#না_চাহিলে_যারে_পাওয়া_যায় পর্ব ১৯
#ফারহানা ইয়াসমিন
রুহি আর নিজের কামরায় ফেরত যায়নি। লবিতেই একা একা বসে ছিলো অনেকটা সময়। শুভর কথা আর কাজে মনটা অস্থির হয়ে আছে। এমনিতেই তার জীবনের জটিলতা কম নয় তার উপর নতুন উপদ্রব শুভ। মনেহচ্ছে সব ছেড়ে ছুড়ে যেদিকে দুচোখ যায় চলে যেতে। এই ঘরসংসার, আশেপাশের মানুষ কাউকেই আর বিশ্বাস করার সাহস হচ্ছে না। সবাইকে মুখোশ মানুষ মনেহচ্ছে। পূনরায় সংসার করা নিয়ে মনে যে দ্বিধা ছিলো তা এখন ফুলেফেঁপে শঙ্কায় পরিণত হয়েছে। যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখান থেকে দুটো পথ দু’দিকে চলে গেছে। কোন পথে শেষটা কেমন তা রুহির অজানা। অথচ একটা পথ রুহিকে বাছতেই হবে। রুহির সানগ্লাসের আড়ালে জমে থাকা চোখের জল ওড়নার কোনে মুছে নিলো। সন্ধ্যা নামতেই সমুদ্র থেকে ভেসে আসা ঠান্ডা বাতাসে রুহির মনটা ক্রমশ শীতল হচ্ছিল। এ পর্যন্ড বারকয়েক চা খেয়ে ফেলেছে। আরো একবার চায়ের কথা বলতে উঠতেই রাযীনকে চোখে পড়লো। ওকে দেখে অবাক হয়ে জানতে চাইলো-
“তুমি নাকি সারাদিন এখানেই বসে আছো? কিছু হয়েছে নাকি?”
রুহির হঠাৎ কি হলো সে দৌড়ে রাযীনের বুকে ঝাপিয়ে পড়ে হু হু করে কাঁদতে শুরু করলো। রাযীন প্রথমে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বোঝার চেষ্টা করলো কি ঘটনা। বোকার মতো বারবার রুহিকে নিজের থেকে আলাদা করতে চাইলো-
“আরে কি হলো তোমার? এভাবে কাঁদছো কেন?”
রুহি আরো বেশি আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে রাযীনকে।
রা্যীন বিরক্ত হলো রুহির আচরণে, আশেপাশের মানুষ তাকিয়ে দেখছে ওদের। হোটেলের কর্মচারীটা মুখ লুকিয়ে হাসছে। রাযীন প্রায় ধমকে উঠলো-
“রুহি, কি হচ্ছে এসব? সবাই তাকিয়ে দেখছে আমাদের। ডোন্ট ফরগেট এটা আমাদের হোটেল, মান সম্মান ডুবিয়ে দিয় না প্লিজ। চলো রুমে চলো কি হয়েছে শুনি।”
রুহি নিজেকে সামলে নিলো, লজ্জিত হলো ভীষণ। আসলেও তো একি বোকামি করলো সে? এতোটা দূর্বল মানসিকতার তো সে কখনো ছিলোনা? আজ হঠাৎ কি হলো? রুহি প্রায় দৌড়ে যেয়ে লিফটে উঠলো।
“এবার বলো কি হয়েছিল তখন? ভয় পেয়েছিলে?”
রা্যীন রুমে এসেই শাওয়ার নিয়ে খাবার অর্ডার করে রুহির সামনে বসলো। রুহি দ্বিধা নিয়ে মুখ খুললো-
“আপনার ভাই শু…”
রাযীন ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই রুহি থেমে গেলো। শুভর কথা কি রাযীনকে বলা উচিত হবে? এসব শুনে রাযীন নিশ্চয়ই শান্ত খোকা বাবু হয়ে বসে থাকবে না। এমনিতেই শশুর অসুস্থ, এসব নিয়ে ঝামেলা হলে সংসারে একটা বিশাল কেওয়াজ বাঁধবে। রুহি মুখে আসা কথাগুলো গিলে নিলো। শুকনো হাসি দিয়ে বললো-
“না কিছুনা। আসলে সারাদিন একা একা ছিলাম তো তাই আপনাকে দেখে মনটা ভীষণ খুশি হয়ে গেছিলো।”
রাযীন ভ্রু কুঁচকে রুহির পানে চেয়ে রইলো-
“সত্যি তো? এখনো সময় আছে অন্য কোন ঘটনা থাকলে বলে ফেলো।”
রুহি সজোরে মাথা নাড়লো-
“অন্য কোন ঘটনা নেই।”
রাযীন আর ঘাটায় না। মোবাইলে ফোন আসতেই সে ব্যস্ত হয়ে ফোনে কথা বলতে উঠে গেলে রুহি যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো।
পরদিন ঘুরে টুরে বাড়ি ফিরতেই ঝিলিকের সামনে পড়লো দু’জন। ওদের দেখে ঝিলিক মুচকি হাসে-
“আরে বাহ, দু’জনকে এতো ফ্রেশ দেখাচ্ছে যে?
