‘লোডশেডিং’
পর্ব ২৩.
তাবিনা মাহনূর
____________________
আরো একটা সপ্তাহ কেটে গেল। চৈতির সাথে সৌরভের একবারও দেখা হয়নি। এমনকি সজীব সাহেবের পরিবারের কেউই চৈতির সাথে কোনো কথা বলেনি। চৈতি নিজের পড়াশোনা নিয়ে খুবই ব্যস্ত। দুইটা মাস পর তার এইচএসসি পরীক্ষা। এরপরেও দম নেয়ার সময় নেই। তাকে এগিয়ে যেতে হবে অনেক দূরে।
এরই মাঝে শিমুলকে পাত্রপক্ষ দেখে গিয়েছে। পাত্রের নাম মাহতাব। অত্যন্ত নম্র ভদ্র ছেলে। নীরা বেগম ক্ষেপে গিয়েছেন যখন মাহতাবের মুখভর্তি দাড়ি দেখেছেন। তিনি ভেবেছিলেন ছেলেটা তার খালার মতো মডারেট মুসলিম হবে। কিন্তু এই ছেলে পুরোপুরি দ্বীন মেনে চলে। এমনকি শিমুলের পর্দা সম্পর্কে জানার পর ছেলে বিয়ের জন্য আর দেরি করতে রাজি নয়। শিমুল পরিবারের সাথে জি-হাদ করে পর্দা রক্ষা করছে, আজকাল তার মতো মেয়ে খুঁজে পাওয়া অনেক কঠিন। দ্বীনদার মেয়েরাও ইদানিং নারী-বাদী হয়ে উঠেছে। নারী-বাদীর সংজ্ঞা নিজের মাঝে ধারণ করে আস্তে আস্তে দ্বীন থেকে ছিটকে পড়ছে। সেই হিসেবে শিমুল একজন কাঙ্ক্ষিত জীবনসঙ্গীনি।
শিমুল ঘরোয়া পরিবেশে বিয়ে করতে চেয়েছে। নীরা সেই রাগে বিয়ের কোনো বাজার করেননি। পার্লারে বুকিং দিয়ে রাখেননি। মায়ের বাড়ি গিয়ে থাকছেন। তিনি বলেছেন, শিমুলের বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর বাড়ি ফিরবেন। শিমুল খুব মন খারাপ করলেও আল্লাহর সাহায্য চেয়ে ধৈর্য ধারণ করছে। সাজিদ সাহেব শিমুলকে আশ্বাস দিলেন, বিয়ের আগ মুহূর্তে হলেও নীরা নিশ্চয়ই আসবেন।
রাত গভীর। তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ে চৈতি মুসাল্লার উপর শুয়ে পড়লো। জিকির করতে করতে ফজরের আজান ভেসে আসলো। চৈতি আজানের উত্তর দিয়ে নামাজ পড়ে নিলো। শুক্রবার, তাই সূরা কাহাফ পড়বে সে। বৃহস্পতিবার মাগরিবের পর থেকে শুক্রবার মাগরিবের আগ পর্যন্ত সময়ে সূরা কাহাফ পড়া নবীজির সুন্নাহ। এছাড়াও এসময় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামে বেশি বেশি দরুদ পড়া উচিত। ইবাদতে মশগুল থাকলে চৈতির মনে প্রশান্তি সৃষ্টি হয়। তার মনে হয়, মানুষকে আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন তাঁর ইবাদতের জন্য। মানুষ যদি একবার নিজেকে ইবাদতে নিবিষ্ট করতে পারে, তবে সত্যিই সে উপলব্ধি করবে, তাকে ইবাদতের জন্যই সৃষ্টি করা হয়েছে। সুতরাং, ইবাদত অবশ্যই প্রশান্তিময়।
দরজা খোলার আওয়াজে চৈতি মুসাল্লা ভাঁজ করতে করতে সেদিকে তাকিয়ে দেখলো, জেবিন এসেছেন তার কাছে। চৈতি নামাজের ওড়না খুলে বড় ওড়না গায়ে জড়িয়ে বললো, ‘মামণি, আপনি এ সময়?’
