‘লোডশেডিং’
পর্ব ২২.
তাবিনা মাহনূর
___________________
সারাফ অফিস থেকে লাঞ্চ ব্রেকের সময়ে বাসায় এলে সিঁড়িতে সজীবের সাথে দেখা হয়। সারাফ দেখেও না দেখার ভান করে যখন উপরে চলে যাচ্ছিলেন, তখন সজীব ডেকে উঠেন, ‘ভাইরে, আমার ঘরে একটু আয়। ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ দিবি না?’
সারাফ ভেতরে গেলেন না। তিন তলার ঘরে যাওয়ার কোনো রুচি নেই তার। সজীব তার মনোভাব বুঝতে পেরে বললেন, ‘এখানেই বলবো?’
– আমার ঘরে আসেন বড় ভাই।
– চৈতি মা আমাকে দেখলে রাগ করবে না?
– চৈতি বাসায় নেই।
ড্রইং রুমে সারাফ সাহেব সজীব সাহেবের সাথে আলোচনায় বসলেন। সজীব খুব মলিন কণ্ঠে বললেন, ‘সারাফ, তোর মেয়ে আমারও মেয়ে। তার ক্ষতি হওয়া আমার ক্ষতি হওয়ার সমান। আমি জানি সৌরভ একটা বাজে কাজ করে ফেলেছে। কিন্তু এটা তো সত্যি কথা যে দুজন দুজনকে ভালোবাসতো।’
সারাফ কিছুটা রেগে গিয়ে বলেন, ‘এটা কী বলছেন ভাই? আমার মেয়ে কখনোই সৌরভকে ভালোবাসেনি। আপনি বড় ভাই। এসব কথা খোলাখুলি বলতেও বাঁধছে।’
– না না। এখন বড় ছোট দেখলে হবে না। একটা সমাধানে আসতে হলে সরাসরি আলাপ করতে হবে। তুই কি চৈতির সাথে কথা বলেছিস?
– নাহ। ও এখন পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। এগুলো বলার ইচ্ছে নেই।
– কিন্তু আমাদের ইচ্ছে ছিল চৈতির ইন্টার পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর দুজনকে এক করে দিব।
– এখন এই দুজন এক হওয়ার সম্ভাবনা আছে বলুন? আমি কোনো কথা বলবো না, আপনিই বলুন। আপনার বিবেক কি বলে?
সজীব চুপ করে মাথা নিচু করলেন। এ ব্যাপারে কিছুই বলার নেই। তবু ছেলের অবস্থা ও স্ত্রীর জোরাজুরির কারণে ছোট ভাইয়ের কাছে মাথা নুয়াতে হলো। সারাফ আবার বললেন, ‘আমি চৈতির সাথে কথা না বলে কিছু বলতে পারছি না।’
__________
চৈতি চুপচাপ সবটা শুনে কোনো মন্তব্য করলো না। শিমুল চৈতির কাঁধে হাত রেখে সারাফের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কাকা, চৈতি চুপ করে আছে। কিন্তু আমি চুপ থাকতে পারছি না। বড় কাকা এই প্রস্তাব দেয়ার সাহস কীভাবে পেলেন?’
জেবিন এবার বলে উঠলেন, ‘আমিও এ বিষয়ে একটু বিরক্ত হয়েছি। চৈতির সাথে যেটা হয়েছে সেটাকে উনারা আমলে নিচ্ছেন না।’
সারাফ বললেন, ‘সিদ্ধান্ত আমার চৈতালি মা নিবে। চৈতি, তুই বল। তোর বড় কাকাকে কি জবাব দিব?’
– আমি এ ব্যাপারে পরে কথা বলতে চাই। এখন আমার ভালো লাগছে না।
সবাই উঠে দাঁড়ালো। চৈতি এখন একা একা কিছুক্ষণ চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিবে। তবে শিমুল বললো, ‘চৈতি, জেদ করে নিজের ক্ষতি ডাকিস না। এই পিশাচের সাথে বিয়ে করবি না তুই।’
সবাই বের হওয়ার সময় চৈতি বললো, ‘বাবা, তুমি আমার কাছে কিছুক্ষণ থাকবে?’
শিমুল আর জেবিন বুঝতে পারলো, চৈতি তার বাবার সাথে একান্তে কথা বলতে চায়। তারা বেরিয়ে গেল এবং সারাফ এসে চৈতির সামনে বসে বললেন, ‘বল মা। তোর সব মতামত আমি সবার আগে প্রাধান্য দিব।’
– আমি যেহেতু ওই ছেলের নামটাই শুনতে পারছি না। তাই আমাকে কিছুদিন সময় দিতে হবে।
– এর মানে?
