেন সোনা? ডাক্তাররা ভালো জানেন। তুই কমপক্ষে একটা দিন তো থাকবি?’

– এখানে ঘুম আসবে না।
– আমি ঘুম পাড়িয়ে দিই?
– না।

শিমুল অবাক হয়ে গেল চৈতির যন্ত্রের মতো কন্ঠস্বর শুনে। অনুভূতিহীন একটা প্লাস্টিকের পুতুলের ব্যাটারি চালিত কন্ঠ যেমন কোনো অভিব্যক্তি প্রকাশ করে না, তেমনি করে চৈতি শূন্য চাহনি দিয়ে কথা বলছে। না কোনো কান্না, না কোনো অঙ্গভঙ্গি। জেবিন ভাবলেন, তিনি কখনোই চৈতির নাম ধরে ডাকেন না। আজ বহুবার ডেকেছেন। এখন চৈতির সামনে ডাকলে হয়তো মেয়েটা অবাক হতে পারে। তিনি বললেন, ‘চৈতি, তোমার এখানে থাকা প্রয়োজন।’

কিন্তু চৈতি স্বাভাবিকভাবেই বললো, ‘থাকবো না।’

সবাই বুঝতে পারলো, চৈতি এখন যা বলবে তা না করলে হয়তো হিতে বিপরীত হতে পারে। সারাফ কিছু বলার পূর্বেই আসাদ ঢুকলো কেবিনে।

– কাকা, টাকা পয়সা নিয়ে এসেছি। রাস্তা একদম ফাঁকা ছিল বলে দেরি হলো না। আপনি বিল পে করবেন নাকি আমি?

বলতে বলতে চৈতিকে দেখে সে বললো, ‘চৈতি? তোমার জ্ঞান ফিরেছে? এখন কেমন লাগছে?’

চৈতি কোনো কথা বললো না। নিজের হাতে লাগানো স্যালাইন টিউবটার দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবছে সে। আসাদ বিব্রত বোধ করলেও কিছু বললো না চৈতির অবস্থা ভেবে। সারাফ সাহেব এবার সুযোগ নিলেন চৈতির প্রকাশভঙ্গি দেখার। তিনি বললেন, ‘স্বাধীনকে এখানে ডাকো।’

আশ্চর্যের বিষয়, চৈতি এখনো নির্বিকার। বাম হাতের কব্জির লাল দাগটা ডান হাত দিয়ে নাড়ছে আর কিছু একটা ভাবছে। আসাদ স্বাধীনকে নিয়ে এলো। স্বাধীন দৃষ্টি নামিয়ে রেখেছে, যদিও তার চৈতিকে একটুখানি দেখতে ইচ্ছে করছে।

সারাফ বললেন, ‘বাবা, এই শরীরে ও বাসায় যেতে চায়। আমি একদম নিশ্চিত যে ও বাসায় গেলেই ওকে কটূক্তি করবে সবাই। আমি সেটা সহ্য করতে পারবো না। এমন ভগ্ন শরীরে আমার মেয়ে কীভাবে এতগুলো আঘাত নিবে তুমি বলো তো বাবা?’

– ওকে বোঝান।
– জ্ঞান ফিরেই ওই একটা কথা বারবার বলছে। ও ঘুমাবে, এখানে নাকি ঘুম হবে না।
– একটা দিন থাকুক। জোর করুন।
– জোর করলে যদি ঝামেলা হয়? উল্টাপাল্টা কিছু করে?

তারপর তিনি ফিসফিসিয়ে বললেন, ‘হাতের স্যালাইন ব্যাগের টিউব যদি টান মেরে খুলে ফেলে? তাহলে বড় বিপদ হয়ে যাবে।’

স্বাধীন হালকা সুরে বললো, ‘তাহলে ডাক্তারকে ডেকে আনি?’