জেবিন চৈতির বিছানায় বসে বললেন, ‘ঘুম ভেঙে গেল। এরপর ওয়াশরুমে গিয়েছিলাম। তোমার কণ্ঠে কুরআন তিলাওয়াত শুনে ড্রইং রুমে বসে ছিলাম। কি মিষ্টি সুর! মা শা আল্লাহ!’
চৈতির সাথে এই কয়দিনে জেবিনের খুব সুন্দর সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। দূরত্ব এখনো আছে, তবে ঘৃণাবোধ নেই। চৈতি বিছানায় বসে জেবিনকে বললো, ‘ঘুম উড়ে গেল?’
– হুম। উড়ে গিয়ে ভালো হয়েছে। আরো আগে উড়ে গেলে ভালো হতো। ফজরের নামাজ কাযা হলো।
– না মামণি। ফজরের নামাজের সময় যদি টের না পান তাহলে যখনই উঠবেন তখনই পড়ে ফেলবেন।
– তাহলে এখন পড়ে আসি?
– অবশ্যই!
জেবিন নামাজ পড়ে এসে দেখলেন, চৈতি বারান্দায় দাঁড়িয়ে। তিনি চৈতির পাশে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘আগে তুমি প্রায়ই এসময় ছাদে চলে যেতে। আমি যদি টের পেতাম তাহলে আমিও তোমার পিছে পিছে চলে যেতাম উপরে। কারণ আমার তোমাকে নিয়ে চিন্তা হতো। এসময় ছাদে গিয়ে নিজেকে বিপদে না ফেলো।’
– আমি কখনোই বুঝতে পারিনি আপনার উপস্থিতি।
– আমি বুঝতে দিইনি। যদি তুমি আমাকে ভুল বুঝো?
নিশ্চুপ চারিপাশ। চৈতি গুনগুনিয়ে উঠলো, ‘রাহমান ইয়া রাহমান…’ জেবিন তা শুনে বললেন, ‘গান শোনাও ছেড়ে দিয়েছো?’
– জি।
– ছাদে যাবে চৈতি?
– আপনি যাবেন?
– তুমি গেলে যাবো।
ভোরের আলো আকাশে ছেয়ে গিয়েছে। রাস্তায় মানুষের আনাগোনা শুরু হয়েছে। চৈতি রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে শীতল বাতাসে মন জুড়িয়ে নিচ্ছে। জেবিন চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ বাতাসের সূক্ষ্ম গন্ধ অনুভব করলেন। চৈতি সেসময় প্রশ্ন করলো, ‘শিমুল আপুর বিয়ে কবে মামণি?’
জেবিন চোখ খুলে চৈতির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘পরশু দিন জুম্মার নামাজের পর ইন শা আল্লাহ।’
– ইন শা আল্লাহ।
– শিমুল চলে গেলে পুরো বাড়ি শূন্য শূন্য মনে হবে। মেয়েটা সবার খোঁজ খবর রাখতো। তোমাকে খুব ভালোবাসতো।
– শিমুল আপুর অবদান আমি কখনোই ভুলবো না। আপুকে আমি মন থেকে ভালোবাসি। আল্লাহ আপুর জীবনে অনেক সুখ দিন।
– আমিন। শিমুলের মা এখনো বাড়ি ফিরলো না। মেয়েটা কাল এই নিয়ে কথা বলতে গিয়ে কান্না করে দিলো। যেমনই হোক, মা তো। মাকে সব ছেলেমেয়েরা ভালোবাসে।
চৈতি চুপ করে পাশের ছাদে তাকালো। সেখানে চিলেকোঠার দরজায় তালা ঝুলছে। জেবিন বললেন, ‘স্বাধীন নাকি তার চাচার বাড়ি বেড়াতে গিয়েছে। শুনেছি ছেলেটা এদেশে থাকবে না। এজন্য সব আত্মীয়ের বাড়ি ঘুরে বেড়াচ্ছে।’
চৈতি চমকালো না। স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো, ‘কোন দেশে যাবেন উনি?’
– রাশিয়া যাবে। মাস্টার্স আর পিএইচডি ওখান থেকে করার ইচ্ছা।
– ওহ।
– শিমুল বললো এসব। আসাদ নাকি স্বাধীনের সাথে প্রায়ই কথা বলে। সামনে সপ্তাহে স্বাধীনের বন্ধুরা সবাই মিলে সিলেট ট্যুর দিতে যাবে। আসাদ আর আনাস দুজনেই পিছে পড়েছে।
– সিলেট সুন্দর জায়গা। যাওয়ার সুযোগ থাকলে হাতছাড়া করা ঠিক হবে না।
– তুমি যাবে?