– বড় চাচাকে বলো চিন্তা না করতে। আমি ঐ পিশাচকে বিয়ে করবো।
অবাক হলেন সারাফ, ‘কি বলছিস চৈতি!’
– ঠিকই বলছি বাবা। শুধু আমাকে স্বাভাবিক হওয়ার যথাযথ সময় দিতে হবে।
সারাফ গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘এরকম নিকৃষ্ট সিদ্ধান্ত আমি তোর কাছ থেকে আশা করিনি।’
– বাবা, তুমি কিন্তু বলেছো আমার মতামতকে প্রাধান্য দিবে?
– আমি কখনোই ভাবতে পারিনি তুই এই সিদ্ধান্ত নিবি!
– বাবা, আমি কিন্তু এখনো সব বলিনি। আর আমার স্বাভাবিক হতে অনেকদিন লাগবে। ততদিনে হয়তো বিয়ের চিন্তা বদলে ফেলতে পারি।
– যা ইচ্ছা কর! আমি তোর অভিভাবক বলে মনেই করিস না তুই!
সারাফ সাহেব রাগ করে বেরিয়ে গেলেন। চৈতি সেদিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবলো। আজকাল ভাবুক চিত্তে থাকা চৈতির প্রতিদিনের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। তবে এখন সে যা ভাবছে, তাতে সারাফ সাহেবের সাহায্য খুব প্রয়োজন। সে বিছানা ছেড়ে উঠে গুনগুন করতে করতে বারান্দায় চলে গেল। তার মনে এখন একটা গান বাজছে। এটা সে নিজেই বানিয়েছে!
সবুর করো গো বন্ধু, পথ এখনো বাকি।
হাত ছেড়ো না বন্ধু, বন্ধ কোরো না আঁখি!
__________
সাইকিয়াট্রিস্ট শাহনাজ খান অত্যন্ত নম্র ভদ্র মহিলা। চৈতির সাথে মধুর সুরে হাসিমুখে কথা বলেছেন। শিমুল চৈতির পাশেই বসে ছিল। চৈতি পুরোটা সময় সাবলীল ভঙ্গিমায় ডাক্তারের সাথে কথা বলেছে। ফেরার সময় শাহনাজ চৈতিকে ডেকে বললেন, ‘সাফওয়ানা শব্দটির অর্থ জানো?’
– জি না ডক্টর।
– আমার মায়ের নাম ছিল সাফওয়ানা। এর অর্থ, একটা উজ্জ্বল নক্ষত্র। তুমি এই নামটিকে বহন করো মা।
আজ এতোদিন পর চৈতি মুচকি হেসে উঠলো। তা দেখে শিমুল নিজেকে সামলাতে না পেরে কেঁদে ফেললে ডাক্তার প্রশ্ন করলেন, ‘কি হয়েছে আপনার? কাঁদছেন কেন?’
শিমুল চোখ মুছে বললো, ‘আজকে চৈতি অনেকদিন পর হেসেছে।’
ডাক্তার মুচকি হেসে বললেন, ‘ওর নাম চৈতি?’
– জি ডাক্তার।
– এটাও সুন্দর নাম। তবে আমি ওকে মা বলেই ডাকবো।
চৈতি আবারো হাসলো। এবার শিমুলও হেসে উঠলো। সে ডাক্তারকে অসংখ্য ধন্যবাদ দিলো। ডাক্তার শাহনাজ বললেন, ‘আল্লাহর কাছে একটা বিষয়ে আমি খুব শুকরিয়া আদায় করি। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ হওয়ার অছিলায় আমি অনেকের ঠোঁটে হাসি ফুটাতে পারি। আল্লাহ আমাকে এই সুযোগ দিয়েছেন বলেই এতগুলো মিষ্টি মুখের হাসি দেখতে পাই আমি। আলহামদুলিল্লাহ। মা, তুমি যখন মন চাইবে তখনই আসবে। আমি কোনো নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করে দিলাম না।’
ডাক্তারের চেম্বার থেকে বের হয়ে চৈতি শিমুলকে বললো, ‘আপু, আমার রিকশায় লং ড্রাইভে যেতে ইচ্ছে করছে।’
– সেকি! তুই রিকশা চালাবি?
– আরে নাহ। রিকশায় চড়ে অনেক দূরে যেতে ইচ্ছে করছে। অনেকটা পথ।
– কোনো রিকশাওয়ালা রাজি হবে নারে।
চৈতি উপায় বের করলো, ‘তাহলে এক কাজ করি, প্রথমে দূরে কোথাও একটা রিকশায় যাই। এরপর সেখান থেকে আবার আরেকটা রিকশা ভাড়া করে আরো দূরে কোথাও যাই। সেখান থেকে আবার আরেকটা রিকশায় চড়ে বাসায় ফিরে যাবো।’
– তাহলে চল আগে হাতিরঝিল যাই। এরপর নাহয় আমার ভার্সিটি ক্যাম্পাসে যাবো?
