#না_চাহিলে_যারে_পাওয়া_যায় পর্ব ৯
#ফারহানা ইয়াসমিন
“আম্মা, সর্বনাশ হইয়া গেছে। রাজ ভাইজানে বউ নিয়ে আসছে।”
কাজের সহকারী মর্জিনা দৌড়ে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে খবরটা দিতেই শিখা চমকে উঠলো-
“কে এসেছে বললি?”
“রাজ ভাইজানে নতুন বউ নিয়া আসছে।”
শিখার মুখে হাসি ফুটে উঠলো, পাশে বসে থাকা তার স্বামী আফজালের সাথে হাসি বিনিময় হলো। মর্জিনার দিকে ফিরে বললো-
“সে তো ভালো খবর। তুই সর্বনাশের কথা বলছিস কেন?”
মর্জিনাকে কিছুটা কনফিউজড দেখায়। সে বোকার মতো শিখার মুখপানে চেয়ে রইলো।
“আরে ওভাবে দেখছিস কি? যা তাড়াতাড়ি সবাইকে খবর দে। আর শোন, বড় ভাবিকে সবার আগে বলবি।”
মর্জিনা ঘাড় কাত করে দৌড়ে গেলো। আফজাল ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে-
“শেষ পর্যন্ত রাজের সুমতি হয়েছে দেখে ভালো লাগছে। ভাইজানের রাগ যদি এবার কমে। তোমার কি মনেহয় শিখা ভাইজান রাজকে মাফ করবে?”
শিখা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখছিলো। চেহারা বেশ গ্লেস দিচ্ছে বলে আর ঝামেলায় গেলোনা। চুলটা হাল্কা আচড়ে হাত খোপা করলো। ঠোঁটে হালকা লিপগ্লসে চেহারা আরো খোলতাই হলো। বাওয়ান্নতেও তার শরীর কি ঝকঝকে আর পেটানো তা দেখে নিজেরই নিজের নজর লাগে। আফজালের কথা কানে যেতেই মুচকি হাসলো, আয়না দিয়েই আফজালের পানে চাইলো। আফজালের মুগ্ধ নজর তার চোখ এড়ায় না তবে সে তা না দেখার ভান করে ঠোঁট ওল্টায়-
“ভাইজানের কথা তিনিই ভালো জানেন আমি কি করে বলবো? চলো যাই, দেখে আসি কি অবস্থা?”
আফজাল অনেক কষ্টে শিখার রুপের ঘোর থেকে বেরোয়-
“চলো।”
“আরে এই অবস্থায় যাবে নাকি?”
আফজাল বিরক্ত হলো, নিজের দিকে নজর বুলিয়ে শিখার কাছে জানতে চাইলো-
“কেন? কি খারাপ পোশাক পরে আছি? সাদা পাজামা পাঞ্জাবি পরেই তো আছি।”
শিখা আলমারি থেকে একটা আকাশী নীল পাঞ্জাবি বের করে দিলো-
“খারাপ নয় তবে বুড়োটে দেখাচ্ছে তোমায়। এটা পড়ে নাও।”
আফজাল মানা করলোনা বটে, পরনের পাঞ্জাবি খুলে শিখার দেওয়াটা পড়তে পড়তে বলে-
“ছেলে বিয়ে দিয়েছি, মেয়েদের বিয়ে দিয়েছি, নানা হয়েছি বয়স তো হয়েছেই।”
শিখা ঠোঁট ওল্টায়-
“এমন কিছু বয়স হয়নি তোমার। ষাটের কাছাকাছি হয়তোবা। এটা এমন কোন বয়স নয় বুঝলে? তাছাড়া তুমি ভুলে যাও কেন তুমি হচ্ছ দা শাহরিয়ার, এস এন্ড এস এর অন্যতম কর্নধার।”
“ভুলে যাই না বাট সবসময় এতোটা প্রেজেন্টেবল থাকতে ভালো লাগে না।”
আফজাল হাসলো, পাঞ্জাবির বোতাম লাগাতে লাগাতে আয়নায় দেখলো নিজেকে। সত্যি বয়স অনেক কমে গেছে এই রঙে। শিখার দিকে ঘুরে দাঁড়ায়-
“এখন হয়েছে তো? চলো নিচে যাই।”
শিখা আফজালকে দেখে সন্তুষ্ট চিত্তে মাথা নাড়লো। শাড়ীর আঁচলটা ভালোমতো টেনে নিয়ে আফজালের পেছনে এগুলো।
★★★