– নাহ। আমার পড়াশোনা আছে। বেড়াতে গেলে পড়া হবে না।
জেবিন চুপ করে রাস্তার দিকে তাকালেন। সেখানে সজীব সাহেবকে বাজারের ব্যাগ হাতে বেরোতে দেখে বললেন, ‘সাত সকালে বাজার খুলেছে নাকি?’
চৈতি নিচু হয়ে সেদিকে তাকিয়ে বললো, ‘উহু। বড় কাকা বাজারের ব্যাগ হাতে নিয়ে সকালে হাটতে বের হন। হাঁটাহাঁটি শেষ করে বাজার করতে যান। ততক্ষণে বাজারের দোকান খুলে যায়।’
– তুমি এতকিছু কীভাবে জানলে?
চৈতি এড়িয়ে গেল। একদিন সে এমনই সকালে স্বাধীনের হারমনিকার সুর শুনতে ছাদে উঠেছিল। স্বাধীন তখন চিলেকোঠার দরজা বন্ধ করে চৈতিকে দেখে বলেছিল, ‘কি ব্যাপার? এই সময় এখানে?’
চৈতি উত্তরে বলেছিল, ‘তার আগে আপনি বলেন, আপনার হাতে কি?’
– হেডফোন। কেন?
– হেডফোন নিয়ে কোথায় যাচ্ছেন? সাথে বাজারের ব্যাগ কেন?
– হাঁটতে বের হচ্ছি। ফেরার পথে বাজার করবো। সজীব আঙ্কেলও করেন। জানো না?
– নাহ। উনি আমার কাকা হন, বাবা না। এত খবর রাখতে পারি?
– ওমা! শশুর আব্বা বলে কথা!
– ধ্যাৎ!
কথোপকথন ওখানেই শেষ হয়েছিল। স্বাধীন ওকে রাগিয়ে দিতে পছন্দ করতো বলেই শশুরের ব্যাপারটা টেনেছিল। চৈতি সেসব স্মৃতি মনে করে কোনো কষ্ট পেলো না। শুধু আফসোস হলো, কতগুলো সময় সে ভুল মানুষের জন্য ব্যয় করেছিল! সেই সাথে যিনার মতো ভয়ঙ্কর পাপে লিপ্ত হয়েছিল! আল্লাহর কাছে নিজের ভুলের জন্য তওবা করে জেবিনের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘মামণি, চলো নীচে যাই।’
__________
– কি করছিস চৈতি?
শিমুলের কন্ঠ শুনে চৈতি বই থেকে মুখ উঠিয়ে তাকালো। প্রচলিত একটা কথা শুনেছে সে, মেয়েদের বিয়ের কথাবার্তা চললে আল্লাহ সেই কন্যার সর্বাঙ্গে রূপের জোয়ার ভাসিয়ে দেন। কেননা মেয়েটি একটি পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হতে চলেছে। শিমুলকে দেখে চৈতি সেই কথার প্রমাণ পেলো। উজ্জ্বল শ্যাম বর্ণের মুখখানি আরো উজ্জ্বল হয়ে গিয়েছে, ঠোঁটের কোণে এখন সবসময় হাসি ফুটে থাকে। মাথায় ওড়না সে আগেও দিতো, কিন্তু চৈতির কাছে ইদানিং শিমুলকে এমন বেশে নতুন বউ মনে হয়। সে মুচকি হেসে বললো, ‘পড়ছিলাম। এসো আপু।’
শিমুল চৈতির কাছে এসে তার কাঁধে হাত রেখে বললো, ‘তুই নাকি শুধু পড়াশোনা করেই যাচ্ছিস? অন্য কোনদিকে খেয়াল করছিস না?’
– কে বললো এসব?
– কাকা কাকী দুজনেই বলেছেন। সাদিয়া খুবই অভিমান করেছে তোর উপর। তুই ওকে একটুও সময় দিস না।
– আমি অনেকদিন পড়াশোনা থেকে দূরে সরে ছিলাম আপু। এখন মনোযোগী হতে চাইছি। আর তাছাড়া ভর্তি পরীক্ষায় ভালো করতে হলে সামান্য কষ্ট করতে হবে।
– যা ভালো লাগে তাই কর। কোনো কিছুতে বাধা দিব না আমরা। কালকে তোকে নিয়ে ডাক্তার শাহনাজের কাছে যাবো।
– আপু?