– হাতিরঝিল না আপু। ওই জায়গা মারা গেছে।
– ওমা! জায়গা মারা যায় কীভাবে?
– প্রকৃতি মারা যায় একসময় যদি সেখানে মানুষের আধিক্য বেশি হতে থাকে। হাতিরঝিল প্রাকৃতিক না হলেও একটা সুন্দর জায়গা যেখানে গেলে মন ভালো হতে পারে। তবে সেই জায়গাটাও মারা গেছে আবর্জনা আর নোংরা মানুষের অতিরিক্ত ভিড়ে।
– বাপরে! কি সুন্দর করে কথা বললি!
চৈতি মুচকি হেসে বললো, ‘ভুলে গেছো? ছোট থেকেই তোমরা আমার মুখে গল্প শুনতে চাইতে।’
শিমুলও হাসলো, ‘তাই তো, ভুলেই গিয়েছিলাম। তাহলে চল এখন ধানমন্ডি লেকে ঘুরতে যাই। শীত শীত আবহাওয়া, সামনে বসন্ত আসছে। ওখানে সবুজ প্রকৃতির মাঝে ভালো লাগবে। এখন দুপুর, লোকজন কমই থাকবে। যাবি?’
– চলো!
রিকশায় চড়ে ধানমন্ডি লেকে গেল শিমুল আর চৈতি। দুজনে আপাদমস্তক কালো বোরখায় আবৃত। তা দেখে আশেপাশের পুলিশ বাহিনী সতর্ক হয়ে গেল। সেটা খেয়াল করে শিমুল চৈতির দিকে তাকালে দুজনেই হেসে উঠলো। চৈতি দুআ করলো, ‘কি দিনকাল এসেছে হে আল্লাহ! তোমার দ্বীন পালন করলে আজকাল মানুষ অপরাধীর চোখে দেখে। তুমি আমাদের তোমার হেফাজতে রেখো আল্লাহ!’
সারি সারি গাছ। একটা বেঞ্চে বসে শিমুল বাদামওয়ালার কাছ থেকে বাদাম কিনলো। চৈতি তা খেতে খেতে প্রশ্ন করলো, ‘আপু, আজকে কামিনী আপুর বৌভাত হওয়ার কথা ছিল।’
– হবে তো।
– কখন?
– সন্ধ্যার পর। রাতের পার্টি।
– বাসায় কোনো লোকজন দেখলাম না যে?
– মেহমান সব বড় কাকার নতুন বাড়ির ফ্ল্যাটে আছে। কাকারা অনেক বড়লোক। এই বাড়ি ছাড়াও দুটো বাড়ি আছে। একটাতে নাকি এই মাসে দুটো ফ্ল্যাট খালি হয়েছে। ভাড়াটিয়া আসবে সামনে মাসে। ওখানেই মেহমান থাকছে। শুনেছি ওই বাড়ির ছাদে একটা ফ্ল্যাট আছে যেটা সবসময় খালি পরে থেকে। কামিনী আপু আর দুলাভাইকে আজ ওখানে নিয়ে যাওয়া হবে।
চৈতি চুপ করে থাকলো। শিমুল বললো, ‘ভাইয়ের কুকীর্তির জন্য আপু বাসায় আসতে চাইছে না।’
– আপুর শ্বশুরবাড়ির লোকজন জানে?
– নারে। আপুকে বড় কাকী এ কথা বলার পর আপু তিনদিন কোনো যোগাযোগ করেনি কারো সাথে। এরই মধ্যে আপু আর দুলাভাই হানিমুনে বান্দরবান গিয়েছিল। আজকে বৌভাত হওয়ার পর আপু অন্য বাসায় যাবে, আর কালকেই নাকি শ্বশুরবাড়ি চলে যাবে। আমি ভাবছি, এভাবে চললে আপুর শ্বশুরবাড়ির লোকজন সন্দেহ করবে না?