এতোগুলো মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে এবার সত্যিসত্যিই রুহির অসস্তি হচ্ছে। এই প্রথম মনে হলো, রাযীন কিছু ভুল বলেনি। তার গা থেকে ভুরভুর করে বমির গন্ধ আসছে, চেহারা একেবারেই যাচ্ছে তাই অবস্থায়, চুলগুলো পুরোপুরি অবিন্যস্ত। সামনে দাঁড়ানো পাঁচজনের পরিপাটি বেশ ভুষা দেখে মনে হচ্ছে এরা বুঝি দাওয়াতে যাবে। রুহির উচিত মুরুব্বিদের সালাম করা কিন্তু নিজের অবস্থা ভেবে এগুনোর সাহস হলোনা। রুহির দ্বিধা দেখে রাযীনের মা রোজী এগিয়ে এলো, যেন অনেকদিনের চেনা এমন ভাবে বললো-
“দাঁড়িয়ে আছো কেন বউমা, সালাম করো এনাদের। তোমার চাচাশ্বশুর আর চাচী শাশুড়ী। তুমি এনাদের ছোট আব্বা আর ছোট আম্মা বলে ডাকবে। গতবার তো এসব বলার সুযোগ ছিলোনা এবার তাই আগেভাগেই বলে দিলাম।”
রুহি মাথা নিচু করে আগে শাশুড়ী মাকেই সালাম করলো। রুহির গায়ের গন্ধে তার নাকমুখ কুঁচকে গেলো। মেয়েটার দোটানার কারন এতোক্ষণে বুঝলেও বাঁধা দিলেন না। আফজালকে সালাম করার পরে যখন শিখাকে সালাম করতে গেলো তখন শিখা দুপা পিছিয়ে গেলো-
“থাক থাক লাগবে না। জার্নি করে এসেছো আগে ফ্রেশ হয়ে খেয়ে আরাম করো। কাল ভালোমতো আলাপ করা যাবে।”
রুহি কিছু না বলে মাথার ঘোমটাটা আরেকটু টেনে নিলো। রাযীন পেছনে দাঁড়িয়ে আছে পুতুল হয়ে। এসব ফর্মালিটিস ওর বরাবর অপচ্ছন্দের। তাই বিরক্ত হয়ে মাকে বললো-
“আমি গেলাম।”
“ওমা! একা একা কোথায় যাচ্ছিস? বৌকেও সাথে নে।”
চাচীর কথায় আবার দাঁড়িয়ে গেলো রাযীন। রোজী বিরক্ত হয়ে ছেলের দিকে তাকালেন, রুহিকে বললেন-
“যাও বৌমা। তুমিও ফ্রেশ হয়ে নাও।”
রুহি রাযীনের পেছনে এগুতেই বাম পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটা এগিয়ে এসে রুহির হাত ধরলো-
“বড়মা, এ কেমন কথা হলো? পরিচিত হওয়ার আসায় দাঁড়িয়ে আছি আর পরিচয় না হয়েই ফেরত যাবো? এই ভাবি, শোন আমি ঝিলিক তোমার বড় জা। অবশ্য বিয়ে তোমারই আগে হয়েছে, আমি তো এই সেদিন এলাম। বিয়ের দিক দিয়ে তুমি বড় আর সম্পর্কের দিক দিয়ে আমি হা হা হা।”
মেয়েটার কথা শুনেই রাযীন কেন যেন আর দাঁড়ালো না। ঝড়ের বেগে হলরুম থেকে বেড়িয়ে দুপদাপ আওয়াজে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে গেলো। রুহি অপ্রস্তুত হয়ে তাকিয়ে ঝিলিক নামের মেয়েটাকে দেখলো। দেখতে ভীষণ সুন্দরী, খাড়া নাক, পাতলা ঠোঁট আর ফর্সা ত্বকের ঝিলিকের মাথা ভরা চুল তবে তা কেটে কাঁধের উপর এনে রেখেছে। চোখ নামাতে যেয়ে হাতের ফর্সা আঙুল গুলোতে দৃষ্টি নিবন্ধিত হলো। সেখানে জ্বলজ্বল করছে একটা আংটি, নখগুলোতে যত্ন করে নেইলপালিশ আঁকা। বেশ সৌখিন বোঝাই যাচ্ছে। শিখার মৃদু ধমকে রুহির মনোযোগ সরলো-
“আহ ঝিলিক, হচ্ছেটা কি? এসব গল্প পরে হলেও চলবে। মেয়েটাকে এখন রেস্ট করতে দাও। দেখছোনা কেমন বিদ্ধস্ত লাগছে দেখতে?”
ঝিলিক সাথে সাথে রুহির হাত ছাড়ে-
“সরি ভাবি। যাও তুমি, কাল তোমার সাথে জম্পেশ আড্ডা দেবো কেমন? আর হ্যা তোমার স্বামীকে এবার একটু মেজাজটা কমাতে বলো তো। এতো মেজাজ কি ভালো?”