– কিরে?
– পরশু তোমার বিয়ে, তুমি কাল বাহিরে যেও না।
– ওমা! কেন?
– এমনি। বিয়ের আগের দিনটা বাসায় কাটাও। এরপর থেকে কতদিন পরপর আসবে তার তো কোনো হিসেব নেই।
চুপ হয়ে গেল শিমুল। বিছানায় বসে মলিন হাসি হেসে চৈতির দিকে তাকিয়ে বললো, ‘আমাকে মিস করবি?’
চৈতিও ম্লান হেসে বললো, ‘খুব!’
রাত্রিটা কাটলো জ্যোৎস্নাহীন, মধুবিহীন। শান্ত বাতাসের সুরে শীতের স্বল্পতা জানান দেয়, ‘আমি চলে যাচ্ছি, আছি আর কিছুদিন! আসবো কোনো এক হেমন্তের শেষে!’ শিমুলের নিঃশব্দে ঝরে পড়া অশ্রুগুলো তেমনি বলে ওঠে, ‘আমি এখন আছি, চলে যাবো শীঘ্রই। আবার আসবো কোনো এক হিমেল রাতে।’
দিনের শুরু হলো চায়ের কাপের টুং টাং আওয়াজে। দোকানে ভিড় জমতে শুরু করেছে। আজকের পেপার কার হাতে আগে পৌঁছাবে, তা যেন এক প্রকার প্রতিযোগিতার মতো। সৌরভ সেই প্রতিযোগিতা চায়ের কাপ হাতে নিয়ে উদাস মনে দেখছে। সে এলাকা থেকে দূরে এক চায়ের দোকানে বসে ছন্নছাড়া ভাবনায় মশগুল। দুই কাপ চা শেষ করে সিগারেট ধরিয়ে দোকানের খুঁটির সাথে হেলান দিতেই দোকানদারের কথা শুনে নড়েচড়ে বসলো।
– মাইনষে দুনিয়ার কিপ্টা হইছে বোজলেন? বিরাট বড়লোক ব্যাটা আমার দোকানে পিপার পড়তে আহে। এক কাপ চা কি? দুইডা বিস্কিট পর্যন্ত খাইয়া যায় না।
সৌরভ এ কথায় বেশ মজা পেয়ে বললো, ‘বড়লোক বুঝলেন কি করে?’
– বোজা যাইবো না ক্যা? প্যান্ট স্যুট পইড়া এইহানে আহে আর একটুপর একখান গাড়ি আইয়া তুইলা লইয়া যায়।
– গাড়িটা হয়তো স্টাফদের জন্য। আর উনি হয়তো কোনো অফিসের কেরানি।
দোকানদার মুখ বেঁকিয়ে চুপ হয়ে গেলেন। সৌরভ জয়ী চিত্তে মনে মনে প্রশান্তি পেলো। ছিঁচকে মস্তিষ্কের মানুষগুলো মূর্খের কাছে জিতে গেলে নিজেকে কিংবদন্তি মনে করে। এই যেমন সৌরভ, সস্তা মস্তিষ্কের মানুষ। তাই দোকানদারের অপ্রয়োজনীয় আলাপে জিতে গিয়ে মানসিক শান্তি পাচ্ছে। কিন্তু সেই শান্তি উবে গেল যখন স্বাধীনকে দেখলো তার কাছেই আসছে। স্বাধীন এখানে কীভাবে এলো সে বুঝতে পারলো না।
পেপার দিয়ে নিজেকে আড়াল করার মতো অবস্থা নেই। অন্য এক লোক মন দিয়ে পেপার পড়ছে। তবে স্বাধীন সৌরভকে পাশ কাটিয়ে দোকানদারকে বললো, ‘চাচা, আপনার কাছে পানির বোতল আছে?’
আশেপাশে আর কোনো দোকান নেই সবজির ভ্যান ছাড়া। চাচা পানির বোতল বের করলেন। সেসময় স্বাধীন সৌরভকে খেয়াল করলে তার মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। বোতল নিয়ে টাকা মিটিয়ে বললো, ‘কি খবর?’