তোমরা কি হানিমুন সেরে এলে নাকি?”
ঝিলিকের বলার ধরনে রুহি ভীষণ লজ্জা পেলো।
সে উত্তর না দিয়ে লাজুক হেসে শশুর কে দেখার ছুতো দিয়ে পালায়। রাযীন রাগী দৃষ্টি হেনে ঝিলিককে দেখছে-
“স্টপ স্টকিং আস। তাহলে নিজেও শান্তিতে থাকতে পারবে সাথে আমিও।”
“আমার জীবনকে অশান্তিতে ফেলে তুমি শান্তিতে থাকতে চাইছো? এটা আমি কিভাবে হতে দেই বলোতো?”
ঝিলিক ক্রুর দৃষ্টিতে রাযীনের পানে চেয়ে রইলো। রাযীন গম্ভীর হলো-
“এ জীবন তুমি বেছেছো ঝিলমিল, এর দায় কোনোভাবেই আমার উপর চাপানোর চেষ্টা করো না।”
“প্রথম কথা এ জীবন বাছতে তুমি বাধ্য করেছিলে কাজেই এখন নিজে দায় এড়াতে চাইলেই পারবে না। দ্বিতীয় কথা ডোন্ট কল মি ঝিলমিল। আম ইয়োর ভাবি, সো কল মি ভাবি।”
ঝিলিক শয়তানি হাসি দিলো। রাযীনও পাল্টা হাসলো-
“যাক আমার আর মনে করিয়ে দিতে হলো না বলে ভালো লাগলো। দেবর ভাবি সম্পর্কটা খুব সেনসেটিভ জানো তো? আমি চাই না তোমার কারনে ভাইয়ের সাথে আমার ভুল বোঝাবুঝি হোক। আর দায়ের কথা যেটা বললে, আমি মনে করি তোমার প্রতি আমার কোন দায় নেই। তুমি আমাকে ভুল বুঝছো, ভাইকে বিয়ে করে এ বাড়ির বউ হয়েছো এসব তোমার সিদ্ধান্ত। তোমার সিদ্ধান্তে বরং আমি কষ্ট পেয়েছি। এ বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়েছি। এখন তুমি আমাকে উল্টো দোষারোপ করছো? শোন, আমি বলি কি যা হওয়ার হয়েছে। সব ভুলে নতুন করে শুরু করো সব। অতীতে পড়ে থেকো না তাতে আমাদের দুজনারই মঙ্গল হবে।”
“কিন্তু আমি যে তোমার মঙ্গল চাই না? যে দহনে আমি সর্বদা জ্বলছি তোমারও তো কিছুটা জ্বলা উচিত তাই না?”
“সেটা আর কোনদিনই সম্ভব হবে না। আমি তোমাকে ভুলে অনেক দূর এগিয়ে গেছি।”
রাযীন মরিয়া হয়ে জবাব দিতেই ঝিলিক হাসলো-
“আমি আবার পিছু টেনে আনবো তুমি ভেবো না।”
“ওকে, ট্রাই ইট এন্ড দেন গো টু হেল।”
রাযীন দাঁড়ালো না, গটগট করে হেঁটে চলে গেলো নিজের কামরায়। ঝিলিক দাঁতে ঠোঁট কামড়ে জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।
★★★
“শুভ, তোর কি হয়েছে বলবি? এমন পাগলামি কেন করছিস? তুই তো কখনো এমন ছিলিস না? কি হয়েছে বাবা বল মাকে?”
শিখার আকুতিভরা কন্ঠ শোনা গেলো। ছেলের হাত ধরে অনুনয় করতেই শুভ এক ঝটকায় সে হাত ছাড়িয়ে নিলো-
“হ্যা, সবসময় তোমাদের লক্ষী ছেলে হয়ে ছিলাম। তাতে কি পেয়েছি জীবনে? না তোমাদের মনোযোগ না তোমাদের ভালোবাসা। তুমি সারাজীবন ছিলে তোমার রুপচর্চা, শাড়ী চুড়ি গয়না নয়তো তোমার বাকী সন্তানদের নিয়ে। আমার দিকে মনযোগ দেওয়ার সময় ছিলো তোমার?”
শিখা দুঃখী চোখে ছেলের পানে চাইলেন-
“এভাবে বলছিস কেন বাবা? তুই তো আমার লক্ষী ছেলে ছিলিস তাই তোকে নিয়ে কখনো সেভাবে ভাবতে হয়নি।”
“হয়েছে থাক, আর মনভোলানো কথা বলোনা মা।এখন এসব কথায় চিড়ে ভিজবে না।”
শুভ একদৃষ্টিতে কাটা হাতের দিকে তাকিয়ে আছে। গতকাল কেটে ফেলা হাতের জায়গাটা বিভৎস ভাবে হা হয়ে আছে। এখনো রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। শিখা সেদিকে তাকিয়ে শিউরে উঠলো-
“জায়গাটা ব্যান্ডেজ করতে দে বাবা। নয়তো সেপটিক হয়ে যাবে।”
“কোন দরকার নেই। যেমন আছে থাক, সেপটিক হোক পচুক তাতে তোমাদের কি?”