সারাফ বললেন, ‘সেটাই করো বাবা।’

ডিউটি ডাক্তার এসে বোঝালে চৈতি আজ রাত থাকতে চাইলো। তার হিমোগ্লোবিন ও আয়রন টেস্টের রেজাল্ট কালকে সকালে পাওয়া যাবে। ততক্ষণ তাকে এখানে থাকার অনুরোধ করলেন ডাক্তার। সেই সাথে রাতে তার প্রেসার ওঠা নামা করে কিনা সেটাও নিরীক্ষণ করবেন তিনি।

চৈতি চুপচাপ শুনে কোনোরকম কথা ছাড়াই মৌন সম্মতি জানালো। ডাক্তার স্বাধীন আর আসাদকে বাইরে ডেকে রোগী সম্পর্কে আরো কিছু তথ্য দিয়ে চলে গেলেন। তার মতে, রোগীকে এক ব্যাগ রক্ত দেয়ার পরও রোগীর শরীরে ফ্যাকাশে ভাব যায়নি। এর কারণ হিসেবে ভেতরে কোনো সমস্যা থাকতে পারে। তাই আরও কিছু টেস্ট না করানো পর্যন্ত এখানে থাকলে ভালো হয়। ডাক্তার চলে যাওয়ার পর আসাদ বলে উঠলো, ‘সবই টাকা কামানোর ধান্দা! ঘরে থাকলে সমস্যা কি? বাসা থেকে আসবে টেস্ট করতে। এখানে থাকা লাগবে এমন কোনো বাঁধাধরা নিয়ম আছে নাকি? যত্তসব!’

স্বাধীন অবশ্য কিছুই বললো না। সে আসাদকে দ্বিধাজরিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো, ‘এখানে তুমি আর আঙ্কেল ছাড়া পুরুষ মানুষ আর কেউ আসেনি?’

আসাদ ছোট্ট এক শ্বাস ফেলে বললো, ‘নাহ ভাই। ওই জানো* ব্যাটা অসুস্থ শুনে ওখানে গেছে কয়েকজন।’

– কি আশ্চর্য! ভুক্তভোগী এখানে আর মানুষ কিনা অপরাধীর পাশে দাঁড়াচ্ছে?
– এটাই সমাজ ভাই। আমি, আনাস আর শিমুল আপু ছাড়া কেউ এখানে আসেনি। আনাস রক্ত দিয়ে বাসায় চলে গেছে। একটা সত্যি কথা কি ভাই, সবাই জানে অপরাধী নিকৃষ্ট প্রকৃতির। কিন্তু কেউ সেটা স্বীকার করবে না। এটা আমার খুব অবাক লাগে যে টাকার কাছে সবকিছু নস্যি!

স্বাধীন আর কিছু বললো না। আসাদ ভুল কিছু বলেনি। সৌরভ বড়লোক বাবার সন্তান। চৈতি যদি সুস্থ হয়ে সৌরভের নামে মামলা করে তবু কিছুই হবে না। টাকা দিয়ে সব কিনে নেয়া যায়। এভাবেই ন্যায় অন্যায়ের পার্থক্য কেনা যায়।

শিমুল কেবিন থেকে বেরিয়ে আসাদকে বললো, ‘তুই কি বাসায় চলে যাবি?’

– আব্বু অনেকবার ফোন করেছে যাওয়ার জন্য। প্রথম দুই একবার কথা বললেও পরে ফোন ধরিনি।
– ভালো করেছিস। তুই গেলে এদিকটা সামলানো মুশকিল হয়ে যাবে। ছোট কাকা বাচ্চাদের মতো করছেন। কোনো দায়িত্ব পালন করতে পারছেন না।
– কীভাবে পারবে! সন্তানের মর্মান্তিক দৃশ্য দেখে ঠিক থাকা যায় নাকি? আমারই তো মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে। ইচ্ছে করছে জানো* এর…
– নোংরা কথা বলবি না। মুমিনরা গালি দিতে পারে না। তুই তাহলে এখানকার বেঞ্চের উপর ঘুমিয়ে যা। ভাগ্য ভালো আসার সময় ছোট কম্বল নিয়ে এসেছিস। নাহলে শীতে কাপাকাপি শুরু হয়ে যেত।