চৈতি বলে উঠলো, ‘এখানে আর ভালো লাগছে না আপু। বাসায় চলো।’
শিমুল ঘাবড়ে গিয়ে বললো, ‘সরি সরি! এই প্রসঙ্গে কোনো কথা বলবো না। রাগ করিস না।’
– রাগ করিনি আপু। আমার পড়াশোনা করতে হবে, প্রচুর পড়তে হবে। এক মুহূর্ত নষ্ট করতে চাই না। চলো উঠি।
__________
বাসায় ফিরে চৈতি গোসল করে নামাজ পড়ে নিলো। সেসময় শিল্পীর সাথে আবারো দেখা। এবার তিনি সতর্ক হয়ে আছেন। সৌরভের নাম উচ্চারণ করবেন না ভেবে রেখেছেন। চৈতির সাথে গল্পের এক পর্যায়ে বললেন, ‘তোর কি ইয়ে বন্ধ হয়ে গিয়েছে?’
– কিসের কথা বলছো ফুপি?
– মেয়েলি অসুখ।
মুখ থমথমে হয়ে গেল চৈতির। গম্ভীর কণ্ঠে বললো, ‘এর মানে কী?’
– বুঝতে পারছিস না? ডেট কবে?
– জানি না।
– আহা! সচেতন থাকতে হবে। তুই বাচ্চা মেয়ে। এবর্শনের কষ্ট সামলাতে পারবি না…
চৈতি উঠে দাঁড়িয়ে এক দৌড়ে ছাদে চলে গেল। এভাবে সে কটু কথা থেকে দূরে থাকতে পারবে না, কখনোই পারবে না! নোংরা এক কাহিনী, সেই কাহিনীর ফলাফল আজীবন বহন করতে হবে। চৈতি আজকেই সাইকিয়াট্রিস্টের কাছ থেকে এসেছে। আজই আবারো কষ্ট পেতে হলো তাকে। হাসতে যেমন ভুলে গিয়েছিল, কাঁদতেও ভুলে গিয়েছিল চৈতি। আজ ডাক্তারের কথায় হেসেছে, ফুপির কথায় কাঁদছে। নিঃশব্দে কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে শুয়ে পড়লো চৈতি। আকাশের দিকে তাকিয়ে আল্লাহর কাছে বললো, ‘আল্লাহ! তুমি তোমার বান্দার বারবার আকাশের দিকে তাকানো লক্ষ্য করো, তুমিই এই কথা কুরআনে বলেছো! আমাকে তোমার রহমতের একটুখানি দিও আল্লাহ! তোমার অসীম দয়ার ভান্ডার থেকে একটুখানি আমাকে দিও আল্লাহ! তাতেই আমি অনন্ত সুখ পাবো। ধৈর্য শক্তি চাই আমি। ধৈর্য চাই!’
– একি চৈতি! উঠো উঠো।
রেবেকা ভাবীর কন্ঠ। উঁচু পেট নিয়ে তিনি নিচু হতে পারছেন না। তবু কিছুটা কুঁজো হয়ে চৈতির দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন, ‘চৈতি, একদম কাঁদবে না। উঠে পরো।’
চৈতি হাত ধরে উঠে দাঁড়ালো। রেবেকা তাকে এক হাত দিয়ে জড়িয়ে বললো, ‘জানি তোমার কষ্ট অতুলনীয়। তোমাকে কেউ অনুভব করতে পারবে না। কিন্তু তুমি যদি এভাবে চলতে থাকো, তাহলে জীবনের বাকি পথ কীভাবে চলবে?’
চৈতি কান্না থামিয়ে বললো, ‘আপনি অসুস্থ ভাবি। ছাদে একা এসেছেন কেন?’
– একা না। আমার স্বামী এসেছিলেন। তোমাকে কাঁদতে দেখে তিনি চলে গেলেন।
– কেন?
– আমাকে বললেন তোমাকে সময় দিতে। আর তিনি বেপর্দা মেয়ে মানুষের সামনে পারতপক্ষে আসেন না।
চৈতি খেয়াল করলো, সে মাথায় ওড়না দিতেও ভুলে গিয়েছে। দ্রুত ঘোমটা দিয়ে রেবেকার পেটে হাত রেখে বললো, ‘মা শা আল্লাহ। বারাক আল্লাহু ফিকি।’
– বাহ! তুমি অনেককিছু শিখে গিয়েছো।
– যা শিখছি, সবই শিমুল আপু শিখিয়েছে।
– মেয়েটা খুব ভালো। চৈতি, আমরা সামনে মাসে বাসা পরিবর্তন করে চলে যাচ্ছি।
– আপনারা যা সিদ্ধান্ত নিবেন তাই ভালো। এই বাসার পরিবেশ নষ্ট হয়ে গিয়েছে। কেউই থাকতে চাইবে না।
– তোমাকে বিব্রত করতে চাইনি। তবু বললাম। তোমার সাথে দেখা করতে চেয়েছিলাম। ভালোই হলো এখানে দেখা হয়ে।
– আপনাকে দেখেও খুব ভালো লাগলো।
– তোমার জন্য একটা জিনিস রেখেছি। তুমি আমার সাথে নীচে যেতে পারবে?