শুভ গোয়ারের মতো বসে রইলো। শিখা পাগলের মতো শুভর হাত ধরে-
“তোর পায়ে পরি বাপ এমন করিস না। তোর কিছু লাগলে বল মাকে। যা চাস তাই দেবো। এমন জেদ করিস না বাপ।”
“সত্যি দেবে তো?”
শুভ আচমকা মায়ের মুখের দিকে তাকালো। শিখা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে জানতে চাইলো-
“কি দেবো?”
“যা চাই তাই দেবে তো?”
“হ্যা হ্যা তাই দেবো। কি চাই তোর বল আমায়?”
“ভেবে দ্যাখো। পরে আবার পিছু ফিরলে কিন্তু আমি নিজের জান দিয়ে দেবো। জীবনে প্রথমবার তোমার কাছে কিছু চাইছি। যদি না দিতে পারো আবার হারিয়ে যাবো তোমাদের জীবন থেকে। মনে রেখো।”
শুভর কথায় কেন যেন শিখার কলিজা কেঁপে উঠলো। ছেলেটা কি এমন চাইবে যে এমন করে বলছে? শিখা ভেতর ভেতর ঘামছে। তার এই ছেলেটা বরাবরই শান্ত। শান্ত মানুষ রেগে গেলে নাকি
ভয়ানক হয়। কথাটা এই মুহূর্তে ভীষণ রকম সত্য মনেহচ্ছে শিখার কাছে। শুভর হাতের দিকে তাকালো আবার। আর তাকিয়েই মনে হলো, শুভ যাই চাক সেটা দেওয়া যাবে। এমন কিছু নিশ্চয়ই চাইবে না যেটা শিখার দেওয়ার ক্ষমতা নেই। এই মুহূর্তে শুভর ট্রিটমেন্ট জরুরি। শিখা কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে-
“তুই যা চাইবি দেবো শুধু এরকম পাগলামো করিস না। চল এখনি হাসপাতালে চল। হাতের ব্যান্ডেজ করিয়ে আনি।”
শুভ ভদ্র ছেলের মতো মায়ের সাথে বেড়িয়ে এলো।
দিন কয়েক বাদে রাযীন রুহির কাছে জানতে চাইলো-
“ব্যাংকের চিটাগং ব্রান্চে কাজ করতে তোমার সমস্যা নেই তো?”
“মানে?”
রুহি অবাক হয়ে জানতে চাইলো।
“মানে তুমি তোমার ম্যানেজমেন্টের সাথে কথা বলে জানাবে তুমি চিটাগং ব্রান্চে জয়েন করতে চাও তাহলেই হবে।”
“কিন্তু ঢাকায় আমার… ”
“চাইলে আবার যে কোন সময় ঢাকায় ট্রান্সফার নিতে পারবে। ঠিক আছে? আপাতত এখানে জয়েন কর।”
এতো প্রশ্ন শুনে রাযীন একটু বিরক্ত স্বরে বললো। রুহি কিছু বলতে যেয়ে থামলো। ওর আসলে জানতে মন চাইছে রাযীন কি করে ম্যানেজ করলো এসব? ভালোও লাগছে এই ভেবে লোকটা ওকে নিয়ে ভেবেছে, ওর মতামতের মুল্য দিয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা একবারও চাকরি ছাড়তে বলেনি বা ফোর্স করেনি। রুহির মনে একটা প্রশান্তির বাতাস খেলে গেলো। ঘটনা হয়তো এখানেই শেষ হতে পারতো। কিন্তু হলোনা, উল্টো একটা জলোচ্ছ্বাস নিয়ে আসলো। সন্ধ্যায় যখন বাসায় ফিরে আফজাল যখন নিচতলা থেকে হুঙ্কার দিয়ে রাযীনকে ডাকলো তখন পুরো বাড়ি যেন কেঁপে উঠলো। রাযীন আফজালের সামনে এসে দাঁড়াতেই আফজাল পুরো বাড়ির লোকের সামনে বিরাশি কেজি ওজনের এক চড় কষালেন রাযীনের গালে। সে দৃশ্য দেখে রুহির হাতে থাকা চায়ের ট্রে ঝনঝন শব্দে মেঝেতে আছড়ে পড়লো।
চলবে—
©Farhana_Yesmin
(বইমেলায় আমার দ্বিতীয় বই ‘অনসূয়া’ পাবেন এশিয়া পাবলিকেশন্স এর স্টল ৯১-৯৪ এ। আমার প্রথম বই তিয়াস পাওয়া যাচ্ছে বইমেলায় ১৪৯ নং স্টলে। দুটো বই রকমারিতেও পাবেন। চাইলে সংগ্রহ করতে পারেন। রকমারি অর্ডার লিংকঃ
তিয়াসঃ
https://www.rokomari.com/book/211757/tiyas
অনসূয়াঃ
https://www.rokomari.com/book/226534/anosoya)