আসাদ বেঞ্চের উপর গা এলিয়ে দিয়ে বললো, ‘তুমি চৈতির পাশে শুয়ে পরো আপু। আর আরেকটা বেড আছে, ওটাতে কাকা কাকী শুয়ে পড়ুক। স্বাধীন ভাই, আপনি বাসায় চলে যান। আমি আছি এখানে।’

স্বাধীনের অকারণ একটা ইচ্ছে জাগছে। মন চাইছে এখানে থেকে যেতে। মানুষ কি ভাববে সেটা ভেবে মুখ ফুটে বলার সাহস পেলো না সে। তাকে দেখে শিমুল বললো, ‘স্বাধীন, একটু ওদিকটায় চলো তো ভাই। কথা আছে।’

কেবিন থেকে কিছুটা দূরে করিডোরে দাঁড়িয়ে আছে স্বাধীন। শিমুল বলছে, ‘আমি শুনেছি চৈতি তোমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে। এটা কি সত্যি?’

স্বাধীনের বুকে শূন্যতা অনুভূত হচ্ছে। হঠাৎ করে তার চোখ ভিজে আসতে চাইছে। সে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করে বললো, ‘সরাসরি নয়। চৈতি আমাকে পছন্দ করে। রাতে ও কিছুটা পাগলামি করছিল আমার সাথে। শেষে আমি যখন ওকে বলি যে আমাদেরকে কেউ এভাবে দেখলে কেলেঙ্কারি বেঁধে যাবে তখন ও বলে, “কেউ দেখলে বিয়ে দিয়ে দিবে। সেটাই ভালো হবে।”

– ইশরে! এখন এমন একটা ঘটনা ঘটলো যে পিশাচকে বিয়ে করতে বাধ্য ও। ও না চাইলেও সমাজ ওকে জোর করবে।
– আপু, ও কি সৌরভকে বিয়ে করবে?
– জানি না। তাছাড়া ওকে কেই বা বিয়ে করবে? এমন মহৎ ব্যক্তি কি আছে?

স্বাধীন চুপ করে থাকলো। এখন সে এটা বলার সাহস পাচ্ছে না যে তার বিয়ে করতে কোনো আপত্তি নেই।

– স্বাধীন, যেটা তোমাকে বলার জন্য এখানে এনেছি এখন সেটাই বলছি। চৈতি তোমাকে বিয়ের প্রস্তাবই দিয়েছে বলতে গেলে। কেননা সে কখনো বলেনি সে তোমার সাথে প্রেম করবে। বলেছে বিয়ে করবে। তাই একটা কথা বলি, ও যে তোমাকে বিয়ের প্রপোজ করেছে এর জন্য ওকে ছ্যাঁচড়া মেয়ে ভাববে না। মেয়েরা বিয়ের কথা আগে বলায় কোনো সমস্যা নেই।
– না না আপু! আমি চৈতিকে কখনোই ছ্যাঁচড়া ভাবিনি। শুধু আজকে ও বেশি বেশি করছিল বলে ওকে বেহায়া বলেছিলাম।
– বেহায়া তারাই যারা অনেকগুলো পুরুষের পেছনে আঠার মতো লেগে থাকে। আমাদের চৈতি তেমন মেয়ে না। সে কিছুটা বাচ্চাদের মতো হলেও খারাপ চরিত্রের না। যাই হোক, ও তোমার কাছে নিজেকে অনেকবার ছোট করেছে। পারলে ওকে মাফ করে দিও।
– আপু, আপনি আমার উপর রাগ করবেন না। আমি চাইনি ওকে কষ্ট দিতে।