সৌরভ কিছুটা চমকে উঠে বললো, ‘ভালো, আলহামদুলিল্লাহ।’
স্বাধীন আর কোনো কথা না বলে চলে যেতে চাইলে সৌরভ উঠে দাঁড়িয়ে বললো, ‘এদিকে আসলি হঠাৎ?’
– চাচার বাসায় এসেছি।
– এখানে থাকেন তোর চাচা?
– না। এখানে চাচাতো ভাইয়ের এক বন্ধু থাকে। ভাই আসলো বেড়াতে, আমাকেও আসতে হলো। এখন ফিরে যাচ্ছি, তুই এখানে?
স্বাধীন ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে দেখে সৌরভের অস্বস্তি মোটামুটি কেটে গেল, ‘এলাকা থেকে একটু দূরে হাঁটতে ইচ্ছে করলো। তাই চলে এলাম।’
স্বাধীন একটু হেসে উঠলো। হাসিটা অনেকটা তাচ্ছিল্যের যা সৌরভ বুঝতে পেরেছে। মাথা নিচু করে সৌরভ বললো, ‘তুই নাকি বিদেশ চলে যাচ্ছিস?’
– হুম।
– ফিরবি কবে?
– জানি না।
– বিয়ে করে যাবি?
– কেন? ভয় পাচ্ছিস যে চৈতিকে বিয়ে করে নিয়ে যাই কিনা?
মুখ থমথমে হয়ে গেল সৌরভের, ‘তুই আমাকে অনেক খুঁচিয়ে কথা বলিস। একটা ভুল করেছি, তুই বন্ধু অথচ সেই ভুলটাকে হাতিয়ার বানিয়ে আমাকে আঘাত করেই যাবি, সেটা আমি মেনে নিবে কেন?’
রেগে গিয়েছে স্বাধীন। তবে রাস্তার মাঝে রাগ দেখিয়ে নিজের সম্মানহানি করার মতো কাজকর্ম সে করে না। তাই স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো, ‘বন্ধু অন্যায় করবে, সেটা সাপোর্ট করে নিজেকেও গুনাহগার বানানোর ইচ্ছে আমার নেই।’
– তুই খুব সাধু মনে করিস নিজেকে?
– মোটেও না। আমার নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গুনাহগার মনে হয়। আর তাই আমি চাই না আমার দ্বারা আর কোনো গুনাহের কাজ হোক।
– আমি তোর কাছে থাকলে ভাইরাসের মতো তোর গায়ে গুনাহ লেগে যাবে?
– উহু। তুই কাছে থাকলে একটা সুবিধা আছে। তোকে দেখলে আমার মনে হয় আলহামদুলিল্লাহ! তোর মত বাজে পরিস্থিতি আমার ভাগ্যে আসেনি, ইন শা আল্লাহ আসবেও না। আর তোর পরিণতি দেখে শিক্ষা হয় আমার। তুই অন্যায় করেও যেভাবে গর্বিত ঢঙে মাথা উঁচিয়ে চলাফেরা করছিস, তা দেখে আমার মনে হয় আলহামদুলিল্লাহ! এমন ফালতু গর্ব আমার কৃতকর্মের ঝুলিতে নেই। আল্লাহ আমাকে অনেক রক্ষা করেছেন।
ক্রোধে কাঁপা কণ্ঠে সৌরভ বললো, ‘তুই আজ থেকে আমার বন্ধু না। আমার সাথে কখনো দেখা করবি না।’
স্বাধীন শেষবারের মতো সৌরভের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘আলহামদুলিল্লাহ!’
__________
শাহনাজ বেগম ওষুধ কমিয়ে দিয়ে বললেন, ‘দুটো ওষুধ কমিয়ে দিলাম। একটা হলো ঘুমের ওষুধ। ঘুম তো ভালো হয় নাকি?’
চৈতি উত্তর দিলো, ‘জি ডাক্তার।’
– আচ্ছা। এই গেল মেডিসিনের আলাপ। এবার আসি ব্যক্তিগত বিষয়ে। কি অবস্থা বলো?