– জি অবশ্যই!
চৈতিকে রেবেকা আন্তরিকভাবে আপ্যায়ন করলো। নিজের হাতে চা বানিয়ে খাওয়ালো, বিভিন্ন ধরনের নাস্তা বানিয়ে দিলো। গল্পের আসর শেষে চৈতির হাতে একটা বই দিয়ে বললো, ‘এটা বুখারী শরীফ। সবার বাসায় কুরআন থাকে। তাই ভাবলাম এটাই দিই। সবার এই বই নেই। তোমার কাছে আছে?’
– না ভাবি।
– আমারও তাই মনে হয়েছিল। তোমাদের পরিবারকে রক্ষণশীল মনে হয়নি। যাই হোক, এটা দেয়ার কারণ হলো, তুমি এখন থেকে হাদিস শিখবে এবং সেই অনুযায়ী আমল করবে। এটায় শানে নুযুল, হাদিসের বিবরণ সব আছে।
– অনেক ধন্যবাদ ভাবি।
– ধন্যবাদ নয়। জাঝাকিল্লাহ খইরন।
– ওহ হ্যাঁ। জাঝাকিল্লাহ খইরন।
– ওয়া ইয়্যাকি।
ফেরার সময় রেবেকা একটা কার্ড দিয়ে বললেন, ‘এটা আমার বিজনেস কার্ড। এখানে উপরে যেই নাম্বারটা আছে, ওটা আমার ব্যক্তিগত নাম্বার। যেকোনো প্রয়োজনে আমাকে ফোন করবে। কোনো দ্বিধা করবে না।’
চৈতি অবাক হয়ে তাকালে রেবেকা হেসে বললেন, ‘আমার স্বামী তার ব্যবসার একটা অংশ আমাকে দিয়েছেন। আমার কিছুই করতে হয় না, শুধু নামটা দিয়ে রেখেছি। তুমি কিন্তু ফোন করবে। তাছাড়া প্রয়োজন না থাকলেও মাঝে মাঝে এই বোনটার খোঁজ নিও।’
– ইন শা আল্লাহ ভাবি।
– আর একটা কথা মনে রাখবে, আমার কথা নয়। স্বয়ং আল্লাহ বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই কষ্টের সাথে স্বস্তি রয়েছে!’
(সূরা ইনশিরাহ : ৫)
চৈতি মুচকি হেসে নীচে চলে গেল। জগতে রেবেকার মতো মানুষ আছে বলেই এখনো জগৎ টিকে আছে!
__________
বৌভাতে সারাফ আর চৈতি গেল না। সৌরভ যেতে না চাইলে দিলারা বেগম জোর করে নিয়ে গিয়েছেন যেন লোকচক্ষুর নজরে না আসে তাদের অস্বাভাবিক কাজগুলো। চৈতি মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করছে। নিরিবিলি পরিবেশে পড়াশোনায় মনোযোগ আসে। সারাফ তার ঘরে এসে হাতে একটা বই দেখিয়ে চৈতিকে বললেন, ‘চৈতালি মা, এই বইটা আমার বুকসেলফ এ ছিল। তুই রেখেছিস?’
– জি বাবা। রেবেকা ভাবি হাদিয়া দিয়েছেন।
– মেয়েটা খুব সরল মনের। ওর স্বামীও খুবই ভালো। ওরা চলে যাবে শুনে খারাপ লাগছে। কিন্তু বইটা আমার ঘরে কেন রেখেছিস?
– আমি চাই ওটা তুমি পড়ো বাবা।
– আমি পড়বো অবশ্যই। কিন্তু তোকেও আমার সাথে পড়তে হবে।
চৈতি পড়া বন্ধ করে বিছানায় বসে বললো, ‘তার আগে একটা বিষয়ে কথা বলতে চাই বাবা।’
সারাফ চৈতির পাশে বসে বললেন, ‘কি বিষয়?’
– আমি ওই নিষ্ঠুরকে বিয়ে করবো। এতে তুমি রাগ করছো কেন?
– ফালতু প্রশ্ন করবি না।
চৈতি হেসে বললো, ‘একটা গোপন কথা বলবো?’
সারাফ এবার সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললেন, ‘কিরে?’
– এইচএসসির পর কোথাও ভর্তি হয়ে বিয়ের চিন্তা করবো বাবা। আর চিন্তাটা ওই পিশাচকে নিয়েই!
_____________________
চলবে ইন শা আল্লাহ….