শিমুল মলিন মুখে বললো, ‘তোমার উপর আমার কোনো রাগ নেই ভাই। চৈতি কেমন মেয়ে তা আমার জানা আছে। আমি চৈতির হয়ে এই কথাগুলো বলে দিলাম। সবাই এখন চৈতির ভঙ্গুর অবস্থা দেখে সহানুভূতি দেখাবে। চৈতিকে দেখোনি তো, তাই বুঝতে পারছো না ওর অবস্থা কেমন। ও কঠিন হয়ে গিয়েছে। আমার মনে হয়, ওকে সহানুভূতি দেখালে সেটা ওর কাটা ঘায়ে নুনের ছিটার মতো লাগবে। তাই অনুরোধ থাকলো, ওকে কোনো সহানুভূতি কিংবা আহ্লাদ দেখানোর প্রয়োজন নেই।’

স্বাধীন চুপ করে নীচে তাকিয়ে আছে। এসব শুনে নিজেকে বেশি অপরাধী মনে হচ্ছে তার। শিমুল বললো, ‘এখন তুমি বাড়ি যাও।’

স্বাধীন সালাম জানিয়ে করিডোর পেরিয়ে লিফটের কাছে এলো। আজকে তার নিজেকে সবচেয়ে অসহায় মনে হচ্ছে। এর কারণটা জানা নেই!

_____

সকালে চৈতির হিমোগ্লোবিন আর আয়রন টেস্টের রিপোর্ট এলো। ফলাফল ভালো, সবকিছু স্বাভাবিক থাকায় তাকে বাসায় ফিরে যেতে আপত্তি করলেন না ডাক্তার। চৈতি সারারাত ঘুমিয়ে সকালে একটু নাস্তা খেয়েছে। কিন্তু কোনো কথা বলেনি। গাড়িতে চড়ে বাসার সামনে যেতেই জেবিন বললেন, ‘চৈতির মুখটা ঢেকে দেয়া দরকার।’

চৈতি দৃঢ় স্বরে বললো, ‘নাহ!’

জেবিন আর কিছু বললেন না। রাতে তার ঘুম হয়নি। তিনি কেবিনে থাকতে চাননি, শুধুমাত্র স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়েছে। সাদিয়া আর সাদিকের চিন্তায় তার ঘুম ভালোমতো হয়নি। তিনি চৈতির সাথে জীবনেও এতো বেশি কথা বলেননি। কাল থেকে কিছু কিছু বলেছেন কিন্তু চৈতির দিক থেকে কোনো সাড়া পাচ্ছেন না। এটা তার জন্য অপমানজনক বটে।

শিমুল চৈতির মাথায় কাপড় দিয়ে দিলো। এতে চৈতি মানা করলো না। গাড়ি থেকে নামার পর শিমুল চৈতিকে যতটা সম্ভব আড়াল করে সিঁড়ির কাছে নিয়ে গেল। চৈতি শিমুলের সাথে কোনো বাজে আচরণ করছে না। চার তলা পর্যন্ত যেতে যেতে তিনতলা থেকে কান্নার রোল শুনতে পেলো তারা। দিলারা এখনো জোরে জোরে কাঁদছেন।

– আমার ছেলেটা কেমন হয়ে গেল রে নীরা! ওকে দেখে আমার বুকে ব্যথা করে, ওর চিন্তায় আমার কিচ্ছু ভালো লাগে নারে! ও তো ভালোবাসে ওই মেয়েকে। কিন্তু সবাই ওর দোষ দিচ্ছে। কেউ বুঝতেই চাইছে না!

শিমুলের কান গরম হয়ে এলো এসব অনৈতিক কথাবার্তা শুনে। সে চৈতিকে লক্ষ্য করে দেখলো, চৈতি চুপচাপ হাঁটছে। তার মাঝে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। কোনো মানুষের কথা তার কানে ঢোকেনি।

চৈতির বাসায় কোনো মেহমান নেই। আগামী সপ্তাহে বৌভাতের অনুষ্ঠান বলে আত্মীয় স্বজন যারা গ্রামে থাকতেন তারা গ্রামে চলে গেছেন সকালে। আর যারা ঢাকায় থাকেন তারা নিজেদের বাসায় চলে গিয়েছেন। গ্রামের কিছু মানুষ অবশ্য আছে, তবে তারা দোতলায় শিমুলদের বাসায় আছে। তাই চৈতির আলাদা করে কোনো সমস্যার সম্মুখীন হতে হলো না। এর পেছনে সারাফ সাহেবের ভূমিকা আছে। তিনি বাড়ির দারোয়ান, আনাস ও আসাদকে স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন যেন কেউ উনার বাসায় হানা না দেয়।

