শহরজুড়ে_প্রেম_নামুক #পর্বঃ০১

0
917

‘সেদিন বাড়ি ফেরার পর কি পিলগুলো খাও নি নিয়মিত?’উচ্ছ্বাস বিচলিত কন্ঠে প্রশ্ন করলো।

দুইমাস ধরে পিরিয়ড মিস হওয়ায় স্বর্ণ কাল রাতে প্রেগ্ন্যানসি টেস্ট করাতেই দেখলো রেজাল্ট পজেটিভ।মানে ওর পেটে এখন উচ্ছ্বাসের বাচ্চা বড়ো হচ্ছে।খুশি হয়েছিলো মনে মনে।তাই তো উচ্ছ্বাসকে আজ ডেকেছে।

‘না,এই বাচ্চাটা রাখা এখন সম্ভব না।’উচ্ছ্বাস সরাসরি বাচ্চা রাখতে মানা করে দিলো।ওর কথা শুনে স্বর্ণ’র পায়ের তলার মাটি সরে গেলো।অথচ কাল রাতে ভেবেছিলো আর কেউ পাশে না থাকলেও উচ্ছ্বাস থাকবে।কিন্তু আজ ওর কথা শুনে উচ্ছ্বাসের প্রতি জমানো বিশ্বাস কাঁচের গ্লাসের মতো এক নিমিষেই পড়ে ভেঙে গেলো।জলভরা চোখে উচ্ছ্বাসের দিকে চেয়ে সে বলল,’কেনো?কেনো রাখতে পারবে না উচ্ছ্বাস?কি দোষ করেছে এই বাচ্চাটা।ও তো আমাদেরই বাচ্চা।’

‘শোনো!এই বাচ্চাটা রাখার জন্য তোমাকে আমার বিয়ে করতে হবে।কিন্তু আমি তোমাকে বিয়ে করতে পারবো না।’উচ্ছ্বাস হৃদয়হীনের মতো জবাব দিলো।

‘তাহলে দুইটা বছর ধরে আমাকে ভালোবাসলে কেনো?কেনো এই সন্তান দিলে আমায়?’

‘আমার কোনো দোষ ছিলো না।যা হয়েছিলো তাতে তোমার সম্মতিও ছিলো।আর তোমার অসাবধানতাও ছিলো।কতবার বলছিলাম পিলগুলো খেয়ে নিও কিন্তু তুমি খাও নি।আসলে আমাকে ফাঁসানোর ইচ্ছে ছিলো তোমার।এইজন্যই এমন করেছিলে তাই না?

‘আমার সম্মতি ছিলো না উচ্ছ্বাস।তুমি আমাকে জোর করেছিলে।আমি নিজের ভালোবাসা বাঁচাতে বাধ্য হয়েছিলাম আর সেদিন পিলও নিয়েছিলাম আমি।কিন্তু যার আসার সে তো আসবেই।’

‘কিন্তু যত যা’ই বলো আমি বিয়েটা করতে পারছি না এখন।তুমি গর্ভপাত করো।এতে কেউ কিছু জানবে না।তুমিও সেইফ আর আমিও।’

ঘৃণায় মনটা বিষিয়ে উঠলো স্বর্ণের।দুইটা বছর ধরে এমন নিকৃষ্ট একটা মানুষকে ভালোবেসেছিল ভাবতেই মরে যেতে ইচ্ছে করে।কিন্তু মরলে হবে না,বেঁচে থাকতে হবে।স্বর্ণ চোখমুছে শ্লেষাত্মক হেসে বলল,’ডোন্ট ওয়্যারি,তুমি এমনিতেও সেফ।আমি কাউকে কিছু জানাবো না আর তোমার বিরুদ্ধে না কোনো অ্যাকশন নিবো।ধরো এই দুইবছর অভিনয়ের পুরস্কার এটা।’

কথাগুলো বলেই স্বর্ণ উল্টোদিকে হেঁটে চললো।নিগূঢ় যাতনায় বিষিয়ে উঠছে শরীর,মন।জীবনে কারো থেকে এভাবে ঠকে যাবে ভাবেনি সে।কিন্তু মানুষ যেটা ভাবে না তার সাথে সেটাই হয়।অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে ওঠার পর একদিন আর্ট এক্সিবিশনে ঘুরতে গিয়ে উচ্ছ্বাসের সাথে পরিচয় হয় স্বর্ণের।কথায় কথায় জানতে পারে ওর ভার্সিটির ই সিনিয়র উচ্ছ্বাস।এরপর ক্যাম্পাসে দেখা সাক্ষাৎ,বন্ধুত্ব,প্রেম,হাসি,কান্না,খুনসুটি সব এখানেই আর বিদায়টাও।

বিষন্ন মনে বাসায় ফিরে দরজা আঁটকে বিছানায় শুয়ে বালিশে মুখ গুঁজে রাখলো স্বর্ণ।বাইরে নিহারিকা খানম ডাকছেন খেতে।না পরতে স্বর্ণ জবাব দিলো,’আমি এখন খাবো না মা।মাথাব্যথা করছে।ঘুমাবো।’
স্বর্ণের কথা শুনে নিহারিকা খানম আর মেয়েকে বিরক্ত করলেন না।

কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছিলো স্বর্ণ।শেষ বিকেলে ক্ষিধের তাড়নায় ঘুম ভাঙলো ওর।বিছানা ছেড়ে গায়ে ওড়না চাপিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে কিচেনে গেলো।নিহারিকা খানম কিচেনেই ছিলেন দুধ গরম করছিলেন নাতির জন্য।স্বর্ণকে দেখে বললেন,’উঠেছিস!যা এখন খেয়ে নে।’
‘হু।’
স্বর্ণ অল্প ভাত,তরকারি নিয়ে খেতে বসলো।খাওয়ার রুচি নেই,ভালো লাগে না খেতে আবার পেটে ক্ষিধেও আছে।যে আলুর তরকারি আগে চেটেপুটে খেতো আজকে সেটাও বিষের মত লাগছে।কোনমতে খেয়ে উঠে পড়লো কিন্তু শরীর কুলিয়ে উঠলো না দৌড়ে গিয়ে ওয়াশরুমে বমি করে দিলো।নিহারিকা খানমও দ্রুত গেলেন মেয়ের পেছনে।মাথায় পানি দিলেন,পানি খাওয়ালেন,মুখ ধুইয়ে দিয়ে বললেন,’কত করে বলি শরীরের যত্ন নে।নিশ্চিত গ্যাস্ট্রিক বেড়েছে।’
স্বর্ণ মায়ের কথায় কিছু বলল না।কেবল মলিন হাসলো।নিয়তিতে কি এসবই ছিলো।ছোটবেলা থেকে অভাব অনটনেই বড় হয়েছে স্বর্ণ।বাবা মারা যাওয়ার পর বড় ভাই সংসারের হাল ধরে।তখন থেকেই বাস্তবতা বুঝতে শিখেছে সে।অনেক কষ্টে এ পর্যন্ত এসেছে।এত বছর সংসারের জন্য করার পর এখন আর কিছুই করতে চায় না বড়ভাই।অবশ্য ওর ও তো সংসার,বউ,বাচ্চা আছে।ভাবি চাইছে ওকে বিয়ে দিয়ে তাড়াতে।এতোদিন তো উচ্ছ্বাসের ভরসায় ছিলো বলে এসব গায়ে লাগে নি কিন্তু এখন কি করে এসব সামলাবে।কারো কাছে বলবেই বা কেমন করে নিজের সর্বনাশের কথা।মা শুনলে নিশ্চিত মরে যাবে।বড়ভাই,ভাবি একেবারে মুখ ফিরিয়ে নিবে,সমাজে ছিঃ ছিঃ পড়ে যাবে।পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন সকলে ধিক্কার দিবে তখন বোধহয় মৃ/ত্যু ছাড়া কোনো পথ থাকবে না।অস্থিরতায় মাথা চক্কর দিয়ে ওঠে স্বর্ণর।চিন্তায় মস্তিষ্ক বিক্ষিপ্ত।কি করবে?গর্ভপাত করবে নাকি রাখবে এই বাচ্চা’টা?এই বাচ্চা’টা আসলে অনেক ঝড়-ঝাপটা পোহাতে হবে আর গর্ভপাত করলে কেউ জানবে না।ভালো কোনো জায়গায় বিয়ে হয়ে যাবে।স্বামী,সন্তান নিয়ে সুখে সংসার করতে পারবে।এক মূহুর্তের জন্য নিজেকে চরম স্বার্থপর মনে হলো স্বর্ণ’র।মন মানছে না গর্ভপাত করতে কিন্তু পরবর্তীতে যা হবে তা সামলাবে কি করে?

সারারাত চিন্তা করে স্বর্ণ’র মনে হলো গর্ভপাত করাই ভালো হবে।এছাড়া আর কিছু করার নেই।এই সমাজে টিকতে হলো স্বার্থপর হতেই হবে,যেমনটা উচ্ছ্বাস হয়েছে।

সকাল হতেই বেরিয়ে পড়লো স্বর্ণ।মনে মনে নিজেকে শক্ত করলো।ক্লিনিকে এসে ডাক্তারের সাথে কথা বলে আল্ট্রা-সনোগ্রাফি করা হলো।ডাক্তার বলল কাল আসতে আজকে দু’টো অপারেশন আছে।কাল আসলেই করে দেবে।স্বর্ণ রিপোর্ট’টা নিয়ে বাসায় এলো।গোপনে আলমারিতে লুকিয়ে রাখলো।কোনোভাবেই কারো হাতে পড়া যাবে না এটা।রিপোর্ট’টা লুকিয়ে রান্নাঘরে এলো সে।তাকে দেখে সিমা ভাবি মুখ বাকিয়ে বলল,’এলে তবে!আমি তো ভেবেছিলাম আসবেই না।’
স্বর্ণ কথা বলল না।কথায় কথা বাড়ে।স্বর্ণ কোনো উত্তর না দেওয়ায় সিমা হুকুমের স্বরে বলল,’রান্নাগুলো করে রাখো ঠিকমত।আমি সাব্বিরের স্কুলে যাচ্ছি।’
স্বর্ণ মাথা নাড়লো কেবল।