– মন খারাপ।
– কেন মা? সবই তো ঠিক আছে। তুমি যা চেয়েছো তাই হচ্ছে।
চৈতি মাথা নিচু করে বললো, ‘আমি জানি মন খারাপ করা ঠিক হচ্ছে না। তবু ভেতরে কেমন যেন লাগছে।’
– বলো মা। কি হয়েছে?
– শিমুল আপুর কালকে বিয়ে। আজকে আমার সাথে আসতে চেয়েছিল। আমিই আসতে দিইনি।
– হুম। আমিও ভাবছিলাম মেয়েটা আজ এলো না কেন। বাইরে যিনি আছেন তিনি কে?
– তিনি বাবার স্ত্রী, আমার মামণি।
– বাবার স্ত্রী বলবে না মা। এটা তোমার ব্যক্তিত্বকে ছোট করে ফেলে। শিমুলের বিয়ে হলেও সে নিশ্চয়ই তোমার কাছে আসবে মাঝে মাঝে। চিন্তা করে দেখো, তোমারও একদিন বিয়ে হবে। তখন তোমার ছোট ভাই বোনগুলোর মন খারাপ হবে। তাই বলে কি তোমার বিয়ে থেমে থাকবে?
– না।
শাহনাজ মুচকি হাসলেন, ‘তোমাকে একটা কথা বলি। যখন কারো সম্পর্কে কোনো নেগেটিভ ধারণা কিংবা সংশয়মূলক চিন্তা জাগবে তখন সেই মানুষের স্থানে নিজেকে কল্পনা করবে। তারপর বিবেচনা করে দেখবে যে তুমি হলে কোনটা ঠিক মনে করতে।’
– জি। বুঝতে পেরেছি।
– এখন বলো শিমুলের স্থানে তুমি থাকলে কি করতে?
– বিয়ে করতাম। কারণ ছোট কাকী শিমুল আপুকে ধর্ম পালনে বাঁধা দেন। তাই দ্রুত বিয়ে করাই ভালো।
– এইতো। এর আগে কি মনে হচ্ছিলো?
– আমাকে অথৈ সাগরে ফেলে শিমুল আপু বিয়ে করে নিচ্ছে। এটা এক ধরণের স্বার্থপরতা।
শাহনাজ আবার মুচকি হেসে বললেন, ‘দেখেছো? নিজেকে কল্পনা করলে পুরো ভাবনাটা বদলে যায়। তবে পরক্ষণেই আগের ভাবনা জেঁকে বসে। সেটাকে হটিয়ে ফেলতে নিজের অবস্থান সবসময় উপস্থিত রাখবে।’
– ইন শা আল্লাহ। এমন ভুল আর হবে না।
– ইন শা আল্লাহ। নিজের পঁচা ভাবনা নিয়ে এখন অস্বস্তি বোধ করছো?
চৈতি অনুতপ্ত ভঙ্গিতে বললো, ‘জি। মনে হচ্ছে যেই মানুষটা আমার জন্য এতকিছু করলো, তাকে নিয়ে আমি বাজে চিন্তা করছিলাম। খারাপ লাগা আরও বেড়ে গেল।’
শাহনাজ বললেন, ‘এখন তাহলে আরেকটা কাজ করো। শুনবে কি কাজ?’
ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেরিয়ে চৈতি জেবিনকে সাথে নিয়ে ফুলের দোকানে গেল। এরপর বাসায় গিয়ে ডাক্তারের কথা অনুযায়ী শিমুলের কাছে গেল। শাহনাজ বলেছিলেন শিমুলকে নিয়ে অযাচিত যেই ভাবনাটা চৈতি ভেবেছে তার প্রায়শ্চিত্ত করতে চৈতি চাইলে শিমুলের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটানোর কারণ হতে পারে। চৈতি তাই কিছু রঙিন জারবেরা ফুল আর কয়েকটা চকলেট নিয়ে শিমুলের সামনে ধরে বললো, ‘আপু, আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি। তুমি কি আমাকে ভুলে যাবে?’
___________________________
চলবে ইন শা আল্লাহ….
[আলহামদুলিল্লাহ, আমি খুব খুশি যে আমার শুভাকাঙ্ক্ষীরা আমার লেখার ভুল ধরিয়ে দেন ভদ্রভাবে এবং নম্র কণ্ঠে (আমি কল্পনা করে নিই) ভালোবাসা অবিরাম!]