চৈতি ঘরে ঢুকেই দরজা আটকে দিতে চেয়েছিল কিন্তু শিমুল জোর করে ঢুকেছে। ঘরটা অগোছালো হয়ে আছে। রাতে যেমন ছিল, তেমনই আছে। বিছানার চাদর কুঁচকানো, গায়ের কম্বলের এক পাশ বিছানা থেকে পড়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে। গাঢ় গাঢ় কিছু দাগ, মেঝেতে বালিশ পরে আছে। চৈতি সেদিকে তাকিয়ে আছে এক দৃষ্টিতে। সেই যে দরজা আটকিয়ে এদিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে আছে সে, আশেপাশে তার আর কোনো খেয়াল নেই। শিমুলের চোখ দিয়ে অশ্রু বের হচ্ছে, কিন্তু চৈতি নিঃশব্দ। শিমুল আর সহ্য করতে পারছে না। ছুটে এসে চৈতিকে জড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে সে বললো, ‘একটু কাঁদ বোন! আমার যে আর সহ্য হচ্ছে না!’

চৈতি হাত ছাড়িয়ে বিছানার দিকে গেল, তবু কাঁদলো না। চাদর একটানে উঠিয়ে মেঝেতে ফেলে দিলো সে। বালিশের কভার খুলে, কম্বল ফেলে নতুন চাদর নিয়ে এলো। শিমুল চোখ মুছে এগিয়ে গিয়ে বললো, ‘আমাকে দে। তুই অসুস্থ, তোর বিশ্রাম দরকার। ডিভানে গিয়ে শুয়ে পর।’

শিমুল বিছানায় চাদর পেরে বালিশ নতুন কভারে ঢুকানোর সময় ক্যাচ ক্যাচ আওয়াজ শুনতে পেলো। সে পেছনে তাকিয়ে দেখলো চৈতি চাদর আর কম্বল কেটে কুটিকুটি করে ফেলছে। শিমুল কিছু না বললেও আতঙ্কিত হলো চৈতির মানসিক অবস্থা চিন্তা করে। সে ভেবে রাখলো, তার বান্ধবীর পরিচিত সাইকিয়াট্রিস্ট এর কাছে চৈতিকে নিয়ে যাবে। তবে আপাতত সে চৈতিকে কোনো কাজে বাধা দিবে না। চুপ করে সব মেনে নিবে। আজ রাতে চৈতির সাথে ঘুমাবে। এতে তার মা বাবার সম্মতি না থাকলেও সে চৈতিকে একা রাখবে না।

চৈতি এখন ডিভান টেনে সরানোর চেষ্টা করছে। ডিভানের ভার তেমন বেশি না, তবে চৈতির নিস্তেজ শরীরে তা সরানো অনেকটা কষ্টকর। শিমুল চৈতিকে থামিয়ে দিয়ে বললো, ‘কি হয়েছে? এটা সরাচ্ছিস কেন?’

যান্ত্রিক উত্তর ভেসে আসলো, ‘এটা সরাবো।’

– কেন?
– এখানে জাহান্নাম ছিল।
– সৌরভ এখানে বসেছিল?

হঠাৎ চৈতি দুই কানে হাত চেপে শীতল ও ধীর কণ্ঠে বললো, ‘জাহান্নামের নাম নেই।’

শিমুল হতভম্ব হয়ে কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেললো। চৈতি হাত নামিয়ে এক আঙ্গুল দিয়ে ডিভান দেখিয়ে বললো, ‘নরক যন্ত্রনা শেষে জাহান্নাম এখানে বসে ছিল। এটা অপবিত্র। এটাকে বের করো।’