রান্না সেরে না খেয়েই বেরিয়ে পড়লো স্বর্ণ।টিউশনি করাতে যেতে হবে।দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তিনটা বাচ্চা’কে পড়ায় সে।

টিউশনি শেষ করে বাসায় ফিরে রান্নাঘরে গিয়ে সন্ধ্যার নাস্তা আর আর রাতের খাবার ঠিক করলো।সবাইকে খেতে দেওয়ার পর মনে পড়লো আজ সারাদিন পেটে কিছু পড়ে নি।সবার খাওয়া শেষ অল্প ভাত তরকারি নিয়ে রুমে আসতেই দেখলো ওর রিপোর্টগুলো হাতে নিয়ে মা বসে আছে।দৃষ্টি নত,চোখ দিয়ে নিঃশব্দে জল গড়াচ্ছে।দৃশ্য’টা দেখে স্বর্ণ’র বুকটা মুচড়ে উঠলো।এই বুঝি সব শেষ!

স্বর্ণ কাঁপা গলায় ডাকলো,’মা!’
নিহারিকা খানম জলভরা চোখে মেয়ের দিকে চাইলেন।এই দৃষ্টিতে একরাশ বেদনা,ঘৃণা লুকিয়ে আছে।নিজেকে ব্যর্থ মনে হচ্ছে।মা হিসেবে ব্যর্থ!
আর্তনাদ করা কন্ঠে নিহারিকা খানম বললেন,’মা,বলে ডাকবি না আমাকে।তোর মা করে গেছে।’
স্বর্ণ ছুটে এসে মায়ের পায়ের ওপর পড়লো।পা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল,’মা,মাফ করে দাও আমাকে।মা মরে যাবো আমি।এমন করো না।’
‘ম/রেই যা তুই।’
নিহারিকা খানম ঘৃণা ভরা কন্ঠে বলে রিপোর্টগুলো ফেলে রেখে চলে গেলেন ঘর ছেড়ে।স্বর্ণ বাঁধভাঙা কান্নায় ভেঙে পড়লো।মায়ের চোখে নিজের জন্য ঘৃণা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না।এরপর যখন সবাই জানবে তখন সবাই ঘৃণা করবে।এই ঘৃণার জীবন কি করে মানবে সে?

কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়লো স্বর্ণ।আজ আর খাওয়াও হলো না।ভাতের প্লেট’টাও পড়ে আছে অবহেলায়।চুলগুলো এলোমেলো হয়ে উড়ছে,গালজুড়ে নোনাপানির আস্তরণ।এভাবেই কেটে গেছে রাত।ভোরের আলো ফুটতেই ঘুম ছুটে গেলো ওর।ভাতের প্লেটের দিকে তাকিয়ে মনে পড়লো কাল রাতেও খাওয়া হয় নি।ক্ষুধায় পেট জ্বলছে।স্বর্ণ কোনরকম হাত ধুয়ে এসে রাতের বাসি ভাতটাই খেয়ে নিলো।

খাওয়া শেষে প্লেট নিয়ে কিচেনে গেলো।এখনো কেউ ওঠে নি ঘুম থেকে।প্লেট ধুয়ে মায়ের রুমের দিকে পা বাড়ালো।ভেতর থেকে দরজা বন্ধ।ভয় পেয়ে গেলো স্বর্ণ।দ্রুত পাশের জানালার কপাটে ধাক্কা দিলো।একটা কপাট খোলা আছে।সেখানে চোখ রাখতেই দেখলো মা শুয়ে আছে বিছানায়।চিন্তামুক্ত হয়ে আবার রান্নাঘরে পা বাড়ালো সকালের নাস্তা বানানোর জন্য।নাস্তা তৈরি হতে হতে ভাইয়া,ভাবি উঠে গেলো।ভাইয়া রেডি হয়ে আসার আগেই স্বর্ণ নাস্তা দিয়ে দিলো টেবিলে।সবাই নাস্তা খেতে বসেছে।শুধুমাত্র নিহারিকা খানম আসে নি।সিমা ভাবি বলল উনি অসুস্থ।পরে খাবেন।খেতে খেতে বড়ভাই বলল,’স্বর্ণ বিকেলে টিউশনি তে যাস না।তোকে দেখতে আসবে আমার বন্ধু।’
ভাইয়ার কথার মাঝেই সিমা ভাবী বলল,’তোমার বন্ধু সুমনের কথা বলছো?’
‘হ্যাঁ।’
‘ও আচ্ছা।ওর তো আগে এক বিয়ে হয়েছিলো।’
‘হোক তাতে কি!বেশিদিন তো টেকে নি।মাত্র ছয়মাসের সংসার।আর ছেলে ভালো।ও ই চেয়েছ স্বর্ণকে দেখতে।’
‘হ্যাঁ তা ঠিক।এরচেয়ে ভালো ছেলে আর তোমার বোন পাবেও না।’

চলবে….

#শহরজুড়ে_প্রেম_নামুক
#পর্বঃ০১
#Arshi_Ayat

(ভূলত্রুটি ক্ষমা করবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here