শেষের কথাটা ফিসফিস করে বলেই ঝিলিক দূরে সরে গেলো। শিখা অগ্নি দৃষ্টিতে ঝিলিককে দেখলো তারপর বেশ গলা চড়িয়ে মর্জিনাকে ডাকলো-
“মর্জিনা, যা তো নতুন ভাবীকে তার রুমে দিয়ে আয়।”
মর্জিনা নামের মেয়েটা দৌড়ে রুহির ব্যাগটা হাতে তুলে নিলো-
“নতুন ভাবী, আসেন।”
★★★
ওয়াসরুম থেকে বেড়িয়ে রাযীনকে ল্যাপটপে বসে থাকতে দেখে বেশ অবাক হলো রুহি। এতোক্ষণ জার্নি করে আসার পরে আবার ল্যাপটপে বসে কি করে লোকটা? প্রশ্নটা মনে এলেও মুখে আনলো না। চুল থেকে টাওয়েল খুলে সেটা দিয়ে তার লম্বা চুলগুলো ঝাড়তে ঝাড়তে তার মনে বরং অন্য ভাবনা এলো। যে মানুষ টা তাকে পচ্ছন্দ করে এ বাড়িতে এনেছিলো তাকে কোথাও দেখলোনা কেন? আশরাফ আঙ্কেল কি বাড়িতে নেই? জিজ্ঞেস করার জন্য পিছু ফিরতেই রাযীনের বিরক্ত কন্ঠ শোনা গেলো-
“আহ, কি করছোটা কি? দেখছোনা ল্যাপটপে কাজ করছি? আর চুলগুলো কি মোছোনি? সব পানি তো আমার গায়ে এসে পড়লো।”
“সরি খেয়াল করিনি।”
রুহি চুলগুলো আবার তোয়ালে জড়িয়ে নিলো। বলবে না বলবে না করেও বলে ফেলে-
“রাগ কি সবসময় আপনার নাকের ডগায় এসে থাকে? ঢাকায় থাকতে বুঝিনি তো? ঝিলিক ভাবি বললো, আপনাকে যেন মেজাজ কমাতে বলি।”
রাযীনের মুখ পেশী হঠাৎ করেই যেন শক্ত হয়ে উঠলো। লাফিয়ে রুহির কাছে চলে এলো, আঙুল উচিয়ে বললো-
“লিসেন, আমার সামনে যার তার কথা বলবে না। আমি চাই না অকারণে তোমার সাথে রাগারাগি করি।”
“যার তার কথা কখন বললাম? আপনার ভাই বউয়ের কথাই তো বললাম?”
রুহি অবাক কন্ঠে জবাব দিলো। রাযীন একটু চুপসে গিয়ে জবাব দিলো-
“ওই হলো। এতো কথা না বলে খেয়ে নাও এখন। মা পাশের ঘরে খাবার রেখে গেছে দেখো।”
রুহি অপ্রসন্ন মুখে দাঁড়িয়ে রইলো-
“আমি শোবো কোথায়?”
রাযীন ফিরে যেতে যেতে ঘুরলো, ধৈর্য্যহীন গলায় বললো-
“কেন? এখানে বিছানাটা চোখে পড়ছেনা নাকি?”
“আপনার সাথে একঘরে আছি তাই বলে এক বিছানায় ঘুমাতে বলবেন না। যাকে মন থেকে মেনে নেইনি তার সাথে বিছানা শেয়ার করতে আমার ঘেন্না হবে।”
“কেন ঘেন্না হবে কেন? ঘুমানোর মধ্যে ঘেন্নার ব্যাপার কোত্থেকে এলো? এখনো প্রেমিকের ভাবনা মাথা থেকে যায়নি দেখছি? এমন তো কথা ছিলোনা?”
রুহি নির্লিপ্ত গলায় উত্তর দিলো-
“আপনার সাথে আমার কোনো কথাই ছিলোনাএখনো নেই। বাবা বলেছে একবার সুযোগ দিতে তাই দেবো। তারমানে এই না যে আপনার সাথে একসাথে ঘুমাতে হবে। বরং আপনি সুযোগ চেয়েছেন, আপনার উচিত নিজেকে শোধরানো। আমার সাথে ঝগড়া না করে সেদিকে মন দিন। আর প্রেমিকের কথা আসছে কেন? আমার মনে যা খুশি চলুক তাতে আপনার হেডেক হওয়া উচিত না।”
হাতি কাঁদায় পড়লে চামচিকাতেও লাথি মারে। রাযীনের এখন সেই অবস্থা। সে রুহির কথার কি প্রতিউত্তর দেবে বুঝে পেলো না তাই চুপ করে রইলো। রুহি পাশের রুমে যেতে যেতে ফিরে এলো-
“শুনুন, আপনার জায়গায় আমার প্রেমিকেরই থাকার কথা ছিলো। আপনি বরং আউটসাইডার হয়ে আমার জীবনে এলেন। শুধু কাগুজে বৈধতা আছে বলে নিজেকে খুব বেশি কিছু ভাববেন না।”
চলবে—
©Farhana_Yesmin