চৈতির কন্ঠ খুব ঠান্ডা ও ধীর। চিৎকার করছে না, জোরে কথা বলছে না। কিন্তু কন্ঠ শুনে যেকোনো মানুষ বুঝতে পারবে মেয়েটা স্বাভাবিক নয়। হয় মনের মাঝে তীব্র ক্রোধ চেপে রেখেছে, আর নয়তো কথা বলার শক্তি নেই। চৈতি হাত দিয়ে ঠেলাঠেলি শুরু করলে শিমুল তাকে সাহায্য করলো। দরজা খুলে তারা সেটা বের করলে সারাফ সাহেব এলেন মেয়ের কাছে।

– মামণি, তুই অসুস্থ শরীরে এসব কি করছিস?

চৈতি কোনো উত্তর না দিয়ে ঘরে ঢুকে মেঝেতে পড়ে থাকা কম্বল ও চাদরের টুকরো গুলো যতটা সম্ভব হাতে নিয়ে বাইরে এলো। সারাফ আবার প্রশ্ন করলেন, ‘কি হয়েছে মা? দে দে, আমাকে দে এগুলো। তুই ঘরে বিশ্রাম নে।’

সারাফ চৈতির হাত থেকে সেগুলো নিয়ে স্টোররুমে থাকা ডাস্টবিনে ফেললেন যেখানে নষ্ট হয়ে যাওয়া যন্ত্রপাতি ও কাপড় রাখা হয়। ফিরতে গিয়ে দেখলেন চৈতি আরো কিছু টুকরো নিয়ে আসছে। সারাফ কিছুটা অবাক হয়ে বললেন, ‘চৈতালি মা, এতগুলো কাপড় কিসের?’

এবারও উত্তর দিলো না চৈতি। শিমুলের হাতেও কিছু টুকরো। জেবিন অদ্ভুত সব কান্ড দেখে চুপ থাকতে পারলেন না। তিনি বললেন, ‘কি হয়েছে তোমাদের? হায় হায়! এটা তো নতুন চাদর। বিয়ে উপলক্ষ্যে ঘর সাজানোর জন্য কেনা হয়েছিল। এই অবস্থা কে করেছে?’

চৈতি নিচু স্বরে বললো, ‘আমি।’

জেবিন চৈতির কন্ঠস্বর শুনে কিছুটা ঘাবড়ে গেলেন। তবু দমে থাকতে পারলেন না, ‘এগুলো কি চৈতি? এখন পাগলামি করলে চলে? একি! এই টুকরো দেখে কম্বলের টুকরো মনে হচ্ছে। কম্বলও কেটে ফেলেছো?’

– হুম।
– কেন!
– জাহান্নামের চিহ্ন ছিল।
– জাহান্নাম মানে?

চৈতি চুপ। জেবিন অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন। উনি চৈতিকে বকছেন না কিন্তু এসব কাজ তার মোটেও ভালো লাগছে না। মেয়েটা যদি পাগল হয়ে যায় তবে তার জীবন শেষ! মেয়েটার স্বাভাবিক জীবনেই তিনি ভালো ব্যবহার করেননি, পাগল মেয়েকে বাকি জীবন কীভাবে রাখবেন?

সারাফ কথাবার্তার দ্রুত ইতি টানার জন্য বললেন, ‘তোরা ঘরে যা। শিমুল মা, তুই চৈতিকে স্যুপটা খাইয়ে দিস।’

– ঠিকাছে কাকা।

চৈতি ঘরের দিকে রওনা হলে জেবিন বলে উঠলেন, ‘ওহ! জাহান্নাম বলতে ও সৌরভকে বুঝিয়েছে?’

চৈতি এবার দুই কানে হাত রেখে পাগলের মতো বলতে লাগলো, ‘জাহান্নামের নাম নেই! জাহান্নামের নাম নেই!’

_______

চলবে ইন শা আল্লাহ……….

[আপনারা ইনবক্সে ম্যাসেজ দেন। আমি সানন্দে ম্যাসেজে ক্লিক করলেই দেখি ‘আপু পরের পর্ব কখন দিবেন?’ ―_― ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here